“... মানুষ যেটুকু অনুভব করে, তার চেয়েও তারা বেশি স্বাধীন।”
—মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৩)
প্রথম সংখ্যা বেরুনোর অনেকদিন পরে অবশেষে যুক্তি দ্বিতীয় সংখ্যা বের হল; অনেক অপেক্ষা-প্রতীক্ষার পর। স্বীকার করতে হবে—এ ব্যাপারে সব কৃতিত্ব পাঠকের। পাঠকের নিরন্তর অনুপ্রেরণা-উৎসাহ-তাগাদা আমাদের সাহস যুগিয়েছে শত অসুবিধা-সীমাবদ্ধতার মধ্যে যুক্তি দ্বিতীয়বার বের করার জন্য উদ্যোগী হতে। পাশাপাশি ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি—সময়মত যুক্তি নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হতে পারিনি বলে।
লাথি মার ভাঙরে তালা! যতসব বন্দীশালায়—আগুন জ্বালা... : চারিদিকে এখন ভয়ঙ্কর দৈন্য, মহামারি, অভাব; নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দু-দফা বন্যা আর ভয়াবহ ‘সিডর’ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে আমাদের দেশের প্রাণ কৃষি আর কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম (১/১১-এর পর) রাজনৈতিক দলগুলো ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ছে, ‘দেশ-জনগণ’ যাদের কাছে এতদিন ‘বাপেরবাড়ি’ আর ‘শ্বশুরবাড়ি’র তালুকদারি হিসেবে গণ্য হতো—চৌদ্দ শিকের ঘরে মোটা চালের ভাত খেয়ে তাদের এতদিনকার ঈশ্বরীয় জীবনের ইন্দ্রপতন ঘটেছে (স্বীকার করতে হচ্ছে, এরকম পতনের আবশ্যিক প্রয়োজন ছিল); ঠেলায় পড়ে ‘ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া’ বাকি রাজনীতিবিদগণ শুরু করেছেন ‘সংস্কার’ নিয়ে চিরাচরিত কানামাছি খেলা। কিন্তু গত ২২ জানুয়ারির ইলেকশন নিয়ে আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, সেই মান্যবর ইয়াজ উদ্দিন ও আজিজ গং এখনো বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছেন! কেন বাপু?
গত বছরের ২০-২২ আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া সশস্ত্র বাহিনীর অবিমৃষ্যকারী ভূমিকা এবং এজন্য পরবর্তীতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ছাত্রবিক্ষোভের ঘটনায় ইন্ধন দেবার দোহাই দিয়ে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয়-সম্মানিত শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, শাস্তিপ্রদান, ছাত্র-শিক্ষকদের নিঃশর্ত মুক্তির বিষয়টি ‘অযথা’ ঝুলিয়ে রাখার মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধপরায়ণতার স্বরূপ তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে—রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পরও ‘পাকি শাসক আইয়ুবীয় ভূত’ ক্ষমতাসীনদের কারো কারো মননে-মগজে-চেতনায় এখনো রয়ে গেছে! আর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সম্মানিত শিক্ষকদের সাথে শাসকগোষ্ঠীর এহেন অন্যায়-অন্যায্য-নিন্দনীয় আচরণের পরও—‘সুশীল’ বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ক্রিয়-নি®প্রভ ভূমিকায়, আমরা চরমভাবে ব্যথিত-লজ্জিত। পূর্বতন সময়ে গণতন্ত্র-মানবাধিকার নিয়ে যাঁদের সোচ্চার পদচারণা লক্ষ্য করা যেত, আজ তাঁদের ‘জার্সি বদল কালচার’ (কারো-কারো অসহায় আত্মসমর্পণ)—আবারো চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকারের মারাত্মক দীনতা ও অভাব। এহেন দুঃসময়ে আমরা স্পষ্ট করেই বলছি, সর্বদা নিঃশঙ্ক চিত্তে থাকা আর যুক্তির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই।
শক্তের ভক্ত নরমের যম : দৈনিক প্রথম আলোর সাপ্তাহিক রম্যম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এ গতবছর (১৭ সেপ্টেম্বর) ছাপানো সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কার্টুনিস্ট আরিফের ‘ছেলেমানুষী’ একটি কার্টুন নিয়ে ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাতে’র অজুহাতে ‘জরুরি অবস্থা’ ডিঙিয়ে কয়েকটি মুখচেনা ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-গোষ্ঠী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সারা দেশে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিল (অথচ যৌক্তিক-নৈতিক-মানবিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জরুরি অবস্থার মধ্যে মৌনমিছিল ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে; শোনা যাচ্ছে ‘সুষ্ঠু আইনি’ প্রক্রিয়ায় বিচার চলছে!—কিন্তু ঐ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-পাণ্ডাদের ব্যাপারে সরকার আশ্চর্যজনকভাবে নীরব!)। প্রথম আলোর সম্পাদক, কার্টুনিস্টকে মুরতাদ-কাফের ইহুদি-নাসারাদের সোল এজেন্ট ঘোষণা করে ফাঁসি দাবি করা হল প্রকাশ্য রাজপথ থেকে। যদিও একই ধরনের কার্টুন আমরা আগেও দেখেছি—জামাতে ইসলামির মাসিক ম্যাগাজিন ‘কিশোরকণ্ঠ’-এর (১৯৯৮ সালের নভেম্বর সংখ্যা) হাসির বাক্স বিভাগে। তখন কোনো ইসলাম দরদী দল বা ব্যক্তিত্ব দেখলাম না, জামাতে ইসলামি দ্বারা ‘ইসলাম’ বা ‘নবিজি’কে অবমাননা করার অপরাধে প্রতিবাদ-মিটিং-মিছিল, নিদেনপক্ষে কোনো বিবৃতি...!
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ‘ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি’-করা নিয়ে একই দ্বিচারিতা (সোজা বাংলায় ভণ্ডামি); আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক-নারীবাদী তসলিমা নাসরিন কবেকার কোন লেখায় ‘ইসলাম’ নিয়ে (সমালোচনামূলক) মন্তব্য করেছেন; এরপর টেমস থেকে সুরমা, নীলনদ থেকে গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে—অথচ এখন এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে জল ঘোলা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসরকার তসলিমার ঐ লেখাটি কথিত সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি রক্ষার নামে অনেক আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল! যতদূর জানা যায়, এরপর তসলিমা আর এ ধরনের লেখা লেখেননি। তাহলে এখন কেন তসলিমাকে ভারত থেকে উৎখাতের জন্য জঙ্গি-আন্দোলন? তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আনা হচ্ছে? কারা মদদ দিচ্ছে এসবে?—বাতাসে অনেক কথাই শোনা যায়, বিশেষ করে ‘নন্দীগ্রাম’ ইস্যু...। যাহোক, এ আমাদের আলোচ্য নয়। বলতে চাচ্ছি—পাকিস্তানের মোশারফ সরকার তো কয়েক দিন আগে ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত লাল মসজিদটি ‘জঙ্গি’ মুক্তকরণের নামে কামান দাগিয়ে গুড়ো করে দিলেন, সেনা পাঠিয়ে রক্তগঙ্গা বানালেন; অথচ তখন বা এখনও এ উপমহাদেশের কোন ইসলাম-মুসলমান দরদী আলেম-ওলামাকে পেলাম না—প্রেসিডেন্ট মোশারফকে ‘আল্লাহর ঘর’ মসজিদে কামান দাগানো, তছনছ করা, গণহত্যা চালানোর অপরাধে—কোনো ফতোয়া দিতে, মুরতাদ ঘোষণা দিতে—ন্যূনতম প্রতিবাদ করে বিবৃতিটুকুও মিডিয়ার মাধ্যমে পেলাম না! মসজিদের ভেতর নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে মুসলমানকে গ্রেনেড-বোমা মেরে হত্যা করলে, কামান দাগিয়ে মসজিদ চুরমার করে দিলে—ইসলামের অবমাননা হয় না! কিন্তু ইসলাম নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা করলে কিংবা ইসলামের কোনো ‘ব্যাকডেটেড চিন্তা-প্রথা’র সমালোচনা করলেই ইসলামের অবমাননা হয়। হায়!... এরকম উদাহরণ সেই মুতাজিলা কিংবা ওমর খৈয়াম-ইবনে সিনাদের সময়কার ঘটনার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়!
একটি কথা মনে পড়ছে, যদিও এখানে প্রকাশ করা বাহুল্য, তবে অপ্রাসঙ্গিক নয়—আজ যারা (বিশেষ করে মৌলবাদীরা) ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ কিংবা মুতাজিলাদের মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ ‘মুসলিম’ মনীষী-বিজ্ঞানী, ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’ হিসেবে অভিহিত করেন (ইউরোপীয়দের সাথে টেক্কা দিবার স্বার্থে), বুক ফুলিয়ে প্রচার চালান (‘ইবনে সিনা ট্রাস্ট’ ধর্তব্য),—তাদের একটু কষ্ট করে ইতিহাসের পুনঃপাঠের অনুরোধ জানাচ্ছি। তৎকালীন মধ্যএশিয়ার শাসকগোষ্ঠী-মৌলবি-সমাজপতিরা কথিত মুসলিম মনীষী-বিজ্ঞানীদের মুক্তচিন্তা-যুক্তিবাদিতা চর্চা করার কারণে কী পরিমাণ নির্যাতন-নিষ্পেষণ চালিয়ে, ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করে সমাজচ্যুত করেছিল, ঘরবাড়ি-বইপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিল, প্রাণে বাঁচার তাগিদে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল—এ ইতিহাস ‘আত্ম-পরিচিতি’র সংকটে ভোগা বর্তমানের এ গোষ্ঠীটি বিস্মৃত হতে পারে, কিন্তু মুক্তমনা-যুক্তিমনস্ক মানুষ বিস্মৃত হয়নি, হতে পারে না। শুধু মধ্যএশিয়ার মনীষী কেন,—আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল, বাংলার নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া, শিখা’র আবুল হুসেন’কেও তো ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করেছিল, লেখনী বন্ধ করার জন্য প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল তৎকালীন মুসলিম সমাজপতিরা। তাই আজো যারা পুনরায় আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন-এর বিরোধিতা করেন, উৎখাতের প্রচেষ্টা চালান তাঁদের মত-মননকে, তখন এদের জন্য করুণাই হয়! ভাবনা হয়,—এদেরই পরবর্তী প্রজন্ম আবার হয়তো কিছুদিন পর হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ, আরজ আলীকে ‘হাইজ্যাক’ করে শ্রেষ্ঠ ‘মুসলিম’ মনীষী, ‘ইসলামি’ চিন্তাবিদ বানাতে কসুর করবে না; তসলিমা নাসরিনকে বানিয়ে দেবে মুসলিম মহীয়সী নারী!