একটি জনগোষ্ঠী কোন একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন যৌথভাবে বসবাস করতে থাকে-তখন ঐ নির্দিষ্ট সমাজ বা রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ, সর্বোপরি শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের অপরিহার্য প্রয়োজনে উক্ত রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি প্রণয়ন করে থাকে, সাধারণভাবে সে নিয়ম নীতিই হল আইন।
আবার কখনো কখনো শাসক শ্রেণী বা ব্যক্তি তার শাসন পরিচালনার প্রয়োজনে কিছু নিয়ম নীতি তার বা তাদের প্রজাসাধারণকে মানতে বাধ্য করে-সে নিয়মনীতিই হল আইন। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে ঐ সমস্ত নিয়ম-নীতি তথা আইনেরও বিকাশ ঘটেছে-গুণগত ও পরিমাণগত ভাবে।
কালক্রমে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে মানুষ তার প্রয়োজন ও চাহিদাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য নতুন নতুন আইন সৃষ্ঠি করেছে। এক্ষেত্রে কখনো কখনো পুরানো আইন পরিত্যাজ্য হয়েছে, আবার কখনো কখনো সংস্কারের মাধ্যমে সংশোধিত ও সংযোজিত হয়েছে। যার ফলে অতীতের অনেক দুর্লঙ্ঘনীয় আইন বাতিল হয়ে নতুন আইনের জন্ম দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজে আইনের এ গুণগত পরিবর্তন উর্ধ্বমুখী-অর্থাৎ আইন ক্রমান্বয়ে গণমুখীরূপ পরিগ্রহ করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ব্যত্যয়ও আছে। যে দেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত সে দেশে গণবিমুখী আইনও প্রণীত হয়েছে।
কেন এ আইন বা নিয়ম-নীতি একটি যৌথভাবে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী তথা রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য ?
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের সর্বজন গ্রাহ্য কোন নিয়ম-নীতি যদি না থাকে, তখন অনিবার্য ভাবে সে সমাজের নীতি হয়ে দাঁড়াবে Survival of the fittest-অর্থ্যাৎ যোগ্যতমের বেঁচে থাকা। অথবা Might is right-অর্থাৎ জোর যার মুল্লুক তার।সে সমাজ বা রাষ্ট্রে তখন মানুষের বসবাসের অযোগ্য একট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করবে-যেখানে সভ্যতা ধ্বংস হবে।
William pitt যথার্থই বলেছেন–Where law ends, tyranny begins. এ প্রসঙ্গে আমরা আদিম মানব সমাজ ব্যবস্থাগুলোর কথা স্মরণ করতে পারি-যে সমাজে কোন আইন ছিল না। শক্তিমানদের ইচ্ছাই ছিল নিয়ম নীতি তথা আইন।
কিন্তু সমাজ ও সভ্যতার ক্রম বিকাশের পথ ধরে আধুনিক যুগে আজ এমন কোন রাষ্ট্রের অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে রাষ্ট্রে আইন নেই। বলা বাহুল্য, আইন ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই অচল।
তবে এক্ষেত্রে যে প্রশ্ন অপরিহার্য, তাহল-আইনের শাসন মানেই কি সুশাসন? সব ধরণের আইনের শাসন কি মানুষের কাক্সিক্ষত? অব্যশই নয়।
আইন যদি জনকল্যাণকর না হয়, যৌক্তিক না হয়, তখন আইনের শাসনও সুশাসন দিতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের আইনের শাসনের কথা স্মরণ করতে পারি।
আমাদের মানতেই হবে, সব আইন কিন্তু জনকল্যাণকর নয়। দেশে দেশে যুগে যুগে বহু আইন কাল আইন ( Black Law) বলে চিহ্নিত হয়েছে-যেগুলো মানুষকে অবদমন, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের জন্য প্রণীত হয়েছে। কোন দেশে যখন ঔপনিবেশিক শাসন চলে, তখন ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের শ্ষোণ-শাসনকে নিষ্কণ্ঠক করার জন্য যে সকল আইন-কানুন প্রণয়ন করে-সে সকল আইন-কানুনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যই থাকে শোষিত ও শাসিত পরাধীন জনগোষ্ঠীকে অবদমন করা। ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি নজির বিদ্যমান।
তাহলে কেবল আইনের শাসন মানেই সুশাসন বা কল্যাণধর্মী শাসন নয়। যুগে যুগে রাজা-বাদশাহরা এবং বিভিন্ন স্বৈরচারী শাসকেরাও বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে তাদের অপশাসন চালিয়েছে-যাকে আইনের শাসন বলতেই হবে, তবে নিশ্চিতভাবে তা সুশাসন বা জনগণের প্রত্যাশিত শাসন ব্যবস্থা ছিল না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু আইনের শাসন বললেই সে শাসন আমাদের কাক্সিক্ষত হতে পারে না। তার সাথে আমাদের অবশ্যই যোগ করতে হবে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসন। কারণ একটি রাষ্ট্রে যদি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে, তাহলে জনগণ কল্যাণকর আইন প্রণয়নে যেমন ভূমিকা রাখতে পারবে, যুগপৎ গণবিরোধী আইন বাতিল করার দাবীও উত্থাপন করতে পারবে।
আবার কল্যাণকর আইন প্রণীত হল, কিন্তু স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেল না, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।
বিশ্বের প্রায় সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে-যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান-সেখানে জনগণের কল্যাণে ও জনগণের ইচ্ছায় আইন-কানুন প্রণীত হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাই ? আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিসহ এখনো বহু দেশে বহু আইন আছে, যা মানুষের অধিকার, বিশেষ ভাবে মৌলিক অধিকার হরণ করে।
তারপরও যে সকল আধুনিক রাষ্ট্র তার জনগণের কল্যাণে গণমুখী আইন প্রণয়ন করে থাকে, আইনের শাসন কি সেসব আধুনিক দেশে আছে ? এটাই হল মূল প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পেতে আমরা আইনের শাসন বলতে কি বুঝায়-তার সঠিক বৈশিষ্ট্য কি তা একটু খতিয়ে দেখব।
আইনের শাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জাতি সংঘ যা বলেছে তা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।
The term rule of law refers to a principle of governance in which all persons, institutions and entities, public and private, including the state itself, are accountable to laws that are publicly promulgated, equally enforced and independently adjudicated, and which are consistent with international human rights norms and standards.
It requires, as well, measures to ensure adherence to the principles of supremacy of law, equality before the law, accountability to the law, fairness in the application of the law, separation of powers, participation in decision-making, legal certainty, avoidance of arbitrariness and procedural and legal transparency.
অত্যন্ত সংক্ষেপে হলেও উপরোক্ত সংজ্ঞায় বস্তুুত: আইনের শাসনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো যথার্থভাবে চিহ্ণিত হয়েছে। যেমন-
প্রথমত: আইন হল শাসনের নীতিমালা-অর্থাৎ একটি রাষ্ট্র কিভাবে শাসিত হবে-তার বিধি-বিধান হল আইন- সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সত্ত্বা, জনগণ এবং স্বয়ং রাষ্ট্রও যে নীতিমালার নিকট দায়বদ্ধ থাকবে।
দ্বিতীয়ত: এ আইন প্রকাশ্যে প্রণীত, সমভাবে কার্যকরী এবং স্বাধীনভাবে বিচারযোগ্য। ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়-আইন প্রণীত হতে হবে প্রকাশ্যে-জনগণের তথা তাদের প্রতিনিধিদের সম্মতিতে-যা সর্বক্ষেত্রে সমভাবে কার্যকর হবে। আইনের শাসনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল-আইনের মাধ্যমে যে বিচার-তা হতে হবে স্বাধীন। অর্থ্যাৎ বিচার প্রক্রিয়ার উপর কোন পক্ষের কোন প্রভাব থাকতে পারবে না।
তৃত্বীয়ত: আধুনিককালে আইনের শাসনের এসব নীতি মালা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এর মাপকাঠির সাথে সঙ্গতিপুর্ণ হতে হবে। দেশ শাসনের জন্য যেমন আইন অপরিহার্য, তেমনি সে আইন আবার মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ-যেমন বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ-সংগঠন করার স্বাধীনতা ইত্যাদি যাতে হরণ না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার এর পরিপন্থী কোন আইন সুশাসন দিতে পারে না।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করতে হলে-সবার উর্ধ্বে আইন, আইনের উর্ধ্বে কেউ নহে, আইনের কাছে সবাই সমান, আইনের কাছে সকলের দায়বদ্ধতা, আইনের প্রয়োগে স্বচ্ছতা, ক্ষমতার পৃথকীকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদারিত্ব, আইনের প্রয়োগে স্বেচ্ছাচার ও স্ববিরোধীতা পরিহার ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
Thomas Fuller এর উক্তিটি এক্ষেত্রে যর্থাথই প্রাসঙ্গিক- Be you ever so high, the law is above you.
আইনের শাসনের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি একটি খতিয়ে দেখলে, কোন একটি দেশে আইনের শাসন আছে কিনা তা সহজে চিহ্ণিত করতে পারা যায়।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর নৈর্ব্যক্তিক বিবেচনায় আমরা কি দাবী করতে পারি, আমাদের দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান?
সর্বসাম্প্রতিক ষোড়শ সংশোধী বাতিল করে প্রদত্ত রায়ের প্রতিক্রিয়ার সরকারী দলের যে আচরণ আমরা দেখতে পেলাম, ঐ রায় প্রদানকারী প্রধান বিচারপতিকে শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত অপমান করে চাকুরীচ্যূত করা কি ইঙ্গিত দেয়?
দেশে অব্যাহত খুন-গুম,ধর্ষণ,ভূমি দখল, ব্যাংকের টাকার হরিলুঠ ইত্যাকার অপরাধগুলোর কি সঠিক বিচার পাওয়া যাচ্ছে ? একাত্তুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বুকভরা বেদনা নিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি-না, আমাদের দেশে এখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সে পথে আমাদের আরো অনেক দূর যেতে্ হবে। আজকের বাংলাদেশ আমাদের একাত্তুরের স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়।
Leave A Comment