“পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও।” ড. হুমায়ুন আজাদ কথাটি বলেছেন এবং বাঙালি এতোদিন পর হলেও তার সারমর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে করছি। আর যারা এরপরো সারমর্ম উপলব্ধিতে ব্যর্থ তাদের জন্য সকলের পক্ষ থেকে আমি একরাশ করুনা জ্ঞাপন করছি, সেই সাথে আশাবাদ, আপনাদের বুদ্ধির দুয়ার একদিন খুলে যাবে।
তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে চট্টগ্রাম গেলাম। চাকরির সুবাধে বাবা(আমি আব্বু ডাকি) সেখানে অবস্থান করছিলেন। সপরিবারে প্রায় একমাস অবস্থান করলাম। চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানগুলো(যেমন: পতেঙ্গা সৈকত, পোর্ট, ফয়েজ লেক, বাটালি হিল, শিশুপার্ক, চিরিয়াখানা ইত্যাদি ঘুরে দেখে অভিভূত হলাম। কারণ এর আগে এতো লম্বা সময় কোথাও বেড়ানোর উদ্দেশ্যে কাটাইনি কিংবা বরিশালের বাইরেই এমন করে বেড়ানো হয়নি।
সে যাহোক, একদিন হালিশহর পুলিশ লাইনের কেন্টিনে বসে আব্বুর এক সহকর্মীর সাথে বসে টেলিভিশনে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করছি। কিছুক্ষণ পর বাবাও আমাদের সাথে যোগদান করলেন। আমাকে এটা ওটা খেতে দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করছেন সবাই মিলে। আমিও বিষয়টা খুব উপভোগ করছি। তবে ছোটোবেলা থেকেই একটু অন্তঃমুখী বলে সেটা বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না। মুখে হাসি নেই, তবে প্রাণে উচ্ছাস আছে, সব সময়ের মতো এরকমই অবস্থা।
এই চলমান পরিস্থিতিতে একজন(কে এখন আর মনে নেই) আমাকে প্রশ্ন করলো, খেলায় কে জিতবে? আমি তখন খেলার তেমন কিছু বুঝি না বা যা বুঝি তাতে মন্তব্য তো দূরের খেলার রস আস্বাদনই করার ক্ষমতা নেই। তবু অকপটে বলে দিলাম, ভারত। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তান এতো ভালো খেলছে তবু তুমি ভারত জিতবে বলছো? তুমি তো হেরে যাবে।
সত্যি বলতে কি আমি তাঁর কথার আগামাথা না বুঝে আবারো বললাম, ভারতই জিতবে দেখে নিয়েন। এরপর কথা অন্যদিকে মোড় নেয় আর আমিও খাদ্যদ্রব্যে মনোযোগ দেই। ওই কেন্টিনের দধির কথা এখনো মনে আছে। আর মনে আছে একটি রেস্টুরেন্টের কাচ্চি ও চায়ের কথা। রেস্টুরেন্টের নামটা এখন মনে নেই, সম্ভবত আল-মদিনা বা এরকম কিছু হবে। কর্ণফুলি মার্কেটের কাছাকাছি এর অবস্থান যতোদূর মনে পড়ে।
সন্ধ্যার কিছু পরে যখন বাসায় ফিরলাম, টেলিভিশন খবর দেখতে দেখতে বাবা জানালেন ভারত হেরে গেছে। আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। মুখ ভার করে আছি দেখে বাবা কাছে এসে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, আমি পাকিস্তানের সমর্থন করি না কেনো? আমি এবেলায়ও অকপটে বলে দিলাম, ওরা ’৭১ এ আমাদের দেশের অনেক মানুষ মেরেছিলো। কখনোই ওদের সমর্থন দিবো না। বাবা হেসেছিলেন শুধু।(এখন তাঁর হাসিটাকে বিজয়ের হাসি বলে মনে হয়)
আমি এখন যে বয়সে অবস্থান করছি তাতে করে স্মৃতিচারণ একটু বেমানান লাগছে। নিজের কাছেই লজ্জিত যে এতো কম বয়সি কেউ স্মৃতিচারণ করে তা আবার অন্যদের ফলাও করে লিখে জানায় না। তবু আজ লজ্জা-শরমের বালাই রেখে এটুকু স্মৃতি সবার সাথে ভাগ করলাম এই জন্য যে, আজই জানতে পারলাম পাকিস্তানের পার্লামেন্টে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদেরের ফাঁসি কার্যকর হওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং তাদের সরকার এই ফাঁসি দেওয়ার বিষয়কে নিন্দা জানিয়েছে।
তবে, বিষয়টিতে আমি বিচলিত বোধ না করে স্বস্তি বোধ করছি। কারণ, পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনীতিক হামিদ মীর যখন নিজ উদ্দ্যেগে ক্ষমা চেয়েছিলেন বা পাকিস্তানের পক্ষে বাঙলাদেশের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন তখন বিষয়টি আমাকে সঙ্কিত করেছে এবং ভেবেছি এটা আবার কোনো নতুন ষড়যন্ত্র নয় তো? কিন্তু আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে তেমন কিছু খেলেনি এবং কিছুদিনের মধ্যে তা মাথা থেকে মুছেও যায়। কিন্তু আজ আবার বিষয়টি পাকিস্তানি শাসক উস্কে দিয়ে হিশেব মিলিয়ে দিলো। অবস্থা পরিষ্কার করার জন্য তাদের ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে কিনা আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন।
হ্যাঁ, তারা এখন পরিষ্কার করে দিয়েছে তাদের অবস্থান। বিশ্ববাসী এখন খুবভালো করে বুঝতে পারবে পাকিস্তানের মানুষের চিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধ কতো নিচে! তারা যতোই এক একজন মালালা’র জন্ম দিক বা আই.এস.আই’র মাধ্যমে তথ্য পাচার করুক না কেনো, যে মানুষের তার কর্মকাণ্ডে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে। একই সাথে বাঙলাদেশে পাকিস্তানি দালালদের(এর মধ্যে অনেক কচিকাঁচা প্রাণ যারা না বুঝে অন্যের প্ররোচনায় বাঙলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তানের সাপোর্ট করে বা গালে পাকিস্তানের পতাকা আঁকে তাদের আমি অন্তভূক্ত করছি না, কারণ, ওরা বিভ্রান্ত এবং এই বিভ্রান্তির জন্য ওরা দায়ি নয় এবং ওদের সঠিক ইতিহাস ও মানবিক বোধে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেশ তথা সরকারকেই নিতে হবে।) চরিত্রও প্রকাশিত হলো। যারা এতোদিন ইসলামের নামে কসাই কাদেরদের সমর্থন দিয়েছে তাদের মুখ আশাকরি এবার ভালো ভাবে বন্ধ হবে।
এদেশে বসবাস করে, এদেশের খাদ্য-পানি-বায়ু-আলো-নাগরিক সুবিধা উপভোগ করে যারা অন্যদেশের স্বপ্নে বিভোর, তাদের কেবল বিভ্রান্ত বলে ক্ষান্ত হলে কম বলা হবে। তারা আদতে চরিত্রহীন ও মানুষিকবোধহীন। এরাই দেশের সম্পদ পাচার করে, দেশের তথ্য অন্যের হাতে তুলে দেয় এবং দেশকে একটি দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় নিয়ে গিয়ে নিজেদের ফায়দা লোটে। কিন্তু ওরা জানে না, ইতিহাস তথা সত্য কাউকে ক্ষমা করে না, সে তার অবস্থান নিয়ে এক সময় হাজির হয় আর এদেশে বসবাসকারী দালালদের জন্য সে সময়টা সম্ভবত আমাদের প্রজন্মেই শুরু হয়েছে।
পরিশেষে, এই লেখার গুটিকয়েক পাঠকের কাছে আমার আবেদন রইলো, আপনারা যে যে মতেরই হোন, পাকিস্তান বিষয়ে দ্বিমত হবেন না কখনো। এছাড়া দেশের স্বার্থে সব ধরনের ক্ষুদ্র স্বার্থকে মুছে ফেলুন। তাহলে আমরা আরো অনেক দূর পর্যন্ত যাবো এই স্বপ্ন এখনো অটুট আছে এবং আপনাদেরো থাকবে এই আশাবাদ।
ওহো! স্মৃতির বাকিটা বলা হয়নি, আমি পরবর্তিতে আরো একবার চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। মেট্রিক পরিক্ষা দিয়ে সে অবসরে। কিন্তু সেবার আর বাবার সাথে তেমন ঘোরার সুজোগ হয়নি। তার কারণ, বাবার কর্মব্যস্ততা এবং একই সাথে বাবার সাথে আমার মানসিক ব্যবধান, ব্যবধানের মূল কারণ হলো, ততোদিনে আমি কিশোর আর বাবা তখনো আমাকে শিশুহিশেবেই দেখেছিলো। ফলে তার সাথে ঘোরাঘুরিটা আর উপভোগ্য ছিলো না। যতোটুকু ঘুরেছি বাবার সহকর্মীর ছেলে আমার সমবয়সি এক কিশোর সুমনের সাথে। সুমনের সাথে আমার আর কখনো দেখা হয়নি, কখনো হবে কিনা জানি না।
আমি একটু অধৈর্য্য মানুষ বলে বড়ো লেখা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, তাই ছোটো লেখা দিয়ে কবিতা বলে চালিয়ে দিয়ে দায় এড়াই প্রায় সময়। আজো আরো লেখার ছিলো, কিন্তু ধৈর্যের অভাবে আর এগুতে পারলাম না।
সবার জন্য শুভকামনা
আমার পিতার চাকুরির কারনে আমার শৈশব কেটেছে পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে আসি। বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গী আমি খুব গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছি আমার ছোটবেলা থেকেই। সেটা আজ অব্দি বদলায়নি।
“পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও।” ড. হুমায়ুন আজাদের কথাটির যথার্থতায় আমি সত্যি বিষ্মিত। লেখককে এই সত্যটি আবার স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
@শফি আমীন, আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের মাঝে শেয়ার করবেন, এই অনুরোধ রইলো।
ধন্যবাদ
একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে, আমরা একাত্তরে পাকিস্তানের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা , আমাদের বিজয় এবং আমাদের দেশ বাংলাদেশকে ছিনিয়ে নিয়েছি। তাই পাকিস্তান আমাদের যতই ভাই বলুক আর মুসলমানের দোহাই দিক তারা কখনই আমাদের ভাল চাইবে না।
@গৌমূমোকৃঈ, এই স্বাভাবিক বিষয়টা অনেক বাঙালি বুঝে উঠতে পারছে না বা তাদের বুঝতে দেয়া হচ্ছে না বলেই এখনো আমাদের ৪২বছর আগের বিষয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে। বাঙলাদেশ আবার ৪২বছর পিছনে ফিরে গেছে। এখনো কাটছে না জাতীয় কলঙ্ক। বর্তমান নানা সমস্যা নিয়ে কেউ কিছু লেখার ফুরসত পাচ্ছে না। এটা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবিন্দের একটা কৌশল বলে আমার মনে হয়। যার বিরুদ্ধেও স্বোচ্চার হওয়া খুব জরুরি।
আশাকরি এই অবস্থার পরিবর্তন খুব শিঘ্রই ঘটবে।
ধন্যবাদ ভাই
মিটুল, চমৎকার! আমারো ভেতরের ভাসাম্যটা আপনার দিকেই। আমিও আপনার মতো স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাবার। অবশ্যই যাবো, তবে এব্যাপারেও আমার ধৈর্য বলতে গেলে নেই। তাই হতাশ হই মাঝে মাঝে। এখন দারুন আশান্বিত আপনাকে পেয়ে। লিখুন আরোও…!
@কেশব কুমার অধিকারী, জীবনের মূলমন্ত্র হলো এগিয়ে যাবার উছিলা খোঁজা এবং তাকে স্বার্থক করে তোলা। এটা আমার চেতনা। তাই হতাশা নয়, স্বপ্ন ও কর্মসাধনাই হোক জীবনের অঙ্গিকার এই প্রত্যাশা আপনার কাছে এবং সব মানুষের কাছে।
আমাদের অন্তরের উপলব্ধি তো একই। বিভিন্ন মহল তাদের স্বার্থে বিভাজন চালায়। তবে আমরা প্রজন্মের স্বার্থে এক এবং একাত্ম থাকতে পারলে ভবিষ্যত পৃথিবী আলোয় ভরে উঠবে, সন্দেহ নেই।
শুভকামনা জানবেন
আপনার এই স্বপ্ন আর মতের সাথে আমারও মিল রয়েছে। 🙂
আপনার গদ্যের হাত খুব ভালো, ঝরঝরে, সাবলীল। নিয়মিত লিখতে থাকুন। (F)
@ফরিদ আহমেদ, প্রেরণাদায়ী মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ফরিদ। আমাদের মিল থাকতেই হবে, কেননা, আমরা নিজেদের বাঙালি হিশেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি এবং বাঙালি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান চেতনা এগিয়ে নেবার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছি।
আরো হাজারটা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধে অবতীর্ণ আছি। একে এক সবাই প্রকাশ করবো…