ভাষার কথা – কথার ভাষা
ইরতিশাদ আহমদ
[আগেভাগেই বলে নিই, এটা কোন গবেষণামূলক নিবন্ধ নয়। আমার ভাসা-ভাসা ভাষাজ্ঞান দিয়ে সেটি সম্ভব হতো না। তবে চিন্তা করার মতো দারুণ একটা ব্যাপার – ভাষা, আমার কাছে। এই লেখাটা ভাষা নিয়ে আমার কিছু এলোমেলো চিন্তার অগোছালো প্রকাশ। মুক্তমনার লেখক-পাঠকদের জন্য রইলো নতুন বছরের শুভেচ্ছা।]
শুনেছিলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্যপ্রার্থী একজন এসে বলেছিলেন, “বাবু, বড়ই দুরাবস্থা আমার, দয়া করে সাহায্য করুন”। বিদ্যাসাগর নাকি বলেছিলেন, “তা তো আকার দেখেই বুঝতে পারছি”।
শব্দটা হবে দুরবস্থা, দুরাবস্থা নয়।
ধ্বনি, শব্দ, বাক্য, (বাক্যের) অর্থ – এই চারের সমন্বয়ে ভাষা পূর্ণতা পায় [১]। আকার-ওকারের সঠিক ব্যবহার শব্দের সঠিক প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয়। এখানেই ধ্বনির সাথে শব্দের সম্পর্ক। শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয় বাক্য – তবে অর্থহীন বাক্য নয়। ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থপূর্ণ বাক্যের গঠন বা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। আর সমৃদ্ধি তার শব্দভান্ডারের বৈচিত্র্যে আর বিপুলত্বে।
প্রথমটা (ধ্বনি) আর শেষেরটা (অর্থ) নিয়ে বেশি কিছু বলার মতো বিদ্যা আমার ঘটে নেই – তাই এই আলোচনা সীমিত থাকছে শব্দ আর বাক্য নিয়ে। এ দু’টোতেও আমার জ্ঞানের দৌড় মোল্লার বাড়ি থেকে মসজিদের দুরত্বের বেশি হবে না। তবুও আমার আগ্রহ এ দুটোকে নিয়েই আপাতত।
আমি প্রথমে বাক্য নিয়েই একটু বকবক করবো, পরে শব্দ নিয়ে। মানুষের উদ্ভাবনা এই ভাষা, কিন্তু কোন ব্যক্তি-মানুষের নয়, সামগ্রিক সমষ্টির। বিশেষ কোন মানুষ ভাষা আবিষ্কার করে নি। মনের ভাব প্রকাশের জন্য কোন গোষ্ঠিভুক্ত সামগ্রিক মানুষ এই অভিনব, অত্যন্ত কার্যকর, এবং দারুণ জটিল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষার এই ‘সিস্টেম’টা (যুতসই বাংলা পেলাম না) গড়ে তুলেছে।
ভাষার এই গড়ে ওঠাটা, মানুষের বানানো হ’লেও এতটাই প্রাকৃতিক যে, স্বনামধন্য চার্লস ডারউইন একে তুলনা করেছেন তাঁর আবিষ্কৃত জৈব-বিবর্তনের প্রক্রিয়া ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনে’র সাথে।[২]।
বাক্য-গঠনের বৈশিষ্ট্যে পার্থক্যের জন্যই একেক ভাষা একেক রকমের হয়।
দেখি, বুঝিয়ে বলতে পারি কি না। বাংলা ভাষায় বহুল-কথিত একটা বাক্য হচ্ছে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাক্যটাকে অন্যভাবেও সাজানো যেতে পারে, অর্থের খুব একটা হেরফের না করে। যেমন –
আমি ভালোবাসি তোমাকে;
তোমাকে আমি ভালোবাসি;
ভালোবাসি আমি তোমাকে; ইত্যাদি।
নাটকে, গানে, কবিতায় একই অর্থবোধক এই কথাগুলো আমরা বিভিন্ন ভাবে শুনে থাকি। অর্থের তারতম্য না হলেও কথাগুলোর ব্যঞ্জনায় পার্থক্য আছে। খুব সুক্ষ্ম এই পার্থক্য, বাংলাভাষার দক্ষ লেখক বাক্য-গঠনে এই স্বাধীনতার সুযোগটা নিতে পারেন এবং নিয়ে থাকেন।
বাংলা ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় এই বৈশিষ্ট্যটা থেকে থাকতে পারে। কিন্তু ইংরেজিতে খুব একটা নেই। আমি যেহেতু বাংলা ছাড়া ইংরেজিটাই একটু-আধটু জানি তাই ইংরেজির উদাহরণই দু’একটা উল্লেখ করবো।
আই লাভ ইয়ু। বলে দেখুন অন্যভাবে (ইয়ু লাভ আই, লাভ ইয়ু আই, বা আই ইয়ু লাভ) কেমন বিদঘুটে শোনাবে। এমন কি কবিতা-গানেও মনে হয় এই ভাবে বলাটা গ্রহনযোগ্য হবে না। কিন্তু একটা ইংরেজি পদ্য শুনেছিলাম অনেক আগে। হাইস্কুলের ইংরেজি স্যারের কাছে। বিখ্যাত ইংরেজ কবি আলেক্সান্ডার পোপ নাকি ছোটবেলায় পড়াশোনা না করে শুধু ছড়া বানাতেন। একদিন এজন্য বাবার কাছে খেলেন পিটুনি। তখন তিনি বাবাকে মিনতি জানাচ্ছেন আর না মারতে, তাও আবার কবিতার ছন্দে। কিন্তু ইংরেজির বারোটা বাজিয়ে…।
Papa, papa, mercy take
Verses I shall no more make
আর একটা বিদঘুটে ইংরেজি বাক্য আমি প্রথম শুনি আমেরিকায় আসার পরে। এখনো শুনি এবং বলেও থাকি। কথাটা হলো – long time no see.
শুনে মনে হয়েছিল, ইংরেজিতে অনভ্যস্ত কোন কবিতাপ্রেমী বাংলাভাষীর বচন বুঝি। কারণ,‘দীর্ঘ সময় নাহি দেখা’ –এর আক্ষরিক অনুবাদ এই কথাগুলো। কিন্তু এটা বাংরেজি নয়, কথ্য ইংরেজি।
যাক্ এমন ব্যতিক্রমতো থাকবেই। ইংরেজিতেই বলা হয়, exception proves the rule।
ইংরেজির সাথে বাংলার আরেকটা বিরাট পার্থক্য আছে না’বোধক বাক্যে না এর অবস্থান নিয়ে। ‘আই ডু নট নো’ আর ‘আমি জানি না’ বাক্য দু’টিতে ‘নট’ আর ‘না’ এর অবস্থান লক্ষ্য করুন। ইংরেজিতে ক্রিয়ার আগে আর বাংলায় পরে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানাচ্ছেন আগে বাংলায়ও ‘না’ আসতো ক্রিয়ার আগে। ইংরেজ আমলে ধীরে ধীরে চলে আসে ক্রিয়ার পরে। এখনো বাংলাদেশের কোন কোন আঞ্চলিক ভাষায় ‘না’ ক্রিয়ার আগেই বসে। যেমন চট্টগ্রামের ভাষায়, ‘আঁই ন জানি’।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আমরা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের কাছে অতি বিনয়ী হতে গিয়ে ভাষায় পরিবর্তন এনেছি [৩]। পর্যবেক্ষণটা ভেবে দেখার মতো। ভাষার ওপরে রাজনীতি আর সমাজের যে প্রভাব পড়ে তার একটা দারুণ উদাহরণ এই ‘না’ এর স্থান পরিবর্তন।
এবারে নীচের বাক্য তিনটি লক্ষ্য করুন। একই বাক্য কাঠামো তিনটি কাছাকাছি ভাষায় –
চিন্তার কোন কারণ নেই (বাংলা)
চিন্তাকা কুই কারণ নেহিহে (হিন্দি)
সোচনেকা কুই বাত নেহিহে (উর্দু)
তিন ভাষাতেই বাক্য-কাঠামো একই, শব্দ ভিন্ন। আবার বাংলা আর হিন্দির মধ্যে শব্দের ভিন্নতাও খুব কম। বাক্য-কাঠামো বা গঠন একই বলেই তারা কাছাকাছি – শব্দের ভিন্নতা সত্বেও। ওপরের বাংলা আর হিন্দি বাক্য দুটোর মধ্যে পার্থক্য এতই কম যে একজন হিন্দিভাষীর বাংলা কথাটা বুঝতে বা একজন বাংলাভাষীর হিন্দি কথাটা বুঝতে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
যে কোন ভাষায় কথা বলতে বা লিখতে গেলে সে ভাষায় বাক্য গঠনের জ্ঞান থাকতেই হবে। তা না হলে বাক্য হবে অসম্পূর্ণ, অর্থহীন বা শিশুর আধো আধো বুলি। একথাটা বিশেষ করে প্রযোজ্য অনুবাদক বা দোভাষীর জন্য। বিভিন্ন ভাষার মধ্যে বাক্যগঠনের পার্থক্য বুঝতে না পারলে একজন অনুবাদক বা দোভাষী নিজে নানা ফ্যাসাদে পড়তে পারেন, এবং অন্যকেও বিড়ম্বনায় ফেলতে পারেন।
মাঝে মাঝে বেশ মজাদার পরিস্থিতিরও জন্ম দিতে পারেন। যেমন, বৃটিশ আমলের এই ঘটনাটা [৪]।
তখন বৃটিশ-ভারতের আদালতে ইংরেজ বিচারকদের সাহায্য করতেন দেশি দোভাষীরা (ইন্টারপ্রেটাররা)। একবার হয়েছে কি, আদালতে এক সাক্ষী বেশ উলটাপালটা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে শুরু করলো। এতটাই নির্জলা মিথ্যা যে জজ সাহেব বিরক্ত হয়ে দোভাষীকে বললেন, “প্লিজ টেল হিম নট টু টেল আননেসেসারি লাইজ”। দোভাষীর উর্বর মস্তিষ্কে কথাটা অনুদিত হলো নিম্নরূপে –
“শুধুমাত্র দরকার হলে মিথ্যা বলবেন (টেল লাইজ অনলি হোয়েন নেসেসারি)।”
এই ঘটনায় দোভাষী অনুবাদ করতে গিয়ে এতটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন যে, বাক্যের গঠনটাকেই পালটে দিয়েছেন – আর তাতে বাক্যটার সম্পূর্ণ নতুন যদিও হাস্যকর একটা অর্থ দাঁড়িয়েছে। (বলেছিলাম অর্থ নিয়ে কথা বলবো না, তবুও একটু বলতে হলো – কারণ বাক্যের গঠন আর তার অর্থ একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত।)
এবারে বলি লেখার ভাষা আর বলার ভাষায় পার্থক্য নিয়ে একটুখানি। আমি এখানে আঞ্চলিকতা-প্রভাবিত উচ্চারণের কথা বলছি না। ধ্বনির ওঠানামা, যা লেখার ভাষায় খুব একটা ধরা পড়ে না, শুধু কি ভাবে উচ্চারণ করছি তার ওপরে নির্ভর করে, তার কথা বলছি। (ধ্বনি প্রসঙ্গেও কথা বলবো না বলেছিলাম, তবুও না বলে পারলাম কই – ধ্বনির সাথে শব্দের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।)
ধ্বনি আর অর্থের সম্পর্ক নিয়ে আরেকটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। শব্দ আর বাক্য একই থাকলেও বাক্যের অর্থ পাল্টে যায় কি ভাবে দেখুন। ‘কি করছো?’ প্রশ্নটা খুব মোলায়েম ভাবে করা যায়, আবার খুব কর্কশ ভাবেও করা যায়। ধ্বনির ওঠানামা এখানে প্রশ্নের অর্থটাকে সম্পূর্ণ পালটে দেবে। কথোপকথনে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যকার সম্পর্কও প্রকাশিত হবে কিছুটা। এই কথাটাকে আবার কেউ একটু হেরফের করে ‘করছোটা কি?’ বলতে পারেন, যদি উষ্মা প্রকাশ করার ইচ্ছা হয়। এখানে বাক্যটাকেও একটু ভিন্নভাবে সাজাতে হয়েছে, ‘কি’টাকে বাক্যের শেষে নিয়ে।
আরেকটা উদাহরণ দেখুন। সেই ছোটবলায় শোনা দেয়াল-বিজ্ঞপ্তির মজার কথাটা।
‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না, করিলে পুলিশে সোপর্দ করা হইবে’।
না-এর পরে কমাটাকে (,) না-এর আগে নিয়ে আসুন। এবং সেইমতো উচ্চারণ করুন। নিজের কানেই কেমন হাস্যকর শোনাবে বাক্যটা। এই বাক্যে দেখতে পাচ্ছেন যতি চিহ্ন দিয়ে কিভাবে উচ্চারণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বা ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, উচ্চারণ কিভাবে যতিচিহ্নের সঠিক অবস্থান নির্দেশ করে।
যতিচিহ্ন দিয়ে ওপরে যে ধরনের সমস্যা আলোচিত হলো, তার একটা বিহিত করা সম্ভব, যেমন দেখানো হলো । কিন্তু লেখার সাথে কথার পার্থক্য থেকেই যায়। যতিচিহ্ন দিয়ে পরিপূর্ণভাবে এই পার্থক্য ঘোচানো যায় না। যেমন কবিতায়, গানে – নাটকেও। স্বরের ওঠা-নামা আর কন্ঠের ব্যাঞ্জনা, লেখার কায়দায় ধরা যায় না। তাই কবিতা পড়ার আনন্দ আর শোনার মুগ্ধতার (অবশ্য আবৃত্তি যদি মানসম্মত হয়) মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। নাটকের সংলাপ পড়া আর শোনার মাঝেও একই কারণে থাকে বিস্তর ফারাক।
এবারে শব্দ নিয়ে বলি। উইলিয়াম জোনসের মতে ভারতীয় আর ইউরোপীয়ান ভাষাগুলোর উৎপত্তি একটা অভিন্ন ভাষা থেকে[৫]। সেই অভিন্ন আদি ভাষাটার অস্তিত্ব খুব সম্ভবত আর নেই।
স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-১৭৯৪) বৃটিশ ভারতে কোলকাতায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব ক্যালকাটা, পরে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল। তিনি ছিলেন একজন ভাষা-বিশারদও। সংস্কৃত ভাষা নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন জোনস[৬]।
তাঁর যুক্তির সপক্ষে তিনি কিছু উদাহরণ দেন। তিনি দেখান সংস্কৃত, গ্রিক আর ল্যাটিন ভাষার মধ্যে অনেক শব্দ মূলতঃ একই। যেমন –
দন্ত – ডেন্টাল
সর্প – সার্পেন
অগ্নি- ইগ্নিশন।
দৈব – ডিভাইন
তারা – সিতারা –স্টার
ভ্রাতা – ব্রাদার
মাতা – মাদার
ত্রি (তিন) – থ্রি
আট – এইট
নয় – নাইন
কামরা (কক্ষ) আর ক্যামেরা শব্দ দুটির উৎপত্তি যে একটা মূল শব্দ থেকে, এই উপলদ্ধি আমাকে হতবাক করেছিল। ইংরেজি ডেন্টাল আর ডেন্টিস্ট শব্দগুলোর সাথে আমাদের দাঁত বা দন্ত সম্পর্কিত – এটাও আমার জন্য ছিল এক বিস্ময়।
ভাষার সমৃদ্ধি শব্দের আদানপ্রদানে। যে ভাষায় শব্দ-সম্ভার যত বেশি সে ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ। কিন্তু শব্দ সৃষ্টি করলেই ভাষা সমৃদ্ধ হয় না, আর জোর করে শব্দ সৃষ্টি করা যায় না। ভাষা সমৃদ্ধ হয় অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায়। ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি – সবকিছুরই প্রভাব আছে ভাষার বিবর্তনে, শব্দ সৃষ্টি বা বিলুপ্তির প্রক্রিয়ায়।
জোর করে শব্দ সৃষ্টি করা যায় না, বা ভাষাকে পরিবর্তিত করা যায় না। করার অপপ্রয়াস হাস্যকর এবং দূর্ভাগ্যজনক হ’তে বাধ্য। যার নজির আমরা দেখেছি নিকট অতীতে, আমাদেরই দেশে, পাকিস্তান আমলে। দেখেছি যে, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি নিয়ে ভাষাকে পরিবর্তিত করার চেষ্টা করলে তাতে ফল ভাল হয় না।
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’ – এর মুসলমানি সংস্করণ হলো, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি’। ফজর, দিল, আচ্ছা এসব শব্দ কিন্তু বাঙালিদের কাছে অপরিচিত নয়। কিন্তু আরোপিত ব্যবহার কেমন হাস্যকর হয়ে উঠেছে!
প্রাক-বাংলাদেশ আমলে আমরা দেখেছি বাংলাকে ইসলামিকরনের অপচেষ্টা। দেখেছি পাঠ্যপুস্তকে জসীম উদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ হয়ে গেছে ‘দাওয়াত’। আর কাজী নজরুল ইসলামের ‘মহাশ্মশান’ পরিণত হয়েছে ‘গোরস্থানে ’। এ সমস্ত কার্যকলাপে বাংলাভাষাকে অধিকতর ইসলামিকরনের একটা প্রয়াস দেখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে প্রয়াস ফলপ্রসু হয় নি। তা বলে কিন্তু দাওয়াত বা গোরস্থান, এই শব্দগুলোকে যে বাংলাভাষা আত্বস্থ করে নেয় নি তা বলা যায় না। আরবি-ফারসি থেকে প্রচুর শব্দ বাংলায় ঢুকেছে, এবং সে কারণে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। শব্দগুলোকে সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার মাঝেই এই সমৃদ্ধির প্রকাশ ঘটে।
পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে সাম্প্রদায়িকতার ধারক ও বাহকেরা বাংলাভাষাকে সাম্প্রদায়িক লেবাস পরানোর অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাদের সভাসমিতিতে ‘উপস্থিত সুধীবৃন্দ’ হয়ে যেত ‘হাজেরান মজলিস’, ধন্যবাদ – ‘শুকরিয়া্’, স্বাগতম – ‘খোশ আমদেদ’।
অখন্ড পাকিস্তানপন্থী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাজ্জাদ হোসায়েন-এর এক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, “মাশরেকী পাকিস্তানের ভাষার স্বরূপ”। সেখানে তিনি লেখেন, “বাংলাকে মুসলিম তমদ্দুনের উপযুক্ত বাহনে পরিণত করিতে হইলে আমাদের আরবী-ফারসী আলফাজ এস্তেমাল করিতে হইবে, তাহা অস্বীকার করা চলে না। এবং যে সমস্ত শব্দ বিজাতীয় তমদ্দুনের পরিচয় বহন করে, সেগুলিকে পরিত্যাগ করিতে হইবে, তাহাও সত্য” [৭]।
সৌভাগ্য আমাদের সাজ্জাদ হোসায়েন-এর বাসনা সত্য হয় নি। অন্যভাবে দেখলে আমরা তাঁর কথাই রেখেছি, ‘বিজাতীয় তমদ্দুনের’ পরিচয় বহনকারী শব্দগুলোকে আমরা পরিত্যাগ করেছি। তাঁর বিজাতীয় তমদ্দুনের সংজ্ঞাটাই যে ভুল ছিল তা তিনি ধর্মান্ধতার কারণে বুঝতে পারেন নি। তথাকথিত ইসলামাইজড বাংলার কবর রচিত হয়েছে বাংলার মাটিতেই।
অথচ আরবি-ফারসি শব্দ বাংলায় ব্যবহার করা মানেই প্রতিক্রিয়াশীলতা নয়। প্রতিক্রিয়াশীলতা হচ্ছে রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্যে একটা জনগোষ্ঠীর ওপরে তার ভাষার বিকৃতি চাপিয়ে দেয়া।
কথিত আছে, একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কোন এক বক্তৃতায় বাংলা কবিতায় ‘খুন’ শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন[৮]। কাজী নজরুল ইসলাম জবাব দিয়েছিলেন, ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ লিখে[৯]। নজরুল তখন তাঁর কবিতায় নিজস্ব ধারায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ জুড়ে দিতেন। প্রত্যুত্তরে নজরুল লিখেছিলেন, “যেখানে ‘রক্তধারা’ লিখবার সেখানে জোর করে ‘খুনধারা’ লিখি নাই। তাই বলে ‘রক্ত-খারাবি’ও লিখি নাই, হয় ‘রক্তারক্তি’ না হয় ‘খুনখারাবি’ লিখেছি”। আরও বলেছেন, “প্রিয়ার গালে যেমন ‘খুন’ ফোটে না তেমনি রক্তও ফোটে না নেহাত্ দাঁত না ফুটালে”। যুক্তি অকাট্য। রোমান্টিক কবি প্রিয়ার লাজরক্তিম কপোলে হয়তো এঁকে দিতে চাইবেন প্রেমচুম্বন, কিন্তু খুনেরাঙ্গা গাল দেখলে শঙ্কিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এবারে পরিভাষা সম্পর্কে দু’টো কথা বলি। রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে যেমন জোর করে ভাষার রূপান্তর ঘটানো যায় না, তেমনি জোর করে পরিভাষাও সৃষ্টি করা যায় না। দরকারও যে খুব একটা আছে তা মনে হয় না। তবু আমরা বাংলায় পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করেছি অনেকসময় খুব একটা চিন্তাভাবনা না করেই।
স্কুলকে বিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটিকে বিশ্ববিদ্যালয় বলে বোঝানো গেলেও কলেজকে মহাবিদ্যালয় বানানোর কাজে খুব একটা সফলতা আসে নি। টেলিফোনও দূরালাপনী হয়ে ওঠে নি। মোবাইল ফোনকে অনেকেই মুঠোফোন বলেন, তবে একে ঠিক বাংলা প্রতিশব্দ বলা যায় না (ফোন শব্দটা তো রয়েই গেল), স্ল্যাং বলা যায়।
‘টক শো’ ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়েছে বাংলাদেশে। এর বাংলা প্রতিশব্দ শোনা যায় নি। যদিও ‘বক বক অনুষ্ঠান’ যথার্থ প্রতিশব্দ হতে পারতো। কম্পিউটার-এর বাংলাও শোনা যায় নি। ‘গণকযন্ত্র’ যে চলতো না, কোন গণকের ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়াই তা বলে দেয়া যায়। ‘ফ্লপি ডিস্ক’-এর বাংলা শুনেছিলাম ‘লটর পটর চাকতি’। অবশ্যই উদ্দেশ্য ছিল হাস্যরস সৃষ্টি, পরিভাষা সৃষ্টি নয়।
কম্পিউটার, ফ্লপিডিস্ক, হার্ডড্রাইভ, এই শব্দগুলো বাংলায় যেমন আছে তেমন রেখে দিলে কোন ক্ষতি হয় না। আমাদের সমাজে-সংস্কৃতিতে, কথায়-বলায় এই শব্দগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে আধুনিক প্রযুক্তিকে আমরা গ্রহণ করেছি বলেই। নতুন প্রযুক্তির সাথে নতুন শব্দকেও আমাদের আপন করে নিতে হবে, হয়েছে। এখানে জোর করে পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা হাস্যকর হতে বাধ্য।
তাই আমরা দেখেছি, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার নামে পরিভাষা সৃষ্টির প্রয়াস মুখ থুবড়ে পড়েছে। অণু পরমাণু পর্যন্ত চলেছে কিন্তু ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, প্রোটনে এসে থমকে গেছে ।
আমরাই যে শুধু ইংরেজি থেকে শব্দ নিচ্ছি তা নয়। ইংরেজিতেও প্রচুর সংস্কৃত, বাংলা শব্দ ঢুকেছে। যেমন, কামারবন্ড (কোমরবন্ধ), গুরু, পন্ডিত, মন্ত্র, বাংলো, প্রভৃতি। ‘হরতাল’ও ঢুকে গেছে ইংরেজিতে (বিশ্বাস না হয়, গুগলে টাইপ করে দেখুন)।
বিদেশী শব্দ ঢোকালেই কিন্তু ভাষা অন্য ভাষায় পরিণত হয় না। শতকরা একশত ভাগ ইংরেজি শব্দ দিয়েও বাংলা বাক্য হতে পারে। যেমন, সবগুলো ইংরেজি শব্দ দিয়ে গঠিত হলেও ‘সিঙ্কিং সিঙ্কিং ড্রিংকিং ওয়াটার’ ইংরেজি নয়। কোন ইংরেজিভাষীকে এই বাক্যটা বলে দেখুন। মাথামুন্ডু সে কিছুই বুঝবে না। কিন্তু যে কোন মোটামুটি শিক্ষিত বাঙালি এর মানে জানেন। তাহলে এটা কে কি বাংলা বলা যাবে? আমার মত হলো, এটা একটা চরম ব্যতিক্রমী উদাহরণ, তবে এটাকে বাংলাভাষায় অর্থবোধক একটা বাক্য বলতে আমার আপত্তি নেই। শুধু মনে রাখতে হবে, বিজাতীয় শব্দ দিয়ে এ’ধরনের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্য। এটি রম্যমূলক। তবে সবসময় উদ্দেশ্যটা হাস্যরসের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, থাকলতো ভালো হতো।
ওই যে বলছিলাম, ‘ফজরে উঠিয়া আমি’-র মতো। এটাও বাংলা, তবে একটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত বাংলা। বিরক্তিকর বাংলা। হাস্যরসের চেয়ে করুণারই উদ্রেক হয় বেশি।
করুণা হয় তাদের জন্যও যাঁরা ইংরেজি শব্দ ছাড়া বাংলায় কথা বলতে পারেন না।
বাঙালিরা ভিন্ন ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি জুড়ে দেয় কথার মাঝে বিশেষ কারণে – আবেগতাড়িত হলে, উত্তেজিত হলে, হীনমন্যতায় ভুগলে, বা আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করলে। আমি অনেককেই শুনেছি (শুধু সিনেমা-নাটকে নয়, বাস্তবেও) ‘বেরিয়ে যাও’, ‘চুপ করো’ বলার সাথে সাথে ‘গেট আউট’ ‘শাট আপ’ বলেও চেঁচিয়ে উঠতে।
ভাষার সাথে সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক আছে, অস্বীকার করার জো নেই। তাই কিছু কিছু শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ হয় না। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, অভিমান শব্দটার ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। ইংরেজিভাষীরা অভিমান কী, বোঝে না। (বাঙালিদের মধ্যেও অনেকেই মনে হয় বোঝে না। বুঝলে মান্না দে কে কেন গাইতে হলো, এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান।)
শেষ করি, বিদ্যাসাগরেরই আরেকটা গল্প দিয়ে। পরিচিত একজন এসে একদিন বললেন, ‘বাবু অমুকে আপনার বদনাম করছে’। বিদ্যাসাগর বললেন, ‘তাই নাকি? আমি তো কখনো তার উপকার করেছি বলে মনে পড়ে না’। বিদ্যাসাগর উপকার-ই বলেছিলেন, অপকার নয়। কারণ তাঁর অভিজ্ঞতায় উপকার অস্বীকার করার একটা পন্থা হচ্ছে উপকারীর দূর্নাম করা।
বাংলাভাষায় এই জাতীয় লোকদের, যারা উপকারীর অপকার বা দূর্নাম করে, তাদের জন্য একটা শব্দ আছে – কৃতঘ্ন। এই শব্দটার কোন সরাসরি প্রতিশব্দ আমি ইংরেজিতে খুঁজে পাই নি। অন্য কোন ভাষায় আছে কি না জানি না।
সূত্রঃ
[১] হুমায়ুন আজাদ, “বাঙলা গদ্যচর্চা ও বিদ্যাসাগর”, নির্বাচিত প্রবন্ধ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা,২০০৭, পৃ ৭৩।
[২] Jerry A. Coyne, Why Evolution is True, Viking 2009, New York, p. 177.
[৩] সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, “অসম্মতের সম্মতি” উপনিবেশের সংস্কৃতি, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১১, পৃ ৩৮।
[৪] Zareer Masani, Indian Tales of Raj, University of California Press, Berkeley, 1987, p. 20.
[৫] http://www.sjsu.edu/faculty/watkins/sanskrit.htm
[৬] https://web.cn.edu/kwheeler/IE_Main4_Sanskrit.html
[৭] হুমায়ুন আজাদ, “পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্বঃ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবৃক্ষ”, ঐ, পৃ ৫৫।
[৮] “বড়র পিরীতি বালির বাঁধ”, নজরুল–রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ ২৬-২৮।
(সূত্র [৯] এ উল্লেখিত)।
[৯] সাদ কামালী, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে ও গদ্যে মুসলমানের কথা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা, আর্টস, বিডিনিউজ২৪.কম, ৬ মার্চ ২০০৮, http://arts.bdnews24.com/?p=1204
জানুয়ারি ১, ২০১৫।
ভাই আমাকে একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতা তে হেল্প করতে হবে।
এই মুহূর্তে আমার কাছে কোন প্রয়োগ অভিধান নেই।দয়া করে যদি কেও আমাকে সাথে এবং সঙ্গের পার্থক্যটা বুঝিয়ে বলতেন উপকৃত হতাম।
সুন্দর লেখা। পড়ে খুবই ভাল লাগল।
কৃতঘ্ন শব্দটার প্রসঙ্গে কিছু শেয়ার করিঃ
অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে বাঙালির চরিত্রের ব্যাখ্যা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেঃ ‘‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।”
কোন ভাষায় কোন শব্দ আছে, তা দিয়ে যেমন সেই জাতির চরিত্র বোঝা দুষ্কর, তেমনি কোন ভাষায় কোন শব্দের ব্যবহার নেই, তা দিয়েও সেই জাতির চরিত্র বোঝা দায়। কৃতঘ্ন বা পরশ্রীকাতরতা শব্দটা ইংরেজীতে নেই বটে, কিন্তু ইংরেজীভাষীরা যে এসব জিনিস বোঝে না, এমনকি বাস্তবজীবনে এসবের অভিজ্ঞতা লাভ করে না, সেটা বলা যায় না। দার্শনিক সিসেরো বলেছিলেন, গ্রীকদের ভাষায় ল্যাটিন শব্দ ineptus (English: having no sense of what is fitting/impertinent/tactless) এর কোন প্রতিশব্দ নেই। সিসেরো ব্যাখ্যা দিলেন – এই শব্দের অনুপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, গ্রীকদের মধ্যে এই দোষটা এত বেশিমাত্রায় বিদ্যমান ছিল যে, তারা সেটা খেয়াল পর্যন্ত করত না। আমি অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা দিতাম। আমার মতামত হতো এরকমঃ যে সমস্যাটা গ্রীকদের সমাজে ছিল না, সেই অদৃশ্য/অনস্তিত্বশীল সমস্যার জন্য তাদের ভাষাতে শব্দই বা থাকবে কেন? অর্থাত, গ্রীকরা কথাবার্তায় ও আচরণে অপ্রাসংগিকতার দোষ থেকে একেবারেই মুক্ত ছিল।
এইখানে দুইটি বিবাদমান পক্ষ – একপক্ষে আধুনিক কালের ভাষাতাত্বিকেরা বলছেন সব ভাষাই আসলে এক ও অভিন্ন; মানুষের বা জাতির চরিত্রে ও ভাবনায় তার প্রভাব অমোচনীয় নয়। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার দূরত্বও আসলে মামুলি, নিছকই পরিভাষার ব্যাপার। আরেক পক্ষ ভাষার সাথে মানুষের সংস্কৃতি ও চিন্তাপ্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক খুঁজে পান। এমনকি ভাষার মধ্যেই জাতির চরিত্রেরও খোঁজ পান তারা।
@আশরাফুল আলম,
অনেক ধন্যবাদ সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য।
আমার অবস্থান এই দু’য়ের মাঝামাঝি।
” সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আমরা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের কাছে অতি বিনয়ী হতে গিয়ে ভাষায় পরিবর্তন এনেছি [৩]। ” আলাপের বিস্তার না ঘটিয়ে একটা উদাহরণ দেয়া যায়ঃ আমরা ভুলে গেলাম ‘লিঙ্গ’-এর অসংখ্য মানে; মনে রাখলাম শুধু শরীরের অংশটুকু। পা বললে যা চোখে ভেসে উঠে পদোন্নতি বললে, তা হয় না । সন্দেহ নেই ব্রিটিশ আমলে কাটছাট করে করে তীর্থকে যেমন পূণ্যভূমি বানিয়ে ; শব্দটার বহু অর্থকে নাশ করে দিল; আর আমরাও মেনে নিলাম বিনা প্রশ্নে । অভিন্ন ভাষা থেকে , সব ভাষার সৃষ্টি য়েছে, দাবী করছেন কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীও । ইংরেজির and-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উনারা দেখিয়েছেন, এর উৎস সংস্কৃত ভাষার মধ্যে । আকার একারে অর্থ কেন পালটে যেতে পারে , তা জানতে হলে বাংলা ভাষার বর্ণগুলোর অর্থ জেনে নিতে হয়। এখানে একটা লিংক দিয়ে দিচ্ছি , বাংলা বর্ণগুলোর অর্থ পেয়ে যাবেন। https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=657636117618317&id=654165444632051&fref=nf ভাবনাগুলোকে উস্কে দেবার জন্য ধন্যবাদ, ইরতিশাদ ভাই ।
@স্বপন মাঝি,
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য।
আপাততঃ আমার কাজ উস্কানি দেয়া।
” সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আমরা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের কাছে অতি বিনয়ী হতে গিয়ে ভাষায় পরিবর্তন এনেছি [৩]। ” আলাপের বিস্তার না ঘটিয়ে একটা উদাহরণ দেয়া যায়ঃ আমরা ভুলে গেলাম ‘লিঙ্গ’-এর অসংখ্য মানে; মনে রাখলাম শুধু শরীরের অংশটুকু। পা বললে যা চোখে ভেসে উঠে পদোন্নতি বললে, তা হয় না । সন্দেহ নেই ব্রিটিশ আমলে কাটছাট করে করে তীর্থকে যেমন পূণ্যভূমি বানিয়ে ; শব্দটার বহু অর্থকে নাশ করে দিল; আর আমরাও মেনে নিলাম বিনা প্রশ্নে । অভিন্ন ভাষা থেকে , সব ভাষার সৃষ্টি য়েছে, দাবী করছেন কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীও । ইংরেজির and-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উনারা দেখিয়েছেন, এর উৎস সংস্কৃত ভাষার মধ্যে । আকার একারে অর্থ কেন পালটে যেতে পারে , তা জানতে হলে বাংলা ভাষার বর্ণগুলোর অর্থ জেনে নিতে হয়। এখানে একটা লিংক দিয়ে দিচ্ছি , বাংলা বর্ণগুলোর অর্থ পেয়ে যাবেন। https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=657636117618317&id=654165444632051&fref=nf ভাবনাগুলোকে উস্কে দেবার জন্য ধন্যবাদ, ইরতিশাদ ভাই ।
ক্লাসিক! :good:
আপনি যে শেষ পর্যন্ত ভাষাবিজ্ঞানী হয়ে উঠছেন তা দেখে যার পর নাই খুশি হলাম। এর পর থেকে প্রুফরিডিং এর জন্য আপনাকেই ধরা হবে!
আরো কিছু আছে। সম্প্রতি জেনেছি।
একটি হল – What say you?
অন্যটি হল – Are you game?
ভাল লাগলো পড়ে!
@অভিজিৎ,
what say you – আগে শুনেছি।
are you game – এই প্রথম শুনলাম এবং জানলাম।
ধন্যবাদ।
@ইরতিশাদ আহমদ,
খুবই ভালো লাগলো ইরতিশাদ ভাই।
যেমন— সর্বজনীন ও সার্বজনীন।
আরেকটি বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ— আমি যার তার হাতে খাই না।একদিকে আমি যার আপন তার হাতে খাই না। অন্যভাবে আমি যার তার মানে যেকোন মানুষের (তুচ্ছার্থে) হাতে খাই না।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ইউনির্ভাসিটির পাথওয়ে প্রকল্পের একটি বুকলেট আছে। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
বাংলাদেশ আমলেও এ অপচেষ্টা অব্যহত। ১৯৯১ সালে চিটাগাং এ সাইক্লোনের পর বিটিভিতে এক আলোচনায় শুনেছিলাম পানিচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাসের জলকে এড়ানোর অপচেষ্টা।
আর বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের নমুনা no চিন্তা doস্ফূর্তি ।
যাহোক, এমন হাজারো উদাহরণ আছে। এগেুলো সংগৃহীত হ্ওয়া প্রয়োজন এবং আপনার প্রচেষ্টা এ প্রয়োজন মেটাবে বলে প্রত্যাশা করছি।
@গীতা দাস,
ধন্যবাদ। আপনার উদাহরণগুলো চমৎকার।
@ ইরতিশাদ আহমদ,
ধন্যবাদ, পড়ে খুব আনন্দ পেলাম।
@অনিন্দ্য পাল,
ধন্যবাদ আপনাকেও।
চমৎকার হয়েছে ইরতিশাদ ভাই। ভাষার মত জটিল ব্যপার নিয়ে এমন সুন্দর সহজ লেখা আগে পড়িনি। অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটা উপস্থাপনার জন্য।
খুব মজা পেয়েছি, এই’টা আমার জন্য নতুন:
যতি চিহ্ন বিভ্রাট আর ডুবে ডুবে জল খাওয়া এগুলোও খুব মজার:
‘এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে পুলিশে সোপর্দ করা হইবে’।
সবগুলো ইংরেজি শব্দ দিয়ে গঠিত হলেও ‘সিঙ্কিং সিঙ্কিং ড্রিংকিং ওয়াটার’ ইংরেজি নয়।
@কাজী রহমান,
কেমন আছেন কবি? আপনার মন্তব্য আমার জন্য পুরষ্কারবিশেষ। ধন্যবাদ।
@ইরতিশাদ আহমদ,
হাহা হা খুব ভালো আছি ইরতিশাদ ভাই; তবে রোমান্টিক কবিতা আপাতত লুকিয়ে রাখছি। বিপদ আছে। আপনার লেখা অমৃতসম। সব সময়ই নতুন কিছু শিখি। খুব আনন্দে থাকুন। 🙂
@কাজী রহমান,
লুকিয়ে কেন রাখছেন? ঘটনা তো গুরুতরভাবে সন্দেহজনক।
@তামান্না ঝুমু,
ওই যে বললাম না বিপদ আছে; সেইজন্য। কল্প নায়িকার জন্য কে যায় শুধু শুধু স্বরে আ আর হ্রস উ এর ঝামেলায় 🙂
হিন্দি আর উর্দু কিন্তু একই ভাষার দুটো স্বরুপ( standardized register – শব্দটার বাংলা পরিভাষা জানা নেই)। হিন্দি ছবিগুলোতে কোন বাছবিচার ছাড়াই উর্দু ব্যবহার হয়ে থাকে, হয়ত এই স্বরুপটির সৌন্দর্যের জন্যই। আই আই টি তে পড়াশোনা করার সময় Indian Institutes of Technology-এর “শুদ্ধ হিন্দি” তে নাম শুনে অবাক হয়েছিলাম– ভারতীয় প্রাদ্যোগিকী সংস্থান। আবার জীববিদ্যায় Suspensory ligament হয়ে গেছিল “নিলম্বিত অস্থিবন্ধনী”। আর calculus হয়েছিল হিসাবশাস্ত্র। ছাত্রদের ওপর এই অত্যাচার না করলেই নয়? যাই হোক- পড়ে ভালো লাগলো। বানান ভুল হলে মাপ করবেন। এখনো বাংলা type করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি।
@সৌম্য,
ধন্যবাদ পড়ার এবং মন্তব্যের জন্য। হিন্দি আর উর্দু খুবই কাছাকাছি দুটো ভাষা – পার্থক্য শব্দসম্ভারে। হিন্দি সংস্কৃত-নির্ভর আর উর্দু ফারসি-নির্ভর।
চিন্তার কোন কারণ নেই এখানে ‘চিন্তা’ শব্দটি মনে হয় ‘উদ্বেগ ‘উৎকণ্ঠা’ ‘Worry’ ‘Tension’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে বোধ হয় এর উর্দু বাক্যটি হবে- ফিকির করনে কি কয়ি জরুরত নেহি فکر کرنے کی کوئی ضرورت
نہیں
অথবা পেরেশান হনে কি কয়ি বাত নেহি।
সোচনা অর্থ ‘ভাবনা’ কিংবা ‘মনে করা’। সোচ কভি এয়সা হো তো কিয়া হো / হাম তুম এক কামরে মে বন্দ হো।
লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।
@আকাশ মালিক,
উর্দু-হিন্দিতে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত – প্রায় শূন্যের কোঠায়। আপনার সংযুক্তির জন্য ধন্যবাদ।
খুব মজা করে পড়লাম। শিরনামটিও চমৎকার।
@তামান্না ঝুমু, অনেক ধন্যবাদ, তামান্না।
কম্পিউটারের বাংলা অর্থ “গণনাযন্ত্র” না?
পরিভাষার ক্ষেত্রে যেটা যে ভাষা থেকে এসেছে সেভাবে না ব্যবহার করে নিজের ভাষায় ব্যবহার করতে পারলে ভালো লাগতো… চেয়ারের যায়গায় কেদারা, টেবিলের যায়গায় চৌপায়া বলাই যায়…
লেখা ভালো লেগেছে… 🙂
@ঔপপত্তিক ঐকপত্য,
‘কেদারা’ ‘চৌপায়া’ ওগুলো কি নিজের ভাষা? ‘কেদারা’ শব্দটি পর্তুগিজ কাদেইরা (cadeira) থেকে আগত। আর ‘চৌপায়া’ বলতে খাট, চৌকি বুঝায় না? নাহ, ওদের ‘যায়গায়’ (জায়গায়) চেয়ার টেবিলই থাক।
@ঔপপত্তিক ঐকপত্য,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। চেয়ার-টেবিলে সমস্যা কী?
অসাধারণ! এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। বিশেষ করে, সংস্কৃত ও ল্যাটিন-গ্রীকের মধ্যকার নিবিঢ় সম্পর্কটি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ! আচ্ছা, এজন্যই কি ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা বলে?
শব্দটি সেই ছোট থেকেই আমাকে ভাবিয়ে আসছে; আচ্ছা, এর সাথে ‘বাংলা’ শব্দটির কোন সম্পর্ক আছে?
‘অভিমান’ কি সংস্কৃতি উৎসরিত বৈশিষ্ট্য? আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, শব্দটি মানবীয় বৈশিষ্ট্য, মানে, হাসি, কান্না, ক্রোধ প্রভৃতির মতই আবশ্যিক কোন মানবিয় অনুভূতি নির্দেশক!
হিন্দি সিনেমাতে ব্যবহৃত হওয়া এই কমন ডায়ালগটি যে উর্দু ভাষা থেকে উৎসরিত, তা জানা ছিল না।
আর শেষে স্যার, আমার একটা নিজস্ব ভাবনা যোগ করে যাচ্ছিঃ
ভাষার ইতিহাস পৃথিবীর সব ইতিহাসকে, এমনকি প্রাগৈতিহাস ইতিহাসকে পৃষ্ঠা খুলে দেখাতে পারে বলে আমার মনে হয়।
@গুবরে ফড়িং,
ধন্যবাদ – পড়া এবং মন্তব্যের জন্য। আপনার নিজস্ব ভাবনার সাথে আমি সহমত পোষন করছি। ভাষার ইতিহাস অনেক অজানার উন্মোচন ঘটাতে পারে।