মাঘের কুয়াশা ছেঁড়া হিম বিষণ্ণতার মাঝে খুব সকালে নৈহাটি জংশনে নেমে চুঁচুড়া যাবো গঙ্গা পার হয়ে। ৪-টাকার টিকেট কেটে আলোময় গহীন হৃদয়ে বসে আছি ফেরির গলুইয়ে। ভোরের সন্ধ্যার চিরচেনা গ্রামীণতার মাঝে ফেরি ছেড়ে দেয়ার ঠিক প্রাক-মুহূর্তে মাঝ বয়সি এক নারী দৌঁড়ে এলো ফেরিতে ওঠার শেষলগ্নে। হাতে ধরা তার দুটো অবোধ শিশু। শিশু দুটো কৈশোরের চপলতায় খিলখিলিয়ে লাফ দিয়ে ফেরিতে উঠতে পারলেও, পা রাখার আগেই ফেরিটি পেছনে গঙ্গার দিকে যেতে থাকলে, আতঙ্কে এক ভয়ার্ত আর্তনাদ করে উঠলো অচেনা সিঁদুরপরা নারীটি। আমি প্রকৃতির মনকম্পনে হেসে ওঠা জীবন ছেড়ে, হাত বাড়িয়ে ভয়াতুর নারীটিকে টেনে ধরি ফেরির দিকে। ছেঁড়া নাটাইয়ের ঘুর্ণনের কষ্ট ভুলে রিণরিণে শব্দে হেসে ওঠে নারীটি। দ্বিধান্বিত দ্বীপমালার ঘ্রাণে নিজ সন্তানের হাতে হাত রেখে ফিরে তাকায় টেনে তোলা সহায়তাকারীর দিকে কৃতজ্ঞচিত্তে। আমিও পাথুরে সময়ের অপ্রতুলতা ছেড়ে চোখ রাখি নারীটির চোখে। পৌরাণিক গুহার পাথর পৃথিবীর মানুষেরা যেমন অসহায়তার মাঝে ডুবে যায়, তেমনি আঁতকে উঠি আমি। প্রাচীন প্রেমিকার স্থবিরতা ঝেরে ফেলে তাকিয়ে থাকি আমি ঐ পৌরাণিক নারীর দিকে। নারীটিও তার সন্তানের হাত ছেড়ে পুরণো ভালবাসার খাদখন্দর খুঁজে মরতে থাকে গঙ্গার শীতার্থ বাতাসে। দিগন্ত ঝুঁকে সময় পেরুতে থাকে, গঙ্গার মানবহীন চরের কাশফুলের কান্নার মত আমিই প্রথম কথা বলি, “তুমি ঝরাপাতা দাস না”?
:
জলের যকৃত ফেটে দু:খ বেড়োনোর মতো ঝরাপাতা দাস বলে, “হা, তুমি এখানে? কেমন আছো তুমি”?
:
নৈহাটি ফেরি ছেড়ে দিগন্ত বিস্তৃত কালের নৌকোয় চড়ে বসি আমি। ফিরে যাই ১৭-বছর আগের ঢাকা ভার্সিটির বাঙলা বিভাগের অপরাজেয় বাংলার আমতলায়। যেখানে ঝরাপাতা দাস আর আমি কাটাতাম ভালবাসার স্বপ্ন আবাদে ঘর সাজানোর সপ্তরঙা পরিকল্পক হিসেবে সারাবেলা। লেখালেখি পড়াপড়ির সূত্রে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রুমে। ভৈরবের এ ছিপছিপে মেয়েটি পড়ালেখায় পাল্লা দিতো আমার সাথে। স্বপ্ন অস্তিত্বের সমুদ্রে স্নানের মাঝেও আমরা কখনো ভুলতাম না জীবনানন্দ, অমিয়, বিষ্ণুদে কিংবা সুধীন্দ্রনাথকে। ত্রিশোত্তর এ কবিদের কাব্যের জটিলতায়ও আমাদের অভিসারী মনের ভাললাগার আলোতে ঘাটতি পরতো না কখনো। ভালবাসার পাথর পাহাড় গলে কখনো তা বিবাদে রূপ নিতো। আমি এ নৈরাশ্যবাদী নারীর তনুতে তৃষ্ণার আগুন জ্বালাতাম, তাতে তার মনশরীর জ্বলে-জ্বলে একসময় তুলতুলে মোম হয়ে গলে পরতো। নিরাভরণ ঈশ্বরের মত প্রতিনিয়ত দু:খাতুর আমরা নিজেদের স্বপ্নগুলো পাকিয়ে তুললাম অস্থিরলগ্নে জেনেটিক প্রেমের মতো। ধর্মান্ধরা যেমন ঈশ্বরের পায়ুপথে চুমো খায়, আমরাও তেমনি অনন্ত বন্দনার জিয়নকাঠী জ্বালিয়ে রাখতাম দুজনে দুজনার।
:
বৈদিক ধর্মপরিবারে জন্ম নেয়া এ মেয়েটি মুসলিম পরিবারে কিভাবে আসবে তা চিন্তনে প্রায়শই আমরা সুখহীনতার অতলতার গভীরে ডুব দিতাম। আমার আলহাজ্ব ধর্মভিরু জননীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে, বাবা-মাকে রাজি করিয়ে মুসলিম হয়ে মার পুত্রবধু হবে সে, যদিও নিরিশ্বরবাদি ছিলাম আমরা দুজনেই। দেবী স্বরসতিকে পুঁজো না দিয়েও ঈর্ষণীয় ফলাফল করি ভার্সিটিতে আমরা দুজনে। দক্ষিণায়নের হৃদটানে হৃদয় রেখে আমরা খুব কাছাকাছি চলে আসি দুজনার। মাস্টার্সে ভর্তির কদিন আগে ঢাবির হল ছেড়ে নিয়তির পরিজায়ী মেঘেরা যেমন দৌঁড়ে যায় স্বজনাকাশে, তেমনি ঝরাপাতা যায় তার মায়ের কাছে, ধর্মান্তরের কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে যেন করুণ বৃক্ষের স্বপ্রাণ ভিক্ষুক হয়ে।
:
জীবন পেন্ডুলামে সময় গড়িয়ে যায় আমাদের। ঝরাপাতা আর ফেরে না ঢাবিতে। ঝরাপাতার স্বপ্নেরা আমার কাছে পালকঝড়া বুড়ো পৃথিবী হয়ে হাঁটতে থাকে ক্যূজো হয়ে। বনান্তরে যেমন খুঁজে মরে কপালকুন্ডলা, তেমনি আমি ভৈরবে খুঁজতে চাই ঝরাপাতাকে আহত দ্রোহী সমুদ্রের নিষ্পলক চাহনি নিয়ে। খরস্রোতা মেঘনার ঘোলাটে ভৈরব জলতলের সপ্তম করতলে ডুবেও আমি ঝরাপাতাকে খুঁজে পাইনা আর। ধর্ম তাকে আমার জীবন থেকে ধুসর প্রান্তের অধীর অস্তিত্বে নিয়ে গেছে। আমাদের ভালবাসার বনজ নীলিমা ছিন্ন করে কোলকাতর বণিক সাহা এক অভালবাসার পুরুষ ঝড়াপাতার কপালে সিঁদুর আর সাতটি পাক দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে তাকে। পরিযায়ী মেঘের কান্না তার আকাশ সাথী হারানোর বেদনা নিয়ে বৈদিক ঝরাপাতা চলে যায় বৈদিক দেশে বৈদিক স্বামীর নৈকট্যে।
:
দুমাস পরে এ সংবাদ যখন পাই আমি ঝরাপাতার পিত্রালয়ে, শতাব্দীর জেগে ওঠা ঘনসবুজ ভৈরবের ঘাসেরা তখন হলুদাভ হয়। ক্রান্তিগ্রহের শিশু গ্রহাণুরা কাঁদে মহাকাশে আমার দু:খের অব্যক্ততায়। এক আঁধার বিভার ঘিরে ধরে আমায়। আমার পালকের পুষ্পগুলো উড়ে যায় দু:খবাতি হাতে নক্ষত্রের মাঝ দিয়ে দূর মহাকাশে। জীবন নির্মাণের নবম প্রহরে কষ্টের এক সাথে জেগে ওঠাকে এক সময় পদদলিত করি আমি। ঘনকৃষ্ণ দু:খের আঙিনায় আলোর আরাধনা শুরুর প্রাক্কালে লঘু রোদের স্ব্প্নময়তায় হাসে আবার জীবন। ঘাসফুলের অতল সান্নিধ্যে দেখি আবার তারার নাচন। স্বর্গীয় হুরপরিদের আস্তানার প্রেমকে ধিক্কার দিয়ে, বিত্তের ঋজু বন্দনা ভেঙে হৃদয় টানি ক্যারিয়ারের দিকে। আবার জীবনকে পরাতে চাই্ শুভ সকালের শিশিরের মালা। রৌদ্রাঘাতে শিশির ভাঙতে থাকি আমি দুহাতে দুপায়ে দলেদলে। দূরাগত বৃষ্টির একটানা সুরকে জীবনে মিলিয়ে তা ঘষে আগুন বের করি আমি। দু:খ নগ্নতাকে তছনছ করে পৃথিবী আর তার মানুষ দেখতে থাকি ক্রমাগত। হাওরজলে আকাশ আর তারারা কেলি কলে আমার অরণ্যানী জনবসতিতে। আকাশের নক্ষত্রদের সাথে কথা কইতে কইতে দিগন্তের সূর্য ঢলে যায় ৪৫ ডিগ্রিতে। আবার আমার জীবন নদীর চরাচরে শব্দহীন নীলে বৃষ্টিরা ঝরে। মাঝে কখনো ঘুম ভেঙ্গে দু:খ জেগে ওঠে কুয়াশাঘেরা জীবনের দিগন্তপারে। মানুষ আর তার সপ্তপদি পৃথিবী দেখে জলের মতন স্নিগ্ধতা ফিরে পাই আমি। কখনোবা ভালবাসার শব্দ রক্ত ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে বুকে আমার। সহিষ্ণুতার বর্ণালি হরিৎ ঘিরে তাকে ঠেলে দেই পৃথিবীর নরম পায়ের তলে। আমার প্রপিতামহের শরীরের দাগ আমায় কিষাণ কথকথা শোনায়! কখনোবা ঝড়ো মন কর্ষিত জমির মতো বিপথগামী হতে চায়। তখন হিম মৃত্যুর মতো হতাশাকে চপেটাঘাত করে আমি আনন্দের ফল্গুধারায় হেসে উঠি জীবন ফাল্গুনে। মাঝে মাঝে মন্ত্রচ্যুত কাপালিকের মতো দিকভ্রান্ত হই আমি। আমার হাড়কাঠ তখন নোনারক্তে ভিজে একাকার হয়। বৃক্ষ সারিতলে জমাট অন্ধকার নীলাকাশ ছেড়ে তখন পৃথিবী দেখতে বের হই। সব ছেড়ে আমি তখন বাতাস পাখির অনাগত রূপকথা শুনি।
:
বধির বিকেলের ঝরে পড়া কষ্টগুলো ভুলতে ক্রমাগত দ্বীপদেশগুলো ঘুরতে থাকি আমি। সতেরো বছর এভাবে সুপ্ত দুঃখ ঘুমোয় আমার পাশে একই বালিশে মাথা দিয়ে। ঝরাপাতাকে মনে পরতো কখনোবা বিস্ময়ের বিষণ্ণ অসীমে। ঢাকা থেকে কোলকাতাতে এলেই মনে হতো হাওড়া কিংবা সল্টলেকে একদিন ঝরাপাতাকে দেখবো কিংবা পাবো একটা চিঠি, এমএমএস বা ইমেইল। অথচ কিছুই এলোনা এ সতেরো বছরে। সিনেমাতে সম্ভবত আসে, বিচ্যুত শব্দের বলিদানে হয়তো বাস্তবতায় নয়। অথচ আজ এ গঙ্গার মাঘের এ হিমেল বাতাস আকষ্মিক চৈত্রের খাঁ খাঁ রৌদ্র হয়ে ঝরাপাতা আর আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল আলুথালু আকাশ হাওর জলে। প্রাচীন যুগের পাথুরে গড়া মূর্তির মতো ঝরাপাতা কোন কথাই কইতে পারলোনা আর। ওর অবোধ সন্তানেরা ওর দুহাত ধরে দাঁড়ায় পাশে।
:
শিশিরের হিমঝরা প্রহর আমাদের মাঝে নীল বিষ্ণু আর অতিনীল মনসার দংশন আর তীব্র আঁতাতের গন্ধে ক্লেদান্ত করে! আমি বন্ধুহীন ক্ষয়িষ্ণু ভগ্ন চাঁদের মত ঝরাপাতার ভাঙান্যূজ শরীরের দিকে চেয়ে থাকি অপলক দৃষ্টিতে। ও কিছুই বলতে পারেনা, সম্ভবত ওর জমাট বাঁধা ক্লেদাক্ত কষ্ট চোখকে রক্তবর্ণ করে। আমি চিন্তিত হই এটা ভেবে যে, কষ্ট দহনের ধোয়া অশ্রু হয়ে ওর চোখে দেখছি না কেন? ওকি তবে প্রস্রবণ রক্তকায়া শবদেহ নারী? যার পিণ্ডদানে আলোর কান্নারা কাঁপাকাঁপা রিণরিণে শব্দ তুলবে? গঙ্গার শীতের ধোয়াশায়ও আষাঢ়ের বৃষ্টিঝড়া ট্রাজিক সুর বাজবে? নোঙরছেঁড়া হৃদয়ের কথা ভুলে আমি মৃত প্রেতের মতো ভয়ার্ত স্ব্প্নালোকে চেয়ে থাকি ঝরাপাতার দিকে।
:
এরই মাঝে বাতাসের পাহারায় স্বনিয়ন্ত্রিত শব্দসন্ত্রাস তোলে চলন্ত ফেরি। বিমূঢ় জীবনের কথকতা না ফুরোতেই প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে ফেরিটা ঘাটে লাগে। নবমন্ত্রে পুণ্যতর ধবংসের সাধনা পুনর্বার জেগে ওঠে আমার মননে। আমি এবার একসাথে ঝরাপাতা আর তার দুসন্তানসহ তিনজনকেই ঝাপটে ধরি, যেন তারা টাল সামলাতে না পেরে গঙ্গার জলে না পরে। পঞ্চনদ উৎস শৃঙ্গ ভেঙে ঊষাকালে জন্মলগ্ন সায়াহ্ন ভাঙার মত অবোধ দুই শিশু একসাথে বলে ওঠে, “মা তাড়াতাড়ি চলো, ঐ দেখ বাবা ইশারায় ডাকছে”!
:
স্বপ্নধূলিতে ধুসরিত হয়ে ঝরাপাতা আর নামতে পারেনা ফেরি থেকে। দুর নক্ষত্রের রিণরিণে ব্যথাগুলো চেপে আমি অচেতন নিত্যকর্মে বলি, “তোমার স্বামী ডাকছে তোমায়? তার সাথে পরিচয় করাবে না”?
:
শুক্লা তিথির জেগে থাকা চাঁদের মত এবার অশ্রু গড়ায় ঝরাপাতার দুগাল বেয়ে। রক্তে ভেসে যাওয়া শতজন্ম অবদমিত করে বলি, “চোখ মুছে সামনে আগাও, তোমার স্বামীকে দেখি”।
:
পোড়খাওয়া চেহারার পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে ক্রাচ ভর করে। তাকে দেখে আঁতকে উঠি আমি। মুখে বসন্তের দাগ অনেকটা সিনেমার ওমপুরির মত। ঝরাপাতা এড়িয়ে যেতে চায় আমায়, বলে “আমরা এখন যাবো, কাছেই আমাদের বাড়ি। তুমি কই যাবে”?
:
বলি, “তোমার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলতে চাই”।
ঝরাপাতাই স্বামীর দিকে তাকিলে বলে, “আমার দাদা, বাংলাদেশ থেকে এসেছে”।
মাথা নিচু করে নমস্কার করেন দুহাত তুলে স্বামী ভদ্রলোক।
ক্লেদাক্ত চেহারার জীবনের ফাটলে-ফাটলে ঝড়াপাতার ক্লেদের গান শুনতে পাই আমি।
স্বামীটি বলে, “বেড়াতে এসেছেন আমাদের বাড়ি? টাকা পয়সা দিয়েছে কিছু ওর বাবা? খুব খারাপ সময় যাচ্ছে আমাদের। টাকার জন্যে ফোন করেছিলাম তা জানেন”?
কাফনের ঢাকনা খুলে মৃত্যুর কাছে যাওয়ার মত ঝরাপাতা ক্ষীণকণ্ঠে বলে, “দাদা এসেছেন অন্য কাজে। বাবার সাথে দেখা হয়নি তার। তুমি যাও তোমার কাজে দাদা। আমরা যাই”।
ঝরাপাতা চলে যেতে চাইছে আমাকে এড়িয়ে। এ কষ্টের ব্যাধিবীজ টাটাচ্ছে মননে আমার। বলি, তোমাদের সাথে নেবেনা তোমাদের বাড়ি? স্বমীটি তৎক্ষণাৎ বললো, “কেন নেব না দাদা চলুন আমাদের সাথে”।
:
ঝরাপাতার অবজ্ঞাকে পেছনে ফেলে ওদের সহযাত্রী হই গ্রামীণ পায়ে চালানো ভ্যানে চেপে। ‘সুগন্ধা’ গ্রামে ওদের বাড়ি। প্রায় ১০কিমি দুর এ ঘাট থেকে। কষ্টকর ঝিকঝিকে কুয়াশার মত কথা কয়ে কয়ে একই ভ্যানে আমরা ৫ জনে পৌঁছে যাই দুপুরের আগেই এক জীর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া বাড়িতে। ঢুকেই রাতভাঙা জলের সিড়ি বেয়ে ঝরাপাতা আমার আপ্যায়নে ব্যাপৃত হয়। কিন্তু ক্রাচভররত স্বামীটি অর্থপ্রাপ্তির আশাহীনতায় তার বিরক্তির কথা প্রকাশে কৃপণতা করেনা। আগত অতিথিকে আপ্যায়নে তার অক্ষমতার কথাও বলে যান অবলীলায়। আমার সাথে থাকা অল্প কিছু ভারতীয় রুপি হাতে দিয়ে বলি, “যান আপনি বাজার করে আনুন। আপনার ঘরে থাকবো আমি আজ”।
:
অর্থপ্রাপ্তিতে পুন নমস্কার করে ক্রাচে ঠকঠক শব্দ তুলে বাড়ি ত্যাগ করেন ঝরাপাতার স্বামী।
:
আমি ঝরাপাতাকে ডেকে তার যুথবদ্ধ অন্তলীন জীবনের কান্না শুনতে চাই। এবার নিটোল মুক্তো গড়াতে ঝিনুকের দু:খগুলো যেমন অকথিত থাকে মুক্তোতে, তেমনি জলবতী টলটলে দু:খমালাগুলো তুলে ধরে ঝরাপাতা ক্রমান্বয়ে রিণরিণে কান্নার ঝংকারে। ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা শুনে কিভাবে তার বাবা-মা তাকে আত্মহত্যর ভয় দেখিছে, কোলকাতার বড় বাজারের এই কাপড়ের ব্যবসায়ী রজত সাহাকে ৫-লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে, বাংলাদেশের ভৈরবে সকল বরযাত্রীকে কোলকাতা থেকে আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করে, মাত্র ৩-দিনে বিয়ের সব কাজ সম্পন্ন করে, আবার সবাইকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিল তার সবিস্তার কাহিনি।
:
প্রথম দিনগুলো তেমন খারাপ ছিল না ঝরাপাতার, মা বাবার জন্যে সব মেনে নেয় সে। কিন্তু স্বামী রজত ক্রমান্বয়ে মদাসক্ত হয়ে ব্যবসার পাততাড়ি গুটায়। এক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় বছর তিনেক আগে মারাত্মক আহত হয়ে ৫-মাস হাসপাতালে থাকে। চিকিৎসা ও সংসার চালাতে দোকানটি লাঠে ওঠে অল্পদিনেই। বাংলাদেশ থেকে ঝরাপাতা বাবাকে বলে ৪-কিস্তিকে অনেক টাকা এনেছে সংসার আর চিকিৎসার নামে। মধ্যবিত্ত ঝরাপাতার বাবাও এখন আর টাকা পয়সা দিতে চায়না ১৭-বছরের পুরণো মেয়ে জামাইকে। তা ছাড়া বাংলাদেশেও তারা খুব ভাল নেই এখন। তাই কোলকাতা ছেড়ে মাস কয়েক আগে রজতের এ পৈত্রিক গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে পুরো পরিবার। সংসারে এখন অর্থ সংকটটাই মুখ্য। টাকা পেলেই রজত চলে যায় মদের দোকানে।
:
ঝরাপাতার কান্নাকাহিনিতে দিনজ্যোস্নায় আদিম গোধূলির ম্লানতা ছায় আমার পুরো শরীরে। আহ! দু:খাতুর ফেরারী অতীত ভাঙে আমার জীবনের জলরঙা সিড়ি! একসাথে পড়তাম আমরা। কত সাবলিল ছিল ঝরাপাতার জীবন। আমি বাংলাদেশ সরকারে উচ্চপদে জব করছি, ঝরাপাতা ধর্মীয় কারণে আমাকে না পেয়ে, কালচক্রে এখন হুগলির সুগগ্ধা গ্রামের অসহায় অচল রজত সাহার স্ত্রী। সেও হয়তো আজ বাংলাদেশে উচ্চপদে জব করতো কিংবা থাকতো আমার পরিবারে সুখের উঠোনের নিজস্ব আকাশের নীলে। ধর্ম আমাদের জীবনের সুখগুলো কিভাবে অনিকেত প্রান্তরে ঝড়াপাতার বৃক্ষের কান্না বানালো, তা ভেবে নিজের জন্য নয়, ঝরাপাতার জন্যে আমার এ অপরিচিত গ্রামীণ বাড়িতে চির সনাতন প্রত্নদাগে দু:খগুলো জেগে উঠলো আবার।
:
১৭ বছরের আগের ঢাবির কলাভবনের ঝরাপাতার সে দিনগুলো খুঁজে ছায়াস্নিগ্ধ ধুসরতার রেপ্লিকা খুজি আমি। কষ্টের বীজ বোনা উত্তরের বৃষ্টির মত দুখরা একসাথে আঁকড়ে ধরে আমায়। আমি আর থাকতে পারিনা ঝরাপাতার কাছে। এ মিথ্যেকে জাপটে ধরে প্রচন্ড দ্রোহ করতে ইচ্ছে করে আমার। গহীন অতল জলধির একাকিত্বের মত আমি উঠতে চাই ঝরাপাতার ঘর থেকে। কিন্তু কষ্টের ছবিরা স্বপ্নের অনুরণে আমাকে পুরণো দিনের নিটোল প্রেমময়তার আটকে রাখে ওর ঘরে। মনের মানচিত্র আঁকা নীলাভ প্রেমময়তা এক অঘোর অমাবশ্যার সৃষ্টি করে। জীর্ণ উদ্ভিদকূলের কষ্টের মত দুখগুলো উড়ে উড়ে আমাকে নিয়ে চলে আকাশ সমুদ্র আর ঘনান্ধকার পাতালরাজ্যে। পসাইডনের মত ক্ষমতারধর পাতাল দেবতাও আমাকে উদ্ধার করতে পারেনা। প্রচণ্ড এক ঘোরের মাঝে আমি চাঁদ, তারা, জোস্নাস্নাত জোনাকির আলোতে ঝিঝি পোকার একঘেয়ে ডাক শুনি। বেদনার বৃক্ষময় বটের ঝুড়িরা আমার পুরো শরীর গ্রাস করে। দু:খ রেখায়নে করুণতার গানের সুর পাল্টে কি করবো ঠিক বুঝতে পারিনা আমি, ঝরাপাতাকে বলি, “তুমি কি বাংলাদেশে ফিরে যাবে আমার সাথে? পুরণো জীবনে”?
:
“সন্তান আছে আমার। না হলে চলেই যেতাম আমি। তোমার বলতে হতো না”।
:
ঝরাপাতার দুই অবোধ শিশু এসে তার কোলে ঝাপ দেয়। বলে, “মা আমরা কি বাংলাদেশে বেড়াতে যাবো”?
আমার বুকের মাঠের ঢেউদিগন্তে শালিক নাচে। বলি, “যাবে মা তোমরা আমার সাথে বাংলাদেশে”?
:
শিশুরা মা’র দিকে তাকায়!
ঝরাপাতা চেয়ে থাকে আমার দিকে পৌরাণিক ঈশ্বরের ধারাভাষ্যের মত !
:
প্রাচীন গলির বিষন্ন সন্ধ্যার মত ঝরাপাতা এ্ই প্রথম ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমার স্মৃতির স্তবির সিম্ফনিরা হাহাকার করে বারবার। অনেকক্ষণ পর জীবনের জলকণারা আবার তীর ভাঙে জীবন নদীতে। দৃঢ়তায় বলি, “আগামীর করুণক্লান্ত বৃত্তে বন্দি থাকবো না দুজনা, চলো এগিয়ে যাই”!
:
ব্যথার উঠোনে জন্মানো শ্যাওলার মত ঝরাপাতা অপলক তাকিয়ে থাকে তার সতেরো বছর আগের নাক্ষত্রিক প্রেমিকের দিকে। ঝরাপাতার চোখে জল ঝরছে!
খুবই চমৎকার।
গল্পটি খুব ভালো লাগলো। গল্পটি অত সুন্দর ও সাবলীল ভাবে লেখার জন্য লেখাটি উচ্চ মাত্রা পেয়েছে, লেখককে ধন্যবাদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে শরৎচন্দ্রের কমললতার কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে গহর ও কমললতার কথা মনে পড়ে গেল। এদের মনের ভাব আদান-প্রদান, একমাত্র শ্রীকান্ত জানতে পেরেছিল। কিন্তু সেখানেও ধর্মের অনুশাসন বাঁধা হিসাবে দাঁড়ায়। আজ থেকে ৭০/৮০ বৎসর পূর্বে শরৎচন্দ্র মিলান্তক গল্প লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজ ও ধর্মের অনুশাসন ওনার কলম থামিয়ে দিয়েছিল।
এখন ধর্ম শরৎ আমলের চেয়ে হিংস্রতর থাবা নিয়ে বিস্তৃত আমাদের সমাজে। তাই খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি আমাদের মননে
নীলরঙা বৃষ্টিতেও এমন রঙধনু?
অদ্ভুত অপূর্ব সুন্দর।
আমি অভিভূত।
শুভেচ্ছা।
কৃতজ্ঞতা জানাই সুন্দর মন্তব্যের জন্যে। আমার বাকিগল্পগুলো পড়ার আমন্ত্রণ জানাই বন্ধুকে
নিশ্চই। আগ্রহ ভরে পড়বো। ভালো থাকুন।
অনবদ্য লেখনি আপনার।
খুব ছুঁয়ে গেল গল্পটা। এমন আরো লিখুন।
হ্যা লিখছি। এ পর্যন্ত এমন সত্যি ঘটনার ৭০টা গল্প আছে আমার, প্রবন্ধ ৮-৯০০০। এখানে কেবল ৫টা দিয়েছি। পড়ার অনুরোধ করছি
এ ছাড়া আমার একটা সমৃদ্ধ পেজ আছে (ধর্ম, দর্শন, মানুষ আর জীবন জিজ্ঞাসা) । অনেক প্রবন্ধ, গল্প আর নানাবিধ কার্টুনে ভরপুর পেজটি ভিজিটকরার অনুরোধসহ লিংক দিলাম:
*******************************************************************
https://www.facebook.com/drlogicalbangali/
আপনার পেজটা আসলেই বেশ সমৃদ্ধ!
মুক্তমনায় আপনার নতুন লেখা পাবার অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ দাদা পেজটা দেখার জন্যে
যারা আমার প্রায় ৯,০০০ পোস্ট (গল্প, প্রবন্ধ, ধর্ম বিষয়ক লেখা, সমাজ আর মানুষ বিষয়ক প্রবন্ধ) পড়তে চান, দয়া করে তাদের ফেসবুকে যাওয়ার অনুরোধ করছি।
ড. লজিক্যাল বাঙালি
https://www.facebook.com/logicalbengali
কষ্ট পাইলাম,,আবার ভালোও লাগসে,,
এ কষ্টকে সাহিত্যে বলে করুণ রস। সত্যি ঘটনাটা করুণ রসে স্নাত হলো সম্ভবত
হৃদয় ছুয়ে গেল
প্রণোদনার জন্য ভাল লাগছে আমার
আমাদের নাস্তিকদের জন্য একটা আলাদা ‘বিবাহ আইন’ করা উচিত। বিয়ের পুরো ব্যাপার টাই কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক।
লিড টুগেদার করাইতো নাস্তিকদের বিয়ে আপাতত। হ্যা আইন নেই। তবে যেদিন পৃথিবীর ৫১% মানুষ নাস্তিক তথা মুক্তমনা হবে সেদিন নাস্তিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে নিশ্চয়ই
কত ঝরাপাতা দাস আর গল্প কথকের গুমরে কান্নায় ভারি হয়ে আছে এই সভ্যতা কে জানে। দারুণ ভাল লাগলো গল্পটি।
হ্যা প্রাগৈতিহাসিক থেকে একুশীয় সভ্যতা পর্যন্ত ধর্মের এটাই অবদান। এর থেকে মুক্তি কবে পাবে সেটাই বোধ্যিক মানুষের চিন্তা! ধন্যবাদ পড়ার জন্যে!
ধর্ম এভাবে কত ঝরাপাতা কে ঝরিয়ে দিয়েছে প্রেম ভালবাসাময় সুন্দর নির্মল পৃথিবীর সুখভোগ থেকে তার হিসেব রেখেছে কেউ?কেউ রাখেনা সে হিসেব।কেউ কেউ হয়ত লিখে রাখে, সেই লেখা শুধুই এক লেখা নয়।হয়ত তেষট্টি বছর কিংবা একশ তেষট্টি বছর পরে মহাকালের বুকে এঁকে যাওয়া ঝরাপাতার ছবি দেখে বিশ্বাস করতে পারবে না।হয়ত ততদিনে ধর্ম নামক দৈত্যখানা তার কোন অত্যাচারী একনায়ক মনোভাবের প্রকাশ কখনো করতে পারবে না,কাউকে আঁকতে হবেনা আর কোন ঝরাপাতার কান্নার ছবি।
হ্যা এমন দিন হয়তো আসবে, যখন ধর্ম কোন ব্যাপার হবেনা মানুষের জীবনে। কিন্তু সেটা আমরা দেখে গেলাম না।
অসাধারণ!
খুবই ভাল লেগেছে। বিশেষ করে আপনার উপস্থাপনার প্রশংসা না করলেই নয়।
তবে সব মিলিয়ে কেন জানি গল্পই মনে হল।
জীবনতো আসলে গল্পই। আসলে জীবন কথন লিখলেই তা গল্প হয়। এতোদিন লিখিনি বলে তা গল্প ছিলনা।
মন্তব্য…মর্মান্তিক
মানুষের জীবন সম্ভবত মর্মান্তিকই
পড়লাম। হৃদয় ছুয়ে গেল। আমি যার কাধে মাথা রেখে জীবন কাটিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তার নাম রাজীব দাস। কিন্তু আপনার ভাইয়েরা তাকে পিটিয়ে পা ভেঙে দিয়েছিল। আর আমার হুজুর পিতা আমাকে আর এক হুজুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। এখন আমার হুজুর স্বামী মৃত। আমি চাকরি করে স্বনির্ভর। কিন্তু রাজীব দাসের খবর জানিনা। আমাকে এনে দিতে পারবেন? তার কাছে চলে যেতাম। তার নিজ হাতে আমার মাথায় সিদুরের রেখা একে নিতাম।
এমন স্বাপ্নির পরিকল্পনার ঘোরতর শত্রু হচ্ছে ধর্মবিধি, যা তোমাকে ‘রাজীব দাস’কে আর আমাকে ‘ঝরাপাতা দাস’তে পেতে দেয়নি। হয়তো হাজার বছর পর যখন ধর্মমুক্ত বিশ্বে আমাদের পুনরায় ক্লোন করা হবে, তখন আমরা আমাদের ‘দাসদ্বয়’কে পেতেও পারি। হাহাহাহা। ধন্যবাদ পড়ার জন্যে