ধর্মগুলোর ইতিহাসের সাথে মুক্তমনা,সত্যান্বেষী, যুক্তিবাদী মানুষের রক্তের ইতিহাস মিশে আছে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ধর্মগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে ধর্মান্ধদের হাতে মুক্তচিন্তার মানুষের খুন-নির্যাতন।
প্রাচীন গ্রীসে মহা দার্শনিক সক্রেটিসকে বিষপান করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল, প্রচলিত ধর্ম, রীতিনীতি, দেবদেবীর সমালোচনা করার অভিযোগে, যুব সমাজের মধ্যে সত্য প্রচার করে জনপ্রিয়তা অর্জন করার অপরাধে। প্রাচীন কালে ভারত বর্ষে অনেক চার্বাকী দর্শনের মনীষী ও তাঁদের শিষ্যরাও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন। ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মবায়ুগ্রস্ত খ্রীস্টানের দল আলেকজান্দ্রিয়ার দর্শনের অধ্যাক্ষা হাইপোথেশিয়াকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পরে নির্মমভাবে হত্যা করে। নবী মহাম্মদের বিরুদ্ধে বিদ্রূপাত্মক কবিতা লেখার অভিযোগে ১২০ বছর বয়সী ইহুদি কবি আবু আফাক, কবি আসমা-বিনতে মারওয়ান নামক এক পাঁচ সন্তানের জননীকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। মহাম্মদের নির্দেশে যখন আসমাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে সময়ে এই হতভাগ্য মা তাঁর এক সন্তানকে বুকের দুধ পান করাচ্ছিলেন।

মনসুর হাল্লাজ নামক মরমী সাধককে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁকে শুধু হত্যা করেই ইসলামিস্টরা ক্ষ্যান্ত হয় নি, তাঁর মৃতদেহকে অগ্নিতে ভস্মীভূত করা হয়। ইসলামিস্টদের হাতে আরো খুন হন মরমী মতবাদের সাধক শিহাবউদ্দিন সুহরাওয়ার্দী, আল-যাদ ইবনে যিরহাম, জিলান দিমিস্কি,অন্ধ কবি বশশার ইবনে বুরজ সহ অসংখ্য ভিন্ন চিন্তার মানুষ।

খ্রিস্টান ধর্মান্ধরা জিওর্ডানো ব্রুনোকে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। ইতালীয় পণ্ডিত লুসিলিও ভ্যানিনিকে প্রথমে জিহবা ছিঁড়ে ফেলে দিয়, পরে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করে। খ্রিস্টান ধর্মান্ধদের হাতে নিহত হন ফ্রান্সিস কেট, ধর্মদ্রোহী লিগেট, মাইকেল সার্ভিটাস সহ আরো অসংখ্য মুক্তচিন্তক। খুন হওয়ার পাশাপাশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হওয়া অসংখ্য মানুষের কথা এখানে আলোকপাত নাই বা করলাম।

ধর্মান্ধ খুনীদের হাতে যুগেযুগে খুন হওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে এদেশের এক ডজনের বেশী মুক্তচিন্তক লেখক, ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও প্রকাশকের নাম; যুক্ত হয়েছে আমাদের প্রিয় অভিজিৎ রায়ের নাম।

অভিজিৎ রায় এক আলোকবর্তিকা, আলো হাতে এক আঁধারের যাত্রী। তিনি আমাদের মাঝে জ্বেলেছিলেন মুক্তচিন্তার আলোর মশাল। তাঁর জ্বেলে যাওয়া সেই আলোতেই আজ আমরা অসংখ্য তরুণ-যুবা উদ্ভাসিত। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর লেখনীতে তিনি আমাদের চেতনায় চিরভাস্বর।

অভিজিৎ দা কলম তুলে নিয়েছিলেন মুক্তচিন্তার পক্ষে, বিজ্ঞান ও যুক্তির পক্ষে, ধর্মহীন মানবিক সমাজের পক্ষে। তিনি বলতেন,

“মুক্তি আসুক যুক্তির পথ ধরে; আর জীবন হোক দীপান্বিত।”

ব্যক্তি জীবনে নিধার্মিক হলেও, সকল ধর্মীয় গণ্ডীর বাইরে মানুষের প্রতি তাঁর ছিল সমান শ্রদ্ধাবোধ, ছিল অপরিসীম ভালোবাসা। যে ধর্মের চাপাতি সন্ত্রাসীদের হাতে তিনি নির্মমভাবে খুন হয়েছেন, সেই ধর্মের মানুষ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,

“ইসলাম হচ্ছে আর ক’টি সাধারণ বিশ্বাসের মত একটি বিশ্বাসমাত্র যা কখনই সমালোচনার ঊর্দ্ধে নয়। কিন্তু ‘মুসলিম’ তো কোন বিশ্বাস নয়, মুসলিমরা হল রক্ত-মাংসের মানুষ- যাদের রয়েছে আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসা আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকবার অধিকার।”

অভিজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। তাঁর পিতা ড. অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি অংশ নিয়েছিলেন উনসত্তুরের অসহযোগ আন্দোলনে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছিলো তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। মায়ের নাম শেফালি রায়। পিতার কর্মসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় কেটেছে শৈশব, কৈশোর। বাবার হাতেই তাঁর মুক্তচিন্তার হাতেখড়ি। অভিজিৎ রায়ের ভাষায়ঃ

“বাবা আমাকে ‘রাজপুত্রে’র মত বড় করতে পারেননি বটে, কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের শেলফে হাজারো বইয়ের পাশাপাশি ছিলো মুক্তধারার কিশোর –বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের‘মহাকাশে মহাত্রাশ’ কিংবা স্বপন কুমার গায়েনের ‘স্বাতীর কীর্তি’ কিংবা ‘বার্ণাডের তারা’ এগুলো তার কল্যানেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র। হযবরল-এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রীর কথা জেনেছি তার কাছ থেকেই। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবিঠাকুরের প্রশ্ন কবিতা।”

অভিজিৎ রায় পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরে অবস্থিত উদয়ন স্কুলে। উদয়ন স্কুল থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি পাশ করেন তিনি। এরপরে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাশ করার পরে ভর্তি হন বুয়েটে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এ ডিগ্রী নিয়ে, এরপরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমেরিকার আটলান্টা শহরে।
২০০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন প্রথম বাংলা কমিউনিটি ব্লগসাইট মুক্তমনা ব্লগ। এই ব্লগের মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মুক্তচিন্তার লেখক ও পাঠকদের একত্রিত করতে সক্ষম হলেন। ক্রমান্বয়ে মুক্তমনা হয়ে উঠল মুক্তচিন্তকদের মিলন মেলা। তিলেতিলে গড়া মুক্তমনার আর্কাইভ আজও বাংলা ব্লগে অদ্বিতীয়। মুক্তমনা ব্লগ আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মের বর্বর, অজানা অধ্যায়গুলো, ধর্মের অসরতা ও অবৈজ্ঞানিক দিকগুলো। আজকে নাস্তিকতা, মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞান চেতনার যতটা বিকাশ ঘটেছে এর পিছনে মুক্তমনা ব্লগের অবদান অনেক অনেক বেশী। আজ, আমরা যারা ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলছি, মানবিক সমাজের কথা বলছি, মানবতার কথা বলছি, নারী অধিকারের কথা বলছি, সমকামীদের অধিকারের কথা বলছি- তার পিছনে অভিজিৎ রায়ের প্রতিষ্ঠিত মুক্তমনা ব্লগের অসামান্য অবদান ছিল, আছে এবং থাকবে।

অভিজিৎ রায়ের লেখা ব্লগগুলো যেভাবে আমাদের আলোকিত করছে, তেমনি তাঁর লেখা প্রতিটি বই-ই মাস্টারপিস। প্রতিটি বই-ই আমাদের চিন্তার নতুন দ্বার উম্মেচিত করেছে। বিশেষ করে ‘ অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, সহলেখক: রায়হান আবীর),‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ (২০১৪)- বই দু’টির কথা না বললেই নয়। এই বই দু’টি ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভীতকে কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ধর্মান্ধরা তাঁর লেখনীর শক্তির কাছে, যুক্তির শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে তাঁকে হত্যার পথ বেছে নিল।

২০১৫ সালের আজকের এইদিনে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ইসলামি চাপাতি সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হন। ঘৃণ্য সন্ত্রাসী বাহিনী রেহাই দেয় নি তাঁর সাথে থাকা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও। দুজনকেই নির্মমভাবে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায় ইসলামী সন্ত্রাসীরা। আশেপাশে অনেক মানুষ, এমনকি একটু দূরে পুলিশ অবস্থান করলেও, এদের কেউ-ই তাঁদের সাহায্যের জন্য ছুটে আসেনি। অবশেষে জীবন আহমেদ নামক একজন ফটো সাংবাদিক ছুটে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে বন্যা আহমেদ ফিরতে পারলেও আমাদের প্রিয় অভিজিৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে। সেই সাথে তিনি প্রমাণ করে গেলেন তিনি যা লিখেছিলেন,ভুল কিছু লিখেন নি। ইসলাম নামের বর্বর ধর্মের কুৎসিত চেহারাটাই সকলের সামনে আরেক বার প্রকাশিত হলো সবার সামনে। অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ড এক লজ্জা, সভ্যতার লজ্জা, লেখালেখি করা কিংবা লেখালেখিকে প্রমোট করার জন্য কাউকে হত্যা করা-এ এক অসভ্যতা, এ এক মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মধ্যযুগীয় পাষণ্ডতা। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত পশুরা হয়তো জানেনা, হত্যা করে সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না, আড়াল করা যায় না, মুক্তচিন্তাকে থামিয়ে রাখা যায় না।

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু আমাদের মুক্তচিন্তার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। অভিজিৎ রা বারে বারে জন্মায় না। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তিনি আমাদের চেতনার মাঝে বেঁচে আছেন, থাকবেন।

জীবিত অভিজিৎ রায়ের লেখনি যেমনটি শানিত ছিল, ধর্মের মৃত্যু ঘন্টা বাজাতে সরব ছিল, ধর্মান্ধদের আত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দিতে সক্ষম ছিল, মৃত অভিজিৎ রায়ের লেখনি আরো বেশী শক্তিশালী। আরো অনুপ্রেরণাদায়ী। দুর্গম পথে চলা দুরন্ত পথিকদের চলার পথের শক্তি। অভিজিৎ রায় তার লেখনীর মাধ্যমে, লেখনীর চেতনা ছড়িয়ে আরো শক্তিশালী ভাবে আমাদের মাঝে অবস্থান করছেন।

অভিজিৎ রায়ের লেখনির ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে, বিস্তার ঘটুক মুক্তচিন্তার, রক্তাক্ত ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারীর এই শোকের দিনে, ‘অভিজিৎ দিবসে’ এইটুকুই প্রত্যাশা।