রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্ব্বের অনেকগুলো গানের বাণীতে, ঠাকুর-দেবতা-দেবীকে খুঁজে পাই না। এই যেমন , ‘আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে,/তোমার সেথায় চরণ পড়ে। শুনলেই চোখের সামনে আমার প্রেমিকার মুখচ্ছবি ভেসে উঠে। এ তো সেই, যে আমার আরাধ্য, আমার সাধনা , আমার প্রেম, যাকে আমি ভালবাসি। হতে পারে সে সামান্য এক নারী।

যাকে ভাললেগে গেল, সেই ভাললাগা যখন ভালবাসায় ঠাঁই পেয়ে যায়; তখন সংসার নামক নাট্যশালায় শুরু হয়ে যাবার কথা প্রেম পর্ব্ব। সংসারকে নাট্যশালা বলছি, এখানে এগিয়ে চলা থাকে, মিথ্যাও থাকে। নরক হতে পারে, স্বর্গও হতে পারে। এটা নির্ভর করে, প্রেম পর্ব্ব শুরু করতে পারা, না-পারার উপর।

কী আছে প্রেমে যা ভাললাগা বা ভালবাসায় নেই? আছে। একটা লড়াই আছে। সচেতন প্রয়াস আছে। একজন অন্যজনের পরিপূরক হয়ে উঠবার তৃষা আছে, একজন অন্যজনকে সম্পর্কের সমোচ্চতায় নিয়ে যাবার সাধনা আছে। এতে সংস্কার করে করে এগিয়ে নিয়ে যাবার মন্ত্রণা আছে। যা ভাললাগায় নেই। ভাললাগা কল্পনা ঘিরে হতে পারে। এটি সম্পর্কের প্রাথমিক পর্ব্ব। তর তর করে তরু-লতার মত বেড়ে উঠা বালক-বালিকারা যখন তরুণ-তরুণী হয়ে উঠে, তখন, তাদের জগত জুড়ে বাস্তব নয়, সম্পর্ক হয়ে উঠে কল্পনা নির্ভর।সেই কল্পিত চিত্রটির সাথে বাস্তব জগতে দেখা হয়ে যায় যখন, তখন ভাললাগা ভর করে। এই পর্ব থেকে শুরু হয়ে যায় অনুরাগ । আমার বিবেচনায়, অনুরাগ পর্ব্বটি , ভাললাগা, ভালবাসা, এবং প্রেম – সব পর্ব্বেই সক্রিয় থাকে। অনুরাগে, ক্রোধ আছে, অত্যন্ত প্রীতি আছে,তাই সম্পর্কের যে কোন পর্বে এর অস্তিত্ব থাকতে পারে।

ভাললাগা, ভালবাসায় আশ্রয় পেয়ে গেলে বন্ধনের নবরূপে উত্তীর্ণ হয়ে বন্ধু হয়ে যাবার কথা। কিন্তু হয় না। না হবার কারণ, সম্পর্কের শুরুতে অর্থাৎ ভালবেসে ঘর বাঁধতে গিয়ে, যে প্রেম পর্ব্ব শুরু হবার কথা, আমরা তা ভুলে যাই। সব পাওয়া হয়ে গেল, ভেবে হাল ছেড়ে দেই। তখন, দিনে দিনে ভালবাসায় জং ধরে, ধূলির স্তর পড়ে।

শব্দের ভেতরেও প্রাণ থাকে। প্রাণ থাকে বলেই, ভালবাসি – শব্দটা শুনে কাঁপুনী উঠে। শরীর কেঁপে উঠেনি এমন প্রেমিক অথবা প্রেমিকা খুঁজে পাওয়া বিরল। তখন শব্দটি কেবল একটি শব না হয়ে, অনেককিছু দান করে দেয়। সম্পর্ক-সংসারের সাথে যোগ সাধনে, শব্দ হয়ে উঠে সেতু।

জাগতিক জীবনে নানা রকম সম্পর্ক থাকে। সম্পর্ক শব্দটির অর্থটুকু মনে গেঁথে নিলে তখন এটি একটি প্রাণহীন শব্দ না হয়ে, সমান পর্ক ( পালিতকে রক্ষাকারী )রূপে উপস্থিত হয়। সম্পর্ক তখন হয়ে উঠে প্রাণবন্ত ।
কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ সংসারে (অর্থাৎ সম্যকভাবে অগ্রসর হয় বা সরে সরে যায় যে) বাস করতে গেলে আগপিছু থাকে। মতবিরোধ থাকে। মতভিন্নতা থাকে।

মতভিন্নতা মন্দ নয়। কিন্তু সেই ভিন্নতা মৌলিক প্রশ্নে দেখা দিলে, সমস্যা হতে পারে। অনভিজ্ঞতা হেতু মানুষ ভুল করে, ত্রুটি হয়। এমনকি বিচ্যূতও হতে পারে। কিন্তু বিচ্যূতি যখন সচেতনভাবে ঘটে, তখন সম্পর্ক নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। মনে রাখা দরকার , এই বিচ্যূতি থেকেই শুরু হয় অধঃপতন।
ব্যক্তিগত ক্ষতিগুলো অনেক সময় মেনে নেয়া গেলেও; সেই ক্ষতি যখন অন্যকেও সংক্রমিত করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন তা মেনে যায় না।
সম্পর্কের ভাঙ্গন তখন অনিবার্য্য হয়ে উঠে, এবং সেই ভাঙ্গনকে স্বাগত জানানোই শ্রেয়।

কিন্তু ভিন্ন মানসিকতা অর্থাৎ মানস (মনঃ দ্বারা উৎপাদিত যে ) এর তারণের আধার যে, সেটির ভিন্নতাজনিত কারণে যা উৎপাদিত হয় তার গতিমুখ অভিন্নমুখী বা ভিন্নমুখী হতে পারে। ভাল মন্দের বিচারে এখানে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’- ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে। সম্পর্কের বাঁচামরা নির্ধারণে কর্ম্মই এখানে নির্ধারক হয়ে যায়।

আমার ব্যক্তিগত পর্য্যবেক্ষণে মনে হয়েছে- মানুষ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যে, মধুরতম সম্পর্কটি হল প্রেম। তারমানে এই নয়, প্রেম পর্ব্বের পূর্ব্বের ধাপগুলো গুরুত্বহীন। প্রথম যৌবনে অনুরাগে সিক্ত হয়নি, ভাললাগায় স্নাত হয়ে , ভালবাসায় সাঁতার কাটেনি – এমন যুবক-যুবতীর দেখা হয়ত পাওয়া যাবে; কিন্তু যারা স্নাতক হয়ে গেছেন , অর্থাৎ প্রেম পর্ব্বে প্রবেশ করে ফেলেছেন, তারা স্মৃতি হাতড়ে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারবেন- পূর্ব্বের ধাপগুলো কখন , কীভাবে নিজের অগোচরে পার করে এসেছেন।
অজানার রহস্য নয়; জানার আনন্দে ভাবরসে ডুবে মরার সুখটাই অন্যরকম ।

(সহায়ক গ্রন্থ: খান-চক্রবর্তীর বর্ণভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক রচনাবলী )