এক.
২০১৪ সালের জুন মাসের ১৪ তারিখ যখন ফিলাডেলফিয়ার নাগরিক জোহান ব্রেয়ারকে গ্রেফতার করা হয় তখন তার বয়স ৮৯ পার হয়েছে। ছবিতে দেখতে পাওয়া আপাত নির্দোষ প্রৌঢ় এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আছে শুনলে গায়ে কাঁপুনি ওঠে। এই ব্যাক্তিটির বিরুদ্ধে আছে ১৫৮টি অভিযোগ যার ভেতরে রয়েছে নিরপরাধ ২ লাখ ১৬ হাজার ইহুদি হত্যার দায়।
জার্মানিতে জন্ম নেয়া জোহান ব্রেয়ার ১৭ বছর বয়সে হিটলারের এসএস যোগ দেয়। Auschwitz এবং Buchenwald এর সংখ্যালঘু ইহুদি নিধন ক্যাম্পের একজন গার্ড হিসাবে কাজ করে পুরো যুদ্ধের সময় কাজ করে। এই দুটি ক্যাম্পে লক্ষাধিক ইহুদিদের হত্যা করা হয়। সে যদিও তার জবানবন্দীতে জানায় তাদের কাজ ছিলো সাইটগুলি বন্দীদের সশস্ত্র পাহারা দেয়া এবং সে নিজের হাতে কাউকে খুন করেনি কিংবা গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করায়নি তবুও নৎসিদের সহায়তার মাধ্যমে যুদ্ধে হত্যাকান্ডের দায় সে কিছুতেই এড়াতে পারেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ২২০ জন এস এস গার্ডের তালিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক ঘটনারই বদলে দিয়েছে। আমেরিকা ইতিমধ্যে এই ২২০ জনের মধ্যে জীবিতদের খোঁজ শুরু করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই বিচার কার্যক্রম শুরু হবে নিঃসন্দেহে।
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে জোহান ব্রেয়ার তার গ্রেফতারের মাত্র এক মাসের মাথায় কারাগারেই মারা যায়।
দুই.
আমাদের অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামি পক্ষের আইনজীবী, আসামীর পরিবার, অনেক ক্ষেত্রে আসামীদের নিজের মুখেই আমরা শুনেছি যে যতজন মানুষকে হত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আসলে তত মানুষকে মারা নাকি তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গনহত্যার অভিযোগ সহ ২৩ অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল যখন তাকে সাজা দেয় তখন তিনি চিত্কার করে বলতে থাকে-
“এক কথায় বললেই তো হয় যে, ৩০ লাখ লোক আমি মারছি…”
আবার কাদের মোল্লার সময় আমরা দেখেছি কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের জন্য আনীত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্বাধীনতাবিরোধী বাহিনী আল বদরের সদস্য মোল্লাকে ৩৪৪ জন নিরীহ ব্যক্তি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে। সেখানেও আমরা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের হাসিহাসি মুখ বলতে দেখেছি যে- ‘এক জন মানুষ কি ৩৪৪ জনকে মারতে পারে… এটা অসম্ভব…’
তারা ভুলে যায় গনহত্যার দায়ের জন্য একজন একজন করে খুন করতে হয় না। হত্যাকান্ডের যে কোন পর্যায়ে ন্যুন্যতম সাহায্যই হত্যার সমান অপরাধ হিসেবে গন্য হয় আর আসামি মোল্লাকে কমপক্ষে বাইশজন সাক্ষি নিজ হাতে খুন করতে দেখেছে। কাদের মোল্লার হাতে ধর্ষণের শিকার একজন বীরাঙ্গনা মোমেনা বেগম নিজে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মোল্লাকে সনাক্ত করেছে। সেখানে আর কিছু বলার আর অপেক্ষা থাকে না।
আমি শুধু ভাবি আমেরিকা কিংবা জার্মানির মত আমরা যদি এরকম গার্ডদের ধরে ধরে বিচার করতাম তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াতো।
আজ যারা বিচারের দেরি হওয়ার কথা তোলেন, আসামীদের বয়স কম বলে ধোঁয়া তোলেন- তারা দেখে রাখুন মাত্র ১৭ বছর বয়সে একটা ক্যাম্পের সামান্য গার্ডের দায়িত্ব পালন করার অপরাধে ৭০ বছর পর ৮৯ বছর বয়স্ক একজন মানুষের বিচার হচ্ছে। শুধু বিচার নয় গনহত্যার দায়ে বিচার।
তিন.
একটা গল্প শোনাই,
একটা না কয়েকটা,
কয়েকটা টুকরো টুকরো গল্প…
“তাদের হেডকোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা বোঝাই চোখ। এ দেশের মানুষের চোখ। আলবদরদের খুনীরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।”
-মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ [দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯.১.১৯৭২]
ডঃ আলীম চৌধুরীর চোখ আলবদররা উৎপাটন করেছিলো। মওলানা তর্কবাগীশ বলেছিলেন, ‘‘খুনীদের নামে এই বাহিনীর নাম দেওয়া হল আলবদর বাহিনী। এ কি কোনো মনঃপুত নাম? যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য, ইসলামের প্রথম লড়াই, সেই যুদ্ধের সঙ্গে কি কোনো সংযোগ এই নৃশংসতার মধ্যে ছিল? হানাদারদের সহযোগী এই বদর বাহিনী শুধু ইসলামের শত্রু নয়। এরা হল জালেম।’’
১৯৭১-৭২ সালের দৈনিক পত্রপত্রিকাগুলো দেখলে আলবদরদের নিষ্ঠুরতার অনেক খবর জানা যাবে। রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমি যা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর, আলবদরদের নৃশংসতার প্রতীক। দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক,
‘‘আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা। …’’
‘‘একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই, কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা … মেয়েটি সেলিনা পারভীন। শিলালিপি এডিটর। … ’’
‘‘মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি ফলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যস্থ কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোক যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’’
অধ্যাপক আনিসুর রহমান শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন–
‘‘ইতিহাসে পৈশাচিকভাবে হত্যার অনেক কাহিনি পড়েছি। কিন্তু শিয়ালবাড়িতে ওই পিশাচরা যা করেছে এমন নির্মমতার কথা কি কেউ পড়েছেন বা দেখেছেন? কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে দু’টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়, কিন্তু তাকে কিমা করার মধ্যে কোন পাশবিকতার উল্লাস?
… সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম, আমার যদি চেতনা না থাকত, এর চেয়ে যদি হতাম কোনো জড় পদার্থ তাহলে শিয়ালবাড়ির ওই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতটা নিচু ধারণা করতে পারতাম না। মানুষ যত নিচই হোক, তবুও ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা একেবারেই উবে যেত না, আর মানুষ কেন, কোনো প্রাণিই কি পারে এত নির্মম, এত বর্বর, এতটা বোধহীন হতে?
… শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চাই না বলে মাটি, ভুল বললাম মানুষের হাড়ের ওপর বসে পড়তে হয়েছে। সারা এলাকার মানুষের হাড় ছাড়া অবিমিশ্র মাটি কোথায়? আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।’’
মানুষ কতটা পাশবিক হতে পারে আমাদের যাদের জানা নেই
তাদের আর কষ্ট করে বিশ্বজোড়া পাশবিকতার ইতিহাস পড়ার দরকার নাই,
আমাদের দেশই যথেষ্ট,
আমাদের দেশই সেরা…
চার.
এরপর আপনাদের সাথে যেই ব্যাক্তিটির পরিচয় করিয়ে দেবো তার নাম হেনরিখ বোয়েরে (Heinrich Boere)। নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন এই ব্যাক্তিটি একজন যুদ্ধাপরাধী। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখে ৯২ বছর বয়সী নিজের মৃত্যুদণ্ডের সাজা ভোগ করতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা এই নরপশুটির কথা আরেকবার সামনে নিয়ে আসার কারণ দুটি। এই নরপশু আমাদের চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রচারিত দুইটি বড় বড় অপপ্রচারের জবাব দেবেন।
প্রথমে হেনরিখ সাহেবকে নিয়ে কিছু জেনে নেয়া যাক। উল্লেখ্য জার্মানির বিচারিক আদালতে স্পষ্ট যে, বয়স যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারে না। এই সাবেক নাজি সদস্যকে ২০১০ সালের ২৩ মার্চ জার্মানির একটি কোর্ট যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে হেইনরিখ বোয়েরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডসের তিন বেসামরিক নাগরিককে হত্যার দায়ে আদালত তাকে এ দণ্ড প্রদান করে। দণ্ড প্রদানের সময় হেইনরিখ বোয়েরের বয়স ছিল ৮৯ বছর। তাই এ ডাচ নাগরিকের পক্ষে বার্ধক্যজনিত দণ্ড মওকুফের বিষয়টি তোলা হয়। কিন্তু আদালত যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।
এবারে আসি যে দুটো অপপ্রচারের কথা বলবো তা নিয়ে।
প্রথম অপপ্রচারটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যনালে যেসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে তাদের বেশীরভাগের বয়স নাকি ১৯৭১ সালে এতই কম ছিলো যে তাদের পক্ষে কোনমতেই গনহত্যা-খুন-ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি প্রতিটা রায়ের পর রাজাকারদের আণ্ডা-বাচ্চারা মিডিয়ার সামনে কাউকাউ করেছে তাদের বাপেরা নাকি যুদ্ধের সময় নাবালক ছিলেন সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ কাল্পনিক-ভিত্তিহীন-অন্তঃসারশূন্য-রাজনৈতিকউদ্দেশ্যপ্রণোদিত… ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের অনেক সুশীলেরা এসব আর্গুমেন্ট গিলেছেনও।
আমার পরিষ্কার মনে পড়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডঃ জাফরুল্লাহ সাহেব খুব দুর্দান্ত প্রতাপে কাদের মোল্লার পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন- “আপনারাই বলেন,এই টুকু ছেলের পক্ষে কি গনহত্যা করা সম্ভব…?”। এদিকে আমাদের মেশিন বালক সাইদি সাবের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের সময় এতই ছোট ছিলেন এতই ছোট ছিলেন যে কেউ কেউ পারলে বলেই ফেলেন ১৯৭১ সালে সাইদি সাবের জন্মই হয় নাই।
আর দ্বিতীয় অপপ্রচারটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামের আমির গোলাম আযম সাহেবকে নিয়ে। কুখ্যাত গনহত্যার মাষ্টারমাইন্ড এই মানুষটির আইনজীবীরা প্রকাশ্যে বলে এসেছে পৃথিবীর ইতিহাসে নাকি এত বৃদ্ধ বয়সে কোন মানুষকে বিচার করার নজির নাই। রাজাকার আলবদরদের পৃষ্ঠপোষকেরা গোলামের জানাজায় গিয়ে বলেছিলো- রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই এরকম একজন বৃদ্ধ মানুষকে অপদস্থ করা হচ্ছে, যার নজির পৃথিবীতে নাই।
মনে আছে বিভিন্ন দেশের ইসলামিক কর্মীরা গোলামের বিচারের ঘটনা অমানবিক বলে উল্লেখ করে। আন্তর্জাতিক মুসলিম স্কলারস ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-কারাদাউই এই গ্রেফতারকে “মর্যাদাহানিকর” বলে উল্লেখ করেন ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাকে অতিশীঘ্রই মুক্তি দেওয়ার অহ্বান জানায়। তিনি বলেন, “অধ্যাপক গোলাম আযম ও তার সহকারী পন্ডিতবৃন্দদের এবং ইসলামিক কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত ৪০ বছর পূর্বের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অযৌক্তিক ও গ্রহনযোগ্য নয়।”
বৃদ্ধ গোলাম আযমের এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে অন্তজার্তিক কয়েকটি সংস্থা সমালোচনা করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
পাচ.
এতগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে আমার তেমন কিছুই লাগে নাই। শুধু লেগেছে সবগুলো নরপিশাচের রায়, একটা ক্যালকুলেটর আর নরপিশাচগুলার বায়োগ্রাফি। আসুন কথা বার্তা বাদ দিয়ে ক্যালকুলেটরে হিসেব কষি। হিসেবের সুবিধার জন্য দিন বাদ দিয়ে দিলাম, শুধু মাস আর বছরের হিসাব করবো
নাজি যুদ্ধাপরাধী হেনরিখ বোয়েরের জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯২১।
হিসেব করে দেখা গেলো সে হতাকান্ড শুরু করে ১৯৪৩ সালের শুরু থেকে
হিসেবে তখন তার তার বয়সঃ ২১ বছর ৩ মাস
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের ১৬ নাম্বার প্যারা অনুসারে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৪৮। ট্রাইব্যুনালের দেয়া কাদের মোল্লার রায়ের ১৭ নাম্বার প্যারা অনুসারে তার জন্ম ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে এবং সাইদি সাবের রায়ের ১৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে তার জন্ম ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে।
সুতরাং ১৯৭১ সালে;
মুজাহিদ বয়স ছিলোঃ ২৩ বছর ১ মাস।
কাদের মোল্লা বয়স ছিলোঃ ২২ বছর ৬ মাস।
আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বয়স ছিলোঃ ৩১ বছর ১ মাস
তিনজনই হেনরিখ বোয়েরের চেয়ে যথাক্রমে ১,২ এবং ১০ বছরের বড়। সুতরাং হেনরিখ বোয়েরে যদি ২১ বছর বয়সে যুদ্ধাপরাধ করতে পারেন তাহলে মুজাহিদ-মোল্লা-সাইদি সাহেবরাও পারেন।
প্রথম প্রপাগ্যান্ডার জবাবটি শেষ হলো এবার আসুন দ্বিতীয় প্রোপ্যাগান্ডায়। গু আযমকে কি সত্যিই এত বেশি বয়সে বিচার করা হয়েছে যেই বয়েসে মানুষের বিচার করার নজির পৃথিবীতে নাই? জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা আন্তর্জাতিক মুসলিম স্কলারস ইউনিয়নের কথা শুনলে সেরকমই মনে হয়।
অথচ হেনরিখ বোয়েরের বিচার শুরু হয় ৮৯ বছর বয়সে তখন কিন্তু জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা আন্তর্জাতিক মুসলিম স্কলারস ইউনিয়নের কাছে খারাপ লাগেনি। খেয়াল করে দেখুন আন্তর্জাতিক মুসলিম স্কলারস ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-কারাদাউই বক্তব্যের কথা
“অধ্যাপক গোলাম আযম ও তার সহকারী পন্ডিতবৃন্দদের এবং ইসলামিক কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত ৪০ বছর পূর্বের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অযৌক্তিক ও গ্রহনযোগ্য নয়।”
অর্থাৎ অভিযোগ যেহেতু ৪০ বছরের পুরনো তখন তা অবশ্যই “অযৌক্তিক ও গ্রহনযোগ্য” হতে হবে।
আমার ভাঙ্গা ক্যালকুলেটরে হিসেব করে দেখলাম ১৯৪৩ সালে সংগঠিত কোন অপরাধের বিচার ২০১০ সালে করতে আসলে সময়ের পার্থক্য হয় ৭৩ বছর। ১৯৪৩, ১৯৪৪, ১৯৪৫ সালে সংগঠিত অনেক অপরাধের বিচার আজও হচ্ছে অর্থাৎ অপরাধ সংগঠনের ৭৫ থেকে ৮০ বছরের পরেও!
ছয়.
এরিখ প্রিবক (Erich Priebke)-ছিলো জার্মান নাৎসি বাহিনীতে ক্যাপ্টেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে তিনশ লোককে ধরে একটা পাহাড়ি এলাকায় একদিনে হত্যা করে ফেলল বেটা। ঘটনার পঞ্চাশ বছর পর ১৯৯৪ সালে বেটার মনে হইল বহুদিন হইসে- এবার মুখ খোলা যায়, তারপর বিবিসির সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকারে সবকিছু বলে দিলো গর্ব ভরে। ততদিনে প্রিবক আর্জেন্টিনা পাড়ি দিয়েছে।
তারপর আর কি; পাবলিক ক্ষেপে গেলো। একে তো রাজাকার তার উপ্রে স্বীকারোক্তি দেয়- জায়েজ করতে চায়! কাদের মোল্লা কেইস আরকি- যাবজ্জীবনে পাবলিক যত না ক্ষেপসিলো তার চেয়ে বেশি ক্ষেপসিলো দুই আঙ্গুল তুইলা ভি দেখানোতে। যাই হোক গণহত্যার দায়ে ইতালির মানুষজন তার বিচারের দাবি উঠাইলো।
ইতালি সরকার আর্জেন্টিনার কাছে প্রিবককে ফেরত চায়। আর্জেন্টিনা থেকে প্রিবককে ইতালি ফেরত আনা হয় ১৯৯৫ সনের মার্চ মাসে। তারপর শুরু হয় বিচার।
সেই বিচারের ম্যালা কাহিনীর পর বেটার যাবত জীবন কারাদণ্ড হইসিলো।
তবে ব্যাপার সেটা না। ব্যাপার হচ্ছে ২০১৩ সালে ১০০ বছর বয়সে জেলখানায় ক্যাপ্টেন এরিখ প্রিবরের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তার লাশ ইতালির মাটিতে রাখতে দেয়নি সে দেশের মানুষ। গণ আন্দোলনের মুখে তাকে আর্জেন্টিনা পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়; তারাও লাশ নিতে রিফিউজ করে। সেই যুদ্ধাপরাধীর লাশ কিছুদিন পড়ে ছিলো মর্গে, কেউ কেউ বলছিলো তাকে পুড়িয়ে ছাই এমন জায়গায় ফেলা হোক কেউ যাতে জানতে না পারে।
শেষমেষ তার পরিবার সংবাদ সম্মেলন করে বলে-
প্রিবকের লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না…
সাত.
সাইদীকে সনাক্ত করে সাক্ষী দেয়ার অপরাধে-রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গোলাম মোস্তফাকে ঘরের সিঁধ কেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। গোলাম মোস্তফার স্ত্রী স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাঁকেও কুপিয়ে আহত করা হয়।
গোলাম মোস্তফা ছিলেন বিশবালী হত্যা মামলায় আট নাম্বার সাক্ষী। আদালতে উপস্থিত থেকে আসামী সাইদীকে সনাক্ত করেন তিনি এবং একই সাথে এই হত্যা মামলা সাইদী জড়িত থাকার পক্ষেও সাক্ষ্য দেন তিনি। সেই বিশাবালী হত্যা মামলায়ই সাইদীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো নিম্ন-আদালত।
সবকিছু বাদ দিয়ে একটু ঘুরে আসি নিহত গোলাম মোস্তফার পরিবারের কাছ থেকে। মোস্তফা ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি, তাঁকে হত্যার পর তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাঁর স্ত্রীর। কেউ তাঁদের পাশে নেই। গোলাম মোস্তফার মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ছেলে হাফিজুল বাজারে একটা ছোট চায়ের দোকান দেয়। এখনো নিয়মিত হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে তাকে। রায়ের আগের দিন পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছিলো হাফিজুলকে।
গোলাম মোস্তফা মারা যাবার পর পাড়েরহাট বন্দরে ছোট চায়ের দোকানের আয়েই কোনো রকমে সংসার চলছে। কিন্তু রায়ের পরবর্তী সহিংসতার আশংকায় কয়েকদিন সেই চায়ের দোকান বন্ধ থাকায় তাঁদের খাবারের বন্দবোস্ত হয়নি।
আজ রাতও এই পরিবারটির হয়তো ভাত জুটবে না…
কেন জানি না এই লেখাটা লিখতে লিখতে চোখে পানি আসে…
আর ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিতে এসে সাক্ষীরা একে একে মরে যায়…
সাক্ষী দেয়ার অপরাধে মৃত সাক্ষ্যদাতার পুত্রটিও মৃত্যুর হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়…
মৃত সাক্ষীর পরিবার অভুক্ত-অর্ধভুক্ত থাকে দিনের পর দিন…
আর সাইদীদের জন্য প্রতিদিন হরেক রকম খাবার…
মণ্ডা মিঠাই, মধু আর অলিভ অয়েল…
আট.
উপরের আইসক্রিমটার নাম- “ওয়ার ক্রিমিন্যাল আইসক্রিম”, এক এক পিসের দাম ৪.৭০$
এ বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৭০তম বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ গণহত্যার কথা এখনো ভুলতে পারে না যে কয়টা দেশ তাদের একটার নাম চীন। জাপানের সেনা বাহিনীর বর্বরতার কথা এখনো তারা স্মরণ করে। এবছর তারা সেই দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করছে বিভিন্ন ভাবে।
তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জেনারেল তোজো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত এক ট্রাইব্যুনাল পার্ল হারবারের ঐতিহাসিক আক্রমণ সহ নানাবিধ অপরাধের সুপেরিয়র রেসপন্সিবলিটির দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭০-বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনের একটি আইসক্রিম কোম্পানি সেই জেনারেলের মাথার মত দেখতে একটি আইসক্রিম বাজারে এনেছে। এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে যারা জেনারেল সাহেবকে কাঁচা চিবিয়ে খাওয়ার ইচ্ছাকে পুরোটা পূরণ করতে নয়া পারলেও প্রতীকী একটা অপমানের সুবর্ণ সুযোগ বলতে হবে।
যেসব বারহশাবক মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যেতে বলে তাদের এটা দেখান। স্মরণ করিয়ে দিন এই ছবি ৭০ বছর পুরনো অপরাধের প্রমাণ বহন করছে, স্মরণ করিয়ে দিন শুধু আমরা না এরাও ঘৃণার চাষাবাদ করে।
যাদের ওপর নির্যাতন হয়েছিলো খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারা-তাদের পরিবার কেউ হয়ত বেঁচে নেই, বেঁচে থাকলে হয়ত আছেন গুটিকয়েক, তাই বলে সেইসব জাতি কিন্তু সবকিছু ভুলে যায়নি। একই সাথে আরেকটা কথা জানিয়ে দেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধিদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল কিন্তু ৭০ বছর বাদে এখনো কাজ করে চলছে।
আজ থেকে পঞ্চাশ একশ বছর আগে ঘটে যাওয়া বিস্মৃত গনহত্যার কথা আজও সেসব মানুষ মনে রেখেছে, সেসব গনহত্যা নিয়ে আজেবাজে কথা বললে বিচারের ব্যাবস্থা করেছেছে। অথচ এইসব আজেবাজে কথা শোনা এবং সশোনার পর আহত হবার জন্য কোন ভিকটিমের পরিবার কিন্তু বেঁচে নেই।
আর আমাদের দেশে এখনও পায়ে গুলি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছেন,
ধর্ষণের বীজ নিয়ে বীরাঙ্গনারা বেঁচে আছেন,
শহিদ বুদ্ধিজীবীর শার্ট বুকে নিয়ে সন্তান বেঁচে আছেন…
তবুও এই আধুনিক সভ্যতায়-
পুরো মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করলেও কিচ্ছু যায় আসে না…
নয়.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ২৬,০০০ আমেরিকান যুদ্ধবন্দি নিজেদের ক্যাম্পে বন্দি রেখে নির্যাতন চালায়। আমেরিকার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় তাদের ৪০% বন্দি অবস্থায় মারা যায়। জীবিতদের ১৬,০০০ যুদ্ধবন্দিদের ৬০টি জাপানি কোম্পানিতে জোর-পূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে।
যুদ্ধ শেষ হবার পর সেসব বন্দিদের অনেকেই হয়ত নিজের দেশে ফিরে আসে। এরপর কেটে যায় ৭০টা বছর, এতগুলো দিনের পর সেসব নির্যাতিত মানুষদের বেশীর ভাগের মৃত্যু হয়েছে। হয়ত বেঁচে আছেন গুটি কয়েক, কিন্তু সেসব নির্যাতিত মানুষগুলোর পরিবার এখনো ভুলতে পারেনি তাদের স্বজনদের দুঃসময়ের স্মৃতি। নিপীড়িত সেসব মানুষেরা এবং তাদের পরিবারেরা এখনো জাপানের সরকার এবং সেই সব নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবী করে আসছে। আজ ৭০ বছর পরেও।
জাপানি বিখ্যাত কোম্পানি মিৎসুবিশি সেইসব বিজনেস জায়েন্টদের একজন যারা প্রায় ৯০০ আমেরিকান নাগরিককে জোর পূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে। ধারণা করা হয় এই ষাট কোম্পানিতে কাজ করা ১৬,০০০ মানুষের ভেতর ১০০০ মারা যায়।
২০১৫ সালের জুলাই মাসের বিশ তারিখ। মিত্সুবিশির জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা হিকারু কিমুরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন প্রাক্তন মার্কিনবন্দীর কাছে সামনা সামনি তার পূর্ব পুরুষের আচরণের দুঃখ প্রকাশ করে। হিকারু কিমুরা বলেন
“‘এটা একটা মাইল ফলক, প্রধান জাপানি কোন কোম্পানি কখনো এই ধরনের কাজ কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিনি। আমরা আশা করবো অনান্য কোম্পানি গুলো আমাদের মত একই কাজ করতে উদ্দীপত হবে। আমরা আরও আগে দুঃখ প্রকাশ না করার জন্য ক্ষমা প্রার্থী”
সেই অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক ভাবে একজন যুদ্ধবন্দি জেমস মারফির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। ৯৪ বছর বয়স্ক জেমস মারফি এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন লস এঞ্জেলস থেকে। সেই সময় মিৎসুবিশিতে কাজ করা শ্রমিকদের মাত্র তিন জন জীবিত আছেন তাদের মাঝে কেবল ৯৪ বছর বয়স্ক জেমস মারফিই এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার মত শারীরিক সক্ষমতা রাখেন। মারফি বলেন-
“এটি একটি মহিমান্বিত দিন…”
“৭০ বছর ধরে আমরা এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম…”
৯০ বছর বয়সি অন্য এক যুদ্ধবন্দির স্ত্রী বলেন-
“তাদের এই কাজ ১৯৫০ সালেই করা উচিত ছিলো। এই ক্ষমা কিন্তু যারা এই অপরাধ করেছে তাদের মুখ থেকে আসছে না বরং তাদের নাতি নাতনিদের কাছ থেকে আসছে। তাই মানুষ এই ক্ষমা গ্রহণ করবে কি না সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।”
সেইসব যুদ্ধবন্দীদের পরিবার জাপান সরকার এবং জাপানের সেসব ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের কৃতকর্মের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিপূরণও দাবী করে।
দশ.
মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আজ থেকে ৪৪ বছর আগে। তিরিশ লাখ মৃত্যু, সাত লাখ ধর্ষণ, এক কোটি দশ লাখ শরণার্থী। যুদ্ধবন্দি তো বাদ দিলাম যুদ্ধাহত মানুষ পাওয়া যায় এখনো। অপারেশন করে পেটের ভেতর গুলি পাওয়া যায়। দুই বছর আগেও বধ্যভূমি আবিস্কার হয়েছে। আসেন একটা গল্প শুনি-
মুক্তিযুদ্ধের সময় মমতাজ বেগমের বয়স ছিল ২৫-৩০ বছর। তার নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক। উদ্ধৃত করছি ডক্টর এম এ হাসানের প্রামাণ্য গ্রন্থ “যুদ্ধ ও নারী” থেকে-
“গণ্ডগোল শুরু হওয়ার পর থাইকাই তো পালাইয়া পালাইয়া বেড়াইছিলাম। একদিন সৈনিকেরা ঐখানে নিছে, কালাই ক্ষেতে। তখন নয় মাসের বাচ্চা পেটে। ছেলেটা হইছিল। পেটে বাচ্চাটা তহনই পইড়া যায়। তহন তো আমার অবস্থাও যায় যায় করে। এক দিকে এই অত্যাচার আবার অন্য দিকে পেটের সন্তানও মারা গেছে। এক ভাবে তো বাইর করতে হইবো…
আমার অবস্থা ক্রমে খারাপ হইতেসে। এক সময় আমাকে বাঁচানোই দায় হইয়া পড়ছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন গ্রামের লোকেরাই আমারে বাঁচানোর জন্য আগাইয়া আইল। তখন তারা দা,বটি দিয়ে ছেলেটারে কাইটা কাইটা পেট থেকে বের করে…
তখন দেখে যেই সন্তান ছেলে সন্তান। তারপর তো আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়। তখন আমারে তাড়াতাড়ি করে মেডিকেলে নিয়ে গেল। ৪ বৎসর রইছি মেডিকেলে। নির্যাতনের কারণে পায়খানার রাস্তাটা আর সন্তানের রাস্তা এক হইয়া গেছিল। অপারেশন করতে হয়, পাঁচটা বড় বড় অপারেশন…
এই জায়গাটা এভাবেই আছে, সেই ৩০ বছর ধরে এভাবেই। এই পর্যন্ত কত কষ্ট করতাছি। সারাদিন ডোমা- নেকড়া দিয়া পেঁচায়া রাখি…
ঐ যে খাঁচাটা আছে না,তার মধ্যে জমাই। পরে একবারে নিয়া ধুইয়া আনি। সারাদিন কি ধোয়া সম্ভব। একটু পর পর ডোমা পাল্টাতে হয়। এই পাঁচ,দশ মিনিট পরপর…
রাস্তা দুইটা এক হওয়াতে পায়খানার রাস্তা খুবই খারাপ হয়ে যায়। তাই পায়খানার রাস্তাটা পেটের ঠিক নাভির পাশে করিয়ে দেয়। তাই কোন নির্দিষ্ট সময়ে তা করতে হয় না। সারাক্ষণই পায়খানা বের হতে থাকে। তাই এই ডোমা দিয়ে রাখি। গায়ে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। ঐ কাজ করার পরে তো পায়খানা আর পেশাবের রাস্তা এক হয়ে গেছে। ২ টা পর্দা আছে না, এক হয়ে গেছে। পরে পায়খানা সারাক্ষণ আসতেই থাকে সন্তানের রাস্তা দিয়ে। জরায়ু কয় না, জরায়ু দিয়েও পায়খানা আসে…”
এগারো.
এই বীরাঙ্গনা মমতাজ ৪৩ বছর ধরে গায়ে দুর্গন্ধ নিয়ে, পস্রাবের রাস্তা-পায়খানার রাস্তা-জরায়ু একত্রে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যান। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই তাকে দাফন করা হয়।
পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে শেখায় কোন যুদ্ধ হয় নাই সব ভারতের ষড়যন্ত্র…
শর্মিলা বসুরা গবেষণা করে বের করে বাঙালি মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় ইজ্জত দিয়েছে…
বাঙালিরা বলে পুরান ইতিহাস নিয়ে এত লাফালাফি কেন…
৪০ বছর অনেক সময় ভুলে যাও সামনে আগাও…
হায়রে বাঙালি…
অনবদ্য রচনা
অত্যন্ত ভালো একটা লেখা। লেখককে অজস্র ধন্যবাদ এরকম একটা লেখা উপহার দেবার জন্য।
ইহুদিরা ভোলে নি কিন্তু আমরা বাঙালিরা ভুলে গেছি। তুলনাটা অসাধারণ। ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিই। কিন্তু এখানে কেউ শিক্ষা নিতে নারাজ। সবাই ভুলতে চায়।
লেখাটি ভালো লেগেছে।
চল্লিশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই অত্যন্ত সম্মানজনক জীবন যাপন করে স্বর্গ লাভ করেছে। দু’একজনের বিচার হতে দেখেছি অবশ্য আমরা। বাকিদের হবে কি?
দুই নর-ঘাতক কুখ্যাত সাকা- মোজা জালিমের ফাঁশির রায়ের আগে এমনতর সুলিখিত তথ্যবহুল লেখাই এমূহুর্তে দরকার ছিল।
জয়তু মুক্তমনা।
পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে শেখায় কোন যুদ্ধ হয় নাই সব ভারতের ষড়যন্ত্র…
শর্মিলা বসুরা গবেষণা করে বের করে বাঙালি মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় ইজ্জত দিয়েছে…
বাঙালিরা বলে পুরান ইতিহাস নিয়ে এত লাফালাফি কেন…
৪০ বছর অনেক সময় ভুলে যাও সামনে আগাও…
হায়রে বাঙালি…
এক কথায় অসাধারণ আরিফ। জাস্ট অসাধারণ
ধন্যবাদ দাদা
মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্বাপরাধী এই দুটো শব্দের উপর কত কিছুই না পড়েছি। এ লেখাটি ভালো লাগা লেখাগুলোর একটি। ধন্যবাদ আপনাকে।
সময়োপযোগী লেখা। বীরাঙ্গনা মমতাজ ৪৩ বছর ধরে সীমাহীন কষ্ট করে মারা যান। তার কপালে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান জটে না। অন্যদিকে আমাদের চুশীল সমাজবাদীদের পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। দাবী তোলা হয় শহীদ মিনারে নিয়ে গিয়ে সম্মান জানানোর জন্য! একটা দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস কোন ফেলনা জিনিস না – এই কথাটা সবাই বুঝবে কবে?
একটি ভালো লেখা। যুক্তি আর প্রমানের সমন্বয়ে সময়োচিত লেখা। আশাকরি অনেক কূটতার্কিকের মুখ বন্ধ বা মুখোশ খুলতে কার্য্যকরি হবে…।