Drawing from an 1879 edition of L’Astronomie, depicting Christopher Columbus predicting the lunar eclipse to the native Jamaicans.

আমেরিকায় ঘটা করে কলম্বাস দিবস পালন করা হয়, ১৯৭১  থেকে প্রতি বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের সোমবার এ দিবস পালনের ধারা চালু করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম “কলম্বাস ডে” পালন করা হয়েছিল নিউ ইয়র্কে, ১৭৯২ সালের ১২ অক্টোবর। ১৯৩৪ সালে কলম্বাস দিবসকে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেনি কিন্তু আমেরিকায় তাকে বীর ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে সবসময় বিবেচনা করা হয়। এই কলম্বাস নতুন দেশ আবিষ্কারের সাথে সাথে অপরাধও কম করেননি। কলম্বাসের বিরুদ্ধে ক্যারিবিয়ান দ্বীপের মানুষের উপর অত্যাচার, শোষণ এমনকি প্রতারণার ইতিহাস আছে। চন্দ্রগ্রহণকে কেন্দ্র করে দ্বীপের মানুষদের সাথে তিনি কীভাবে প্রতারণা করে নিজের ও দলের জীবন বাঁচিয়েছেন সেই ইতিহাস অনেকেরই অজানা।

আনুমানিক ১৪৫১ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কোনো এক দিনে এক তাঁতি পরিবারে কলম্বাসের জন্ম হয়। কলম্বাসের শ্বশুর ছিলেন নাবিক। সম্ভবত শ্বশুর থেকেই সমুদ্র অভিযানের বিভিন্ন গল্প শুনে সমুদ্র অভিযানের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

১২ অক্টোবর, ১৪৯২ সাল। কলম্বাস তার দলবল নিয়ে প্রথম সমুদ্র অভিযান শুরু করেন। পরবর্তীতে ১০ বছরে সে আরও তিনটি অভিযান পরিচালনা করে আর চতুর্থ অভিযানেই তিনি কিউবার উত্তর-পূর্ব একটা দ্বীপে নোঙর ফেলেন। ১১ মে ১৫০২ সালে কলম্বাস জাহাজ নিয়ে চতুর্থ-বারের মতন সমুদ্র নামেন। আর পোকার আক্রমণে জাহাজ ফুটো হওয়ার কারণে ২৫ জুন ১৫০৩ সালে জামাইকার উপকূলে নোঙর ফেলেন।পরবর্তীতে জায়গাটির নাম রাখেন সালভাদর (San Salvador) যার অর্থ পবিত্র ত্রাণকর্তা। অনেকটা বাধ্য হয়ে (আটকে পড়েছিলেন) এই অঞ্চলে নোঙর করতে হয়েছিল। কারণ ইতোমধ্যে তাদের দুটো জাহাজ বিকল হয়ে পড়েছিল। শুরুতে দ্বীপের মানুষজন কলম্বাসের দলকে খাবার, পানীয় সহকারে উঞ্চ অভ্যর্থনা জানায়। কিন্তু দিনের পর দিন তো আর এভাবে কেউ আপ্যায়ন করবে না তাই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রায় ৬ মাসের মতন কলম্বাস ঐ দ্বিপের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছিল যদিও স্থানীয়দের সাথে হালকা কিছু পণ্য বিনিময়ও করেছিল। কিন্তু এসব সামান্য জিনিসে ও একঘেয়েমি জীবনে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে এই সময়ের মধ্যে কলম্বাসের দলের কর্মীরা স্থানীয়দের খুন, হামলা, লুট করা শুরু করে।

পনের শতকে জার্মান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষী রেজিওমন্টানাস একটি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন। কলম্বাসের সুযোগ হয় এই পঞ্জিকার একটি কপি নিজের কাছে রাখার। কারণ এই পঞ্জিকাটি শুধু গ্রহণের কথাই নয়; নক্ষত্রগুলোর চলাচল সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। আর  এই পঞ্জিকার মাধ্যমেই কলম্বাস জানতে পারেন যে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৫০৪ সন্ধ্যায় পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবে। বুদ্ধিমান কলম্বাস চন্দ্রগ্রহণের তিনদিন আগে স্থানীয়দের নেতা (আরাওয়াক প্রধান) সাথে এক বৈঠকের  অনুরোধ করেন এবং নেতাকে জানানো হয় যে- কলম্বাসের দলকে খাদ্য সরবরাহ না করার কারণে খ্রিস্টান খোদা খুব রেগে আছেন। এর এই রাগের লক্ষণ তিন দিন পর রাতের আকাশে স্পষ্ট হবে। ঈশ্বরের ক্রোধ চাঁদের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে যা স্থানীয়দের উপর অভিশাপ হিসেবে বর্ষিত হবে।

 

সময় অনুযায়ী তিন পর সন্ধ্যায় চন্দ্রগ্রহণ শুরু হয়। আকাশের চাঁদ রক্তবর্ণ ধারণ করে। সাধারণত শীতের শেষ দিকে পূর্ব আকাশের চাঁদ এমনিতেই বড় দেখায় তার উপর এমন লাল টুকুটুকে চাঁদ অনেকের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। কলম্বাসের ছেলে ফার্দিনান্দের বর্ণনা অনুসারে- আরাওয়াকরা চন্দ্রগ্রহণ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং দৌড়ে কলম্বাসের জাহাজের নিকট ছুটে আসে। তারা কলম্বাসের দলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে যাবে তবে তার জন্যে অবশ্যই চাঁদকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কলম্বাস তাদের উদ্দেশে বলে; তিনি এ নিয়ে ঈশ্বরের সাথে একান্তে যোগাযোগ করবেন এবং ৫০ মিনিটের জন্যে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেন। কলম্বাস নিজের রুমে গিয়ে ঘড়ি দেখছিলেন এবং চন্দ্রগ্রহণ কখন শেষ হবে তার হিসেব করছিলেন। চন্দ্রগ্রহণ যখন শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট বাকি ছিল তখন তিনি বাহিরে এসে আরাওয়াকদের বলেন-ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করেছেন এবং চাঁদ তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে। ৭ নভেম্বর ১৫০৪ সালে স্পেনে রওনা হওয়ার আগ পর্যন্ত কলম্বাসের দল স্থানীয়দের ঘাড়ের উপর বেশ আরাম আয়েশেই ছিলেন।

এই গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৮৯ সালে মার্ক টোয়াইন A Connecticut Yankee in King Arthur’s Court উপন্যাসটি লেখেন। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হাঙ্ক মরগানের চরিত্রে কলম্বাসের ছায়া দেখা যায়। উপন্যাসে দেখা যায় মরগানকে যখন আগুনে কাবাব বানাতে চলছিল তখন সে সূর্য গ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করে প্রাণে বেঁচে যান। সূর্যের উপর তার প্রভাব আছে এটি মরগান দাবী করেন। সূর্যকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তিনি শর্ত জুড়ে দেন যে, তাকে রাজ্যের মন্ত্রী করতে হবে। যদিও এই গল্পের একটাই সমস্যা ছিল; ২১ জুন, ৫২৮ সালে কোন গ্রহণ হয়নি। তারিখ লেখার সময় মার্ক টোয়াইনের পঞ্জিকা দেখা উচিত ছিল।

কলম্বাসের চন্দ্রগ্রহণ পড়তে গিয়ে ভারতবর্ষের মানুষের কথা মনে পড়ল। আরাওয়াকরা চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে জানতো না অন্যদিকে ভারতবাসী কুসংস্কার নিয়ে বেঁচে আছে!  প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন ,”আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল , নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ ।”

মূল প্রবন্ধ: How a Total Lunar Eclipse Saved Christopher Columbus