লিখেছেন: অনিন্দ্য বর্ষণ

বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার আবেদন বহু পুরনো। অনেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক বইও লিখেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানকে নি:স্বার্থভাবে সাধারণ মানুষের কাছে কেউ তুলে ধরেছেন এবং বিজ্ঞানের আলোয় কুসংস্করাচ্ছন্ন সমাজের অন্ধকারকে দূর করার প্রয়াস নিয়েছেন – এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তবে বিজ্ঞান অনুষদের অনেক শিক্ষক পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন, তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু এটাও সত্যি যে, পাঠ্যপুস্তকের গুরুগম্ভীর মৌলিক আলোচনায় সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিশ্বাস-গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে অবস্থান অনুপস্থিত। শ্রেণিকক্ষের বিজ্ঞানের মৌলিক বইগুলি বিজ্ঞানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েই অবসর নিয়েছে মাত্র; অর্থাৎ বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকগুলি কখনোই চ্যালেঞ্জ করে নি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রথা ও বিশ্বাসকে, ফলে এর কু প্রভাবে আজও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে আছে আজকের বাংলাদেশ।

একটি উদাহরণ দেয়া যাক:

শাহবাগ নিকটস্থ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের মূল ভবনের প্রবেশ পথে কালো রঙের একটি বড় ফলক চোখে পড়বে, যেখানে কোরানের আয়াত বড় বড় করে লিখা আছে! পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের মতো এমন স্মার্ট গবেষণাকেন্দ্রে ঈশ্বরের বাণীর কী ভূমিকা থাকতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়। ঐ ফলকটিতে বরং শোভা পেতে পারতো বিখ্যাত কোনো গাণিতিক সমীকরণ, বিখ্যাত কোনো সায়েন্টিফিক ‘ল’ কিংবা এদেশের বড় কোনো বিজ্ঞানীর ছবি; যা দেখে তরুণ বিজ্ঞানী অনুপ্রাণিত হতে পারতো।

এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার যে, আমরা বিজ্ঞানের যেসব শিক্ষার্থী তৈরি করছি, তারা বিজ্ঞান আত্মস্থ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ! বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়েও তারা জিন-ভুতে বিশ্বাস করে, তারা দোয়া-পানি পড়ার ওপর আস্থা রাখে, তারা কোভিড-১৯ ভাইরাস থেকে বাঁচতে দোয়া দরুদ পড়ে! আবার, ইউরোপ-আমেরিকায় ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর তারা ঈশ্বরের শোকর করে এবং পরিশেষে ঈশ্বরের ওপর ভরসা করে ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে যায়!

Warped Universe Photo: Internet

দেশের এই উদ্ভট বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে মুক্তি দিতে কাজ করেছেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। এই মহাবিশ্বের উদ্ভব কী করে হল, কী এর পরিণতি, কীভাবে জীবনের বিকাশ ঘটল, এই বিকাশের যাত্রা কতটা রোমাঞ্চকর এমন অনেক বিষয়ে পরিষ্কারভাবে ধারণা দিয়ে সমাজের প্রথা-বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন যে অল্প সংখ্যক মানুষ, তারমধ্যে অভিজিৎ রায় অন্যতম একজন। বিশেষ করে আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলিকে পাঠকের মগজের বোধগম্য করে পৌঁছু দিতে সমর্থ হয়েছেন অভিজিৎ। যে বইগুলি আমি পড়েছি, তারমধ্যে ’শূণ্য থেকে মহাশূণ্য’ বইটি আমার খুব ভালো লেগেছে। বইটি অবশ্য মীজান রহমান ও অভিজিৎ রায় যৌথভাবে লিখেছেন। বাংলা ভাষায় মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে সাধারণভাবে জানার একটি অসাধারণ প্রয়াস।

শূণ্য মানে কি কেবলই শূণ্য? নাকি শূণ্যতাও কিছু অর্থ প্রকাশ করে? শূণ্য নিয়ে বইটির শুরু, ধীরে ধীরে জটিল বিশ্লেষণ, যেন আড্ডায় বসে কেউ একজন বলে যাচ্ছেন অসাধারণ কিছু বক্তব্য! শূণ্য থেকে মহাশূণ্য কীভাবে তৈরি হতে পারে, আধুনিক বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিকাশের যে জটিল মতবাদ ব্যক্ত করেছেন, গাণিতিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তা বোধগম্যভাবে তথ্য-প্রমাণ ও জ্যামিতিক চিত্র সহকারে সাধারণ পাঠকের কাছে বাংলা ভাষায় প্রাণবন্ত উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন অভিজিৎ। মহাশূণ্য ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি-বিকাশ নিয়ে অভিজিৎ রায় একাধিক বই লিখেছেন। প্রতিটি বই অনেক বেশি তথ্য সমৃদ্ধ। ’আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ টি এক কথায় অসাধারণ, বইটি প্রাচীন মহাকাশ বিজ্ঞানের ধারাবাহিক ইতিহাসের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের ওপর ভিত্তি করে বইটির বক্তব্য এগিয়েছে এবং পরিশেষে তিনি বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণ সহ এটাও দেখিয়েছেন যে, প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলি মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি নিয়ে যেসব বক্তব্য প্রদান করেছে তা একেবারেই অসার ও তাৎপর্যহীন। বইটি লিখতে গিয়ে অভিজিৎকে যথেষ্ঠ পরিশ্রম করতে হয়েছে বলে অনুভূত হবে।

আমরা জন্মাই মহাশূণ্যের ধুলিকণায় পরিণত হওয়ার জন্যে। যে মুহুর্তে আমাদের রক্ত সঞ্চালন থেমে যায়, সেই মুহুর্ত থেকে আমাদের বাস্তবিক জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোন ধরণের আবেগ অনুভূতি কাজ করে না। রক্ত সঞ্চালনহীন মৃত ব্যাক্তির জীবিত হয়ে ওঠার কোনো ধরণের সম্ভাবনা নেই; তবে মৃত ব্যক্তি আজীবন জীবিত থাকতে পারেন কেবল তাঁর মানসম্মত যৌক্তিক লিখালিখির মাধ্যমে। অভিজিত তাই মরে গিয়েও বেঁচে আছেন তাঁর বইয়ের পাতায়-পাতায় কালো-কালো অসংখ্য অক্ষরের মাঝে।