“ইতালিয় ভাগ্যান্বেষী নাবিক কলম্বাস স্পেনীয় রাজমহিষীর আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে ইন্ডিয়া আবিষ্কারের জন্য বেরুল। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই অক্টোবর তিনি পা রাখলেন কোন এক বেলা ভূমিতে। তিনি ভাবলেন তিনি ইন্ডিয়া আবিষ্কার করে ফেললেন তাই তিনি ঐ ভূভাগের বাসিন্দাদের নামকরণ করলেন ইন্ডিয়োস। তার এই ভুল ধরা পড়ল কয়েক বছর পর আমেরিগো ভেসপুসির কাছে। আমেরিগো পেশাতে ছিলেন কসাই। কলম্বাসের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং লুটপাট চালাতে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে হাজির হন আমাজান নদীর মোহনায়। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে তারই নামানুসারে ইউরোপীয়রা নব্য আবিষ্কৃত গোলার্ধটির নামকরণ করে আমেরিকা।

শেষ তুরুপের তাসটি সম্ভবত রক্ষিত ছিল পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামার থলিতে। দক্ষিণ আফ্রিকার টেবিল মাইন্টেনের কোল ঘেঁষে কেপ অব গুড হোপ পেরিয়ে কষ্টেসৃষ্টে ভাস্কো ডা গামা হাজির হলেন মাদাগাস্কারে। সেখানে দৈবচক্রে তার পরিচয় ঘটে গেল জনৈক ভারতীয় বণিক মজিদের সঙ্গে। এই মজিদই নিতান্ত ব্যবসায়িক স্বার্থে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে ভারতের পশ্চিম উপকূলভাগের কালিকট বন্দরে। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ছয় বছর পরে। উপনিবেশবাদীদের হাতে লিখিত হয়ে ভারতীয় মজিদ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেও ভাস্কো ডা গামা হারাননি, খোদ ভারতবাসীদের আজও তাকে পড়তে হয় ভারত আবিষ্কারক হিসেবে। এই পর্তুগিজ বণিকদের কুঠি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে গোড়াপত্তন হলো ইউরোপীয় দখলদারিত্বের।

ভাস্কো ডা গামার ইন্ডিয়া আবিষ্কারের পরবর্তী সাড়ে চারশো বছরের প্রথম আড়াইশ’টি বছর ধরে ভারতে চলতে থাকে বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতির বাণিজ্য ও প্রাধান্য স্থাপনের প্রতিযোগিতা, ঠিক যেমনটি তারা চালিয়েছে পশ্চিম গোলার্ধের আমেরিকা মহাদেশে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ বহিরাগত তুর্কি-আফগান শাসকরা পরাভূত হলো অপর এক বহিরাগত ইংরেজ ও স্থানীয় বণিকগোষ্ঠীর হাতে এবং সেই সঙ্গে বাংলা বিহার উড়িষ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে পরিসমাপ্তি হলো সাবেকী সামন্ত যুগের। ভারতবর্ষের এতদাঞ্চল পা রাখল পুঁজিবাদের বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ। “

রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে এসব মানুষ কী আচরণ করেছিল তা একটু দেখে নেওয়া যাক। নতুন দেশ খোঁজার মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন সম্পদের খোঁজ ও লুট করা। যেমন ব্রিটেনের লর্ড উপাধির লোকজন মূলত দস্যু ও লুটেরা ছিল। ব্রিটিশ রাণী যখন দেখল এরা সমাজের বেশ সম্পদশালীতে পরিণত হচ্ছে এবং এদের কারণে দেশ লুটেরা পয়সায় ধনী হচ্ছে তখন এদেরকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা শুরু করল। মনে রাখা দরকার; বাঙলা দখলের ফলে লর্ড ক্লাইভ এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটেন এর সেরা দশ ধনীর তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছেন।

“ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আমেরিকার ভূখণ্ডে নামলেন; রেড ইন্ডিয়ানরা কলম্বাস ও তার দলকে তাদের প্রথাগত রেওয়াজ অনুসারে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন, আদর আপ্যায়নও করেছিল যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে। তাই তো কলম্বাস স্পেনের রাজা ও রানীকে লিখলেন, ” এখানকার মানুষজন এতোই সুবোধ ও শান্তিপ্রিয় যে, মহামান্য রাজপদে আমি শপথ করে বলতে পারি সারা দুনিয়াতে এদের চেয়ে ভালো কোনো জাতি আর নেই।

যারা কলম্বাসকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই তাদেরই দশজনকে কলম্বাস অপহরণ করে নিয়ে যান স্পেনে। উদ্দেশ্য, উহার হিসেবে অর্পণ করবেন মহামান্য রাজা-রাণীর পদযুগলে। স্পেনে পৌঁছানোর পরপরই মারা গেলো তাদের একজন। অবশ্য এর আগেই তাদের সবাইকে দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল পবিত্র খ্রিস্টান ধর্মে।”
.
.
“মে ফ্লাওয়ার নামক জাহাজে চড়ে ম্যাসচুসেটস-এর প্লাইমাইথে ইংরেজরা পা রেখেছিল ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে। ক্ষুধা ও অনাহারে তারা সেদিন নির্ঘাত মারা যেতো। কিন্তু তাদের অসহায় অবস্থা দেখে খাদ্য ও পানীয় নিয়ে একান্ত বন্ধুর মতোই সেদিন এগিয়ে গিয়েছিলো স্থানীয় অধিবাসীরা। তাদের অক্লান্ত নিঃস্বার্থ সেবায় সেদিন ইংরেজরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল।

প্লাইমাইথে বসতি গাড়া ইংরেজদের এই আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা তাদের মনে করতো সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব শিশু। কোথায় কেমন করে মাছ ধরতে হয়, চাষাবাদ ও বপন পদ্ধতি সব কিছুই তারা শিখিয়েছিল এই ইংরেজদের। কিন্তু শেখ পর্যন্ত ইংরেজদের সাথে সংঘাত ও ইংরেজদের হাতে করুণ পরাজয় ঘরে প্লাইমাইথের আদিবাসীদের।”

আমারে কবর দিও হাঁটুভাঙার বাঁকে- ডি ব্রাউন (অনুবাদ- দাউদ হোসেন) বই থেকে