যে প্রেক্ষাপট না বদলালে রক্ষা নেই

 

আবুল হোসেন খোকন

 

মাস আগে বেসরকারী কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে রাজধানীর শেরাটন হোটেলের বলরুমে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলআলোচনার বিষয় ছিল Campaign for Sustainable Rural Livelihoodsঅনুষ্ঠানে রাজধানীর নির্ধারিত শ্রোতা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রোতাদের আনা হয়েছিলএইসব শ্রোতাদের যাতায়াত খরচসহ আনুসাঙ্গিক খরচ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল এবং যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন তাদের আসা-যাওয়া এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলআলোচনা অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্য তেমন কিছুই ছিল নাসরকারের একদল প্রতিনিধি বিদেশে যাবেন এ ধরণের বিষয়ে আরেকটি আলোচনা সভায় যোগ দিতেসেখানে কি বলা উচিত সে বিষয়ে অভিমত দেওয়াই ছিল এই আলোচনা অনুষ্ঠানটির লক্ষ্যঅনুষ্ঠানে সরকারের একজন উপদেষ্টাও ছিলেন বক্তা হিসেবেবাকি বক্তারা ছিলেন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার নির্ধারিত ব্যক্তি-বর্গ

 

এই অনুষ্ঠানে খুলনার চিংড়িচাষ এলাকার দুজন সদস্য এসেছিলেন, যাদের সঙ্গে কিছু কথা হয়এ দুজনের মধ্যে একজন মহিলাদুজনই একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যতবে এরা একেবারেই তুণমূলের মানুষ বলে রাজধানী বা উঁচুপর্যায়ের মানুষ সম্পর্কে ধারণা ছিল না, আয়োজকদের সম্পর্কেও প্রকৃত ধারণা ছিল নাতাদেরকে আনা হয়েছিল, তৃণমূল এলাকার সমস্যা সম্পর্কে (স্বাক্ষী হিসেবে) কিছু বলার জন্যএ ব্যাপারে দফায় দফায় তাদের সংগঠন থেকে ব্রিফিং করা হয়েছে, যাতে যা বলাতে চাওয়া এরা তাই-ই বলেএই দুজনের সঙ্গে কথা বলছিলামএরা জানায়, তারা একেবারেই গরিবদুবেলা পেট পুরে খাওয়ার কথা ভাবতেই পারে নাএকবেলা কোন রকমে খাওয়া জোটে এদেরখুব ভোরে, অর্থা অন্ধকার থাকতে তাদের যেতে হয় নোনা পানিতে মাছ শিকারের জন্যসেখানে দিনভর গলাপানিতে ডুবে থেকে মাছ ধরতে হয়ওই মাছই তাদের আয়ের উতারা জানালো, সারাদিন নোনা পানিতে থাকার ফলে শরীরে থকথকে ঘা জন্ম নিয়েছেমাছ ধরার সময় তাদের কালো মিশমিশে দেহ মরা মানুষের মতো সাদা হয়ে যায়তাই সারা শরীরে নানা রোগ ভর্তিকী কষ্ট করেই না তাদের দিন যাপন করতে হয়! এরা এর বিষদ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলআলাপ করে জানা গিয়েছিল, এই দুই সদস্যই চিংড়িচাষবিরোধীতারা চায় এই চাষ বন্ধ হোক এবং চিংড়ি চাষের জমিতে আগের মতো ফসল আবাদ করা হোকতাহলে তাদের এতো কষ্ট থাকবে নাএটা এদের সংগঠন থেকেও বলে দেওয়া হয়েছে

 

এই দুই সদস্য যে সংস্থার সঙ্গে জড়িত তার প্রধানও ছিলেন আয়োজিত অনুষ্ঠানের একজন গুরুত্বপূর্ণ বক্তাদেখলাম এ দুই গরিব কর্মী তাদের প্রধান সম্পর্কে অন্ধ ভক্তএরা তাকে দেবতা বলে মনে করেকারণ তিনি নাকি মাঝে মাঝেই তাদের এলাকায় যান এবং তাদের সঙ্গে সুখ-দুখের গল্প করে আন্দোলনগড়ে তোলার কথা বলেন, যাতে করে তাদের অভাব-অনটন দূর হয়ে যায়বলেন, সংঘবদ্ধ হতেএজন্য সাহায্য-সহযোগিতাও করেনকর্মী দুজন জানালো, শেরাটন হোটেলের এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে তাদের বলা হয়েছে যে গরিবদের গরিবি দূর করার জন্যই এ আয়োজনকিন্তু সদস্য দুজন কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে, গরিবি দূর করার জন্য এখানে লাখ লাখ টাকা খরচ কেন? এ রকম একটি ব্যয়বহুল হোটেলেই বা এই বিশাল রাজকীয় আয়োজন কেন? তারা বেশ হতবাক অবস্থায় সব লক্ষ্য করে যাচ্ছিলমাঝে মাঝে একে-অপরকে প্রশ্ন করছিল, এটা কি হচ্ছে? গরিবি দূর করার জন্য এতো ব্যয় হচ্ছে অথচ এই ব্যয়টা গরিবদের ঘরে গিয়ে করলে তো বহু মানুষ দু-বেলা পেট পুরে খেতে পারতোপারতো আরও অনেক কিছু করতেকিন্তু এখানে এটা কি করা হচ্ছে? 

 

এই অনুষ্ঠানে দুপুরের যে খাবার প্যাকেট দেওয়া হলো, তার দাম শেরাটন হোটেলের দাম অনুযায়ী প্রতিটি ৩শটাকার বেশীঅনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন শপাঁচেক মতো শ্রোতাসবার মাঝেই এ মূল্যবান খাবার পরিবেশন করা হয়সদস্য দুজন হিসেব মেলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলবারবার করে বলছিল, গরিবি দূর করার এই যদি হাল হয় তাহলে কোনদিন কি গরিবি দূর হ্েব? দেখলাম তারা খুব মন খারাপ করে নিজেরা কথা বলছেএই দুই সদস্য এইসঙ্গে আরও দেখলো, তাদের সংস্থার প্রধান দামী একটি গাড়িতে করে এলেন এবং হাসিমুখে কথা বলে বিদায় নিয়ে ওই গাড়িতেই চলে গেলেনসদস্য দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলফলে তাদের মনোভাব থেকে বোঝাই যাচ্ছিল তাদের মনে কেবলই প্রশ্ন জাগছিলহয়তো খুব স্পষ্ট করেই এ প্রশ্নটিও আসছিল যে, যা হচ্ছে তা করে কাদের লাভ হচ্ছে?

 

এরকম আরও অনেক তৃণমূলের মানুষের মনোভাব লক্ষ্য করা গেছেতাদের কেউ কেউ বলছিল, এরকম একটা অনুষ্ঠান করে বিদেশিদের কাছ থেকে কতো বড় অংকের অর্থ আয়-ই না হচ্ছে! আবার অভিজ্ঞরা মন্তব্য করছিল, আজকে এটাই হলো উন্নয়ন ভাবনার আসল চরিত্রতারা বলছিল, বিদেশিরা টাকা দেয়, ওই টাকার খুব ছোট অংশটা খরচ হয় তৃণমূল মানুষের মাঝেবড় অংশটা চলে যায় উদ্যোক্তাদের পকেটেআর একটা অংশ ব্যয় হয় এরকম সভা-সেমিনার-আলোচনা-প্রচার অনুষ্ঠান, ট্রেনিং ইত্যাদিতেএই খরচ যা হয় তার চেয়ে কয়েকগুন বেশী দেখানো হয় এবং তাও দেয় ওই বিদেশিরাইসাহায্য বলা হোক, শিক্ষা বলা হোক, স্বাস্থ্যসেবা বলা হোক, মোটিভেশন ওয়ার্ক বলা হোক সব কিছুতেই ডোনারারটা টাকা দেয় এবং এতে তৃণমূলের কোন কাজই হয় না, কাজ হয় উদ্যোক্তাদেরএটা এখন বাংলাদেশের জন্য  রমরমা ব্যবসাসমালোচনাকারীরা এও বলছিল, গ্রামের মানুষও এখন এটা বেশ বুঝে গেছেবুঝে গেছে বলেই তারা আমাদের বিশ্বাস করে না

 

এইসব ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে এই দেশে মাথাহিসেবে পরিচিত এক শ্রেণীর লোক আছেতারাই যতো সর্বনাশের মূলএরা বাংলাদেশের মর্যাদা ভেঙে দিয়েছেএরা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গৌরবকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছেএরাই বাংলাদেশকে পরনির্ভর করেছে, দেশকে গরিব-ভিখিরির দেশে পরিণত করেছেএরাই দেশকে দারিদ্র পীড়িত, মঙ্গা কবলিত, অনাহার-বুভুক্ষ কবলিত, বন্যা তথা প্রাকৃতিক দূর্যোগ কবলিত, অস্বাস্থ্যকর-রোগবালাইয়ে পরিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেআর এসব করে তারা হাতিয়ে নিয়েছে বিপূল বৈদেশকি অর্থবানিয়েছে রাজকীয় জীবন-যাপন-আবাস-বিএমডাব্লিউ গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদিআর এরাই এদেশকে বিদেশিদের লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ করে দিয়েছেএই দেশে যখন দরিদ্রের সংখ্যা কম ছিল, অনাহারি মানুষের হার কম ছিল, অভাব-অনটন কম ছিল তখন শুধুমাত্র এই কম সংখ্যক মানুষের দূর্দশার চিত্র বিদেশিদের কাছে ফলাও করে তুলে ধরেছে, আঁতকে ওঠা ছবি-ভিডিওচিত্রগুলো পাঠিয়েছে, আর বিদেশিদের কাছে সাহায্য চেয়েছেবিদেশিরা এসব চিত্র দেখে আঁতকে উঠেছেসাহায্যের জন্য তারা হাত বাড়িয়েছেআর এইসব সাহায্য বিলি-বণ্টনের দায়িত্ব নিয়েছে এই প্রচারকারীরাএরফলে মানুষের দারিদ্র, অভা-অনটন-ক্ষুধা-অনাহার-রোগ-বালাই ইত্যাদি দূর তো হয়ই নাই, তার বদলে এইসব প্রচারকারীদের প্রচারাণা আরও বেড়েছেসঙ্গে তাদের বাণিজ্য বেড়েছেতারা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, অর্থ-বিত্ত্বে লালে লাল হয়েছেতাদের এই কারবার এভাবে আজও চলছেতারা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে ভূখা-নাঙ্গা-হতদরিদ্র-বিপর্যস্ত দেশ হিসেবে তুলে ধরে যাচ্ছেই, আর কাড়ি কাড়ি অর্থ-সম্পদ বানাচ্ছেইএভাবেই এরা আজ দেশের মাথাহয়ে উঠেছেএই মাথারাএভাবে দেদারছে এ দেশের মানুষকে নিয়ে ব্যবসা করছে এবং দেশকে পরনির্ভর হিসেবে দাঁড় করিয়েছেএভাবেই এরা নিজেদের হীন স্বার্থে দেশের মহা সর্বনাশ করেছে এবং করে চলেছে

 

কারও অজানা নয় যে, বিদেশিরা একটা সময় পর্যন্ত হয়তো স উদ্দেশ্য নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ালেও একটা পর্যায়ে তারা বাংলাদেশের মতো সুজলা-সুফলা-ধন-সম্পদে ভরা এই দেশেকে লুণ্ঠনের সুযোগ নেবেইআর সে সুযোগ যদি দেশের মাথাহিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ারা করে দেয় তাহলে তো সোনায় সোহাগাহয়েছেও তাইসুতরাং আজ যারা গ্রাম-গঞ্জে দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান তৈরি কিংবা মানুষকে সচেতনায়ন করার কথা বলে বিদেশি অর্থে কাজ করছে তাদের আসল উদ্দেশ্য একটাইসেটা হলো মানুষকে ব্যবহার করে বাণিজ্য, লুণ্ঠন, নিজেদের আখের গোছানোসবচেয়ে সত্য কথা হলো মুখে এই লোকগুলো যতো ভাল ভাল কথাই বলুক না কেন আসলে এই লোকগুলো কখনই চায় না যে এদেশ থেকে দারিদ্র দূর হয়ে যাকচায়না অভাব-অনটন-ক্ষুধা-বেকারত্ব-বন্যা-মহামারী-দুর্ভীক্ষ-দূর্যোগ দূর হয়ে যাকএরা চায় না রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক সংকট, সামাজিক অত্যাচার-অনাচার-কূসংস্কার, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গি মৌলবাদ ইত্যাদি দূর হয়ে যাকচায় না এ কারণেই যে এগুলো না থাকলে না বাড়লে তাদের বাণিজ্য হবে না, তাদের রাজকীয় বিলাস-ব্যাসনের জীবন থাকবে না, আয়েশ থাকবে না, থাকবে না কর্তৃত্বওসুতরাং এদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এসব চাই-ই, আরও বেশী করে চাইআর বিদেশিরা এতে উসাহী এই কারণে যে এইসব ইস্যুতে তারা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে পারছে, দেশকে ঋণের জালে আটকাতে পারছে, পারছে যা খুশী তাই করারঅধিকার এবং ক্ষমতা অর্জন করতেচাইকি কোন কোন ইস্যুতে  আফগানিস্তানের মতো সামরিক হস্তক্ষেপ করার অধিকারও তাদের থাকছে

 

আজকের বাস্তবতা লক্ষ্য করলেই এই সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়এই বাস্তবতাই এদেশের গৌরব, ঐতিহ্য, আত্মনির্ভরতা, সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করার মূল কারণবাজার অর্থনীতির বিস্তার, সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের বিস্তার, অপসংস্কৃতির বিস্তার, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারানোর ক্ষেত্র গড়ার ঘটনা সব এই বাস্তবতার কারণেকথিত মাথারা এখানে আসল শত্রএরা বিদেশিদের মিডিয়া বা দালাল হিসেবে কাজ করছে

 

আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো আগে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতোএকে-অপরের জন্য পাশ দাঁড়াতোআজ কিন্তু সেভাবে দাঁড়ায় নাবিশ্বাসও করে নাকরে না বলেই আজ দেশে অতীতের মতো ঐতিহাসিক আন্দোলন হয় না দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতিতেওমানুষ মাঠে নামে নানামে না, কারণ তারা কাকে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাসের জায়গাটাই তো নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা করেসুতরাং দেশে এতো অভাব, এতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, দুর্নীতি-লুণ্ঠন-অত্যাচার-নির্যাতন-নিরাপত্তাহীনতা-দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা-অশান্তি তারপরেও মানুষের মুখে টু শব্দটি নেইবিশ্বাসঘাতকদের কারণে যে ভীতি-সন্দেহ তা মানুষ কাটাতে পারছে নাআবার পারছে না ওই বিশ্বাসঘাতরাই যখন ভাল ভাল কথা বলে সামনে আসছেসুতরাং তারা ৪৮-৫২-৬২-৬৮-৬৯ বা ৭১-এর মতো মাঠে নামবে কেমন করে? কিংবা এই বাংলাদেশেও জিয়া-এরশাদ-খালেদা বিরোধী আন্দোলনে মানুষ যেভাবে মাঠে নেমেছ আজও সেটুকুও নামছে নাঅথচ পরিস্থিতি অতীতের চেয়ে বহু বহু গুনে গণবিরোধী

 

কিন্তু এ প্রেক্ষাপট না বদলালে যে রক্ষা নেই সেটা সর্বজনবিদিতহ্যাঁ, এদেশের খেটে খাওয়া মাটির মানুষ যারা তারা নানা সন্দেহে ভুগলেও মাঠে নামবেন না, তা নয়তারা মাঠে নামবেন এবং তাদের নামতেই হবেনা হলে এই প্রেক্ষাপট যে বদলানো যাবে না তারা সেটাও ভাল বোঝেনবোঝেন বলেই তারা হয়তো অপেক্ষা করছেনতারা শত্রদের চিনছেন, জানছেনআর এভাবেই হয়তো ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠছে নতুন গণবিস্ফোরণের প্রেক্ষাপট

 

———————————————————–

 

আবুল হোসেন খোকন : সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী