পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, আগের পর্ব,
পর্ব-৮ (ভাষান্তরিত)
প্রথম অধ্যায়
সামরিক আগ্রাসনের প্রথম মাস: কোচাং (Kochang) এবং সিনজু (Chinju)
মা’য়ের কথা (পর্ব-৮)
আমার মা বিশেষ করে আমার আচার ব্যবহারের ব্যাপারে নির্দ্দেশ দিতেন। তাঁর অনেক গুলো গুনের মধ্যে একটি ছিলো অসাধারন গল্প বলার দক্ষতা। সাধারনতঃ গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় প্রায়ই আমরা ছোটরা আমাদের সামনের উঠোনে কোন আগুনের কুন্ডলীকে ঘিরে নতুবা জ্বলন্ত মশার কয়েলকে ঘিরে বসতাম নতুবা বসতাম কোন কেরোসিন ল্যাম্পকে ঘিরে দীর্ঘ শীতের রজনীতে লেপের নীচে পা ঢুকিয়ে, আসরের মধ্যমনি ছিলেন মা আর তাঁর গল্প। যে সব গল্প তিনি আমাদের শোনাতেন তার মধ্যে আমার কাছে তাঁর জীবনের ঘটনা গুলো ছিলো ভারী আকর্ষনীয়। বিশেষ করে কিকরে তিনি আমার বাবাকে বিয়ে করেছিলেন এবং এই কোচাং (Kochang) এ এসে পেতেছিলেন তাঁদের সংসার। অনেক অনেক দিন আগের ঘটনা এটি, কিন্তু আমাদের কাছে এটি একটি সুন্দরতম গল্প হিসেবে প্রতিভাত হতো। আর গল্পটি আমাদের সবার মাঝে কিরকম যেনো এক ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো। আমরা তাঁর বলা গল্প গুলো এতোটাই পছন্দ করতাম যে আমরা কেবলই চাইতাম তাঁর শৈশব-কৈশোরের আরোও আরোও ঘটনা গুলোর বিস্তারিত শুনতে।
আমার বাবা-মা পরষ্পরকে তাঁদের শৈশব পেরিয়ে অনেক পরেই বিয়ে করেছিলেন। আমার বাবা তখন ঊনিশ আর মা আঠারো বছরের যুবক-যুবতী। এইরকম একটু কম বয়েসে বিয়ের পিঁড়িতে বসা সেকালের রেওয়াজ ছিলো। তাঁরা পরষ্পরের প্রতি ভীষন আন্তরিক এক জুটী ছিলেন এবং বিবাহিত জীবনে সুখীও। একমাত্র স্বাচ্ছন্দ্বময় জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের কিছুটা ঘাটতি ছাড়া তাঁদের সংসারটি ছিলো শান্তিময়। আমার মা এসেছিলেন কিয়াং-পুক (Kyung-Pook Province) প্রদেশের সনসান (Seonsan) শহর থেকে, এটি কোচাং-এর উত্তর (North of Kochang) থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে। অবশ্য সে সময় নিজের শহরের বাইরে কোথাও বিয়ে করাটাও খুব অসাধারন ব্যপারই ছিলো, বিশেষ করে অন্য একটা প্রদেশে বিয়ে করা। আমার মা বড় হয়েছিলেন একটা অতি ধনী পরিবারে এবং ঘরে ও বিদ্যালয়ে সেই রকমই এক অভিজাত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতামহ ইয়াই রাজত্ত্ব (Yi Dynasty) কালে ঐ এলাকার আঞ্চলিক গভর্নর ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন কনফুসিয় আদর্শের একজন বিশেষজ্ঞ (Confucian Scholar)। জাপানী অধিকৃত কোরিয়ায় সেই যুগে তিনি ৬ষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন, তবে তিনি মেয়ে হিসেবে সেই যুগেও নিয়মিত পড়াশুনা করতেন এবং স্বপ্রনোদিত সুশিক্ষিত ছিলেন। তাঁর বাবা তাঁর ভাইদের চীনা অক্ষর আর সাহিত্য পড়িয়েছিলেন নিজেই, কিন্তু মেয়েদের তা শেখান নি। আমার মা বড় হয়েছিলেন অতি কঠোর সামাজিক অনুশাসনের বেষ্টনী এবং মেয়েদের জন্যে লভ্য অতি স্বল্পমাত্রার লেখাপড়ার সুযোগের ভেতর দিয়ে। সেসময় প্রথা ছিলো তারা বিয়ে করে পুরুষের সংসার দেখবে, সন্তান দেবে এবং স্বামী ও তার পরিবারের সকলের দেখভাল করবেন। কিন্তু আমার মা প্রায়ই সেই ঘরের বাইরে বসে থাকতেন যেখানে তাঁর বাবা তাঁর ভাইদের নিয়ে বসে পড়াতেন। তিনি বাইরে বসে বসে সেই সব পড়া গুলো শুনতেন এবং অতি দ্রুত সেই সব আলোচিত পড়া গুলোর সারমর্ম করে মনে রাখতেন যেগুলো আমার মাতামহ তাঁর ছেলেদের এইমাত্র শিখিয়েছেন। সেই সব হাজারখানেক চীনা অক্ষর যেগুলো, যেগুলো সাধারন ভাবে খুব ব্যবহার হতো, সেগুলো পরম যত্নে তিনি মুখস্ত করে ফেলেছিলেন সব। সাথে সাথে তিনি প্রচুর চীনা, কোরিয়ান এমনকি জাপানী সাহিত্য সামগ্রীও পড়েছেন।
বাবার সাথে তাঁর বিয়ের ব্যপারটা মূলতঃ যারা ব্যবস্থা করেছিলেন তারা ছিলেন তাদের পারিবারিক বন্ধু এবং স্বজন। আর পরষ্পর থেকে অনেক দূরের দুই শহরের মধ্যে এই বিয়ের আলোচনা মূলতঃ তারাই চালিয়েছিলেন। ঘটক মূলত: আমার মা-কে একই শহরেই বিয়ের সম্মন্ধ ঠিক করেছিলেন এক ধনী পরিবারের ছেলের সাথে। ঘটক ঐ পরিবার এবং আমাদের উভয় পরিবারের খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন, এবং তিনি আমার মা-কে নিজের চোখের সামনেই এক কিশোরী থেকে ক্রমান্বয়ে বিবাহ-যোগ্যা এক তরুণী নারীতে রুপান্তরিত হতে দেখেছেন। আয়োজনের পরবর্তী ধাপে, ঘটক, যিনি যাতায়াত জনিত কারণে এলাকায় অতি পরিচিত ছিলেন। ভাবলেন, বর্তমান ছেলেটির দ্বিতীয় কাকাতো ভাই যে কোচাং-এ থাকে এবং যতটুকু জানেন পাত্র এবং পাত্রের পরিবার সম্পর্কে, সে হিসেবে হয়তো সেই বেশী ভালো হবে এই মেয়েটির হবু বর হিসেবে। ঘটক মহোদয় কোচাং-এ গেলেন এবং আত্মজ ভাইটির পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করলেন। এর ফলশ্রুতিতে তিনি বর এবং কণে উভয় পরিবারের সদস্যদের সাথে একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করলেন। উভয় পরিবারই বিষয়টি ইতিবাচক ভাবে নিলেন এবং ছেলে-মেয়েদের বিয়ের ব্যপারে সিদ্ধান্তও নিলেন। কিন্তু আমার মা বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত ছেলেটির সাথে কোচাং-এ দেখা করলেন না। সনছন-এ (Seonsan) বর এবং তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমার মায়ের মনে বোধগম্য কারনেই অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছিলো। যেমন তাঁর হবু বরটি কি যোগ্য একজন মানুষ? সে কি তাঁকে পছন্দ করবে? আমি (মা) কি তাঁকে ভালোবাসতে পারবো? সর্ব্বোপরি আমি (মা) কি সুখী হতে পারবো?
আমার বাবার কোন চাকুরী ছিলো না তখন, কিন্তু তিনি এসেছিলেন একটি ভালো পরিবার থেকে। এটুকু তথ্যই ছিলো জানা যা দিয়ে ঘটক আমার বাবাকে কণে’র পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নির্ধারিত বরের বাবা ছিলেন একজন কনফ্যুসিয়ান (Confucian) বিশেষজ্ঞ এবং বরের পিতামহ ছিলেন একজন ইয়াই রাজতন্ত্রের (Yi- Dynasty) মন্ত্রীসভার সদস্য। কেন্দ্রীয় সরকারের এমন একজন উচ্চ পদস্থ রাজ পরিবারের কারোও সাক্ষাৎ পাওয়া দেশের প্রান্তিক কোন বিশেষজ্ঞের জন্যে দুর্লভ শুধু না, এমন কি জাতীয় ভাবে অনুষ্ঠিত কোন পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত উচ্চপদস্থ বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রেও কঠিন ব্যপার! এই গুরুত্ত্বপূর্ণ বরের পিতামহ গত হয়েছিলেন যখন বর ছিলেন এক ছোট্ট বালক মাত্র, এবং সমস্ত সম্পদের একমাত্র অধিকর্তা হিসেবে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে সেসবেরও মহাপ্রয়াণ ঘটে। অবশিষ্ট স্থাবর সহায় সম্পত্তি দ্রুত নিঃশেষিত হয় বরের পিতার হাতে, সুতরাং যখন আমার বাবা কৈশোরোত্তীর্ণ হলেন, তখন আমাদের পরিবারটি হয়ে পরে আর্থিকভবে দৈন্য। কিন্তু পরিবারটি শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পায়, ফলে সবাই আমাদের সবাইকেই অত্যন্ত ভালো ভাবেই চিনতেন এবং জানতেন।
যখন এই নবপরিণীতা বধু কোচাং-এ (Kochong) এসে পৌঁছুলেন তখন, যেখানে তাঁকে আজ থেকে বাকি জীবনটা হয়তো কাটাতে হবে সেই বাড়ির অবস্থা ছিলো অত্যন্ত অবর্ননীয় রকমের শোচোনীয়। এই যুগলের কথিত ঘটক তখন মন্তব্য করেছিলেন, পরিবারটি যথেষ্ট ধনী নয়, কিন্তু আমার মা মনে করতেন যে পরিবারটিকে অতি দরীদ্র ভাবাটা সমিচীন নয়। আমার পিতামহী তাই বলে কিন্তু গৃহিনী ছিলেন না কোন কালেই। তিনিও তাঁর পারিবারিক মর্যাদাকে অনেক উজ্জ্বল করেছিলেন কারণ তিনি পড়াশুনা করেছিলেন প্রগৈতিহাসিক কোরিয়ান সাহিত্যতত্ত্বের উপরে, একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন! তাঁর অনেক সমবয়েসী সতীর্থ ছিলেন যাঁরা সাধারন ভাবে আমাদের কাছে ছিলেন ‘হারমনি’ (Harmoni, কোরিয়ান ভায়ায় এর মানে হলো পিতামহী বা দাদী বা ঠাকুরমা। অর্থাৎ ঠাকুরমা শ্রেণীয় বিদূষীবৃন্দ) । এনারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত সুশিক্ষিত এবং বিদূষী। সেই হিসেবে আমার পিতামহীর শিক্ষা এবং জ্ঞান তাঁদের মাঝে ছিলো এক অলঙ্কার স্বরূপ এবং জনপ্রিয়। প্রায়ই তাঁর প্রতিদিনের কয়েক ঘন্টা কোন না কোন বিদূষীবৃন্দের সাথে কোরিয়ার পুরনো কোনো সাহিত্য সামগ্রী সহ শীতের প্রত্যূষে কোন উষ্ণ বাষ্প-ঘরে (Smoke-Filled Room) নতুবা গ্রীষ্মে কোন কাঠের মেঝেওয়ালা চাতালে বসে (Wooden floor of a patio) পড়াশুনায় কাটতো। এঁদের প্রায় সবাই ধুমপানে অভ্যস্ত ছিলেন। বাঁশের লম্বা নলওয়ালা হুঁকা যার করুকার্যময় ধাতুতে মোড়া একপ্রান্ত মুখে দিয়ে টানতে হতো তামাকের ধোঁয়া। আমার পিতামহীর সুরেলা কন্ঠে বিবৃত কোন অতীতের কোরিয়া এবং চীনের যুদ্ধবিজয়ের কাহিনী কিংবা কখনো বর্নিত কোন অন্তরছোঁয়া অতীত প্রেমের আখ্যান তাঁরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। ঘরে যখন নবাগতা অষ্টাদশী নাতবৌ এলো, তখন তিনি ঘরের সমস্ত কাজকর্ম আর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ত্ব তার হাতে দিয়ে এসব সামাজিক কাজে আরো বেশী করে জড়িয়ে গেলেন। আমার পিতামহীর এই ধরনের সাংসারিক কাজে উদাসীনতা এবং বৈবাহিক জীবনের প্রতি নিরাসক্ততা আমার পিতামহের সাংসারিক জীবনকে অসুখী করে তুলেছিলো। ফলশ্রুতিতে তিনি অপর এক মহিলাকে তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে নেন এবং বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে থাকেন। আমার বাবা ছাড়াও পিতামহ এবং পিতামহীর আরোও দুজন স্বল্প বয়েসী সন্তান ছিলো। রক্তের কোন বন্ধন না থাকা সত্ত্বেও আমার মা-কেই এই দুই সন্তানের মায়ের দায়িত্ত্ব নিজের হাতে তখন তুলে নিতে হয়েছিলো, যাদের একজন ১৩ বছর বয়েসী বালক আর অপরজন ১০ বছর বয়েসী বালিকা। আমার মায়ের জীবনে, যখন তিনি নিজেই একজন কিশোরী আর তখন যখন এই নাটকীয় পরিবর্তন গুলো ঘটে চলেছে, বাবা তখন তাঁকে তেমন কোন সহযোগীতা করতে পারছিলেন না। বাবার তখন ছিলোনা কোন চাকুরী এমনকি নিজের নব পরিনীত জীবনকে কিছুমাত্র সুখী করার মতো কোন অবলম্বনও ছিলোনা তাঁর। বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা আর আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া তাঁর আর কিছু করার ছিলো না। প্রাথমীক বিদ্যালয়ের সমাপনান্তে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভর্তি হয়ে পরবর্তী ধাপে পড়াশুনার ইচ্ছে তাঁর ছিলো। যেটি তাঁকে তাঁর বর্তমান প্রন্তিক শহরের পাট চুকিয়ে অন্যত্র পড়াশুনা আর বিশ্বটাকে আরোও নিবীড় করে দেখার সুযোগ হয়তো দিতো। যাইহোক পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাঁর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়নি।
আমার মা বেড়ে উঠেছিলেন অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল আর্থিক সংগতি সম্পন্ন এক পরিবারে। কিন্তু তাঁর নতুন বাড়িতে কোন শোভনীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবের কিছুই তেমন ছিলো না, অথচ সেখানেই তাঁকে ধরতে হয়েছিলো সংসারের যাবতীয় দায়িত্বের হাল। বিশেষ করে রান্নাঘরে তাঁকে কাজ করতে হতো যত্তোসব পুরনো প্রায় বাতিল তৈজসপত্রের সাহায্য নিয়ে। রান্না ঘরে ঢালাই লোহার একটা প্রমান সাইজের হাঁড়ি ছিলো যার তলায় ছিলো বেশ বড় একখানা ফুটো! মা খুব অবাক হয়ে ভাবতেন যে কিকরে তাঁর শ্বাশুড়ি সেই হাঁড়িতে এতো লোকের রান্না সেকালে করতেন! আজ সেই হাঁড়ি এসেছে আমার মায়ের হাতে যাতে রান্না করতে হবে! মা’য়ের প্রথম কাজ হলো এখন সেই হাঁড়িটি সাড়াতে হবে যাতে ওতে আমাদের সবার ভাত রান্না করা যায়। গ্রামের কামারের কাছে নিয়ে ওটি সাড়াতে হলে অনেক খরচ হবে বিধায় মা আমার সিদ্ধান্ত নিলেন কোন ভাবে তাঁকে নিজেকেই ওটা সাড়তে হবে। বাসার ছোট হাঁড়ি গুলোও নিখুঁত ছিলোনা। তার মধ্যে একটি ছিলো যা প্রায়শঃই ব্যবহার করা হতো, তার তলাতেও একটা ছোট ছিদ্র ছিলো। মা একটা পদ্ধতি বের করেছিলেন সেসব অকেজো হাঁড়ি গুলো ব্যবহারের। তাঁকে দেখতাম বার্লি বা ময়দার একটা গোল্লা দিয়ে ফুটোটা হাত দিয়ে চেপে বন্ধ করে দিতে। মেরামতের পর হাঁড়ির ঐ জায়গাটায় থাকতো পোড়া আটার একটুকরো কয়লার মতো। চেপে ময়দার দলাটাকে লেপটে দেবার পরে তিনি সেটাকে উনুনের আগুনে বসিয়ে দিতেন। তখন সেটা শক্ত হয়ে সেখানে লেগে যেতো। এর পরেই কেবল তিনি সেই হাঁড়িটি রান্নার জন্যে ব্যবহার করতে পারতেন। যদিও প্রতি দিন বা কখনো কখনো একদিন পরপর তাঁকে এভাবেই হাঁড়ি মেরামতের কাজটি করতে হতো। কারন তাপে সেই বার্লির পিন্ডটি কখনো কখনো ফেটে যেতো বা পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। এমনকি আমি অনেকটা বড় হয়ে যাবার পরেও কখনো কখনো সেই বার্লি-লেপ্টানো পদ্ধতিতে সেই হাঁড়ি কর্মক্ষম করে মা’কে সাহায্য করেছি তাঁর রান্নার কাজে।
আমাদের সংসারে মা’য়ের উপস্থিতিটি আরোও বিমূর্ত এবং অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে পরেছিলো তাঁর নিজের সংসারে এধরনের অদ্ভূত সমাধান দাতা আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক দেবর ও নিজ সন্তানের অসম্ভব যত্নশীলতার জন্যে। তাঁর দেবরটি ছিলো অত্যন্ত দুরন্ত এবং চঞ্চল। প্রায়ই স্কুলে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে মারামারি করতো। মা আমার অতি যত্নে ধোয়া এবং ইস্তারি করা স্কুল পোষাক পড়িয়ে ওদের পাঠাতেন স্কুলে, কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই সেই পোষাক কাদায়মাটিতে লেপটে কিংবা মারামারি করে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ফিরতো বাড়ি। যথারীতি পরদিন সকালেই আবার তার দাবী থাকতো পরিচ্ছন্ন নতুন স্কুল পোষাকের। বাড়ির এইসব প্রাত্যহিক কাজ মা কখনোই মধ্যরাতের আগে শেষ করতে পারতেন না। কখনো কোন একাকী মুহুর্তে যখন হাতে কাজ থাকতো না, মধ্যাহ্ণের পর নিরিবিলিতে মা মাঝে মাঝে ভাবতেন তাঁর জীবনটা ঠিক কেমন হতো যদি এই পরিবারেরই আমার পিতামহের ২য় ভ্রাতুষ্পুত্রকে তিনি বিয়ে করতেন, যে ছিলো সনছান-এ (Seonsan) অপেক্ষাকৃত একটি সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের ছেলে। সেটাই ছিলো তাদের বিয়ের ঘটকের প্রথম প্রকৃত প্রস্তাবনা। সে ক্ষেত্রে আমার মায়ের হতে পারতো এক স্বাচ্ছন্দ্যময়, সাবলীল ও আরোও আনন্দময় এক জীবন। সেসময় সংসারের নিত্য কাজকর্মের মধ্যে আজকের মতো সব কিছুই হয়তো তার জন্যে নির্ধারিত থাকতো না। বাড়ির চাকর-চাকরানীরাই হয়তো সব কিছু সামলাতো। যাই হোক সব কিছু সুবিবেচনায় সম্পন্নের জন্যে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য তিনি তখন বুঝেছিলেন যে অনেক দেরী হয়ে গেছে যেখানে আর কোন বিকল্প নেই জীবনকে পাল্টে নেবার এই কর্মহীন মানুষটির জীবনের সাথে নিজেকে বেঁধে নেওয়া ছাড়া। অনুভব করতেন, এটিই তাঁর ভাগ্য লিখন হয়তো ছিলো।
আশেপাশের বৌ-ঝিরা সে সময় মাঝে মাঝে বাজীও ধরতো এই বলে যে, দেখো এই নতুন বৌ আর ক’দিন এবাড়ির সব কিছু সামলে এখানে টিকে থাকতে পারে! তারা এও বাজী ধরতো যে, বেশীদিন টিকবেনা, কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমার মা তাঁর বাক্স-প্যাটরা বাঁধবেন তাঁর পিত্রালয়ে ফিরে যাবার জন্যে। অথচ এ ধরনের পিত্রালয়ে ফিরে যাওয়া সেইসব দিনে একজন বিবাহিত মেয়ের জন্যে একেবারেই এক অচিন্তনীয় বিষয় ছিলো, এবং এধরনের ঘটনাকে তখন শশুরবাড়িকে সম্পূর্নই অশ্রদ্ধা এবং আসম্মানিত করার সামীল বলে গন্য হতো। এমনকি এমন কিছু ঘটলে সেসময় আমার মায়ের জন্মবৃত্তান্তটি তাদের পারিবারিক ইতিহাস থেকে একেবারেই মুছে ফেলা হতো, শুধু তাই নয় এমনকি তাঁর স্থানীয় সরকারের জন্মনিবন্ধন শাখার নিবন্ধন পর্যন্ত বাতিল বলে গন্য হতো। যাই হোক তিনি তাঁর স্বামীর পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হলেন যদিও তিনি তাঁর নামের পৈত্রিক পদবী বজায় রেখেছিলেন তাঁর সব আবশ্যিক সরকারী নথিতে এই নতুন পরিবারে এসেও। যা ছিলো বিবাহিতা কোরীয় নারীদের তখনকার পারিবারিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী। আমার মা জানতেন যে তাঁর আর যাবার কোন জায়গা নেই, তাই তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন জীবনকে অর্থবহ এবং সাফল্যময় করে তুলতে। সংসারিক উন্নয়নে তার উপার্যনহীন স্বামীর তেমন কোন উপযোগীতা বা সহায়তা বলতে গেলে ছিলোনা একমাত্র কিছু সাদামাটা মেরামত আর বাড়ির আশেপাশের জমিতে কিছু কাজ ছাড়া। সম্ভবতঃ অল্প বয়েস জনিত কারনে তিনি পর্যাপ্ত সচেতন এবং দায়িত্ত্বশীল ছিলেননা সংসারিক কর্তব্যবোধের ব্যাপারে। অধিকন্তু আমার বাবা ছিলেন তার পরিবারের প্রথম সন্তান, সুতরাং সেই কারনেও আমার মায়ের কিছু বিশেষ দায়িত্ত্ব ছিলো স্ত্রী হিসেবে তাঁর শ্বশুরের প্রথম সন্তানের প্রতি অবশ্যপালনীয়। আমার প্রপিতামহ এবং পিতামহ উভয়ই ছিলেন তাঁদের সংসারের প্রথম সন্তান! সুতরাং প্রথাগত ভাবে আমার মা’কে প্রতিপালন করতে হতো অনেক অনেক নিয়ম এবং কানুন, ছিলো অনেক দায়িত্ত্ব যতোদিন না এই অগ্রবর্তী বর্ষীয়ানবৃন্দ তাঁদের ইহলৌকিক জীবন স্বচ্ছন্দে বংশানুক্রমে অতিক্রম করে না যান।
Leave A Comment