বিশ্বাসের ভাইরাস

অভিজি রায়

 

ভারতের ৯/১১ 

যখন এ লেখাটা লিখছি তখন মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলায় দেড়শ জনেরও বেশি লোক মারা গেছে। প্রায় ৫০ জন ফিদাইন জঙ্গী সবমিলিয়ে তাজ হোটেল সহ মুম্বাইয়ের ৫ টা বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক আক্রমন করে  আখচার গোলাগুলি করে নিমেষ মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফেলল। ডেকান মুজাহিদিন নামের একটি অজানা সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে, যদিও লকায়দা, ভারতীয় মুজাহিদিন এবং সর্বোপরি অন্যান্য পাকিস্তানী টেরর গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিহত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পাঁচজন আমেরিকান সহ পনের জন বিদেশীর মৃত্যুর ব্যাপারটা নিশ্চিত করা গেছে। ঘটনার ভয়াবহতা এতই বেশি যে,  অনেকেই ঘটনাটিকে ভারতের ৯/১১ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।  সিএন এন সারা দিন ধরে ভারতের ঘটনাবলী সরাসরি সম্প্রচার করে চলেছে এখনো।  

একটা প্রশ্ন আমাকে বরাবরই আমাকে  উদ্বিগ্ন করে। কেন  এই সব তরুন যুবকরা কেন আত্মঘাতি পথ বেছে নিচ্ছে? কেন তারা সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিচ্ছে? ঘটনা তো একটা দুটো নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই ঘটে চলেছে শত শত। শুধু মুম্বাইয়েই ২০০৫ সালের পর সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে অন্ততঃ দশটি, যেগুলোর সাথে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস নির্ভর সন্ত্রাসবাদ এত ব্যাপক আকারে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পরার পেছনে কোন নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক কিংবা জীববৈজ্ঞানিক কারণ আছে কিনা তা খূজে দেখাকে আমি আসলেই এখন জরুরী মনে করি 

বিবর্তনবাদ কি এ  ব্যাপারে আমাদের কোন পথ দেখেতে পারে?  অনেক সামাজিক জীববিজ্ঞানীই কিন্তু মনে করেন পারে।  আমরা যতই নিজেদের যুক্তিবাদি কিংবা অবিশ্বাসী বলে দাবী করি  না কেন, এটা তো অস্বীকার করার জো নেই – ‘বিশ্বাসের’ একটা প্রভাব সবসময়ই সমাজে বিদ্যমান ছিলো।  না হলে এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রাচীণ ধর্মগুলো স্রেফ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এভাবে টিকে থাকে কিভাবে? এখানেই হয়ত সামাজিক বিবর্তনবাদের তত্ত্বগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এটা মনে করা ভুল হবে না যে, বিশ্বাসব্যাপারটা মানব জাতির বেঁচে থাকার পেছনে হয়তো কোন বাড়তি উপাদান যোগ করেছিল একটা সময়।   মানুষ আদিমকাল থেকে বহু সংঘাত, মারামারি এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌছেছেএকটা সময় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করাটা ছিল মানব জাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামকযে গোত্রে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারা গিয়েছিল যে যোদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলে পরলোকে গিয়ে পাবে অফুরন্ত সুখ, সাচ্ছ্বন্দ্য, হুর পরী উদ্ভিন্নযৌবনা চিরকুমারী অপ্সরা, (আর বেঁচে থাকলে তো আছেই সাহসী যোদ্ধার বিশাল সম্মান আর পুরস্কার) – তারা হয়ত অনেক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং নিজেদের এই যুদ্ধাংদেহী জীন পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে।  মুক্তমনার ইবুক বিজ্ঞান ও ধর্ম সংঘাত নাকি সমন্বয়?’এ রিচার্ড ডকিন্সের একটি চমকার প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত  হয়েছে ধর্মের উপযোগিতা নামে। প্রবন্ধটিতে  ডকিন্স এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন 

ডকিন্সের লেখাটি থেকে একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় উল্লেখ করিমানব সভ্যতাকে অনেকে শিশুদের মানসজগতের সাথে তুলনা করেনশিশুদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকদের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয় –এ আমরা জানিধরা যাক একটা শিশু চুলায় হাত দিতে গেল, ওমনি তার মা বলে উঠল – চুলায় হাত দেয় না – ওটা গরম! শিশুটা সেটা শুনে আর হাত দিল না, বরং সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলোমার কথা শুনতে হবে – এই বিশ্বাস পরম্পরায় আমরা বহন করি – নইলে যে আমরা টিকে থাকতে পারবো না, পারতাম নাএখন কথা হচ্ছে – সেই ভাল মাই যখন অসংখ্য ভাল উপদেশের পাশাপাশি আবার কিছু মন্দ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশও দেয় –‘শনিবার ছাগল বলি না দিলে অমঙ্গল হবে, কিংবা রসগোল্লা খেয়ে অংক পরীক্ষা দিতে যেও না গেলে গোল্লা পাবে জাতীয় – তখন শিশুর পক্ষে সম্ভব হয় না সেই মন্দ বিশ্বাসকে অন্য দশটা বিশ্বাস কিংবা ভাল উপদেশ থেকে আলাদা করারসেই মন্দবিশ্বাসও বংশপরম্পরায় সে বহন করতে থাকে অবলীলায়সব বিশ্বাস খারাপ নয়, কিন্তু অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস হয়ত অনেক সময় জন্ম দেয় বিশ্বাসের ভাইরাসেরএগুলো একটা সময় প্রগতিকে থামাতে চায়, সভ্যতাকে ধ্ব্বংস করেযেমন, ডাইনী পোড়ানো, সতীদাহ, বিধর্মী এবং কাফেরদের প্রতি ঘৃণা,  মুরতাদদের হত্যা এগুলোর কথা বলা যায়

 

বিশ্বাসের ভাইরাস 

বিশ্বাসের ভাইরাসব্যাপারটা এই সুযোগে আর একটু পরিস্কার করে নেয়া যাকএকটা মজার উদাহরণ দেই ডেনিয়েল ডেনেটের সাম্প্রতিক ব্রেকিং দ্য স্পেলবইটি থেকেআপনি নিশ্চয়ই ঘাসের ঝোপে কিংবা পাথরের উপরে কোন কোন পিপড়াকে দেখেছেন – সারাদিন ধরে ঘাসের নীচ থেকে ঘাসের গা বেয়ে কিংবা পাতরের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়, তারপর আবার ঝুপ করে পড়ে যায় নিচে, তারপর আবারো গা বেয়ে উপরে উঠতে থাকেস্বভাবতই প্রশ্ন জাগে – এই বেয়াক্কেলে কলুর বলদের মত পন্ডশ্রম করে পিপড়াটি কি এমন বাড়তি উপযোগিতা পাচ্ছে, যে এই অভ্যাসটা টিকে আছে কেন? কোন বাড়িতি উপযোগিতা না পেলে সারাদিন ধরে সে এই অর্থহীন কাজ করে যাচ্ছে কেন? আসলে সত্যি বলতে কি – এই কাজের মাধ্যমে সে বাড়তি কোন উপযোগিতা তো পাচ্ছেই না, বরং ব্যাপারটি সম্পুর্ণ উলটোগবেষনায় দেখা গেছে পিপড়ার মগজে  থাকা ল্যাংসেট ফ্লুক নামে এক ধরনের প্যারাসাইট এর জন্য দায়ীএই প্যারাসাইট বংশবৃদ্ধি করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন কোন গরু বা ছাগল একে ঘাসের সাথে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেফলে প্যারাসাইট টা নিরাপদে সেই গরুর পেটে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারেপুরো ব্যাপারটাই এখন জলের মত পরিস্কার – যাতে পিপড়াটা কোন ভাবে গরুর পেটে ঢুকতে পারে সেই দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য ঘাস বেয়ে তার উঠা নামাআসলে ঘাস বেয়ে উঠা নামা পিপড়ের জন্য কোন উপকার করছে না বরং ল্যাংসেট ফ্লুক কাজ করছে এক ধরনের ভাইরাস হিসবে – যার ফলশ্রুতিতে পিপড়ে বুঝে হোক, না বুঝে তার দ্বারা অযান্তেই চালিত হচ্ছেআমাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রথাগত বিশ্বাসের ভাইরাসগুলোওকি আমাদের সময় সময় এভাবে আমাদের অযান্তেই বিপথে চালিত করে না কি? আমরা আমাদের বিশ্বাস রক্ষার জন্য প্রাণ দেই, বিধর্মীদের হত্যা করি, টুইন টাওয়ারের উপর হামলে পড়ি, সতী নারীদের পুড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পাই, বেগানা মেয়েদের পাত্থর মারি … 


ছবিঃ ল্যাংসেট ফ্লুক নামের প্যারাসাইটের কারণে পিপড়ের মস্তিস্ক আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন পিপড়ে কেবল চোখ বন্ধ করে পাথরের গা বেয়ে উঠা নামা করে। ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও কি মানুষের জন্য একেকটি প্যারাসাইট?

ধর্মগ্রন্থের যে অংশগুলোতে জিহাদের কথা আছে (২:২১৬, ২: ১৫৪), উদ্ভিন্নযৌবনা হুরীদের কথা আছে (৫২: ১৭-২০, ৪৪: ৫১-৫৫, ৫৬:২২), ‘মুক্তা সদৃশ’ গেলমান দের কথা আছে (৫২:২৪) সে সমস্ত ‘পবিত্র বাণী’গুলো ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে কিংবা বছরের পর বছর সৌদি পেট্রোডলারে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা নামক আগাছার চাষ করে  বিভিন্ন দেশে তরুণ সমাজের কিছু অংশের মধ্যে এক ধরণের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ তৈরি  করা হয়েছে; ফলে এই ভাইরাস আক্রান্ত জিহাদীরা স্বর্গের ৭২ টা হুর-পরীর আশায় নিজের বুকে বোমা বেঁধে আত্মাহূতি দিতেও আজ দ্বিধাবোধ করে না, ইহুদি, কাফের নাসারাদের  হত্যা করে ‘শহীদ’ হতে কার্পন্যবোধ করে না ল্যান্সফ্লুক প্যারাসাইটের মত তাদের মনও কেবল একটি বিশ্বাস দিয়ে চালিত –  অমুসলিম কাফেরদের হত্যা করে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করতে হবে, আর পরকালে পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে উদ্ভিন্নযৌবণা আয়তলোচনা হুর-পরীর লোভনীয় পুরস্কার। তারা ওই ভাইরাস আক্রান্ত পিপড়ের মত  হামলে পড়ছে  কখনো টুইন টাওয়ারে, কখনো  রমনার বটমূলে কিংবা তাজ হোটেলে।   

কিভাবে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয়, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আধুনিক মিম তত্ত্বকে। মিম নামের পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে, তার বিখ্যাত বই ‘দ্য সেলফিশ জিন’-এ আমরা তো জিন-এর কথা ইদানিং অহরহ শুনি।  জিন হচ্ছে মিউটেশন, পুনর্বিন্যাস ও শরীরবৃত্তিক কাজের জন্য আমাদের ক্রোমোজমের ক্ষুদ্রত্তম অভিবাজ্য একক।  সহজ কথায়,  জিন জিনিসটা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের অখন্ড একক  যা বংশগতীয় তথ্যকে এক প্রজন্ম  থেকেপরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়।  জিন যেমন আমাদের শরীরবৃত্তিয় তথ্য বংশ পরম্পরায় বহন করে, ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক তথ্য বংশপরম্পরায় বহন করে নিয়ে যায় ‘মিম’।  কাজেই ‘মিম’ হচ্ছে আমাদের ‘সাংষ্কৃতিক তথ্যের একক’, যা ক্রমিক অনুকরণ বা প্রতিলিপির মধ্যমে একজনের মন থেকে মনান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেভাবে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের একক জিন  ছড়িয়ে পড়ে এক শরীর থেকে অন্য শরীরেযে ব্যক্তি মিমটি বহন করে তাদের মিমটির ‘হোস্ট’ বা বাহক বলা যায়‘মেমেপ্লেক্স’ হল একসাথে বাহকের মনে অবস্থানকারী পারষ্পরিক সম্পর্কযুক্ত একদল ’মিম’, কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস,  রীতি-নীতি, কোন দেশীয় সাংষ্কৃতিক বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ –এগুলো সবই মেমেপ্লেক্সের উদাহরণ  সুসান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে মেমেপ্লেক্সের অনেক আকর্ষনীয় উদাহরণ হাজির করেছেন।  সুসান ব্ল্যাকমোর মনে করেন জিন এবং মিমের সুগ্রন্থিত সংশ্লেষই মানুষের আচার ব্যবহার, পরার্থতা, যুদ্ধাংদেহী মনোভাব, রিতী-নীতি কিংবা কুসংস্কারের অস্তিত্বকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।   ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম সংঘাত নাকি সমন্বয়?’ ই-বইটিতে দিগন্ত সরকার ধর্মের উসন্ধানে নামের বাংলা প্রবন্ধটিতে মিমবিন্যাসের আলোকে ধর্মের উপত্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা মুলতঃ ডকিন্স এবং সুসান ব্ল্যাকমোরের  মিম নিয়ে আধুনিক চিন্তাধারারই অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ।    

কোন সাংস্কৃতিক উপাদান  কিংবা কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস কিভাবে মিমের মাধ্যমে জণপুঞ্জে  ছড়িয়ে পড়ে? মানুষের মস্তিস্ক এক্ষেত্রে আসলে কাজ করে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার যেভাবে কাজ করে অনেকটা সেরকমভাবে।  আর মিমগুলো হচ্ছে  কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মধ্যে ইন্সটল্ড সফটওয়্যার যেন।  যতক্ষণ পর্যন্ত এই সফটওয়্যার গুলো ভালমত চলতে থাকে  ততক্ষণ তা নিয়ে আমাদের কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু কখনো কখনো  কোন কোন ডাউনলোড করা ইন্সটল্ড সফটওয়্যারগুলো  ভাল মানুষের (নাকি ‘ভাল মিমের’ বলা উচি) ছদ্মবেশ নিয়ে  ‘ট্রোজান হর্স’ হয়ে ঢুকে পড়ে। এরাই আসলে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো। এরা সূঁচ হয়ে ঢুকে, আর শেষ পর্যন্ত যেন ফাল হয়ে বেরোয়। যতক্ষণে এই ভাইরাসগুলোকে সনাক্ত করে নির্মূল করার ব্যবস্থা নেয়া হয় – ততক্ষণে  আমাদের হার্ডওয়্যারের দফা রফা সাড়া।  এই বিশ্বাসের ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারায় শত সহস্র মানুষ – কখনো নাইন-ইলেভেনে, কখনো বা বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসে কখনো বা তাজ হোটেলে গোলাগুলিতে। Viruses of the Mindশীর্ষক  একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স দেখিয়েছেন কিভাবে কম্পিউটার ভাইরাসগুলোর মতই  আপাতঃ মধুর ধর্মীয় শিক্ষাগুলো কিভাবে সমাজের জন্য ট্রোজান হর্স কিংবা ওয়ার্ম ভাইরাস হিসেবে কাজ করে তিলে তিলে এর কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। আরো বিস্তৃতভাবে  জানবার জন্য পাঠকেরা পড়তে পারেন  ২০০৪ সালে রিচার্ড ব্রডির লেখা ‘Virus of the Mind: The New Science of the Meme’ নামের বইটি।  এ বইটি থেকে বোঝা যায় ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিস্ক কি শান্তভাবে রবোটের মত ধর্মের আচার আচরণগুলো নির্দ্বিধায় পালন করে যায় দিনের পর দিন, আর কখনো সখনো বিধর্মী নিধনে উন্মত্ত হয়ে ঊঠে; একসময় দেখা দেয় জিহাদ  কিংবা ক্রুসেডের মহামারী।  

ছবিঃ ভাইরাস অব মাইন্ড – রিচার্ড ব্রডি

 

ভাইরাস আক্রান্ত মনন 

ভাইরাস আক্রান্ত মন-মানসিকতার উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে ঢের।  কিছু উদাহরণ তো দেয়াই যায়।  এই ধরণের ভাইরাস-আক্রান্ত মননের সাথে বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা আমার খুবই তিক্ত। তার কিছু কিছু বর্ণনা আমি আমার নৈতিকতা কি কেবল বেহেস্তে যাওয়ার পাসপোর্ট সহ আগের বেশ কিছু প্রবন্ধে রেখেছি।  আপনি যত ভাল যুক্তি দেন না কেন, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞান থেকে যত আধুনিক এবং অথেন্টিক গবেষণারই উল্লেখ করুন না কেন, তারা চির আরাধ্য ধর্মগ্রন্থকে মাথায় করে রাখবেন আর আপনার প্রতি গালি গালাজের বন্যা বইয়ে দেবে। এই ধরণের অভিজ্ঞতা শুধু আমার নয়, বোধ হয় অনেক লেখকদেরই আছে।  নন্দিনী হোসেন আমার বইয়ের জন্য একটি চমকারলেখা লিখেছেন পুরুষ রচিত ধর্মেবিকলাংগ নারী।  লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশের পর ইন্টারনেটে গলাবাজি করা এক অতিবিশ্বাসী  মডারেট মুসলিম-এর আঁতে ঘা লেগে গেলো।  তিনি একটি ইসলামী সাইটে হর হর করে একটি লেখা লিখে ফেললেন –‘নন্দিনীও একাধিক স্বামী চান শিরোনামে।  অথচ নন্দিনী কোথাও একাধিক স্বামী চাওয়ার কথা লেখেননি; ধর্মগ্রন্থ থেকে পুরূষ এবং নারীর মধ্যকার অসাম্য এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী কিছু আয়াতের উল্লেখ করেছিলেন মাত্র, তাও একেবারেই মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে। এর মধ্যে স্বামীর স্ত্রীকে প্রহারের অধিকার, স্বমীর নির্দ্বিধায় তালাকের অধিকার, দাস-দাসী উপভোগের অধিকার, উত্তরাধিকার আইনে নারীকে বঞ্চিত করা, সাক্ষীর ক্ষেত্রে দুইজন নারী একজন পুরুষের সমান বলা সহ বিভিন্ন বিষয় আছে। ব্যাস ওই ধার্মিক ভদ্রলোক এবং তার পোষ্য ইসলামিক সাইটের মডারেটর বলা শুরু করলেন  নন্দিনীও একাধিক স্বামী চান। যুক্তির বলিহারি বটে। শুধু তাই নয়, উদ্ভট রিসার্চ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, নন্দিনীর বাবা মা দুই ধর্মের, তাদের মধ্যে পারিবারিক সমস্যা ছিলো তাই নন্দিনী এগুলো লিখছে!  নন্দিনী অবশ্য প্রতিবাদ করেছেন তার সাইটে- বলেছেন এগুলো ডাহা মিথ্যে কথা। বলেছেন, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে লিখবার আগে ভাল করে জেনে নেওয়া ভাল।  কিন্তু আমার প্রশ্ন তা নয়, আমার প্রশ্ন হল নন্দিনী তো লেখার মাধ্যমে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি, ধর্মগ্রন্থের কয়েকটি আয়াতকে কেবল সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছেন মাত্র।  অথচ ওই অতি বিশ্বাসী ভদ্রলোক ধর্মের সমালোচনা সইতে না পেরে মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে নন্দিনীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা শুরু করে দিলেন। শুধু নন্দিনীকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হলেন না, তার বাবা মা চোদ্দগুষ্টি পর্যন্ত চলে গেলেন।  এই হচ্ছে ধার্মিকদের তথাকথিত মূল্যবোধ।  ভাবখানা যেন, যুক্তি কন্ডন করতে না পেরে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেই তার মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে আর কি।  ওই ভদ্রলোককে কি করে বোঝানো যাবে যে,  নন্দিনীর বাবা-মার মধ্যে যদি সমস্যাও থেকে থাকেও, সেটা নন্দিনী ইসলামের যে সমস্যাগুলোর কথা বর্ণনা করেছে তা খন্ডন করার জন্য যথেষ্ট নয়, বরং হাস্যকর রকমের অপ্রসঙ্গিক এবং খেলো।  ওই ভদ্রলোক ধর্মের নেশায় এমনই বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন যে,  তিনি লেখার জবাব দিতে গিয়ে যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, সেই বোধটুকুও তার ছিলো না।  বোঝা যায়, ভদ্রলোকের মাথা আসলে পুরোটাই ভাইরাস আক্রান্ত।  

ওই ‘মডারেট’ ভদ্রলোক হয়ত ভাইরাস আক্রান্ত মননের খুব ছোট উদাহরণ। কিন্তু ভাইরাস আক্রান্ত মননের  চরম উদাহরণগুলো হাজির করলে বোঝা যাবে কিভাবে ধরণের মানসিকতাগুলো সমাজকে পঙ্গু করে দেয়, কিংবা কিভাবে সমাজের প্রগতিকে থামিয়ে দেয় ।  এর অজস্র উদাহরণ সাড়া পৃথিবী জুড়ে পাওয়া যাবে। কিছু প্রাচীণ সভ্যতার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যখন কোন নতুন প্রাসাদ কিংবা ইমারত তৈরি করা হত, তার আগেসেই জায়গায় শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত – এই ধারণা থেকে যে, এটি প্রাসদের ভিত্তিমজবুত করবেঅনেক আদিম সমাজেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকেরক্ষা পাওয়ারজন্য কুমারী উসর্গ করার বিধান ছিল; কেউ কেউ সদ্যজন্মলাভ করা শিশুদেরহত্যা করত, এমনকি খেয়েও ফেলতকোন কোন সংস্কৃতিতে কোন বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্যমহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তারা পরকালে গিয়ে পুরুষটিরকাজে আসতে পারেফিজিতে ভাকাতোকানামে এক ধরনের বিভস রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনেরহাত-পা কেটে ফেলে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কর্তিত অংগগুলো খাওয়া হতআফ্রিকার বহুজাতিতে হত্যার রীতি চালু আছে মৃত-পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যভারতে সতীদাহের নামে হাজার হাজার মহিলাদের হত্যা করার কথা তো  সবারই জানাএগুলো সবই মানুষ করেছে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে প্রাধান্যদিতে গিয়ে, অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়েএধরনের ধর্মীয় হত্যাসম্বন্ধে আরোবিস্তৃতভাবে জানবার জন্য ডেভিড নিগেলের ‘Human Sacrifice: In History And Today’বইটি পড়া যেতে পারে এগুলো সবই সমাজে বিশ্বাসের ভাইরাস নামক আগাছার চাষ ছাড়া আর কিছু নয়।

অন্ধবিশ্বাস নামক ভাইরাসগুলো  কিভাবে সন্ত্রাসবাদী তৈরীর কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার কিছু উদাহরণ আমি রেখেছি আমার নৈতিকতা কি কেবল বেহেস্তে যাওয়ার পাসপোর্ট নামের একটি প্রবন্ধে।  প্রতিটি ধর্মগন্থের মত কোরানেও বেশ কিছু ভাল ভাল কথাবার্তা  আছে যেগুলো নিয়ে ইসলামিস্টরা যারপর নাই গর্ববোধ করে।  যেমন, ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই (২ : ২৫৬),  তোমার ধর্ম তমার কাছে, আমার ধর্ম আমার (১০৯ : ৬), এমনকি কোরানের নির্দেশ আছে শত্রুর প্রতি ভাল ব্যবহার করার (২ : ৮৩)  ইত্যাদি।  কিন্তু সেই কোরানেই আবার আছে – যেখানেই অবিশ্বাসীদের পাওয়া যাক তাদের হত্যা করতে (২:১৯১, ৯:৫), তাদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতে, কঠোর ব্যবহার করতে (৯:১২৩), আর যুদ্ধ করে যেতে (৮:৬৫)কোরাণ শেখাচ্ছে বিধর্মীদের অপদস্ত করতে আর তাদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করতে (৯:২৯)কোরাণ ইহুদী এবং নাসারাদের সাথে বন্ধুত্বটুকু করতে পর্যন্ত নিষেধ করছে (৫:৫১), এমনকি নিজের পিতা বা ভাই যদি আবিশ্বাসী হয় তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখতে উদ্বুদ্ধ করছে (৯:২৩, ৩:২৮) ইত্যাদি

কোরানের পরস্পরবিরোধিতার এর চেয়ে ভাল নমুনা আর কি হতে পারে।  কোরান কেন প্রতিটি ধর্মগ্রন্থই ত আসলে এরকম।  ভালমানুষেরা ভাল ভাল বানীগুলো থেকে ভালমানুষ হবার অনুপ্রেরনা পায়, আবার সন্ত্রাসবাদীরা  ভায়োলেন্ট ভার্সগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পায় সন্ত্রাসী হবার।  সেজন্যই তো ধর্মগ্রন্থগুলো একেকটি ট্রোজান হর্স ছদ্মবেশী ভাইরাস! কি করে হলফ করে বলা যাবে যে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া নীচের ভাইরাসরূপী আয়াতগুলো সত্যই জিহাদী সৈনিকদের সন্ত্রাসবাদে উসাহিত করছে না ?

তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে…  (২: ২২১৬ )।

আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে থাকুন, আপনি নিজের সত্তা ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ের যিম্মাদার নন! আর আপনি মুসলমানদেরকে উসাহিত করতে থাকুন (৪ : ৮৪)।

হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না; তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না (৫: ৫১)।

যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত (৩:৮৫ )।

আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় (৮:৩৯)।

তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ্ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে  (৯:২৯)।

অত:পর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দার মার, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর তখন তাদেরকে শক্ত করে বেধে ফেল। অত:পর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ লও।যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ্ কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না (৪৭:৪) ।

অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অত:পর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না (৪:৮৯)।

আর তাদেরকে হত্যা কর যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে … (২:১৯১)

আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয় (২:১৯৩)।

আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব| কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায় (৮:১২)।

অত:পর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর| আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁ পেতে বসে থাক (৯:৫)।

যদি বের না হও, তবে আল্লাহ্ তোমাদের মর্মন্তুদ আযাব দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্খলাভিষিক্ত করবেন (৯:৩৯)…ইত্যাদি।

 

ধর্মবিশ্বাসীরা জোর গলায় বলেন,  কোরাণ কখনো সন্ত্রাসবাদে কাউকে উৎসাহিত করে না, কাউকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্ররোচিত করে না, ইত্যাদি। এটা সত্যি সরাসরি হয়ত কোরানে বুকে পেটে বোমা বেধে কারো উপরে হামলে পড়ার কথা নেই;  কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, কোরাণ খুললেই পাওয়া যায় যে – যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ্ কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না (৪৭:৪), কোরাণে বলা হয়েছে  – আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না (৩:১৬৯); কিংবা বলা হয়েছে যদি আল্লাহর পথে কেউ যুদ্ধ করে মারা যায় তবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত (৯:১১১)

আর আল্লাহর পথে শহীদদের জন্য জান্নাতের পুরস্কার  কেমন হবে?  আল্লাহ কিন্তু এ ব্যাপারে খুব পরিস্কার

তথায় থাকবে আনতনয়ন রমনীগন, কোন জিন ও মানব পূর্বে যাদের ব্যবহার করেনি (৫৫:৫৬)।

তাদের কাছে থাকবে নত, আয়তলোচনা তরুণীগণ, যেন তারা সুরক্ষিত ডিম (৩৭:৪৮-৪৯); সুশুভ্র (wine) যা পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু (৩৭: ৪৬)।

আমি তাদেরকে আয়তলোচনা হুরদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দেব (৫২:২…

তাঁবুতে অবস্খানকারিণী হুরগণ (৫৫:৭২); প্রবাল ও পদ্মরাগ সদৃশ রমণীগণ (৫৫:-৫৮)।

উদ্যান, আঙ্গুর, পূর্ণযৌবনা (full-breasted) তরুণী  এবং পূর্ণ পানপাত্র (৭৮: ৩৩-৩৪)।

তথায় থাকবে আনতনয়না হুরগণ, আবরণে রক্ষিত মোতির ন্যায়, (৫৬: ২২-২৩)।

আমি জান্নাতী রমণীগণকে বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি, অত:পর তাদেরকে করেছি চিরকুমারী (৫৬:৩৫-৩)।

 

শুধু আয়তলোচনা চিরকুমারীদের লোভ দেখিয়েই আল্লাহ ক্ষান্ত হননি, ব্যবস্থা রেখেছেন গেলমানদেরও

সুরক্ষিত মোতিসদৃশ কিশোররা তাদের খেদমতে ঘুরাফেরা করবে (৫২:২৪)।

 

বেহেস্তে সুরা-সাকী-হুর-পরীর এমন অফুরন্ত ভান্ডারের গ্রাফিক বর্ণনা দেখে দেখে আমারই তো শহীদ হতে মন চায়! এ যদি বিশ্বাসের ভাইরাসের সার্থক উদাহরণ না হয়, তবে আর ভাইরাস বলব কাকে, বলুন?

আজকে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদের যে তুঘলকি কান্ড সংগঠিত হয়ে গেল, তা বিশ্বাসের ভাইরাসের  রোগ ছড়ানোর জলজ্যান্ত উদাহরণ।  তবে একটি জিনিস কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। কাশ্মিরি জনগনের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাগাতার অত্যাচার, বাবড়ি মসজিদ ধবংস কিংবা গুজরাটে সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের উপর যে ধরণের অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে তা ভুলে যাবার মত বিষয় নয়। মুসলিমরা ভারতের জনগনের প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ তারাই ভারতে সবচেয়ে নিপিরীত, অত্যাচারিত এবং আর্থসামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠি। এ বাস্তবতাটুকুও বিশ্লেষনের সময় মাথায় রাখতে হবে।

 

ভাইরাস প্রতিষেধক

তাহলে এই সন্ত্রাসের ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায় কি করে? ভাইরাস যে প্রতিরোধ করতেই হবে এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই।  কারণ এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ সভ্যতার ক্যান্সারে রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে  ধ্বংস করবে।  একই কথা ডঃ বিপ্লব পাল বলেছেন একটু অন্যভাবে তার সাম্প্রতিক প্রবন্ধে

রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ ইত্যাদির ধারনা গুলোর বৈপ্লবিক পরিবর্ত্তন হচ্ছে-তখন মধ্যযুগীয় ধর্মগুলির আত্মিক উন্নতির কিছু বানী ছাড়া আর কিছুই আমাদের দেওয়ার নেইসেই আত্মিক উন্নতির নিদান ধর্ম ছাড়াও বিজ্ঞান থেকেই পাওয়া যায়-তবুও কেও আত্মিক উন্নতির জন্য ধার্মিক হলে আপত্তি করার কিছু  নেইকিন্তু ধর্মপালন যখন তার হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়বোধকে উস্কে দিচ্ছে-সেটা খুব ভয়ঙ্কর।  ধর্ম থেকে সেই বিষটাকে আলাদা করতে না পারলে, এগুলো আমাদের সভ্যতার ক্যান্সার হয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংশ করবে

অর্থা, এ ভাইরাসকে না থামিয়ে বাড়তে দিলে একসময় সারা দেহটাকেই সে অধিকার করে ফেলবে। আমার প্রবন্ধের উপরের দিকে দেয়া ল্যান্সফ্লুক প্যারাসাইট আক্রান্ত পিপড়ের উদাহরণের মত মানবজাতিও একসময় করে তুলবে নিজেদের আত্মঘাতি, মড়ক লেগে যাবে সমাজে।  তাহলে এই সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি? এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার এন্টিবডি, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস প্রতিষেধকের।  আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমারআপনার মত বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। আমি কিন্তু আসলেই মনে করি – এই এন্টিবডি তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের মুক্তমনার মত বিজ্ঞান মনস্ক, যুক্তিবাদী সাইটগুলো; ভুমিকা রাখতে পারে বিশ্বাসের নিগড় থেকে বেরুনো মানবতাবাদী গ্রুপগুলো এবং  মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গ। এই এন্টিবডির কারণেই বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে রোগমুক্তি ঘটেছে আমাদের শিক্ষানবিসের, আর রোগমুক্তির সাম্প্রতিক উদাহরণ তো পাবনার রানা ফারুকের মূল্যবান চিঠিটি।  আমরা যে ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করে  রোগমুক্তি ঘটাতে কিছুটা হলেও পারছি, এ বিচ্ছিন্ন উদাহরণগুলোই তার প্রমাণ।  কিন্তু তারপরও বলতে হবে সন্ত্রাসবাদের সাংগঠনিক শক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য দরকার আরো বৃহ কিছুর দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার, দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর মত স সাহসের, দরকার আমার-আপনার সকলের সামগ্রিক সদিচ্ছার।  আপনার আমার এবং সকলের আলোকিত প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমারা একদিন সক্ষম হব সমস্ত বিশ্বাসনির্ভর প্যারাসাইটিক ধ্যান ধারণাগুলোকে তাড়াতে, গড়ে তুলতে সক্ষম হব বিশ্বাসের ভাইরাসমুক্ত নিরোগ সমাজের।

দেখুন বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে ডেনিয়েল ডেনেটের একটি চমকার আলোচনা (ইউটিউবের সৌজন্যে)

http://www.youtube.com/v/KzGjEkp772s&hl=en&fs=1

:line:

. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজগ্রন্থের লেখক সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়? শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত।  ইমেইল : [email protected]