ভূমিকাঃ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী  সরকার গঠিত হয়। এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা তৈরী করে।  এই অভ্যুত্থান কোন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা সংগঠিত হয়নি, হয়েছে ছাত্র-জনতার স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনে এবং অতি অল্প সময়ে। সে কারণে এই সরকারের উপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোন ধরণের চাপ প্রয়োগের নৈতিক অধিকার নেই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেনাবাহিনী মৌনতা অবলম্বন করে তাদের সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছে। সুশীল সমাজ, এনজিও পাড়া বিদেশি সংস্থার পরোক্ষ ভূমিকার কথাও শোনা যায়। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার প্রধান হয়েছেন বিশ্বখ্যাত প্রফেসর মোঃ ইউনুস, যাঁর দেশ-বিদেশে বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা ও গুরুত্ব আছে। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবেও তিনি কোন দূর্বল ব্যক্তি নন। তাঁকে কোন দল ও  নেতানেত্রীকে সমীহ ও তোয়াজ করে চলতে হবে এমনটা মনে হয় না।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কি অবস্থা?

দলটির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পলায়ন করলে দলটির নেতাকর্মীরাও জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেন, অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান, কেউ কেউ পালাতে গিয়ে ধরা পরেন, অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে, অনেকে খুনও হন। মোটকথা দলটি এখন অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা ও মার্কিন দেশে থাকা তাঁর ছেলে জয়ের বক্তব্য দলটির নেতা-কর্মীদের যতটা না স্বস্তির কারণ হয়েছে তারচেয়ে অধিক অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। তবে দলকে পূর্ণগঠন ও নেতাকর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে তিনি বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অন্তবর্তি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জয় দ্রুত নির্বাচন দাবী করেছেন, এমন কি বিএনপি’র সাথে কাজ করতেও আগ্রহী এমন মন্তব্যও করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অভ্যুত্থান পরবর্তি বলাবক্তব্যে অত্যন্ত সতর্ক। তাঁরাও বলেছেন এখন প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের সময় নয়, দেশ গঠনের সময় ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ এখন সারা দেশে ছাত্র-জনতার ক্রোধ ও প্রতিহিংসার কবলে। তারা এখন ফের কিভাবে রাজনীতিতে সংগঠিত হবেন, ঘুরে দাড়াবেন তার হয়তো কৌশল ভাবছেন। অন্তবর্তি সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন সেটা এখনো পরিষ্কার নয় তবে সকল দলই এই বিষয়ে সতর্ক মন্তব্য করছেন। বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের দাবী এখনো কেউ জোড়ালো ভাবে তুলছেন না, যদিও সবাই সরকারকে সময় দিচ্ছেন প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য। আরেকটি বড় বিষয় ছাত্ররা এখনো সক্রীয় ও সংগঠিত আছে, তাদের প্রতি মানুষের আস্থাও এখনো অটুট আছে। তবে এই অবস্থা থাকা না থাকার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে আজকের অবস্থাটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য শেষ কথা এমনটা নয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়তো এই অবস্থা সহসাই পাল্টে দিতে পারে। কিভাবে?

ভবিষ্যত ক্ষমতাকেন্দ্রীক কোন পক্ষ তাদের নিজ স্বার্থে তাদের সাথে কোন গোপন আতাত ও বোঝাপড়ায় আসতে পারে। সেটা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ক্ষমতার জন্য জেলে থাকা স্বৈরাচার এরশাদের সাথে এবং স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবিরের সাথেও ক্ষমতাকেন্দ্রীক দলগুলো আশির্বাদ নিয়েছিল, বোঝাপড়া করেছিল। তাৎক্ষনিক স্বার্থ, সুবিধা, ক্ষমতা অতীত শত্রুতাকেও ভুলিয়ে দেয় তার নজীর উপমহাদেশে অনেক।

বিএনপি কি তাহলে সহসাই ক্ষমতায় যাচ্ছে?  

আগস্ট অভ্যুত্থান বিএনপির জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠ থেকে বিতারিত হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই তাদের জন্য মাঠটি ফাকা হয়ে যায়। সরকার পতনের পরপরই সর্বত্রই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। বিএনপির নেতাকর্মীরা জেল থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে। শুধু তাই নয় সর্বত্র তাদের মহড়াও শুরু হয়ে যায়। নেতাকর্মীদের মধ্যে শাসক দলের ভাবভঙ্গি আমেজ চলে আসে। কোনঠাসা ও নিরব থাকা সমর্থকরাও সক্রীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু  অজানা বাস্তবতায় ক্ষমতাকেন্দ্রীক সমীকরণ কি এতটা সরল ও সহজ হবে তাদের জন্য?

দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে অনেক কথা বলেছেন। বিএনপি তাতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাদের নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ (রূপরেখা) দেবেন। আমরা গণতন্ত্রে উত্তরণের সেই রোডম্যাপ ওনার বক্তব্যের মধ্যে পাইনি। ধোঁয়াশা এখনো পরিষ্কার হয়নি।’ ইতোমধ্যে বিএনপি নেতা মির্জা ফকরুল ১/১১’র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

বিএনপি নির্বাচমুখী একটি দল, এটা কোন বিপ্লবী বা শক্ত নীতি-আদর্শের সুশৃংখল দল নয়। তাই আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের ক্ষমতায়ন যত বিলম্ব হবে সংকট ততোই বাড়বে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের তারা কিভাবে, কি বলে নিয়ন্ত্রণ করবেন? তারা ইতোমধ্যে দখল, চাঁদাবাজি, মাস্তানি শুরু করে দিয়েছে। হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে গোপনে-প্রকাশ্যে লেনদেন চলছে। নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি হলে তা নির্বাচনে ফলাফলে প্রভাবিত করতে পারে।  পড়বে, সেটা নিশ্চয়ই দলটির জন্য সুখকর হবে না। অতএব তাদের দাবী দ্রুত নির্বাচন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও বিদেশ থেকে সে কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে অন্তবর্তি সরকার যদি নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে অন্য কোন পথে হাটে তাহলে নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করা ছাড়া উপায় নেই। এক্ষেত্রে তাদের মিত্র দরকার। কে হবে সেই মিত্র?

বিএনপি প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে দলটির উপর দিয়ে গেছে অনেক বিপর্যয়। একটি বুর্জোয়া দল হিসেবে এখানে নীতি-নৈতিকতার বিষয় সামান্যই কাজ করে ব্যক্তিগত স্বার্থ-সুবিধাই প্রধান। এমতাবস্থায় ক্ষমতার বাইরে যতদিন থাকবে ততো তাদের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ইতোমধ্যে এই দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে দখল, চাঁদাবাজি, ক্ষমতাবাজির অভিযোগ আসছে। সেটা নিশ্চয়ই তাদের ইমেজকে উজ্জল করছে না। যদি মূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কথা বলা হচ্ছে কিন্তু কিন্তু নেতাকর্মীরা তার সামান্য অনুসরণ করছেন।

জামাত-হেফাজত কি হবে বিএনপি’র জোট সঙ্গী না একক শক্তি?

জামাত ও ইসলামি দলগুলো বিএনপি’র জোট সঙ্গী হিসেবে আছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি তা বজায় থাকবে? ইতোমধ্যে ইসলামপন্থী দলগুলোর একটা বৈঠক হয়েছে। সেখানে তারা আলোচনা করেছে যে, ইসলামপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভবিষ্যতে তারেই সরকার গঠন করবেন এবং ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন। তেমনটা হলে বিএনপি’র জন্য সেটা স্বস্তিকর নয়। কেননা বিএনপি ও ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একটা ভোট ভাগের হিসেবে আছে। তেমনটা হলে সেই অবস্থা কাকে সুবিধা করে দেবে?

আগস্ট অভ্যুত্থানের পর জামাত বেশ খোশ মেজাজে আছে। তাদের তৎপরতার, কর্মকান্ড চোখে পরার মত। নেতৃত্বের বক্তব্যও শোভন ও নেতৃত্বসুলভ। তাদের কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জামাতই একমাত্র দল যাদের পরিষ্কার হিসেবে আছে প্রশাসনের কোথায় তাদের কি অবস্থা? এমন কি দল হিসেবেও সুশৃংখল। তারা বাংলাদেশে ইসলামি শাসন কায়েম করতে মরিয়া। তারা এই সময়টা উপযুক্ত মনে করছে তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। অতএব জামাত হয়তো এখন নিজেদেরকে আর কারো জোট সঙ্গী না ভেবে হয়তো একক শক্তির কথা ভাবছে।

বিএনপির জোট সঙ্গী জামাতও তাদের সবটুকু শক্তি নিয়ে সক্রীয় ওয়ে ওঠে, তারাও তাদের শক্তির জানান দেয়। অন্তবর্তি সরকার নির্বাচন দিলে তারা ক্ষমতায় যাবে এমন একটা আকাঙ্খা তাদের মধ্যে তৈরী হয়েই আছে। তবে জামাত-হেফাজত এখনই নির্বাচনের পক্ষে না, তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে চায় এই সুযোগে তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান সংহত ও দলকে গ্রহনযোগ্য করে তুলতে চায়।

ইউনুসকে ঘিরে কি তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান ঘটবে?

শোনা যাচ্ছে প্রফেসর ইউনুসের ছত্রছায়ায় ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরী হতে পারে। ইতোমধ্যে বিদেশি একটি সংবাদ মাধ্যমে ছাত্রদের নতুন দল গঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তারা অবশ্য পরে জানিয়েছেন তারা এখনই এমনটা ভাবছেন না। সেটা হলে নির্বাচনের আরেকটি শক্তি মাঠে চলে আসবে তখন নির্বাচনী লড়াই হবে ৪ থেকে ৫টি ফ্রন্টে। যদি প্রধান দলগুলো এককভাবে নির্বাচন করে তাহলে নির্বাচনের হিসেব হবে হয়তো অন্যরকম।

ইউনুসের পক্ষেও একটি ব্যাপক জনসমর্থন আছে। মানুষ পরিবারকেন্দ্রীক দ্বি-দলীয় ধারার তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট দেখতে চায় না। এখান থেকে বেড়িয়ে আসতে একজন যোগ্য, শিক্ষিত, স্বীকৃত বিশ্ব নন্দিত ব্যক্তির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। একই সাথে বিভিন্ন সামাজিক শক্তিও তার প্রতি ইতিবাচক।

জনগণই ঠিক করবে অন্তবর্তি সরকারের মেয়াদকাল

জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রফেসর ইউনুস বলেন, আমাদের ক্ষমতায় থাকা নির্ভর করছে ছাত্র-জনতার উপর। তিনি বলেছেন, ছাত্ররা আমাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, সুতরাং ছাত্র-জনতার আকাঙ্খাকে আমার গুরুত্ব দিতে হবে। এই কথার ব্যাখ্যা অনেক রকম হতে পারে। তারমনে কি তাঁর ক্ষমতায় থাকা কি অনির্দিষ্ট নয়? তিনি বলেন, গত সরকারের সময় সকল প্রতিষ্ঠান বিচার, শাসন, আইন, নির্বাচন সব ধ্বংস হয়ে গেছে সেগুলো ঠিক করতে হবে এবং তা করতে সময় লাগবে। সেটা করেই অবাধ-সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরকার বিদায় নেবে। মিডিয়ার সাথে এক আলাপে সাংবাদিক নুরুল কবির বলেছেন, অন্তবর্তি সরকার যে পর্যায়ের সংস্কারের কথা বলছেন তা করতে তো প্রায় ২০ বছর সময় লাগবে? ততোদিন কি রাজনৈতিক দলগুলো অপেক্ষা করবে? অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকবে? সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিষ্কার রোড ম্যাপ থাকা উচিত। সেটা পরিষ্কার না থাকাই ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির আরেক অধ্যায় ও গল্পের শুরু।

প্রথমত ইউনুস সাহেব কি কোন ক্ষমতালোভি ব্যক্তি? সেটা হলে সেই সুযোগ তাঁর আগেই ছিল তিনি নেননি। কিন্তু সেই অবস্থার বাস্তবতা ও মানুষের চাওয়ার উপর পরিবর্তন হতে পারে না?

তাঁকে ঘিরে যে সুশীল সমাজ, এনজিও পাড়া, ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী, পশ্চিমা শক্তি, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি, ছাত্র শক্তির নতুন আকাঙ্খা তৈরী হচ্ছে। তারা সর্বক্ষেত্রে সংস্কারমুলক কাজের মাধ্যমে দৃশ্যমান একটি গুণগত পরিবর্তন আনার অঙ্গীকারের কথা বলছেন। তার জন্য তারা ৩ থেকে ৬ বছরের একটা ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন। তার অধিক সময় নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ড. ইউনুসকে ঘিরে দেশ-বিদেশের একটি বৃহত জনগোষ্ঠী দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। জনগণ অতীতে একাধিকবার বিএনপি-আওয়ামী লীগের শাসনামল দেখেছে। তারা আর তাদের অপশাসন দেখতে চায় না। তারা চায় পরিবারকেন্দ্রীক রাজনীতির বাইরে তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান। সেই শক্তি তারা ড. ইউনুসকে ঘিরে দেখছেন। তারা চায় ক্ষমতার কামড়াকামড়ি বন্ধ হয়ে ইউনুসের নেতৃত্বে উন্নয়ন ও মর্যাদাপূর্ণ একটি দেশ গড়ে উঠুক।

কেমন হতে পারে সেই নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক সমীকরণ?   

এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেয়া যাক।

১। ভবিষ্যতে নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান দাবীদার কি বিএনপি? নির্বাচন কি বিএনপি একা করবে না জোটগত ভাবে?

২। জামাত ও ইসলামী দলগুলো কি নিজেরা আলাদা জোট করে নির্বাচন করবে?

৩। ড. ইউনুসকে ঘিরে তৃতীয় কোন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটবে কিনা?

৪। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে সেক্ষেত্রে পরিস্থিতিই বলবে অন্য দলগুলোরর সাথে/প্রশ্নে তাদের অবস্থান কি হবে?

৫। ডান-বাম-মধ্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর দল-জোট অবস্থান কি হবে সেটা খুব বিষয় না হলেও তারাও নির্বাচনে থাকবে।

৬। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই সরকার কি সেনা সমর্থিত না ছাত্র সমর্থিত সরকার? ছাত্রদের শক্তির ও সাহসের উৎস তাহলে কি?

৭। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, সমীকরণ ও বোঝাপড়াও গুরুত্বপূর্ণ।

কোথায়, কেমন সংস্কার হতে পারে?

সরকার পদ্ধতি কি হবে? সংসদীয় পদ্ধতিরই থাকবে, নাকি রাষ্ট্রপতি শাসিত হবে, নাকি উভয় ব্যবস্থার মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা হবে? এক কক্ষ বিশিষ্ট না দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হবে? ভোটের পদ্ধতি কি হবে, এফপিটিপি (Fast-past-the-post)  না সংখ্যানুপাতিক? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও সরাসরি ভোটে হবে কিনা? মোটকথা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক কাঠামোয় কি ধরণের সংস্কার-পরিবর্তন ঘটবে তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছুর হিসেব।

সংবিধান পরিবর্তনের আলাপ শুরু হয়েছে। সংবিধানের কি ধরণের পরিবর্তন হবে তার উপরও নির্ভর করছে ভোট ও জোটের হিসেব। সংবিধান বা শাসন ক্ষমতা নিয়ে গণভোটের প্রশ্ন উঠলে সেখানে তৈরী করবে ভিন্ন বাস্তবতা ও অন্য সমীকরণ।

রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কি ধরণের সংস্কার হবে, কি ধরণের বাধ্যবাধকতা থাকবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। মোটাদাগে বর্তমান ব্যবস্থাকেই কল্পনা করে ভোট ও জোটের নির্বাচনী আতাত ও বোঝাপড়া কি হবে, তা মাথায় রেখে একটি দৃশ্যকল্প চিন্তা করলেও বিষয়টা হয়তো গতানুগতিক ধারার কিছু হবে না।

অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো অনেকে ক্ষেত্রেই সংস্কার করবেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর অধিক আগ্রহ নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কেন্দ্রীক বিষয় নিয়ে। এই সংস্কার শুধু কমিশনেই হবে এমনটা মনে করি না। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কী ধরণের সংস্কার হবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে ধারণা থেকে বলা তা সাধারণ বা জোড়াতালির কোন বিষয় ঘটবে না। প্রার্থীর যোগ্যতার শর্ত, মনোনয়ন পদ্ধতি, ভোট প্রদানের ধারায় বাধ্যবাধকতা নির্বাচনের চেহারা অতীতের মত নাও থাকতে পারে।

কতদিন থাকবে ছাত্রদের এই ঐক্য ও শক্তি?

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছে কিন্তু ছাত্রদল, শিবির অন্যান্য সংগঠনগুলো যদি এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে দাড়ায় তাহলে কি হবে? এখন না হয় তারা পরিস্থিতির কারণে নিরব কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে তারা সুযোগ নেবে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এটা কোন আদর্শ বা কর্মসূচী ভিত্তিকও কোন সংগঠনও নয়। তাদের কোন একক নেতৃত্বও নেই, অভিভাবক সংগঠনও নেই। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী সুবিধাভোগী হবে অন্যরা কি দীর্ঘমেয়াদে তাকে সহজ ভাবে নেবে? একটা ইস্যুতে তারা একত্রিত হয়েছিল তাদের আবেদনের অধিক পুরণ হয়েছে এখন তারা সমন্বয়কদের নির্দেশ-আহ্বান মানবে কেন? বিভিন্ন স্থানে সিক্সটিন্থ ডিভিশনের (১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর’ মানে বিজয়ের পর যারা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল তাদের সিক্সটিন্থ ডিভিশন বলা হয়) মত ৫ আগস্টের পর কমিটি হয়েছে।

প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনগুলোর দেশ জুড়ে একটা সাংগঠনিক কাঠামো, শক্তি ও শৃংখল (?) আছে। বৈষম্য বিরোধীদের সে অবস্থা ভাসা ভাসা সেটা কতদিন টিকবে সে প্রশ্ন সঙ্গত। সমাজে যে শক্তিগুলো তাদের সাহস-ইন্ধন যুগিয়েছে তারা সেটা কতদিন করবে তা নির্ভর করছে আসন্ন রাজনীতির সমীকরণের উপর। বিএনপি নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরলে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে সেটা তাদের জন্য স্বস্তিকর নাও হতে পারে। পরিস্থিতি তেমন হলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে অন্যান্য ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোর অবস্থা ছাত্র রাজনীতির প্রশ্নে মুখোমুখি হতে পারে।

ছাত্রদের পুলিশী দায়িত্ব কি দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়াবে না?

বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের ব্যবহার করে অন্যায় ও বিতর্কিত কাজ করানো হচ্ছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মব সৃষ্টি নৈরাজ্য করানো হচ্ছে। যেমন ২৫ আগস্ট আনসার বাহিনী সচিবালয়ে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে যায়। তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে পুলিশের স্থলে ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রদের সচিবালয়ে এনে আনসাদের ধাওয়া করে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে গেলে আনসারদের সাথে ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। ছাত্রদেরকে পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটা কি ভাল? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তৈরী হলে ছাত্র-জনতার বিভেদ বাড়বে। সেটা হলে অন্তর্বর্তী সরকার বিতর্কিত হবে তাদের গ্রহনযোগ্যতা কমবে।

নির্বাচন যদি অনিশ্চিত হয় তাহলে কি ভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতা ও সমীকরণ তৈরী করবে?

[] গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরী সরকারের প্রধান কাজ নির্বাচন না। : ফরিদা আখতার

[]এটা কোনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার না যে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই তার মূল দায়িত্ব। এটি অভ্যুত্থান থেকে আসা সরকার। অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাকে বাস্তবতায় পরিণত করা এই সরকারের প্রধান কর্তব্য। : নাহিদ ইসলাম

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য থেকে পরিস্কার যে, তাদের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা আছে নির্বাচন তাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন রোড ম্যাপ না থাকা ও সরকারের মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় রাজনীতিতে নানা ডালপালা, শাখাপ্রশাখা ছড়াচ্ছে।

নির্বাচন বিলম্ব বা অনিশ্চিত প্রধান দলগুলো হিসেবে-অবস্থান কি হবে?

১। নির্বাচন বিলম্বিত হলে ক্ষমতামুখী দল বিএনপিতে সংকট সৃষ্টি করবে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশ বাড়বে ও দলটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি যতদিন ক্ষমতার বাইরে থেকেই তাদের জনপ্রিয়তা-গ্রহনযোগ্যতা কমতে থাকবে। তাদের নেতাকর্মীরা নানা অন্যায় ও অনৈতিক কর্মকান্ডে অধিকমাত্রায় যুক্ত হতে থাকবে। সুন্দর কথা ও ভাল উপদেশে চলা দল তারা এখনো হয়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচনের দাবী তাদের পক্ষ থেকে জোড়ালো হতে থাকলে তারা এই সরকারের বৈরী হবে। তখন তাদের নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করা ছাড়া কোন পথ থাকবে না।

২। আওয়ামী লীগ এখনো মাঠে নেই সহসাই মাঠে নামার মত পরিস্থিতিও তাদের নেই। সুতরাং এই মুহুর্তে তাদের মাথায় হয়তো নির্বাচন নেই। দলকে কিভাবে গোছাবে, হামলা, মামলা মোকাবেলা করবে, আত্মগোপন থেকে বেড়িয়ে আসবে ও কারামুক্তিই তাদের প্রধান বিষয়। সেক্ষেত্রে উভয় দিক থেকে নির্বাচনের ইস্যু তাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসতে পারে। নির্বাচন যদি অনিশ্চিত ও বিলম্বিত হয় সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভিতরে ভিতরে দলকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে তারা। নির্বাচনে তাদের হেভিওয়েট এমন কি পরিচিত প্রার্থীরাও নির্বাচন করতে পারবে এমনটা নয়।

৩। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাতে হয়তো এখন তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি কিন্তু তাদের নেতৃত্বের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে নির্বাচন নিয়ে তাদের কোন তাড়াহুড়া নেই। জামাত নিজেদের ক্ষমতাকেন্দ্রীক করতে ইসলামপন্থী অন্যান্য দলগুলোকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ছকে হাঁটছে। সে জন্য তারা সময় নিয়ে নিতে চাইছে, নিজেদের শক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরী করতে। তারা আওয়ামী লীগের শূণ্যতা ও বিএনপি’র সংকটকে কাজে লাগাতে পারে।

৪। নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ডান-বাম দলের অবস্থান ও কৌশলও অনেকটা নির্ভর করছে বড় দলগুলো রাজনৈতিক অবস্থানের উপর। তারা বড় দলগুলো জোট-ঐক্যের শরীক থাকবে না নিজস্ব অবস্থানে থাকবে। তবে এই বাস্তবতায় খুচরা দলগুলোর গুরুত্ব থাকবে থাকবে এমনটা মনে হয়?

নির্বাচন যদি বিলম্বিত ও অনিশ্চিত হয় সেক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের সমীকরণ ভিন্ন হতে পারে। বিএনপি যদি নির্বাচন নিয়ে অন্তবর্তি সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামে সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গী হবে কে, কোন দল? জামাত কি তাদের সঙ্গী হবে? কিন্তু জামাতের আপাত কৌশল ও বক্তব্য সে কথা বলছে না। সেক্ষেত্রে কি আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গী হতে পারে? আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনের দাবী করে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে? সেটা করলে কি তাদের কোন স্বার্থ-সমীকরণ থাকবে না? সেটা কি হতে পারে? জেলে থাকা তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি, মামলা-মোকর্দামা প্রত্যাহার, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার আবদার/দাবী ইত্যাদি এমন কোন কিছু? তেমন পরিস্থিতি হলে বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে ও নির্বাচনের দাবী আদায়ে আওয়ামী লীগকে লাগতেও পারে, সেটা সময়ই বলবে।

জামাত ও ইসলামী দলগুলো কি আলাদা কোন জোট হয়, ইউনুসের নেতৃত্বে তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান ঘটে সেক্ষেত্রে এমনও সমীকরণ হতে পারে যে, আওয়ামী লীগ, বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রেখে ড. ইউনুসের ক্ষমতায় থাকাকে সমর্থন করবে বা নিজেরা ক্ষমতায় আসতে চাইবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসুক সেটা তারা চাইবে না নিশ্চয়ই। তারচেয়ে বরং তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় গেলে তাদের কোন আপত্তি থাকবে না। বিষয়টি কি এমন? এমন কি সেটা যদি জামাত ও ইসলামিপন্থী দলগুলোর জোটও হয়? এটা কি মাইনাস টু ফর্মুলার নতুন সংস্করণ ও কৌশল? এমনটা হলে প্রতিদ্বন্দ্বি দল দুটি কাছাকাছি আসতে পারে?

ড. ইউনুসের ছত্রছায়ায় যদি নতুন একটি দল গড়ে ওঠে, তারা যদি প্রধান দলগুলোর চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত ক্ষমতাকেন্দ্রীক দলগুলোর সমীকরণ কি হবে, সেটাও ভাবার বিষয়। অথবা, বিএনপি যদি নির্বাচনের প্রশ্নে নি:সঙ্গ হয় সেক্ষেত্রে কি তারা জামাত, আওয়ামী লীগ ও অন্তর্বর্তী সরকার দুই-তিন ফ্রন্টে একাই সংগ্রাম করবে?

ছাত্র-জনতার অবস্থা, সমর্থন কি এখনকার মত থাকবে? সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন? তারা কি রাজনৈতিক দলগুলোর বিপক্ষে অবস্থান নেবে? এই সরকার কি সেক্ষেত্রে সেনা সমর্থিত সরকার হবে? অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যত অবস্থান ও কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করছে নানা মাত্রিক রাজনৈতিক জটিলতা ও সমীকরণ।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বয়ষ্ক বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। সে সময় দেশের আইন-শৃংখলার পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতে দূর্বল সাত্তারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী তথা এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন! অন্তর্বর্তী সরকার যদি ব্যর্থ ও অকার্যকর হয় তেমন কিছুর আশঙ্কাও অমুলক নয়। স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর এই সরকার এখনো এমন কোন চমক দেখাতে পারেননি যে মানুষ তাদের প্রচন্ড আস্থায় নিতে পারেন। তবে এখনই এই বিষয়ে চুড়ান্ত কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে যেভাবে হামলা-মামলা-দখল, মব ভায়োলেন্স, দলীয় নিয়োগ, চিহ্নিত অপরাধীদের খালাস, শিল্পকারখানা বন্ধ হচ্ছে তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নে জন্ম দিচ্ছে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, চর্চা কোথায়, কিভাবে হচ্ছে? সরকারি অনেক সিদ্ধান্ত কোন স্থান থেকে আসছে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে কে বা কারা আছেন? সেনাবাহিনী, ছাত্ররা, বিএনপি-জামাত না আমলা-প্রশাসন? এ সব কিছুর কি কোন সমন্বয় হচ্ছে? নাকি যার যেখানে অবস্থান সেই ক্ষমতার কেন্দ্রকে নিজের দিকে টানছে? সেটা হলে পরিস্থিতি জটিল বৈ সহজ নয়। নাকি অদৃশ কোন হাত ক্ষমতার পিছনে কলকাঠি নাড়ছে কোন পরিস্থিতি সৃষ্টির? সময়ই সে কথা বলবে।

অন্তর্বর্তী সরকার কি ঠিক পথে আছে, তাদের এজেন্ডায় চলছে?  

গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে তাদের ৩/৪ জন ছাড়া কেউই এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন না। এমন কি ২/৩ বাদে তাঁদের কোন রাজনৈতিক ও গণসংগ্রামের অভিজ্ঞতাও নেই। তাঁরা মূলত ছাত্রদের আহ্বান/অনুরোধে সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই অবস্থাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যে নব জাগরণ ও দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বল হচ্ছে, আলাপ-আলোচনা, বক্তৃতা, সেমিনারে তা থাকলেও বাস্তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রশাসনিক নিরপক্ষে ভূমিকার ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের দৃঢ় নৈতিক অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। একই কথা বলার কারণ ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াতকে স্বরাষ্ট্র থেকে বস্ত্রতে পাঠানো হলো কিন্তু আসিফ নজরুলকে স্বপদে রাখা হলো, বিষয়টি বিষ্ময়ের।

পুলিশ ও প্রশাসন দূর্বল হয়ে পড়ার কারণে তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে উপদেষ্টাদের উপর। উপদেষ্টা মনে হয় রাজনৈতিক প্রভাবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। জামাত-বিএনপি যে যেভাবে পারছে প্রশাসনে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। পূর্বে এরা ক্ষমতায় ছিল, প্রশাসনিক কাঠামো তাদের যোগাযোগ ও প্রভাব আছে। ছাত্রদের সেটা বোঝার ক্ষমতা-অবস্থা নেই। প্রশাসনে থাকা উদারপন্থীদের বাদ দিয়ে রক্ষনশীলদের পদায়ন করা হচ্ছে। সেখানে হয়তো উদারতার কথা বলা বিপদজনক হয়ে পড়েছে। কোন প্রশ্ন-প্রতিবাদে আওয়ামী ট্যাগ, দালাল হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়-বিপদ তৈরী হয়েছে।

সারাদেশে হামলা-মামলা-আক্রমণ-দখল, চাদাবাজি, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস চলছেই। প্রান্তিক পর্যায়ে বাড়ছে। দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী. দাগী আসামীরা ছাড়া পাচ্ছে। বিষয়টি কি এমন যে, যে আকাঙ্খা নিয়ে এই সরকার গঠিত হয়েছিল, তা কি দিনদিন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে? মধুচন্দ্রিমার সময় পেরিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এখন জনতার মূল্যায়নের পাল্লায় উঠেছেন। ছাত্র-জনতার অর্জন যেন কোন ভাবেই বিশেষ দল ও মতাদর্শের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণ না হয়।

দেশ কি অজানাতন্ত্রের খোলায় পড়বে?

সমাজতাত্ত্বিক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান দৈনিক সমকালের এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ’ছাত্র জনতার দাবী কোটা থেকে সরকারের পদত্যাগ ছিল তার বেশি কিছু নয়। এর বেশি কিছুর ম্যান্ডেট তারা জনগণ থেকে নেয়নি।’ তাহলে প্রশ্ন এর চেয়ে বেশি কিছু তারা করতে চাইছে কোন অধিকারে, কিসের ভিত্তিতে? ৭০এর নির্বাচনের ইস্তেহারের সাথে ৭২ এর সংবিধানের রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতি নিয়ে অনেকে বিতর্ক করেন। সেটার যদি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তা যদি বিতর্কের বিষয় তাহলে এই ক্ষেত্রে কেন নয়? ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়েছিল এক দফা তথা হাসিনার পতনের লক্ষ্যে। এই ছাত্র-জনতার কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল না। এই আন্দোলনে সাধারণ জনতার সাথে সরকার বিরোধীদের একটি বড় অংশ ছিল, তাদেরও একটি আকাঙ্খা ছিল। যে কারণে অন্তবর্তি সরকারকে বড় কোন পরিবর্তন ও সংস্কারে অভ্যুত্থানকারীদের সম্মতি দরকার আছে।

সে যাইহোক, অন্তবর্তি সরকার প্রধান ছাত্র-জনতা যতদিন চাইবে তিনি ততোদিন ক্ষমতায় থাকবেন কিন্তু সেটা বোঝার মানদন্ড কি? এমন দাবী তো শেখ হাসিনাও করেছিলেন জনগণ যেদনি না চাইবে সেদিন তিনি ক্ষমতা থেকে চলে যাবেন। বিষয়টি কি এতটা সরল ছিল? একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই তাকে উৎখাত করা হয়েছে। কথার মারপ্যাচে এমন ধুম্রজাল সৃষ্টি না করে সংস্কার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ হাজির করা  জরুরী। সেটাই হবে সম্ভাব্য আসন্ন রাজনৈতিক জটিলতা এড়ানোর পথ। একজন নন্দিত ব্যক্তি নিন্দিত হবেন সেটা কারো কাম্য নয়।

————————————————————————-

ড: মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।