সাধুবাদ শেখ হাসিনাকে যে কারণে

 

আবুল হোসেন খোকন

 

 

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সম্প্রতি দেশে ফিরে দলীয় এক সভায় একটি গৃরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেনকথিত এক-এগারোর পর তার দলের অভ্যান্তরে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, বিশেষ করে দল থেকে তাঁকেই মাইনাস করার জন্য যারা সংস্কারবাদী সেজে নানা কীর্তি করে ক্যান্টনমেন্টের কতিপয় উচ্চাভিলাষীর স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি তাদের সম্পর্কে বলেছেনবলেছেন, “অপরাধীদের ক্ষমা করছি, কিন্তু তাদের ভুলে যাবো না

 

আসলে এই অপরাধীদেরকথা ভাবতে গেলেই আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাসের কথা মনে পড়ে যায়এ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি ঘটে, সেটা ১৯৭৫ সালেবিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোস্তাক জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের খুব ঘনিষ্ট থেকে তাকে মাইনাস করার কূটিল ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিলোআসলে ষড়যন্ত্রটা আরও অনেক আগে থেকেই মোস্তাকের মাধ্যমে চলছিল১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই মোস্তাক জনযুদ্ধটাকে বানচাল করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি আপোসরফার তপরতায় ব্যস্ত ছিলসে চাইছিল বাংলাদেশ স্বাধীন না হোককিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন তার ব্যাপারেফলে তাজউদ্দিনকে মাইনাস করার জন্যও মোস্তাকচক্র কম চেষ্টা করেনিযাই হোক সব চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেই মোস্তাক সফল হয়েছিলআর সফলতার জন্য তার মদতদাতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ছাড়াও দেশের মাটিতে সঙ্গী হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের ফারুক-রশিদ গং এবং ৭১-এর ঘাতক দালালরাএদের নিয়ে মোস্তাক জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করাতে পেরেছিলআরও পেরেছিল তাজউদ্দিন আহমেদসহ মুক্তিযুদ্ধের মূল চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করাতেপরবর্তীতে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং সেসব কাজে অংশ নিয়েছে মোস্তাক চক্রের অনুসারীরাএরমধ্যে জিয়াউর রহমানও একজন, যিনি ৭৫-এর ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর ঘটনার পর ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছিলেনক্ষমতা দখলের পর তার প্রধান কাজই হয়েছিল ৭১-এর ঘাতক দালালদের সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং সামরিক ও বেসামরিক পর্যায় থেকে ৭১-এর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করাতিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এ মিশনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলেনতারপর বাকি কাজ তার দল এবং পরে এরশাদের মাধ্যমে এগিয়েছিলসাম্রাজ্যবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এ কাজে সর্বাত্মক ভূমিকা রেখে এসেছেতবে বলা যায় এতোকিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যায়নি, কিংবা শেষ হয়ে যায়নি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষের সংখ্যাকিন্তু শেষ না হলেও, বা আওয়ামী লীগ ধ্বংস না হলেও যে এর ভিতরে এখনও মোস্তাকের অনুসারীরা সক্রিয় তা নতুন করে দেখা গেছে কথিত ওই এক-এগারোর ঘটনার পরদুঃখের বিষয় হলো এই অনুসারীদের মধ্যে এমনও অনেককে দেখা গেছে যারা সত্যিকার অর্থেই ত্যাগী নেতা এবং গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনীতিতে অসামান্য ভূমিকা রেখে এসেছেনএঁদেরও কেমন করে উচ্চাভিলাষীরা কব্জা করতে পেরেছিল সেটাই আশ্চর্য়! যাইহোক, অপরাধ অপরাধইসেটা যেই করুক, তাতে আসে যায় না

 

জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পরও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন তার কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকারণ ওই হত্যাকাণ্ডের সময় তারা দেশে ছিলেন না, বিদেশে অবস্থান করছিলেনআর সেজন্যই প্রাণে রক্ষা পেয়েছেনকিন্তু হাল যে ছেড়ে দেওয়া হয়নি তার প্রমাণ বিভিন্ন সময় তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা, এমনকি ৯৬-এর ক্ষমতায় থাকার সময়ও কোটালিপাড়ায় হেলিপ্যাডের কাছে বোমা পেতে রাখার ঘটনা, ২১ আগস্ট জনসমাবেশ মঞ্চে গ্রেনেড হামলা পরিচালনার ঘটনাসর্বশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাকে মাইনাস করার কতো না চেষ্টা হয়েছেআর এ চেষ্টায় যখন দলের ভিতরেই গুরুত্বপূর্ণ লোকদের পাওয়া গেছে তখন তো আর কথাই ছিল নাকিন্তু তারপরেও এ চেষ্টা সফল হয়নিভবিষ্যতে কতোটুকু সফল হবে না হবে তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারেতবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায় জাতিরজনককে হত্যা করে এবং তার দলসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশপ্রেমিক মানুষদের হত্যা, দমন-পীড়ন-বিতাড়ন করে, এমনিক মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থ-রাজনৈতিকভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও যখন কোন কাজ হয়নি তখন এ ক্ষেত্রে কোন ভবিষ্যতই সহায় হবে নাকারণ এ মাটি ও মানুষ অন্য ধাতুতে গড়া এবং এ মাটি ও মানুষের রয়েছে গৌরবোজ্জল লড়াকু ইতিহাসসুতরাং এটা মুছে ফেলা বা নিশ্চিহ্ন করা যাবে না

 

আর এ বিষয়টিকে আস্থায় নিয়েই হয়তো শেখ হাসিনা অত্যন্ত শক্ত এবং বড় শক্তির বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে আজকের অবস্থানটি নিতে পেরেছেনতিনি অপরাধীদের ক্ষমা করছি, কিন্তু তাদের ভুলে যাবো নাএ কথাটির প্রমাণ রেখেছেন আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন প্রার্থী বাছাইয়েওএতে অনেক বাঘা বাঘাকে কুপকা করে দিয়েছেন তিনিমনোনয়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিশেষ করে যারা স্বার্থপর, বিতর্কিত, সুবিধাবাদী, বিশ্বাসঘাতক এমনদের বাদ দিয়ে সর্বগ্রহণযোগ্য, ত্যাগী, এবং আদর্শবান নতুনদের প্রতি সর্বাত্মক গুরুত্ব দিয়েছেনফলে তাঁর এবং দলের ভাবমূর্তি বেড়ে গেছে একলাফে অনেকবঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে এটাই তাঁর কাছ থেকে আশা করেছেন সচেতন মানুষতিনি এ ক্ষেত্রে নিজের অবস্থানে ঠিক থেকেছেন এবং দুঃসাহিক ভূমিকা রেখেছেনআর এই কাজের জন্য তিনি সাধুবাদ পেতেই পারেন

 

এখানে না বললেই নয় যে, বিশ্বাসঘাতকদের অনুচররা ঘরে-বাইরে থেকে দূর হয়ে যায়নি তা আগেই বলা হয়েছেবঙ্গবন্ধুকে মাইনাস করার মতো তার কন্যা শেখ হাসিনাকেও রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য যে চেষ্টা হয়েছিল বা ভবিষ্যতেও হবে সে চেষ্টার নেপথ্যে আছে ক্যান্টনমেন্টে থাকা কতিপয় উচ্চাভিলাষীএদের গাটছড়া বাঁধা আছে আরও অনেক জায়গায়মিডিয়ার বাঘা বাঘারাসহ সুশীল শ্রেণীবলে খ্যাতরাও আছেনআছেন -যোগ্যনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিদার একটি শ্রেণীওবোঝাই যায় নেপথ্য থেকে এদের দিয়ে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের ছক সাজানো হয়েছে শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধেএই ছক কিন্তু এখনও বহালযারা ওলোট-পালট করে দে মা লুটেপুঠে খাইপরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, তারা হাল ছেড়ে দেয়নিদেশের মানুষ তাদের পক্ষে থাকেননি বলে আপাত তারা বিপাকে আছেন বটেকিন্ত সুযোগের অপেক্ষা কিন্তু শেষ হয়নিবলা যায় এ ক্ষেত্রে এরা এখন মরিয়াযদি কোনভাবে আসন্ন নির্বাচনটাকে বানচাল করা যায়, বা দেশে এমন কোন অবস্থা তৈরি করে পরিস্থিতি তৈরি করা যায়Ñ তাহলে তাদের চেষ্টা সফল হয়এজন্য যেসব মোক্ষম ইস্যু দরকার তারও কিন্তু ঘাটতি নেইইস্যু তৈরির জন্য আছে মৌলবাদী জঙ্গি, আছে সন্ত্রাসের সূতো, আর আছে সীমান্তে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা বাঁধিয়ে দেওয়ার বিষয়আছে দুই বড় রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে দেওয়ার বিষয়ওএগুলো পরিস্থিতি তৈরির জন্য অত্যন্ত যুসই ইস্যুতবে ব্যাপার হলো জুসই ইস্যুকে জুসইভাবে পাওয়া না পাওয়াটা এখানে বড়নেপথ্যেই এসব নিয়ে জোর গবেষণা-হিসেব-নিকেষ যে চলছে না তা নয়চলছে, বেশ ভালভাবেই চলছেচলছে বলেই ১৮ তারিখের নির্বাচন নিয়ে এতো জটিলতা এবং বারবার তফসিল পেছানোসময়ই বলে দেবে শেষ পর্যন্ত কি হবে

 

তবে যে কথা সেটা হলো এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা দলীয় বিশ্বাসঘাতক, দুর্নীতিবাজ এবং সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে নতুনদের মনোনয়নে দৃঢ় থেকেছেন এবং শেষ পর্যন্তও এ দৃঢ়তা বজায় রেখেছেনবলার অপেক্ষা রাখে না যে যাদের অন্য নেপথ্যশক্তি রয়েছে, কালো অর্থ-কড়ি রয়েছে এবং রয়েছে পাকা কূটবুদ্ধি ও নেটওয়ার্ক তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া চট্টিখানি কথা নয়কিন্তু শেখ হাসিনা তা নিয়েছেন এবং নেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেনতিনি এটা দেখাতে পেরেছেন এই বিশ্বাসে যে তাঁর পেছনে সচেতন মানুষ আছেন, আর আছেন সুবিশাল দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীনিঃসন্দেহে তাঁর এই অবস্থান থেকে এটাও প্রমাণ হয় যে তিনিও মানুষের শক্তিকে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করেন এবং সেই শক্তিকে নির্ভর করেই চলতে চাইছেনভবিষ্যতেও তিনি যদি এরকম সুদৃঢ় থাকতে পারেন তাহলে বলাই যায় অতীতের পূণরাবৃত্তি আর ঘটতে পারবে নাভবিষ্য এভাবে চললে উজ্জ্বল সময় অনিবার্য

 

——————————————————————–

 

আবুল হোসেন খোকন : সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট