মঙ্গলগ্রহ এবং পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদে মানুষের অভিযান ও বসতি স্থাপনের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতি এমন দ্রুতগতিতে হচ্ছে যে, আগামী এক দশকের মধ্যেই হয়ত মহাকাশ বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরের এ দু’টো জায়গায় মানুষের “দ্বিতীয় বাসস্থান” স্থাপন প্রক্রিয়া সফলভাবেই সম্পন্ন করতে পারবে; সম্প্রতি মঙ্গল ও চাঁদে পাঠানো বিভিন্ন মহাকাশযানের নানা তথ্য-উপাত্ত সে স্বাক্ষ্যই দিচ্ছে।
তাই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এখনই ভাবতে শুরু করেছেন, মঙ্গল ও চাঁদের পরে কোথায়? নাসার বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই সে প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন । মংগল ও চাঁদের পরে মনুষ্য বসতি স্থাপনের সম্ভাব্য জায়গা হয়ত “টাইটান”।
যাঁরা মহাকাশ নিয়ে একটু পড়াশোনা করেন, তাঁরা জানেন, “টাইটান” হলো শনি ( স্যাটার্ন) গ্রহের একটি উপগ্রহ বা চাঁদ। পৃথিবীর যেমন একটি উপগ্রহ আছে, যার নাম “চন্দ্র”, তেমনি শনিগ্রহের আছে অসংখ্য উপগ্রহ যারা শনিগ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এ পর্যন্ত মহাকাশ বিজ্ঞানীরা শনির ৬২টি উপগ্রহ বা চাঁদের সন্ধান পেয়েছেন; যাদের ৫৩টির নামকরণ করা হয়েছে। “টাইটান” শনিগ্রহের বৃহত্তম চাঁদ। এখানে উল্লেখ্য যে, “টাইটান” আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাঁদ; “জুপিটার গ্রহের” উপগ্রহ “গ্যালিলিয়ান মুনস” হ’লো সৌরজগতের বৃহত্তম উপগ্রহ।
শনির উপগ্রহ “টাইটান” নিয়ে বলার আগে শনিগ্রহ নিয়ে কিছু বলা দরকার। পৃথিবী থেকে সূর্য যে দিকে শনির অবস্থান ঠিক তার বিপরীত দিকে। দূরত্বের দিক থেকেও সূর্য ও শনি গ্রহের দূরত্ব পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের প্রায় ৯ গুন অর্থ্যাৎ ১.৪ বিলিয়ন কিলোমিটার। তাই সহজেই অনুমান করা যায় সূর্যের আলো ও উত্তাপ শনিগ্রহে পৌঁছে অনেক কম। আর শনিগ্রহ সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ২৯ বছরের মতো।
কিন্তু একটি সম্ভাবনাময় দিক হলো, শনিগ্রহ এবং তার উপগ্রহে পৃথিবী ও মংগলের মতো একটি সক্রিয় বায়ুমন্ডল আছে। এই সক্রিয় বায়ুমন্ডলই বিজ্ঞানীদের আশাভরসা জাগিয়েছে। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও মিথেন গ্যাসে ভরা এই দূরের গ্রহ ও তার উপগ্রহ নিয়েও তাই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এতো উৎসাহ -উদ্দীপনা।
শনির উপগ্রহ “ টাইটান” আবিষ্কার করেন ডাস মহাকাশবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হিউজেন্স মার্চ ২৫, ১৬৬৫ সালে। গ্যালিলিও ১৬১০ সালে জুপিটারের সর্ববৃহৎ উপগ্রহ আবিষ্কার করেন এবং তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই ক্রিস্টিয়ান ও তার ভাই কন্সটান্টিন হিউজেন্স টেলিস্কোপের উন্নতি ও মহাকাশ নিয়ে নানা গবেষণা আরম্ভ করেন। মহাকাশ বিজ্ঞানে এই দুই ভাইয়ের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য।
১৬৬৫ সালের পর থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা “টাইটান” নিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা “টাইটান”-এ মানুষের বসতি স্থাপনের পক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
“টাইটান”-এর বায়ুমন্ডল মংগল এবং পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের বায়ুমন্ডল থেকেও অনেক পুরু। ফলে সূর্যের আলো এবং বায়ুচাপের যে প্রতিকূলতা মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মংগল ও চাঁদে সহ্য করেন, “টাইটান”-এ সেটা অনেকটা সহনীয় মাত্রায় থাকবে এখানে।
“টাইটান”-এর আয়তন আমাদের পৃথিবীর চাঁদের আয়তনের প্রায় দেড়গুন। একমাত্র পৃথিবীর বাইরে “টাইটান”-এ আছে তরল সমুদ্র এবং লেক। যদিও এ লেকের তরল পদার্থ জল নয়, শুধুই মিথেন গ্যাস। তবুও এই মিথেন গ্যাসের লেক বা সমুদ্রে মানুষ মিথেন প্রতিরোধক পোশাক নিয়ে সাঁতার কাটতেও পারবে; এ টুকু সম্ভাবনাও কিন্তু মংগল ও চাঁদের পৃষ্ঠে নেই।
এখানে মধ্যাকর্ষণ টান পৃথিবীর মাত্র ১৪ শতাংশ কিন্তু এর পুরু বায়ুমন্ডলের জন্য মংগল ও চন্দ্র পৃষ্ঠের তুলনায় এখানে মহাকাশের পোষাক প’রে চলাফেরা করা অনেক সহজ হবে ব’লেই ধারণা।
সূর্য থেকে অধিক দূরত্বের জন্য এখানকার গড় তাপমাত্রা মাইনাস ১৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো। “টাইটান” একটি নির্দিষ্ট অক্ষকে কেন্দ্র করে শনি গ্রহকে আবর্তন করে এবং একবার আবর্তন করতে সময় লাগে ১৫দিন ২২ ঘন্টা কিন্ত এর অবস্থানের জন্য টাইটানের “দিন” সব সময় এই কক্ষ আবর্তনের ঠিক সমান থাকে।
পৃথিবী থেকে “টাইটান”- এ যেতে সময় লাগবে প্রায় ৭ বছরেরও অধিক সময়। এই দীর্ঘ সময়ের জন্য শনি ও তার উপগ্রহ “টাইটান” নিয়ে গবেষণা করাও বেশ সময় সাপেক্ষ।
তবুও বিজ্ঞানীদের ধারণা, মংগল ও চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের বসতি নিশ্চিত করতে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এখন থেকে যে সময়টুকু লাগবে , “টাইটান” অভিযানে এখন যেসব প্রতিকূলতা আছে সেগুলো ততোদিনে সমাধান হয়ে যাবে।
মানুষের কল্পনা ও স্বপ্নের কোনো সীমারেখা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি মানুষের সেই অসীম স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলে।
১৬৬৫ সালে ক্রিস্টিয়ান হিউজেন্স যখন “টাইটান” আবিস্কার করেন, সেদিন তিনি কি ভেবেছিলেন ১.৪ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরের তাঁর আবিস্কৃত উপগ্রহে বসতি স্থাপনের কথা ভাববে তাঁরই উত্তর প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা একদিন?
। মার্চ ২৩, ২০১৯।
আশা করি আমরা টাইটানে মানুষের বসতি স্থাপন দেখে যেতে পারব।।
খুবই সাধারণ ও সহজ ক’রে এবং বেসিক কিছু তথ্য দিয়ে সাজানো এ লেখাটি। মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা অধিকতর লেখাপড়া করেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ রইল মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে আরও লেখালেখি করার। প্রায় সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে মহাবিশ্বের অসীমের মাঝেই তাদের তথাকথিত স্রষ্টার বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নানা কল্পকাহিনী লেখা আছে। মহাবিশ্বের অজানা রহস্য তাই যতো উন্মোচিত হবে, মানুষের মন ও মনন থেকে ধর্মীয় প্রভাব ও অলৌকিকতা ততো দূর হবে। ধন্যবাদ।