লেখকঃ অনিন্দ্যসুন্দর চক্রবর্ত্তী
[প্রসঙ্গঃ ২০১৫ সালে কোলকাতায় মুক্তি প্রাপ্ত একটি ছবি। নাম- নির্বাক; পরিচালক- শ্রী সৃজিত মুখোপাধ্যায়; প্রযোজক-শ্রীভেংকটেশ ফিল্মস।]
যুগ যুগ ধরিয়া বাস্তবের প্রতিচ্ছবির উপর ‘দাগা বুলাইতে’ বুলাইতে মানুষ নিদারুন ক্লান্ত হইয়া পড়িলে পর কিছু শীল্পি বাস্তবের বজ্রকঠিন সীমানা ভাঙ্গিয়া, তাহার আটশাট বাঁধনকে শীঁথিল করিয়া তুলিতে সচেষ্ট হন। বাস্তব ত্যাগ না করিয়া কেবল তাহার শরীরে কিছু মোচড় লাগাইয়া শীল্প-সাহিত্যের বাস্তব-অচলায়তনে তাঁহারা একটি সফল গতি আনেন। সেই গতির-ই বলে শিল্প-সৃষ্টি পরা-বাস্তব, যাদু-বাস্তব ইত্যাদি নানা খাতে বহিতে শুরু করে।
গতরাত্রে একটি বাংলা চলচ্ছবি দেখিতেছিলাম। আমি চলচ্ছবির বিশেষজ্ঞ বা সমালোচক নহি। আমার সে শিক্ষার অধিকার নাই। আমি নিতান্ত বায়েন-গায়েন মানুষ। তথাপি কিছু একটা দেখিয়া শুনিয়া কেবল জড়বৎ নিস্পৃহ থাকা যায় না! অতয়েব এই দুই চারিটি কথা। বাতুলতাই বলা যায়।
চলচ্ছবিটি পরাবাস্তব (মানে উহার-ই মতন কিছু) উপাদানে সমৃদ্ধ। কিন্তু কেবল তাহাই নহে সমাজ হইতে বহিষ্কৃত এবং স্থবির সমাজে নিন্দিত ও স্বল্পচর্চিত কিছু বাস্তব যেমন নারসিসিস্ম ও নেক্রোফিলিয়া-ও এই ছবির প্রধান উপজিব্য। এই সব আসক্তি বিকার কিনা সেই প্রশ্নে যাওয়া নিরর্থক এবং এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক। প্রচলিত ও সরলীকৃত মর্যা ল মাপকাঠিতে জগত বিচারে আমার রুচি নাই। কিন্তু ছবি দেখিয়া মনে হইল পরিচালক মহাশয় নিজেই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না উহা বিকার না রোম্যান্টিক! যেহেতু এটি কোন তথ্য-চিত্র নহে পরিচালকের-ই মানস-জাত তাই তাঁহার নিরপেক্ষ থাকিতে চাহিবার বাসনা-ও যদি থাকে সে গুড়ে বালি (যদিও তথ্যচিত্রেও কতদূর নিরপেক্ষ থাকা যায় সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে)।
ধরিয়া লইলাম তিনি রোম্যান্টিক পন্থি। বিকারপন্থি নন। ভালো কথা। কিন্তু প্রথম অংশে নারসিসিস্টিক বৃদ্ধের একদিনের জীবন দ্যাখাইয়া যে কি রাজকার্য সমাধা হইল তাহা বোধগম্য হইল না! ধরুন একটি সচারচ দ্যাখা যায় এমন ব্যক্তির জীবন লইয়া গল্প লিখিতে বসিলাম। এবং সে গল্পে লিখিলাম এক ব্যক্তি প্রেমে পড়িয়াছেন। তিনি সকালে উঠিয়া স্নানাদি সম্পন্ন করিয়া, প্রেমিকার সাথে নানা স্থানে দিন কাটাইয়া, দোকানে ঘুরিয়া জামা খরিদ করিয়া, হোটেল-রেস্তোরায় পানাহার সারিয়া বাড়ি ফিরিলেন। অতঃপর রাত্রে প্রেমিকার কথা স্মরন করিয়া হস্তমৈথুন পূর্বক নিদ্রা দিলেন। পরদিন পা পিছলাইয়া পড়িয়া গেলেন এবং সম্ভবত মরিলেন । কেমন গল্প হইল? কিছুই হইল না। ইহাতে মূল দ্বান্দিক রসদটির অভাব। চলচিত্রটির প্রথম গল্পেও ওই রসদটি-ই অনুপস্থিত। আর সেই অনুপস্থিতি কেবল আত্মপ্রেমের মোচড় দিয়া পূরন করা অসম্ভব। তাহাতে কৌটার আকার কিঞ্চিত আকর্ষনীয় হয় কিন্তু উহা শূন্য-ই থাকে। এই দোষে সমগ্র ছবিটি-ই দুষ্ট।
ছবিতে আর একটি স্বল্প চর্চিত বিষয় নেক্রোফিলিয়া। এক ব্যাক্তি এক মৃত নারীদেহের প্রেমে পড়েন। তাহার পরের ঘটনা স্বল্পই এবং তাহা একদম সাধারন প্রেম কাহীনিতে যেমন হয় তেমন-ই। অর্থাৎ লোলুপ, বলবান, মাস্তান প্রতিদ্বন্দী পুরুষদিগের লালসা হইতে প্রেমিকাকে বাঁচাইতে প্রেমিকের লড়াই ও মৃত্যুবরণ। তা ইহাই যদি এই অংশের উপজিব্য হয় তাহা হইলে নারীটিকে মারিবার যে কি প্রয়োজন ছিল তা ঠিক ধরিতে পারিলাম না। সে নারী জীবিত থাকিলে কাহীনির কোন পাকা ধানে যে মই পড়িত তাহা কেবল বিধাতাই জানেন। তদুপরি ইহাও জানিলাম যে মোকাম কলিকাতার বুকে একটি দুইটি নহে, দলে দলে লোক আছেন যাহারা নেক্রোফিলিক। তাহারা মৃতদেহ কামনা করেন। নির্মাতা নিশ্চয় অনুসন্ধানসমৃদ্ধ তথ্যই পরিবেশন করিয়াছেন। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!
এই হইল বাস্তব। উপরোক্ত দুইটি অংশের মাঝে ছবিটিতে আর-ও একটি অংশ (বাস্তব-ই বোধ হয়) বিদ্যমান। তাহা একটি সারমেয়র প্রেম! কিন্তু উহা দেখিয়া হাসিব না কাঁদিব নাকি গম্ভীর থাকিব তাহা এতাবধি স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই বলিয়া তৎসম্বন্ধে কিছু বলিলাম না।
ছবির অপর একটি দিক পরা-বাস্তব। যাহা বাস্তব কে অতিক্রম করে। যেমন একটি বৃহৎ মহীরূহ নিম্নে উপবিষ্ট এক তরুনীর প্রেমে পড়ে (এই তরুনীর মৃতদেহ লইয়াই উপরোক্ত রক্তক্ষয়ী বিবাদ ও হত্যা; যাক সে কথা)। শুধু ইহাই নহে সে বৃক্ষ হাসে, কাঁদে এবং একদিন সেই তরুনী বৃক্ষতলে নিদ্রিত হইয়া পড়িলে তাহার আংশিক অনাবৃত বক্ষ অবলোকন করিয়া হস্তমৈথুন করে ও উহার রেতঃস্খলন হয়। এই অংশ হইতে যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি দর্শক পাইয়া থাকেন সেইটি হইল যাহাই শুনিতে ভাল তাহা সর্বদাই দেখিতে ভালো হইবে এইরূপ স্থিরতা প্রত্যাশা করা নিতান্তই অনুচিত। এই শিক্ষা পরিচালকের নাই কিন্তু সফল ভাবে তিনি তাঁহার দর্শকদিগকে দিয়াছেন। বৃক্ষের প্রেম শুনিতে যতই কাব্যিক ও বৈপ্লবিক লাগুক বায়স্কোপে দেখিতে তাহা যে নিদারুন হাস্যকর লাগিল। উপরন্তু দেখিয়া মনে হইল না হাস্যরস আমদানি পরিচালক উদ্দেশ্য ছিল!
তদুপরি ছবি দেখিতে দেখিতে যে রাজনৈতিক সমস্যাটি উপস্থিত হইতেছিল সেইটি হইল, বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না কোনটি বাস্তব আর কোনটি পরা-বাস্তব। নারসিসিজ্ম বাস্তব, কিন্তু বৃক্ষের প্রেম পরা-বাস্তব। এক্ষনে বৃক্ষের রেতঃস্খলন দেখিয়া আমার মত নির্বোধ দর্শকের নারসিসিজ্ম বা নেক্রোফিলিয়া কেও বাস্তব অতিক্রান্ত কল্পনা বলিয়া ভ্রম হয়। অন্তত বিভ্রান্ত হইবার উপক্রম তো হয়-ই। যাহা সত্য (সে যতই স্বল্পসংখ্যক হউক) তাহাকে কল্পনা বলিয়া ভ্রম উৎপাদন করা রাজনৈতিক ভাবে সঠিক নহে।
সবশেষে পুজার বাজার, সর্দিগর্মি, সিপিএম-তৃণমূল দ্বন্দে ক্লীষ্ট কোলিকাতার বাঙ্গালীর পক্ষে নারসিসিজ্ম, পরা-বাস্তব কিম্বা নেক্রোফিলিয়া-র মধ্যে যেকোন একটি-ই যথেষ্ট ছিল। তাহার স্থলে তিন তিনটি চমক দিয়া বাঙ্গালীকে হেঁচকি তুলিয়া নির্বাক করিয়া দেওয়াই বোধকরি পরিচালকের উদ্দেশ্য ছিল। প্রবাসী হইবার সুবাদে আমার হেঁচকি ওঠে নাই; ছবি দেখিয়া হাসিয়া খুন হইবার জোগাড় হইয়াছিল।
হাসিয়া খুন হইবার জোগাড়ের নিমিত্ত পরিচালকের জন্য মামলা করা কর্তব্য কিন্তুক।
আজ্ঞে মামলা করিবার উৎসাহ পাইতেছি না। পরিচালক মহাশয় হাসাইয়াছে মাত্র, কাঁদায় তো নাই। যদিও কাঁদানো-ই বোধ করি উহার উদ্দেশ্য ছিল। সর্বপরি আমি সামান্য সঙ্গীতকার ও শিক্ষক আমার সামর্থ্য কই!
রিভিউ ব্যপারটি মজার। ভালো কিংবা কম ভালো দুটোই ভালো। না দেখে শুনেও দেখবার বা শুনবার ইচ্ছে জাগে। সমালোচনার মজাদার ভঙ্গিটি দেখে আপনার মতের কম ভালোকেও দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু ভায়া 🙂
ধন্যবাদ শ্রী কাজি রহমান। নিশ্চই দেখবেন। অন্তত দেখতে শুরু করাটাতো যেতেই পারে। এটি ঠিক রিভিউ নয়। ‘বলতে পারেন দেখে আমার যা মনে হল’… গোছের লেখা।
শ্রীজিত মুখার্জী ভাল পরিচালক। নির্বাক বাদে তার সব ছবিই দেখেছি। অটোগ্রাফ এবং বাইশে শ্রাবন ভাল লেগেছিল। যাই হোক এই রিভিউ পড়ে আর নির্বাক দেখার আগ্রহ পাচ্ছি না।
আপনাকে ধন্যবাদ শ্রী আলম লেখাটি পড়বার জন্য। নির্বাক ছবিটা একবার দেখে নিতে পারেন আমার কথা বিশ্বাস করে না দ্যাখাটা বুদ্ধিমানে মত কাজ নয়। 🙂 🙂