২০০৪ সালের শেষের দিকে মুক্ত-মনার সাথে আমার পরিচয়। বাসায় পিসি ছিলো কিন্তু ইন্টারনেট কানেকশন ছিলো না। আর তাই প্রতিদিন বিকালে যেতাম আম্বরখানার এক ছোট সাইবার ক্যাফেতে। ফ্লপি ভরে মুক্ত-মনার পিডিএফ ফরমেটের ফাইলগুলো নিয়ে আসতাম আর রাত জেগে পড়তাম। মুক্ত-মনার লেখা পড়ে এতোই আলোড়িত হয়েছিলাম যে একদিন সাহস করে দূর্বল ইংরেজিতে লিখে ফেলি অভিজিত দাকে এক ইমেল। অভি দা সেই ইমেলখানা ছেপে দেন মুক্ত-মনার ইয়াহু গ্রুপে। ইমেলটি মুক্ত-মনায় ইয়াহু গ্রুপে প্রকাশের পর তা থেকে আমার ঠিকানা সংগ্রহ করে একদিন অনন্ত আমার সাথে যোগাযোগ করে। সেই থেকে শুরু আমার আর অনন্তের বন্ধুত্ব।
এরপর প্রায় বিকেলে আমাদের দেখা হতো। কখনো পুরাতন মুসলিম সাহিত্য সংসদে, কখনো শাহজালাল ইউনিভার্সিটির প্রাঙ্গণে, কখনো ষ্টেডিয়ামের বাইরের গ্যালারিতে আবার কখনো হয়তো আম্বরখানার কোন সাইবার কাফেতে। বই বিনিময় হতো। অনন্তের বইয়ের সংখ্যা ছিলো আমার চেয়ে অনেক বেশি। ওর মাধ্যমেই আমি পরিচিত হয় প্রবীর ঘোষ, ভবাণী প্রসাদ সাহু, রাহুল সাংস্কৃতায়ন সহ অন্যান্য লেখকদের লেখনীর সাথে। সেই সময়েই অনন্তের কয়েকটি লেখা মুক্ত-মনায় প্রকাশ হয়েছিলো।প্রথমদিকে অনন্ত মূলত আরজ আলী মাতুব্বর, সুমিত্রা পদ্মানভান, জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় সহ আরো কিছু লেখকের লেখা টাইপ করে মুক্ত-মনায় পাঠায়। সেই সময়ে অনন্ত আমাকে উৎসাহিত করে মুক্ত-মনায় লিখার জন্যে। আমার পিসিতে বাংলা নেই শুনে বর্ণসফট ইনস্টোল করে দেয়। আমিও অনন্তের উৎসাহে মুক্ত-মনায় পাঠাই আহমেদ শরীফের একটি লিখা। ২০০৫ এর মার্চে আমি ইউকেতে চলে যাই। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই থাকে। আমি প্রতি সাপ্তাহে টেলোফোনে খবর নিতাম। অনন্তকের কাছ থেকেই জেনেছিলাম তার হাতের প্রতিষ্ঠিত “সিলেট বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদি কাউন্সিল” সব কার্যক্রমের কথা। খুবই রোমাঞ্চিত অনুভব করেছিলাম হখন শুনেছিলাম অনন্ত আর তার বন্ধুরা সিলেটের কয়েকটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের উদ্যোগে “মুক্ত-মনার” ব্যানার টাঙ্গিয়েছিলো। তখন ঘণ ঘণ ফোন করে জানতাম ব্যানারের খবর কি? শিবিরের ছাগলেদের রিয়েকশন কি? কয়েকদিন পর শিবিরের ছাগলগুলো সত্যি সত্যি নামিয়ে ফেলেছিলো সেই সব ব্যানার।
২০০৬ এর মেতে এ অনন্ত মুক্ত-মনা রেশোনালিষ্ট এওয়ার্ড পায়। আসলে সত্যি বলতে এওয়ার্ডের জন্যে “অনন্তকে” মনোনীত করতে বোধ হয় মডারেটরদের কোন বেশি ভাবতে হয় নি। অনন্ত তখন ছিলো মুক্ত-মনায় যেকোন ব্লগারের চেয়ে বেশি নিবেদিত প্রাণ, সবচেয়ে যোগ্য। বিজ্ঞানের প্রতি অনন্তের দূর্বলতা ছিলো অসীম। বিজ্ঞান বক্তা আসিফকে সিলেটে নিয়ে এসেছিলো অনন্ত। আমার সাথে অনন্তের কথোপকথনের অনেকটা জুড়েই থাকতো ওর ভালো লাগা বিজ্ঞানের কোন বইয়ের বাংলা অনুবাদের ব্যাপারে ওর চিন্তা ভাবনার কথা। খুব ভালো কয়েকজন সমমনা বন্ধু ছিলো ওর। ওদের নিয়ে সামনে আরো কিছু বিজ্ঞানের বই অনুবাদের পরিকল্পনা ছিলো ওর। দূর্ভাগ্য আমাদের মৌ্লবাদিদের হাতে অন্ততের এই মৃত্যু ভবিষ্যতে আমাদের অনেক ভালো বই প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। অনন্ত যে বিজ্ঞানমনস্কতার ছোট কাগজ ‘যুক্তির’ সম্পাদনা সহ “ডারউইন : একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা”,”পার্থিব”,”জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ” সহ আরো কিছু বইয়ের লেখক ও সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলো তা আমরা সকলেই জানি। তাই আমি এগুলোর সম্পর্কে আর আলোচনায় না গিয়ে অনন্ততের অসমাপ্ত একটা বইয়ের পরিকল্পনার কথা পাঠকদের সাথে শেয়ার করি। বইয়ের কন্টেন পরিকল্পনা থেকেই বুঝা যায় সম্পাদক হিসেবে অনন্ত কতটা বিজ্ঞান্ মনস্কো ছিলো, ছিলো চিন্তা ভাবনায় কতটা অগ্রসর। এ বছরের বইমেলার সময় অনন্ত জানিয়েছিলো আগামী বইমেলায় তার একটি বই নিয়ে পরিকল্পনার কথা। অনন্ত বলেছিলো
বইটার নাম হবে একুশ শতকের বিজ্ঞান। পাঁচ থেকে ছয়টা ক্যাটাগরিতে লেখা নেব ১০-১২টর মত।
যেমন : ১. Science & Education : সায়েন্টিফিক লিটারেসি নিয়ে লেখা। বিভিন্ন দেশের উপর জরিপ আছে এ-বিষয়ে। বিশেষ করে আমেরিকাকে নিয়ে আছে অনেক জরিপ। এই বিষয়ে লেখা। এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার হাল-হকিকত নিয়ে লেখা। ১ নাম্বার টপিক্সে ২ টা লেখা নিবো।
২. Science Vs Pseduscience : The Philosophy of Pseudoscience বিষয়ক লেখা। মাইকেল শারমারসহ আরো কয়েকজনের লেখা আছে। অনুবাদ করা লাগবে। বাংলাদেশ থেকে একজন লেখবে এ-বিষয়ে।
৩. Science & Philosophy : Basic Science vs Applied Science নিয়ে লেখা। এ-বিষয়ে আমার একটা লেখা আছে। সাথে কার্ল পপার, মাইকেল পলানিসহ আরো একাধিক লেখা দরকার পরবে।
৪. Science in Future: এই টপিক্সে অনুবাদ দরকার পড়বে। কার্ল সাগান, মিশি কাকু, রিচার্ড ডকিন্সসহ কয়েক জনের। মিশি কাকুর একটা বইই আছে এই বিষয়ে। বইয়ের নাম Physics of the Future। কনটেন্টগুলা ফাটাফাটি। কিন্তু এই বইয়ের উপর ভিত্তি করিয়া লেখা দিবার মতো লোক এক্কেবারে কম বাংলাদেশে।
৫. Science & Economics : সায়েন্টিফিক রিসার্চ আর ইকোনমিক্সের সম্পর্ক নিয়া লেখা। মিলিটারি সায়েন্সের পিছনে ব্যয়বহুল বাজেট আর পাবলিক হেল্থ, সিভিল ডিফেন্সের বাজেট কর্তন নিয়া লেখা। এ-বিষয়ে আমার নিজের লেখার ইচ্ছে আছে। তবে ভালা হইবো আনু মুহাম্মদ বা মুনীর উদ্দীন স্যার লেখা পাইলে। তারা এ-বিষয়ে অনেক এক্সপার্ট।
এছাড়া বিভিন্ন সময় অনন্তের সাথে কথোপকথোনের সময় অনন্ত আর যে সকল বইয়ের অনুবাদের ইচ্ছা প্রকাশ করে তার মধ্যে রয়েছে-
Ann Gibbons-এর The First Human: The Race to Discover Our Earliest Ancestors,John Reader এর Missing Links: In Search of Human Origins, Charles M. Wynn এর The Five Biggest Ideas in Science , Richard A. Muller এর Physics for Future Presidents: The Science Behind the Headlines।
লক্ষ্য করেছি অভিজিত দা আর অনন্তের মৃত্যুতে মুক্ত-মনার অনেক ব্লগাররাই এতোটাই মুষড়ে পড়েছেন যে তার আর লিখছেন না বা লিখবেন না বলে ঠিক করেছেন। মুষড়ে পড়াই স্বাভাবিক। দুই সাপ্তাহ হয়ে গেছে, অনন্তের খুনীদের ধরা হয় নি। ধরা পরেনি অভিজিত দার খুনিরা। কিন্তু আমাদের শেষ অস্ত্র তো সেই কলমই। তাই পরবর্তি প্রজন্মের জন্যে হলেও লিখতে হবে। আজ যারা চাপাতি হাতে ব্লগার হত্যায় মক্ত তাদেরই কারো সন্তানই হয়তো একদিন খুজে পাবে মুক্ত-মনা কিংবা যুক্তির কোন কপি। অভিজিত কিংবা অনন্তের কোন প্রবন্ধই হয়তো তাদের নতুন করে ভাবতে শিখাবে, প্রশ্ন করতে শিখাবে প্রচলিত বিশ্বাসের অসারতার বিরুদ্ধে। অনন্তের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও ভালো বিজ্ঞানের ভালো বই গুলো অনুবাদ করতে পারি। এক্ষেত্রে পুরো একটি বই কয়েকজন ভাগ করে অনুবাদ করা যেতে পারে। অনন্ত তার লেখার মাধ্যমে বেচে থাকবে অনন্ত কাল।
লেখা চালিয়ে যেতে হবে সবাই মিলে। এমন কি প্রকাশ করতে ভয় লাগছে তবুও লিখুন। রিখে নিজের কাছে সংরক্ষন করুন। একটু একটু করে ছড়িয়ে দিন। থামলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে।
Comment…থেমে থাকে না,আত্মত্যাগেই আসে বিজয়,সে দিন আর বেশি দূরে নয়, এ আমার মনোচক্ষুর চেয়ে দেখা প্রজ্ঞাময়ী বিশ্বাস।
জাহিদ রাসেল, বন্ধুর কথা লিখুন। তার সাথে আপনার কথোপকথন নিয়ে লিখুন। সবাই অনন্তকে অন্তরে অনুভব করুক সর্বক্ষণ।
বই অনুবাদের আইডিয়াটা ভাল। কাউকে না কাউকে উদ্যেগ নিতে হবে। ভাল থেকো। আরো বেশী লেখা চাই
জাহিদ, তোমার সাথে আমার একটা মিল খুঁজে পেয়ে আমি অসুখী হচ্ছি ঃ তুমি ও আমার মত মুক্তমনাতে অনিয়মিত; নিয়মিত লেখা চাই। খুব ভাল লাগল অনন্তের গল্প শুনে। থ্যাংকস।
অভি নেই, অনন্ত নেই। এক এক করে মেরে ফেলা হচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষদের। কার জন্য, কাদের জন্য কথা বলছি আমরা এক একটি ক্ষণজন্মা মানুষের জীবনের মূল্যে?
এ জাতি মগজের ভার সইতে পারে না । বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখায় আমার জ্ঞান বোধ কম । তবে আমি টুকিটাকি কিছু অনুবাদ করার অভিজ্ঞতা পেয়েছি । যদি নিজের জ্ঞানে না কুলায় তাহলে আরো দুই-একজন বিজ্ঞান মনস্ক মেধাবীর সহায়তাও পেতে পারি । আশা করি কিছুটা শযোগীতা করতে পারব ।
অনন্তের জন্য ভালোবাসা থাকবে অনন্তকাল।
কলম চলুক।
নতুন প্রজম্ম আর তাদের সন্তানরা মুক্তমনের মানুষ হোক। পুরোনোদের বদলানো খুব কঠিন। তবু, মূলত এই ব্লগটির কারণেই আমরা বদলেছি। অন্যদেরও বদলাতে চেষ্টা করেছি আমরা সবাই মিলে। প্রাণ দিয়ে। আমরা জেগে থাকবো; বাতিঘর হয়ে জ্বলব যতদিন থাকি। সবাই নিরাপদে থাকুন।
থাকনা হাজার অযুত বাধা, দীর্ঘ দূর যাত্রায় কিসের ভয়?
লিখাটা চমৎকার।
খুবই সত্যি কথা। হয়তো ঠিক আগের অবস্থানে ফিরতে একটু সময় নেবে, তবে ফিরবেই সেখানে। আমিও আশাবাদী। এ অচরায়তন তো ভাঙ্তে হবেই। আসুন চেষ্টা করি সবাই মিলে।