কাজে ডুবে থাকতে চাইলেন ফাইনম্যান। লস আলামোসের ল্যাবে কাজ করার সময়েই ফাইনম্যানের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতায় মুগ্ধ সবাই। তত্ত্বীয় বিভাগের প্রধান হ্যান্স বেথে ফাইনম্যানকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরি দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালের অক্টোবর থেকেই রিচার্ড ফাইনম্যান অফিসিয়ালি জয়েন করেছেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। ম্যানহাটান প্রজেক্টের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য যোগদানের পর থেকেই ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে তাঁর। ফাইনম্যান এবার কাজে যোগ দিলেন ১৯৪৫ সালের ৩১ অক্টোবর।
বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসছেন তাঁদের অসমাপ্ত পড়াশোনা শেষ করার জন্য। তাই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীর সমাবেশ। ছাব্বিশ বছর বয়সী অধ্যাপক ফাইনম্যানকে দেখতে আরো কমবয়সী মনে হয়। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায় সহজেই।
ফাইনম্যান উপভোগ করতে চাইলেন তাঁর নতুন চাকরি। ফ্যাকাল্টি ক্লাবে লাঞ্চ করতে না গিয়ে লাঞ্চ করেন ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিশে গিয়ে। স্টুডেন্ট সেন্টারে গিয়ে মেয়েদের সাথে বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের সাথে আড্ডা মারতে বেশ ভালোই লাগছে ফাইনম্যানের। মেয়েরাও সহজে আকৃষ্ট হচ্ছে ফাইনম্যানের ক্যারিশমার কাছে।
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছাত্রী নেই বললেই চলে। ফাইনম্যান যে সব ছাত্রীদের সাথে মেশেন তারা সবাই নন-সায়েন্স স্টুডেন্ট। কেউই তাঁকে সেভাবে চেনে না। ফাইনম্যান খেয়াল করলেন তিনি যখন সত্যি কথা বলেন মেয়েদের কেউ তা বিশ্বাস করে না বা করতে চায় না। তারা জানতে চায় –
“রিচার্ড, তুমি আসলে কী করো?”
“আমি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর”
“এটম বোমা সম্পর্কে কিছু জানো?”
“জানবো না কেন? আমরাই তো বানালাম।”
“মানে?”
“মানে আমি তো ম্যানহাটান প্রজেক্টে কাজ করেছি। আমি ছিলাম কম্পিউটিং ডিপার্টমেন্টের হেড।”
“তুমি কি ট্রিনিটি টেস্টের সময় ছিলে সেখানে?”
“অবশ্যই। আমি ছিলাম গ্রাউন্ড জিরো থেকে ২০ মাইল দূরে।”
“বিস্ফোরণ দেখেছো?”
“আমার মত করে আর কেউ দেখেনি। যারা দেখেছে তারা সবাই চোখে কালো চশমা পরে দেখেছে। মনে হয় একমাত্র আমিই দেখেছি খালি চোখে। একটা ট্রাকের ভেতর বসে ট্রাকের জানালার কাচের ভেতর দিয়ে। কারণ আমি জানতাম যে বিস্ফোরণের পর ২০ মাইল পর্যন্ত যা আসতে পারে তা আলট্রাভায়োলেট – যার বেশির ভাগ শক্তি সাধারণ কাচেই আটকে যাবে।”
“রিচার্ড, তোমার মত এত বড় মিথ্যুক আমি জীবনে দেখিনি।”
ফাইনম্যান ভেবে পান না কেন কেউ তাঁর সত্যি কথা বিশ্বাস করতে চায় না। ক’দিন পরপরই তাঁর মেয়েসঙ্গী বদলে যাচ্ছে। শান্তি পাচ্ছেন না তিনি কোথাও।
এক বছর পরেই ১৯৪৬ সালের ৭ অক্টোবর ফাইনম্যানের বাবা মারা যান। ফাইনম্যান আরো বিষন্ন হয়ে পড়েন। মনের মেঘ কাটানোর জন্য তাঁর সঙ্গী হয়ে পড়ে আরো বেশি পদার্থবিজ্ঞান। আর আরলিনের অভাব ঘোচাতে আরো বেশি নারীসঙ্গ।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাফল্য আসতে শুরু করলেও আরলিনের অভাব-জনিত বিষন্নতা কাটছে না কিছুতেই। এসময় কর্নেল ইউনিভার্সিটির অনেক সুন্দরী মেয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন ফাইনম্যান কিন্তু কারো সাথে দু’দিন মেশার পরেই মনে হয় আরলিনের মত তো নয় মেয়েটি। জোর করে আরো কিছুদূর এগোনোর পরে মনে হয় আরলিন এসে দাঁড়িয়েছে পথজুড়ে।
সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে শুরু করেছেন ফাইনম্যান। গবেষণা করছেন পুরোদমে। মৌলিক বলগুলো আলো, বিদ্যুৎ এবং চৌম্বক বলের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত তা নিয়ে কাজ করতে করতে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের ভিত্তি তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করেছেন ফাইনম্যান। এম-আই-টিতে ছাত্র থাকাকালীন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক পল ডিরাক ছিলেন ফাইনম্যানের হিরো। ডিরাকের কোয়ান্টাম মেকানিক্স বই তার প্রিয় পদার্থবিজ্ঞান বইগুলোর একদম শুরুতে আছে। ডিরাক তাঁর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বইটা শেষ করেছেন এই বাক্য দিয়ে যে ইলেকট্রনের ডায়নামিক্স পুরোপুরি বোঝার জন্য নতুন ধারণার দরকার। ফাইনম্যান নতুন ধারণার সৃষ্টি করে চলেছেন। তাঁর কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে।
নিউইয়র্ক রাজ্যের ইথাকায় – যেখানে কর্নেল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস – আবহাওয়া এত খারাপ – বিশেষ করে শীতকালে তুষারপাত বরফঝড় লেগেই থাকে। সে সময় বরফঢাকা রাস্তায় চাকায় শিকল না লাগিয়ে গাড়ি চালানো যায় না। ফাইনম্যানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এরকম আবহাওয়ায় গাড়ি চালিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে।
একদিন তাঁর মনে হলো ইচ্ছে করলেই তো তিনি এসব থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ওয়েস্ট কোস্টের দিকে কোন ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেই তো হয়। অনেক ভাবলেন ফাইনম্যান।
এমনিতেই তাঁর ভালো লাগছিলো না কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। কর্নেলে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ছাড়াও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, হোটেল ম্যানেজমেন্ট এসব বিষয়েও ডিগ্রি দেয়া হয়। এসব সাবজেক্টকে খুব একটা দরকারি সাবজেক্ট বলে মনে করতেন না ফাইনম্যান। তিনি বুঝতে পারতেন না হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে নতুন কী জিনিস আবিষ্কৃত হয়। তাঁর মনে হতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সব রকমের ডিগ্রি দেয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্বতা বলে কিছুই থাকে না।
শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ডিগ্রি দেয়া হয় এমন প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি – ক্যালটেক। ক্যালটেকে যোগ দেয়ার জন্য তিনি অফার পেয়েছেন অনেকবার। এবার অফারটা নিয়ে নেবেন ঠিক করলেন। কিন্তু সমস্যা হলো হ্যান্স বেথে। তিনি ফাইনম্যানকে এত পছন্দ করেন – তাঁকে যদি বলেন যে কর্নেল ছেড়ে চলে যাবেন – তখন কারণ জানতে চাইবেন, বেতন বাড়িয়ে দেবেন ইত্যাদি। সুতরাং ফাইনম্যান ঠিক করলেন আগে থাকতে কাউকে কিছু বলবেন না। ক্যালটেকে একটা সিরিজ অব লেকচার দেয়ার কথা আছে ফাইনম্যানের। তখন দেখবেন কেমন লাগে ক্যালটেকে।
ইতোমধ্যে নিউইয়র্কের বাজে আবহাওয়া থেকে সাময়িকভাবে হলেও পালাতে চাইছেন। দক্ষিণ আমেরিকায় যাবার ইচ্ছে অনেক দিনের। প্রস্তুতি হিসেবে স্প্যানিশ শিখতে শুরু করেছিলেন।
১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে প্রিন্সটনে একটা সেমিনারে গিয়ে পরিচয় হলো ব্রাজিলের দু’জন প্রফেসরের সাথে। তাঁরা সে সময় জন উইলারের সাথে কাজ করছিলেন। ফাইনম্যানকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানালেন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যাওয়ার জন্য। ফাইনম্যান রাজি হলেন। কর্নেলে ফিরে এসে স্প্যানিশের বদলে পর্তুগিজ শিখতে শুরু করলেন ব্রাজিলের কথা ভেবে।
১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে ব্রাজিল গেলেন ফাইনম্যান। ছয় সপ্তাহ ছিলেন সেখানে। ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের আমন্ত্রণে বক্তৃতা দিলেন তাঁর কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স বিষয়ে। ব্রাজিল তাঁর ভালো লেগে গেলো। বিশেষ করে ব্রাজিলের খোলামেলা সংস্কৃতি, উদ্দাম সাম্বা নৃত্য, আর সর্বোপরি ব্রাজিলের সুন্দরী মেয়েদের খুব ভাল লাগলো ফাইনম্যানের।
ব্রাজিল থেকে ফিরে এসে ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে ক্যালটেকে অস্থায়ীভাবে কাজ করলেন। স্থায়ী পদ নেবেন কিনা ভাবছেন। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে প্রায় এক বছরের ছুটি পাওনা আছে। ভাবলেন সেই লম্বা ছুটিটা তিনি আবার ব্রাজিলে কাটিয়ে আসবেন।
১৯৫১ সালের আগস্টে আবার ব্রাজিল চলে গেলেন। রিও ডি জেনেরিও ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন ১৯৫২ সালের জুন পর্যন্ত। সেই সময় তিনি ব্রাজিলিয়ান স্টুডেন্টদের ফিজিক্স পড়াতে গিয়ে খেয়াল করলেন সবাই এত মনযোগী ক্লাসে – তিনি যা বলেন সবই তারা নোট করতে থাকে, ব্ল্যাকবোর্ডে যা লেখেন তাই তারা টুকে নেয়। কিন্তু যখন তিনি প্রশ্ন করেন – সবাই হুবহু একই রকমের উত্তর দেয়।
ফাইনম্যান দেখলেন সবাই পদার্থবিজ্ঞান মুখস্থ করছে, কিন্তু বিজ্ঞানের মূল যে সুর তা ধরতেই পারছে না কেউ। ফাইনম্যান খেয়াল করলেন ব্রাজিলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে – অথচ সারাদেশে উল্লেখ করার মত পদার্থবিজ্ঞানী খুব একটা নেই।
ব্রাজিলের আবহাওয়া আর উদ্দাম সংস্কৃতিতে ভীষণ উদ্দীপ্ত ফাইনম্যান। সুযোগ পেলেই তিনি বংগো ড্রাম বাজাচ্ছেন বিভিন্ন পার্টিতে। ড্রামার হিসেবেও খুব নাম হয়ে গেল ফাইনম্যানের। এক পার্টিতে নাচার সময় একজন ব্রাজিলিয়ান এয়ার-হোস্টেজকে ভাল লেগে গেল ফাইনম্যানের। এই সুন্দরী এয়ারহোস্টেজকে নিয়ে অনেকবার বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেছেন ফাইনম্যান। প্রায় মাস ছয়েক ডেটিং এর পর একদিন তারা দুজনে গেছেন মিউজিয়ামে। মিশরীয় সভ্যতার প্রদর্শনীতে গিয়ে ফাইনম্যান সবকিছুর বিস্তারিত বর্ণনা দিতে শুরু করেছেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি এতসব জানলেন কীভাবে?
মনে পড়লো মেরি লুই বেলের কথা। মেরি লুইয়ের কাছেই ফাইনম্যান শিখেছেন মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে এত সব। হঠাৎ মেরি লুইয়ের জন্য ভালবাসা জেগে উঠলো ফাইনম্যানের মনে।
মেরি লুইয়ের সাথে ফাইনম্যানের পরিচয় কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। ক্যানসাসের মেয়ে মেরি লুইর শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান, ব্যাপক ভালবাসা। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। তখন তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। ফাইনম্যানের সাথে তখন বেশ অন্তরঙ্গ সময় কেটেছে মেরি লুইর।
ক্যালটেকে যাবার পর ফাইনম্যান শুনেছিলেন মেরি লুই তখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসের (ইউ-সি-এল-এ) কাছে ওয়েস্টউডে থাকেন। তখন যোগাযোগ করেননি। এখন মনে হচ্ছে মেরি লুইয়ের সাথে অত ঝগড়াঝাটি না করলেও চলত।
এয়ারহোস্টেজের সাথে ফাইনম্যানের সম্পর্ক কোন পরিণতির দিকে যাচ্ছিল না। ফাইনম্যান একটা স্থায়ী সম্পর্কের কথা ভাবছিলেন। মনে হলো মেরি লুইয়ের সাথে একটা স্থায়ী সম্পর্ক হলে খারাপ হয় না। যদিও মেরি লুইর নাকউঁচা স্বভাব আর কর্তৃত্বপরায়ণতার কারণে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যেতো কর্নেলে থাকতে – এখন মনে হচ্ছে একটু মানিয়ে নিলেই হবে।
ফাইনম্যান মেরি লুইকে ব্রাজিল থেকে চিঠি লিখে বিয়ের প্রস্তাব জানালেন। মেরি লুই প্রস্তাবে রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু ফাইনম্যান ব্রাজিল থেকে আমেরিকাতে ফিরে আসার আগেই প্রশ্ন তুললেন অনেক ব্যাপারে যেগুলোর দিকে ফাইনম্যান আগে কখনো নজর দেননি। যেমন, ফাইনম্যান যেহেতু ক্যালটেকে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও সেরকম স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী হওয়া উচিত। ফর্মাল পোশাকের ব্যাপারটা ফাইনম্যান কোনদিনই মন থেকে মেনে নেননি। সুট-কোট-টাই পরতে পছন্দ করতেন না তিনি। বাধ্য না হলে তিনি টাই পরতেন না। দরকার ছাড়া নতুন পোশাক কেনার দরকার আছে বলেও তিনি মনে করেন না। মেরি লুই এ ব্যাপারে ফাইনম্যানের বিপরীত। তিনি মনে করেন একজন অধ্যাপকের অবশ্যই পোশাকে আচার-আচরণে অধ্যাপক-সুলভ ব্যবহার করা উচিত।
নতুন বাসা নিলে সে বাসার নতুন ফার্নিচার কিনতে হবে। সে ফার্নিচারের বাজেট কত সেটা নিয়েও বিয়ের আগেই অনেক ঝগড়া করেন মেরি লুই।
ফাইনম্যান প্রায় সবকিছু মেনে নিয়েই বিয়ে করলেন মেরি লুইকে ব্রাজিল থেকে ফেরার পরপরই ১৯৫২ সালের ২৮ জুন।
ফাইনম্যানের সহকর্মী ও বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে গেলো ফাইনম্যান মেরি লুইকে বিয়ে করাতে। ক্যাম্পাসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ফাইনম্যানকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাঁরা জানেন ফাইনম্যান সুন্দরী উচ্ছল মেয়েদের সাথে মিশতে ভালবাসেন, কিন্তু যাঁকে বিয়ে করলেন তাঁর সাথে কোন কিছুরই মিল নেই ফাইনম্যানের। চোখে পড়ার মত সৌন্দর্য নেই মেরি লুইর, বয়সেও তিনি ফাইনম্যানের চেয়ে কয়েক মাসের বড়। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে মেরি লুইর ধারনা খুবই আপত্তিজনক।
বিয়ের দিন থেকেই মেরি লুই’র কর্তৃত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বিয়ের পর ফাইনম্যান ও মেরি লুই হানিমুনে গেলেন মেক্সিকো আর গুয়াতেমালায়। কিন্তু একটা ঘন্টাও নির্ঝঞ্ঝাট উপভোগ্য হলো না। সবকিছু নিয়েই ফাইনম্যানের মজা করার প্রবণতা দেখে ভীষণ বিরক্ত মেরি লুই। ফাইনম্যানের কোন কিছুই তাঁর পছন্দ হয় না।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ফাইনম্যান সম্পর্কে অভিযোগের পাহাড় মেরির। “রিচার্ড ষাঁড়ের মত চেঁচায়, কথায় ব্যাকরণ ঠিক থাকে না, লং আইল্যান্ডের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, পোশাকের কোন ঠিক নেই, প্রফেসর হয়েও কোট-টাই পরে না, জুতায় ময়লা লেগে থাকে, বংগো ড্রাম বাজায়, স্টুডেন্টদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে না” – এরকম অভিযোগের শেষ নেই মেরি লুইর। শুরুতে কী এক আশ্চর্য কারণে ফাইনম্যান মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।
সেই সামারে ব্রাজিল থেকে আবার আমন্ত্রণ পেলেন ফাইনম্যান। এবার সাথে নিয়ে গেলেন মেরি লিউকে। যে ক’দিন মেরি ছিলেন সেখানে ফাইনম্যান সুট-কোট-টাই পরে ইউনিভার্সিটিতে গেলেন। ক’দিন পরে মেরি লুই বলিভিয়ায় চলে গেলে সুট-কোট-টাই ছেড়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ফাইনম্যান।
মিউয়ন নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন ফাইনম্যান। বেশ কয়েকবার জাপান ভ্রমণ করেছেন কয়েক বছরে। ১৯৫৫ সালে মেরি লুইকেও সাথে নিয়ে গেলেন। জাপানীদের প্রচন্ড আন্তরিক আতিথেয়তাতেও বিরক্ত মেরি লুই।
ফাইনম্যানের দাম্পত্য জীবন অসহনীয় হয়ে পড়ছিল দিনের পর দিন। মেরি লুই উঠতে বসতে বলতে শুরু করেছেন তিনি কত বড় একজন বুনো লোককে বিয়ে করেছেন। তাঁর মতে ফাইনম্যান একজন পি-এইচ-ডি ডিগ্রিধারী অশিক্ষিত মানুষ। ক্যালটেকের অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে ফাইনম্যানের মেলামেশাও পছন্দ করেন না মেরি। তিনি ফাইনম্যানকে বাধ্য করেছেন ক্যাম্পাসের অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের বাসা থেকে দূরে একটা বড় বাংলো ভাড়া করতে।
গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা তাদের পার্টিতে ফাইনম্যানকে নিমন্ত্রণ করলে ফাইনম্যান যেতেন সেখানে। বিয়ের পর এরকম একটা পার্টিতে মেরি লুইকে নিয়ে গেলেন ফাইনম্যান। ফাইনম্যান ততদিনে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মজা করার জন্য অন্য মাতালদের সাথে মাতালের মত অভিনয় করতেন। ফলে তাঁকে মাতালদের চেয়েও বেশি মাতাল মনে হত।
সেদিনের পার্টিতে ফাইনম্যানকে ওরকম করতে দেখে মেরি লুই সবার সামনেই গর্জন করতে লাগলেন, “রিচার্ড, স্টপ ইট। লজ্জা করে না একজন প্রফেসর হয়ে এরকম মাতলামি করতে? ছি ছি। স্টপ ইট নাউ!” পার্টি বন্ধ হয়ে গেল। ফাইনম্যানের মত মানুষকে কেউ এরকম অপমান করতে পারে তা ক্যালটেকের কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
ফাইনম্যানের কোন কাজই পছন্দ হয় না মেরির। বংগো ড্রাম বাজালে তার শব্দে মাথা ধরে। বন্ধুদের কাছে অভিযোগ করতে শুরু করেছেন মেরি – “ফাইনম্যান ঘুম থেকে উঠেই ক্যালকুলাস করতে শুরু করে, গাড়ি চালাতেও ক্যালকুলাস, খেতে বসেও মাথার মধ্যে ক্যালকুলাস, বিছানাতেও ক্যালকুলাস। অসহ্য!”
ফাইনম্যান সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একদিন আর পারলেন না যেদিন নিল্স বোরের সাথে তাঁর দেখা হওয়াটা মিস হয়ে গেল মেরির কারণে। কেউ ফোন করে ফাইনম্যানকে কোন খবর দিতে বললে মেরি লুই প্রায়ই তা ভুলে যেতেন বা ইচ্ছে করেই ভুলে যাবার ভান করতেন। ফাইনম্যানের কাজের কোন গুরুত্বই তিনি দিতেন না। সেদিন ডিনার করতে বসেছেন ফাইনম্যান ও মেরি লুই। হঠাৎ মেরি লুই বললেন, “ওহ, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়েছে। সকালে টমি লরিটসেন ফোন করেছিল। বলেছিল আজ তাদের ওখানে ডিনার করতে। কোন্ এক বুড়ো বোয়ার নাকি এসেছে। আমি ভাবলাম কোথাকার বুড়ো এসেছে – তুমি নিশ্চয় যাবে না।”
“বুড়ো বোয়ারের সাথে দেখা করতে বলেছে নাকি নিলস্ বোর বলেছে?”
“কী জানি, হয়তো নিল্স বোর বলেছে। কী এমন পার্থক্য!”
“কী পার্থক্য! নিল্স বোর কে তুমি জানো না?”
না, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের জনক রিচার্ড ফাইনম্যানের স্ত্রী হয়েও মেরি লুই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনক নিল্স বোরের নাম শোনেন নি। ফাইনম্যান কীভাবে তা মেনে নেন?
একদিন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সবাই গেছেন পিকনিকে। সমস্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বার, রিসার্চ স্টুডেন্ট ও তাদের পরিবার যোগ দিয়েছেন সেখানে। সবাই মিলে খুব হৈ চৈ মজা খেলাধূলা হচ্ছে। এ ধরনের পিকনিকে বরাবরই খুব মজা করেন ফাইনম্যান। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলতে খেলতে নিজেও অনেকটা ছেলেমানুষ হয়ে ওঠেন।
মেরি লুই এসেছেন হাই-হিল আর ধবধবে সাদা শর্টস পরে। তিনি এসেই এমন ভাব করতে শুরু করলেন যেন একদল জংলীর মাঝে এসে পড়েছেন। ক্যাম্প-চেয়ারেও বসছেন না কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে বলে। বেশি হাঁটছেন না কারণ পেন্সিল হিল মাটিতে দেবে যাচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। প্রফেসর মারি গেলমানের স্ত্রী মার্গারেট অনেক আদর আপ্যায়ন করেও মেরিকে বসাতে পারলেন না।
বাচ্চারা ছুটতে ছুটতে কাদা ছোড়াছুড়ি করছিল। একটা বাচ্চা পড়তে পড়তে কাদামাখা হাতে মেরিকে ধরে ফেললো। মেরির ধবধবে সাদা শর্টসে কাদামাখা হাতের ছাপ। এতক্ষণ ধরে তার রাগের আগুন ফুঁসছিল – এবার দপ্ করে জ্বলে উঠলো। মেরি গট্ গট্ করে ফাইনম্যানের সামনে এসে বললেন, “আর এক মুহূর্ত নয় এখানে। চলে এসো রিচার্ড।” পিকনিকের সবাই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। বুঝতে পারছে না কী ধরনের সিন-ক্রিয়েট হতে চলেছে।
“রিচার্ড, কী বলছি শুনতে পাচ্ছো না?” গলা চড়ছে মেরির। সবাই অপেক্ষা করছে ফাইনম্যান কী করেন দেখার জন্য।
“রিচার্ড, আমি চললাম।”
“তোমার যা খুশি করতে পারো মেরি। আই ডোন্ট কেয়ার।” – ফাইনম্যানের সাদাসিধে উত্তর। মেরি চলে গেলেন।
ফাইনম্যানের গবেষণা ও কাজকর্ম নিয়ে মজার মজার আলোচনা ক্যালটেকের ক্যাম্পাসে নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। সেসব আলোচনায় শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মিশে থাকতো। কিন্তু এখন ফাইনম্যান ও মেরির জীবন-যাপন নিয়ে অন্যরকম সব মুখরোচক গল্প তৈরি হতে লাগলো।
রাজনৈতিক মতাদর্শেও বিরাট ফারাক মেরি আর ফাইনম্যানের মধ্যে। মেরি কট্টর ডানপন্থী। মেরির চাপে পড়ে ফাইনম্যানও কিছুদিন রিপাবলিকানদের সাপোর্ট করেছিলেন। কিন্তু যখন ওপেনহাইমারকে কমিউনিস্ট সন্দেহে তারা বিচারের নামে দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করতে শুরু করলো – ফাইনম্যান আর সহ্য করতে পারেন নি। কিন্তু মেরি লুই ওপেনহাইমারের নামে যাচ্ছেতাই আজেবাজে কথা বলতে বলতে ফাইনম্যানের মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিলেন।
১৯৫৪ সালে ফাইনম্যান লিকুইড হিলিয়ামের কোয়ান্টাম মেকানিক্স সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। তিনি চাইছিলেন দূরে কোথাও চলে যেতে। প্রফেসর হ্যান্স বেথেকে লিখলেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে আবার ফিরে যাবার কোন সুযোগ আছে কী না। যে কোন বেতনেই তিনি কর্নেলে ফিরে যেতে রাজি।
হ্যান্স বেথে তো ভীষণ খুশি ফাইনম্যানের চিঠি পেয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই মুহূর্তে ফাইনম্যানকে শুধুমাত্র একটা অস্থায়ী পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব। ফাইনম্যান চিন্তা করছিলেন কী করবেন।
এসময় ক্যালটেকে কর্মরত জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওয়াল্টার বাডে, রসায়নবিদ লাইনাস পাউলিং সহ অনেকের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘটনা ঘটলো ক্যালটেকে যা ক্যালটেকের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলো অনেকগুণ। ফাইনম্যান বুঝতে পারলেন অচিরেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও গবেষণায় ক্যালটেক বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সুতরাং ক্যালটেক ছেড়ে যাবার কোন মানেই হয় না।
সেবছর নভেম্বরের ২৮ তারিখ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি মারা গেলেন। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ফার্মির পদে ফাইনম্যানকে নিয়ে যাবার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন ওয়াল্টার বার্টকি। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর মারভিন গোল্ডবার্গারকে সাথে নিয়ে ডিন নিজে চলে এলেন ফাইনম্যানের বাসায়। বললেন ফাইনম্যানের যে কোন শর্ত মেনে নিয়ে তাঁরা ফাইনম্যানকে শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যেতে চান। ফাইনম্যান বললেন, “ক্যালটেক থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত আমি বদল করেছি। আমি আর যাচ্ছি না।”
“সিদ্ধান্ত আরেকবার বদলানো যায় না?”
“না, এ ব্যাপারে আমি আর সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।”
“আপনাকে আমরা কত বেতন অফার করতে রাজি আছি তা কি জানতে চান?”
“না। প্লিজ, তা উল্লেখ করবেন না। আমার স্ত্রী পাশের রুমে আছে। শুনতে পেলে আমাকে আপনাদের চাকরিটা নেবার জন্য বাধ্য করবে। আমি চাইনা আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে। আমি দুঃখিত।”
বিফল হয়ে ফিরে গেলেন বার্টকি ও গোল্ডবার্গার। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। পরের সপ্তাহেই ফাইনম্যান একটা চিঠি পেলেন শিকাগো ইউনিভার্সিটির ডিনের অফিস থেকে। চিঠির প্রথম লাইনেই লেখা আছে বেতনের অংক। অবিশ্বাস্য রকমের বেশি বেতন অফার করছে শিকাগো – ফাইনম্যান ক্যালটেকে যত পান তার চারগুণ। ফাইনম্যান সাথে সাথেই উত্তর লিখে তাঁর অসম্মতির কথা জানালেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন এত বেশি বেতন পেলে তাঁর স্ত্রী হয়তো খুশি হবেন, কিন্তু লোভ আরো বেড়ে যাবে। ফাইনম্যানের জীবন আরো এলোমেলো হয়ে যাবে।
ফাইনম্যান ক্যালটেকে রয়ে গেলেন। কিন্তু মেরি লুইয়ের সাথে তাঁর বিয়েটা আর টিকলো না। ১৯৫৬ সালে তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। বিচ্ছেদ ত্বরান্বিত করার জন্য ফাইনম্যানকে স্বীকারোক্তি দিতে হয় যে তিনি মেরি লুইয়ের প্রতি শারীরিক মানসিক অত্যাচার করেছেন। ডিভোর্সের পরবর্তী তিন বছরে দশ হাজার ডলার খোরপোশ দিতে হয়েছে তাঁকে।
একটানে চারটা পর্বই পড়ে নিলাম। অসাধারণ লাগলো। এটা যে কেবল ফাইনম্যানের প্রতি আকর্ষণ তা-ই নয়, লেখাকে চমৎকার আকর্ষণীয় করতে লেখকের মুন্মিয়ানাও অপ্রতিরোধ্য ! হা হা হা !
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
বরাবরের মতই দারুণ। পরের পর্ব তাড়াতাড়ি লেখেন।
একেবারে শেষে পড়ব প্রদীপদা।
ধারাবাহিক লেখা পড়তে গেলে আমার ধৈর্য থাকে না। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করতে গেলে খুবই খারাপ লাগে। আর সেই লেখা যদি আপনার হয় তাহলে তো কথাই নেই।
একেবারে শেষে একসাথে পড়ব।
লেখাটা মুক্তমনায় ইবুক করে রাখার কথা কি ভেবেছেন? চমৎকার হবে আমার ধারনা।
@সাইফুল ইসলাম,
এই সিরিজটার দারুণ একটা ইবুক হতে পারে কিন্তু।
দুর্দান্ত! প্রতিটি পর্ব পড়ি আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে। বিজ্ঞান নিয়ে, বিজ্ঞানীদের নিয়ে এমন সাবলীল লেখা বোধ হয় কেবল প্রদীপ দেবের পক্ষেই সম্ভব।
দারুণ!
মেরি লুইএর ব্যবহারের নমুনা পড়তে পড়তে তো আমিই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। পঞ্চম বাণটি তাড়াতাড়ি ছাড়ুন।
হাহাহা! ফাইনম্যান হয়তো তা ছিলেন না, তবে বাংলাদেশে বহু পিএইচডি ডিগ্রিধারী অশিক্ষিত মানুষ রয়েছে।
চমৎকার ব্যতিক্রমধর্মী লেখা হচ্ছে প্রদীপদা। (F)