লেখক: মাসুদ সজীব
গত এক দশকে বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ অনেকখানি বদলে গেছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, পণ্যের উৎকর্ষতা, যোগাযোগের সহজতা সহ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের মাঝে রাজনীতি তথা মানুষের পশ্চাৎমুখী পথ চলাই আমাদের অবাক করে। বিজ্ঞান যেখানে হাঁটছে অগ্রগতির পথে ঠিক তখন মানুষ হাঁটছে তার উল্টো পথে। দিকে দিকে অন্ধ জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, বর্বরতা সবকিছুই আগের যে কোন সময় কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও এ কথা সত্যি পৃথিবীর কখনো পুরোপুরি অসম্প্রদায়িক, যুদ্ধ-সংঘর্ষ ছাড়া পথ চলেনি। তারপরও আজকের পৃথিবীতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, এশিয়া থেকে ইউরোপ, ইউরোপ থেকে আমেরিকা কিংবা আফ্রিকা-ওশোনিয়া সর্বত্র যেভাবে ধর্মান্ধতার জয় হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান হচ্ছে, মানুষে-মানুষে বর্ণ, জাতীয়তা নিয়ে ভেদাভেদ তৈরি হচ্ছে তা রীতিমতো ভয় জাগানিয়া।
সেই ভয় জাগানিয়া স্রোতে বাংলাদেশ নামক দেশটিও যে পাল তুলে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে সে কথা আজ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। অথচ পাকিস্তানের অন্ধ ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, শোষণ, নিপীড়ণকে ছুঁড়ে ফেলতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো। সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের দিকে তাকালেই এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। ৭২ এ বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয়েছিলো তাতে চারটি মূলনীতি ছিলো ১) ধর্মনিরেপেক্ষতা; ২)জাতীয়তাবাদ; ৩) গণতন্ত্র; ৪) সমাজতন্ত্র। এ চার মূলনীতির অন্যতম ছিলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কোন নিদিষ্ট ধর্মের অধীনে থাকবে না অর্থাৎ রাষ্ট্র হবে ধর্মহীন। যা ছিলো পাকিস্তানি চেতনার সাথে একেবারে সাংঘর্ষিক। পাকিস্তান ভেঙ্গে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো সেই দেশ সেনাপ্রীতি তথা সামরিক শাসন আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কে বাতিল করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর থেকে পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের নাম ছিলো, ‘ People’s Republic of Bangladesh’ অর্থাৎ রাষ্ট্রের নামের সাথে ধর্ম নেই। অথচ পনেরোই আগষ্টের পরে সেটি হলো Islamic Republic Of Bangladesh! কারণ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি এবং রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হয়েছিলো। হত্যা করা হয়েছিলো বাংলাদেশের গনতন্ত্র, অসম্প্রদায়িকত চেতনা কে। তারপর পঁচাত্তর থেকে নব্বই এই সুদীর্ঘ সময় জলপাই রঙের স্বৈরশাসনে একে একে যোগ হলে রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’, সংবিধানের শুরুতে সংযোজন হলো ’বিসমিল্লাহ’! যে স্বপ্ন, যে আত্নত্যাগে বাংলাদেশের জন্ম হলো নানান ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় তা বিসর্জন দিয়ে আবার পাকিস্তান হওয়ার পথে পথ চলতে শুরু করলো!
এখন প্রশ্ন হলো, এই যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মের অনুপ্রবেশ, ধর্মান্ধতার জয়, রাজনীতিতে ধর্মের শক্ত অবস্থান এগুলো কি জনমানুষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে? বাংলাদেশের মানুষ কি ধর্মান্ধ ছিলো চিরকাল? তারা কি ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা পুষে রেখেছিলো এতোকাল? কিংবা অন্যভাবে বলা যায় বাঙালিরা আসলে চিন্তা-চেতনায় জায়গায় কতটুকু উদার ছিলো, জীবনযাপনে কতটুকু অসম্প্রাদায়িক ছিলো এবং এসব বিবেচনায় আজকের বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ হলেও বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষেরা প্রবলভাবে ধর্মান্ধ ছিলো না, বরং ছিলো উদার সংস্কৃতি আর সহনশীল একটা জাতিগোষ্ঠি। একটা রাষ্ট্রের চরিত্র বুঝতে প্রথমে দৃষ্টি দিতে হয় তার রাজনীতির দিকে, আরেকটুক গভীরে প্রবেশ করে জানতে চাইলে যেতে হয় তার শিল্প-সাহিত্য আর সংস্কৃতি চর্চার কাছে। যদি রাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখা যাবে, ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালে তাদের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়। মূলত একটা নিদিষ্ট ধর্ম তথা সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ছেঁটে ফেলা হয় এ নতুন নামকরণের মাধ্যমে, এই নতুন নামকরণ সত্যিকার অর্থে তাৎপর্য্যপূর্ণ। কারণ সেই পরিবর্তনের ধারাতেই ৫২র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ সকল আন্দোলনে অসম্প্রদায়িক চেতনার আবির্ভাব ঘটেছে। রাজনৈতিক স্লোগান থেকে রাজপথের রক্তে সর্বত্র মানুষ এক হয়েছে এই অভিন্ন চেতনাতে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্লোগান ছিলো,
আমরা হিন্দু
আমরা খৃষ্টান
আমরা বৌদ্ধ
আমরা মুসলমান
আমরা সবাই বাঙালি।
যদিও পাকিস্তানি-রা এ যুদ্ধকে ধর্মীয় তথা ভারতের ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়ার সবধরণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু অসম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালি-রা সে কথায় বিশ্বাস রাখেনি, আর বিশ্বাস রাখেনি বলেই যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলো এবং জয় ছিনিয়ে এনেছিলো।
রাজনীতি থেকে এবার একটু শিল্প সাহিত্যের দিকে আলোকপাত করা যাক। পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন সময়ে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় যে সাহিত্যিকরা প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাদের মাঝে শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, মুনীর চৌধুরী , জহির রায়হান , শহিদুল্লাহ কায়সার , আবু ইসহাক, শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবির, প্রমুখও লেখকদের লেখায় ধর্ম নয় বরং অসম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটেছিলো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু (১৯৪৮), শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বউ, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, শওকাত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬৩), আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), জহির রায়হানের আরেক ফ্লাগুন (১৯৬৯), জহিরুল ইসলামের অগ্নিসাক্ষী (১৯৬৯), সত্যে সেনের উত্তরণ (১৯৭০), এবং আনোয়ার পাশার নীড়সন্ধানী (১৯৬৮) প্রভৃতি রচনায় সমকালীন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম বস্তুনিষ্ঠভাবে ধরা পড়েছে। ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের বাহিরে এসে মূলত গ্রামীণ পটভূমি, মানুষের ব্যক্তিক সংঘাত, টানাপোড়েন সহ জীবনের ঘরের নানান সুক্ষ বিষয়ের উপর সাহ্যিত রচিত হয়েছে।
সে সময়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষ, দেশের মাটি ও প্রকৃতিকে নিয়ে বিশেষ এক ধরণের কবিতা রচনার চেষ্টা দেখা যায়। যেগুলিকে অসম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ধারার কবিতা হিসেবে চিন্থিত করা যায়। এগুলির মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর বিষ কন্যা (১৯৫৫), সাত ভাই চম্পা (১৯৫৫), উত্তর আকাশের তারা (১৯৫৮), মাযাহারুল ইসলামের মাটির ফসল (১৯৫৫), মতিউল ইসলামের সপ্তকন্যা (১৯৫৭), বেগম সুফিয়া কামালের মন ও জীবন (১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া শামসুর রহমান, হেলাল হাফিজুর রহমান, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদের মতো তরুণদের কবিদের লেখায়ও সেই অসম্প্রদায়িক চেতনার স্ফুরণ ঘটে, স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্খা জেগে ওঠে। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের খুব কম সংখ্যক শিল্পী, সাহিত্যিক তাদের সৃষ্টিশীলতায় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছিলো। শিল্প সাহিত্য চর্চা মূলত মানুষের যাপিত জীবন আর সংস্কৃতি থেকে উঠে আসে। বাঙালির যাপিত জীবনে, সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মান্ধতা এগুলো কখনো প্রধান নিয়ামক ছিলো না বলেই সাহিত্যিকদের লেখায় সেগুলো বহুল অংশে চর্চিত হয়নি।
একটা নিদিষ্ট মানচিত্রের জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি কতটা উদার কিংবা কতটা সংকীর্ণ তা জানার জন্য সেই জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের জীবনযাপন, ভাষার ব্যবহার, উৎসব আর পোশাক পরিচ্ছেদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা ভাষায় অনেক বিদেশী শব্দ প্রবেশ করলেও যাপিত জীবনে বাঙালিরা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্য্যপূর্ণ শব্দ কিংবা আরোপিত আরবী-উর্দু শব্দের বহুল ব্যবহারে যায়নি, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো সেই সময়ে। পোশাক পরিচ্ছদের দিকে তাকালেও দেখা যাবে আজকের দিনের মতো তখন ঘরে ঘরে বোরকা-হিজাবের প্রচলন ছিলো না, ছিলো না লম্বা আল্লাখাল্লার জয়জয়কার। তাই বলে বিষয়টি এমন নয় যে, তখনকার মানুষ ধর্মকর্ম মানতো না। ধর্ম সব সময় বাঙালির ব্যক্তিগত জীবন চর্চার বড় একটা অংশ জুড়ে ছিলো। তবে যা ছিলো না তা হলো, ধর্মীয় উন্মাদনা অর বিধিনিষেধের ফতোয়া। পূর্ব পাকিস্তানের সময়কালেই বাঙলার নারী-রা কোন প্রকার বাড়তি পর্দা ছাড়া শাড়ি-কামিজ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, চাকুরী করেছে। ৬০ কিংবা ৭০ এর দশকে ধর্মীয় পোশাক তথা বোরকা-হিজার পরে কোন ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতো, এমন নজির নেই। বাঙালির উৎসবগুলোর দিকে তাকালেই তাদের অসম্প্রদায়িক চেতনার দেখা মিলে। পাকিস্তান পর্বে এ ভূখন্ডের গ্রামে গ্রামে বসতো পালা গানের মেলা, পুঁথিগান কিংবা যাত্রা, মঞ্চ নাটক গ্রামকেন্দ্রিক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রধান বিনোদন ছিলো। এসব উৎসবে কখনো ধর্ম আসেনি, কে হিন্দু, কে মুসলমান সে কথা কেউ খোঁজ করতে যায়নি। কিংবা সেগুলো নিয়ে ধর্মীয় বিধি নিষেধের ফতোয়ায় আটকে যায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে এমন উৎসব, সংস্কৃতির চর্চা সে সময়ে অসম্ভব ছিলো। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ কিংবা লড়াইটা শুধু রাজনৈতিক ছিলো না, ছিলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক।
অন্যের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি নয়, শোষণ নয়, নিজেদের মতো করে নিজের সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচতে, ন্যায়বিচার আর সকলের জন্য সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো। এবং বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ঠিক সেই বিষয়গুলোই মূল স্তম্ভ হয়েছিলো। ধর্ম কে রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে না আনা ছিলো বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের বহি:প্রকাশ। কিন্তু যারা পাকিস্তান ভাঙ্গা কে মানতে পারেনি, যাদের মাঝে ধর্মান্ধতার অন্ধকার গাঢ় হয়ে বাসা বেঁধেছিলো তেমন বাঙালিও ছিলো, সংখ্যায় কম হলেও ছিলো। সেই কম সংখ্যক পাকিস্তানি চেতনার বাঙালিদের হাতেই ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক খুন হলে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানমুখী পথ চলা শুরু করে। সে পথ চলা ছিলো রাষ্ট্রের সর্বত্র ধর্মকে ব্যবহার। পঁচাত্তর থেকে নব্বই এই সময়টাতে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, ত্যাগ, মহত্ত্ব থেকে দূরে রাখতে নানান প্রোপাগান্ডা আর ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে ক্লান্তিহীন ভাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান কে অস্বীকার করতে ধর্মের সুগন্ধি মেখে ভারতবিদ্বেষী সকল প্রচার প্রচারণা চালানো হয়েছে । ফলে নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটলেও সাধারণ বাঙালির রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ধর্মান্ধতা, ইতিহাস বিমুখতা আর অন্ধ ভারত বিদ্বেষ। ভারতবিদ্বেষ, মানুষের মাঝে ধর্মান্ধতার বীজ বুনে দেওয়ার মতো কাজ পাকিস্তানি শাসকেরা না পারলেও, সেটিই স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসক জিয়া আর এরশাদের অক্লান্ত চেষ্টায় সফল হয়েছে। এবং সেটির প্রতিফলন ঘটেছে একানব্বইয়ের নির্বাচনে। ‘আওয়ামীলীগ জয় লাভ করলে দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে, দেশের মসজিদে আযান দেওয়া যাবেনা’ এমন কিছু প্রোপাগান্ডা সে সময়ে অনেকবেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিলো ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশে। ফলশ্রুতিতে স্বৈরাচার পতনের পর প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে, এক স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া আদর্শের দল বিএনপি জয়ী হয়। এভাবেই বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা আর ইতিহাস বিকৃতির চর্চায় স্বৈরাতন্ত্র থেকে কথিত গনতন্ত্রের সড়কে উঠে।
সেই সফলতা চরম উৎকর্ষে পৌছায় ২০১৩ সালে নাস্তিক নাম দিয়ে ব্লগার হত্যার মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় লেখক, প্রকাশক, ধর্মীয় উপস্থাক, শিয়া আর হিন্দুদের হত্যার উৎসব, যা আজও চলোমান। তাই আজকের বাংলাদেশ কেমন আছে সে উত্তর দেওয়া খুব কঠিন কিছু না। বাংলাদেশ ভালো নেই, সেই অসম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, উদার সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা, বাক-স্বাধীনতা এখন ইতিহাসের পাতায় বন্দি। দিকে দিকে শুধু ধর্মান্ধদের জয়োৎসব, সেই ধর্মান্ধদের রক্ষা করতে আবার দেশজুড়ে মডারেটর ধার্মিকে সয়লাভ। এখন এখানে শিল্পে, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে আরোপিত বিধি নিষেধ চলে, মু্ক্তচিন্তায়, বাক-স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র কর্তৃক রহিত করা হয়। ডানপন্থি কিংবা বামপন্থি সব রাজনৈতিক দলই আজ ধর্ম আশ্রয়ী শক্তির কাছে মাথা নত করেছে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদান কারী দলটাও সেই গর্তে ঢুকে পড়েছে। তবে বিষয়টি যত সহজে বলছি তত সহজে হয়নি কিংবা একদিনে হয়নি। শিক্ষাক্রমে সাম্প্রদায়িক চেতনা, মাদ্রাসাগুলো তে মূল শিক্ষার বাহিরে শিক্ষা দান, রাষ্ট্র কর্তৃক রাজনীতিতে ধর্ম নির্ভর দলগুলো কে শক্তিশালীকরণ এবং সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর বিষয়ে সরকারের অবহেলা, উদাসীনতা যেমন জঙ্গিগোষ্ঠী গুলোকে সারাদেশে শক্তিশালী করেছে তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও ধর্মান্ধতার বীজ বুঁনে দিয়ে দিয়েছে।
ইতিহাস বিমুখ, কুসংস্কারমনা, ভারত বিদ্বেষী মানুষদের মাঝে অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো যেমন সহজ তেমনি সহজ ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো। প্রোপাগান্ডার স্বর্ণযুগের ফলে ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশের চারিদিকে আবার ধর্ম জেগে ওঠেছে। ২০০২ সালে আমি যখন কলেজে পড়তাম তখনও আমার কোন সহপাঠিনী কে বোরকা কিংবা হিজাব করতে দেখিনি, আর আজকের বাংলাদেশে মফস্বলের কলেজ পড়া প্রায় সব মেয়েই ধর্মীয় পোশাকে নিজেকে ঢেকে নিয়েছে। বিষয়টা শুধু পোশাক কিংবা পর্দার করার নয়, এখানে এ পোশাকের সাথে সাথে তাদের মাঝে ধর্মান্ধতার বিষয় ছড়ানো হয়, জঙ্গিবাদের তালিম দেওয়া হয়। তাই পর্দার আড়ালে ধর্মীয় উন্মাদনা, ধর্মান্ধতার জন্ম দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর পাশাপাশি টেলিভিশন-ইউটিউব সহ নানান প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় বক্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আজ ঘরে ঘরে সাম্প্রদায়িক চেতনা, ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় সেনাশাসনের অন্ধকার এবং তারপর কথিত গনতন্ত্রে আবার সেই ইসলামীকরণ সব মিলিয়ে আজকের বাংলাদেশ ভয়াবহ জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে।
ভুল ইতিহাস পাঠ, সাম্প্রদায়িক চেতনায় ভরা পাঠ্যক্রম আর ভারত বিদ্বেষ কে এমন দক্ষতার সহিত মানুষের মগজে-মননে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ভারতকে ঘৃণা করাই এখন বাঙালি খাঁটি মুসলমানের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ভারতের উপর সঞ্জীভূত ক্ষোভ কে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর দখল, আগুন দিয়ে প্রশমিত করছে ধর্মান্ধের দল। দিকে দিকে ক্ষমতার মোহ, পুরষ্কারের মোহ, ধর্মের মোহে আজ এ দেশের সুশীল সমাজ, সাংবাদিক সমাজ, কবি সমাজ, বুদ্ধিজীবি সমাজ সবাই মাথা নত করেছে। পদক-পুরষ্কার আর সম্মান পেতে আদর্শ, নীতি, সততা সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছে। অথচ এদের পূর্ব পুরুষেরাই একাত্তরে নিজের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলো। ঘরে বাহিরে, রাষ্ট্র-সমাজে সর্বত্র অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালি মুসলমানরা আজ হয়ে ওঠেছে হিংস্র, চোখে-মুখে-অন্তরে করছে অবিরত ঘৃণার চাষাবাস।
এরপরও সংখ্যায় কমে আসলেও সময়ের স্রোতে সব বাঙালি গা ভাসায়নি, ক্ষমতা-অর্থ কিংবা প্রতিপত্তির লোভে না গিয়ে একাত্তরের চেতনা আর অসম্প্রদায়িক বোধের একটা প্রজন্ম এখানে পূর্ব থেকেই ছিলো। রাজনৈতিক আর সামাজিক পট পরিবর্তনের মাঝেও এ মানুষেরা নিজের পথে কাজ করে গেছে। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, আরজ আলী মাতুব্বর, তসলিমা নাসরিন সহ মুক্তমনা সাহসী কিছু মানুষ সে পথ সৃষ্টি করে গেছে। সেই পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই এ প্রজন্মের তরুণেরা গণজাগরণের জন্ম দিয়েছিলো, আবার অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কে জাগিয়ে তুলেছিলো।
আলোর বিপরীতে যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি প্রগতিশীলতার বিপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীলতা থাকে। ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩র সেই গণজাগরণ থেকেই বাংলাদেশের আলো-অন্ধকারের মাঝে দৃশ্যমান সবচেয়ে বড় পার্থক্যটির পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে আসে। রাজাকারের বিচারের দাবিতে শাহবাগে জন্ম নেওয়া সেই গণজাগরণ-ই স্পষ্ট করে দিয়েছে এ্ই মানচিত্রে জন্ম নেওয়া দুই ভিন্ন পথের মানুষদের। সেই সময়েই অন্ধকারের অগ্রদূতদের হাতে খুন হয়েছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দায়। তারপর মত আর বিশ্বাসের সেই বিভক্তি শুধুমাত্র প্রকাশের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি, শুরু হয় কতল করার প্রক্রিয়া, শুরু হয় মৌলবাদের বীজে হত্যার চাষাবাদ প্রক্রিয়া। আর সেই কর্মে ইতিহাসের পাতা থেকে আজ পর্যন্ত জয়ী দলটার নাম ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন। গণজাগরণের ঠিক তিনমাস পরে ৫ই মে, অন্ধকারের লাঠিয়াল-রা নিজেদের আর আড়াল রাখেনি, বরং বীরদর্পনেই অন্ধকারের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে জড়ো হয়েছিলো রাজধানীর বুকে। দাবি আদায়ে জন্যে ঢাকা ঘেরাও করার দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছিলো ধর্মীয় শান্তি আর সম্প্রীতির ধারক ও বাহকেরা। সেই স্মৃতি মৃত্যুর আগেও ভুলার কথা না বাঙালির।
পর্দার সামনে দৃশমান ঘটনায় বল প্রয়োগ করে তাদের সেদিন সরিয়ে দিলেও পর্দার আড়ালে ওদের কেই বুকে টেনে নিয়েছিলো একশ ভাগ স্বচ্ছ , নিরপেক্ষ আর আন্তর্জাতিক মানের অসম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের দলটি। মৌলবাদী সংগঠনটিকে শান্ত করতেই তাদের তৈরি করে দেওয়া ব্লগারদের গ্রেফতার করেছিলো মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী সরকার। সত্যিকার অর্থে সেই প্রথম নিবিড় করে মৌলবাদের সাথে প্রকাশ্যে আপোষের বীজ বুঁনেছিলো আওয়ামীলীগ সরকার। এবং হেফাজতে ইসলাম নামের মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধ দলটাকে কে খুশি রাখতেই অনুভূতি রক্ষার জন্যে ৫৭ ধারা নামক এক মধ্যযুগীয় ধারার জন্ম দেওয়া হলো ।
কিন্তু রক্তপিপাসুর দানবের দল তাতেও তুষ্ট হলো না, তাই নিজেরাই তাদের মতের কিংবা বিশ্বাসের বাহিরের মানুষ কে কঠোর শাস্তি দিতে মাঠে নেমে পড়লো। তারপর তালিকা লম্বা হলো, চাপাতির তলে যাওয়া মানুষের পরিচয়ে ভিন্নতা এলো। লেখক, প্রকাশক, ধর্ম যাজক, ধর্ম প্রচারক, শিয়া সম্প্রদায় থেকে শুরু করে যারাই তাদের মতের-বিশ্বাসের বাহিরে গেলো তাদের জীবন-ই স্বাধীন সার্বভৌম জন্মভূমে বিপন্ন হয়ে উঠলো। আর রাষ্ট্র তথা অসম্প্রদায়িক সরকার ততদিনে গর্তে ঢুকে পড়া ইঁদুরের বনে গেলো, যদিও মাঝে মধ্যে বেরিয়ে এসে এসব বিচ্ছিন ঘটনা, এগুলো দেশী-বিদেশী চক্রান্ত, স্বাধীনতা বিরোধী দোসর চক্রের ঘটনা বলে নিজেদের অসম্প্রদায়িক দায়িত্ব শেষ করতে থাকলো। ছাড় পাওয়া রক্তপিপাসু ঘাতকদের দেখেই অনুপ্রাণিত হলো অসম্প্রদায়িক দলটির রাজনৈতিক কর্মী বৃন্দরা। তারাও শুরু করলো হিন্দুদের ঘর বাড়ি দখল, পেটের বাচ্ছাকে লাথি মেরে মৃত্যুদানের মতো মহৎ কর্ম সম্পাদন করা। শুরু হলো লুটের উৎসব, শুরু হলো যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পাওয়ার উল্লাস। এরপর ঘাতকেদের বুঝতে বাকী থাকে না বর্তমান আর ভবিষ্যত সরকার প্রধান যখন পণ করছে তাদের ধরবে না তখন আর রাতের আধাঁরে কেন? তারপর শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাযজ্ঞ, বাসায় ঢুকে, মার্কেটের মতো জনবহুল এলাকয় খুনের উৎসব এবং সর্বশেষ গুলশানের হলি আর্টিজেনে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা!
আর সাধারণ মানুষ? তারা তো রাষ্ট্র কর্তৃক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক শিক্ষায় বড় হয়েছে, তারা জেনেছে, নাস্তিক কিংবা বিধর্মী মারা খারাপ কিছু নয় । পাঠ্য বইয়ের পাতায় পাতায় যখন জেনেছে, বীরের বেশেই তাদের পূর্ব পুরুষেরা প্রতিমা ভাঙ্গচুর করেছে, তখন সেখানে এই সময়ে ভাঙ্গলে দোষের কি হতে পারে? একটা সুচিন্তিত প্রক্রিয়ায় শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে মসজিদ-মাদ্রাসায় দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক চেতনা, ঘৃণার চর্চা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষের মনে সংখ্যায় কম ধর্মের মানুষ, শ্রেণীর মানুষ কিংবা অবিশ্বাসী মানুষদের জন্য কোন মানবতা, সহনশীলতা, মানবপ্রেম নেই। ফলে নিজ দেশে চাপাতি দিয়ে নিরীহ মানুষ কে হত্যা, বাড়ি-ঘর দখল, ধর্ষণ কিংবা একটা নিদিষ্ট আদিবাসীর উপর সেনাশাসন চাপিয়ে দিয়ে মানবধিকার বুলন্ঠিত করা হলেও সাধারণ মানুষ কে সেগুলো ছুঁয়ে যায় না। অথচ নিজ মানচিত্রের বাহিরে (মায়ানমার, সিরিয়া, ইরাক কিংবা ভারত) কোথাও কোন মুসলমান আক্রান্ত হলে এই সংখ্যাগরিষ্ঠদের মানবতা জেগে ওঠে, তারা প্রতিবাদের রাজপথে নামে। হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখতে বেমানান লাগলেও প্রকৃত অর্থে এমনটাই হওয়ার কথা এবং হচ্ছেও তাই।
বাংলাদেশে আজ মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতার ভবিষ্যত তাই সত্যি অন্ধকার। এ অন্ধকার দূর করার জন্য প্রয়োজন অসম্প্রদায়িক চেতনার শোষণ-নিপীড়ণহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। যেখানে মুক্তচিন্তা, ইহজাগতিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও কুসংস্কারবিরোধিতা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেটি করতে না পারলে বাংলাদেশ দিনে দিনে আরেকটা পাকিস্তান হয়ে উঠবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ।
কিন্তু কিভাবে তা করব? চিন্তা করছি, সঠিক পথ পাচ্ছি না এখনো। পথ চাই, পথ।
:rose: :rose: :rose: :rose: