না, আমি পঁচিশে মার্চের সেই কালো রাতের কথা বলছি না।  আমি বলতে বসেছি আরো প্রায় নয় মাস পরের বিস্মৃতপ্রায় আরেকটা রাতের কথা।

ডিসেম্বর ১০, ঊনিশশো একাত্তর।

ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কন্সাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক একটা বার্তা পাঠাচ্ছেন সেক্রেটারি অব স্টেট (মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) উইলিয়াম রজার্স আর ইসলামাবাদে অবস্থানকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড-এর কাছে।  বার্তাটা গোপনীয়।  সকালে উঠেই লিখতে বসেছেন।  রাতে মনে হয় ভালো ঘুম হয় নি তাঁর।  বার্তাটা না পাঠানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না স্পিভাক।  বিবেকের দংশনও কি কিছুটা অনুভব করছেন?  কে জানে?

আর্চার ব্লাডকে কিছুদিন আগে সরিয়ে স্পিভাককে বসানো হয়েছে এই পদে। স্পিভাক অভিজ্ঞ, প্রবীণ – উপরস্থ কর্তৃপক্ষকে পারতপক্ষে বিব্রত করেন না।  ব্লাড মার্চেই বাঙালি জনসাধারণের ওপরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনির নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর খবর বিস্তারিত জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে।  বাঙালিদের ওপরে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বর আক্রমণের – আর মার্কিন প্রশাসনের তা দেখেও না দেখার ভান করার – প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি আর তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা।  পিটিশনে স্বাক্ষরদানকারীদের মধ্য থেকে অনেককেই ঢাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।  ইসলামাবাদে পৌঁছার পরে তাদের, বিশেষ করে তাদের স্ত্রীদের, বলা হয় ঢাকায় তারা যা দেখেছেন তা ‘হ্যালুসিনেশন’ জাতীয় কিছু একটা হবে আর পরামর্শ দেয়া হয় ‘ট্রাঙ্কুলাইজার’ খেতে।

আর্চার ব্লাডকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠানো হয় একাত্তরের জুনে।  তাঁর ঢাকা ফিরে না যাওয়ার কোন কথা ছিল না।  কিন্তু তাঁকে আর ফিরতে না দিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পার্সোনেল অফিসে বসিয়ে দেয়া হয়।  বলা হয়, ব্লাডের মতো ‘এলার্মিস্ট’-দের এখন আর ঢাকায় প্রয়োজন নাই।

আর্চার ব্লাডের স্থলাভিষিক্ত সেই স্পিভাক বার্তা পাঠাচ্ছেন তাঁর ঊর্ধস্তনদের কাছে।  বার্তাটা অতি অবশ্যই গোপনীয়, এই ধরনের বার্তা গোপনীয়ই হয়।  কিন্তু অবস্থার বিবেচনায় শব্দচয়নেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে স্পিভাককে।  বার্তাটার অর্থবহ – যদিও গুরুত্বহীন, অপেক্ষাকৃত নির্দোষ টাইপের – একটা শিরোনামও দিয়েছেন তিনি, Villainy by Night (ভিলেইনি বাই নাইট)। বাংলায় হয়তো বলা যেতে পারে – মধ্যরাতের কূটচাল।  কিন্তু সে’রাতে যা ঘটানো হয়েছিল তাকে বাংলায় কূটচাল বা ইংরেজিতে ‘ভিলেইনি’ বললে ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে কোন ধারণাই পাওয়া যায় না।

স্পিভাকের বার্তার বিষয়বস্তু – আগের রাতে (আট-নয় ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে) ঢাকায় বোমা হামলা।  সবাই জানে ভারতীয় বিমান থেকেই বোমা ফেলা হয়েছে।  বিশ্বের সংবাদ-মাধ্যমগুলো (এসোসিয়েটেড প্রেস, ইউপিআই) ফলাও করে প্রচার করলো ভারতীয় বিমান থেকে তেজগাঁর অদূরে বোমা-হামলায় প্রায় দুশো এতিম বালকের কয়েক মূহুর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সংবাদ।  আর যথানিয়মে তা প্রকাশিত হলো বিশ্বের সংবাদপত্রসমূহে, আর রেডিও-টেলিভিশনের সংবাদে – ডিসেম্বরের নয় তারিখে।

নীচের দু’টো ছবিতে তার কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে ([১], [২])।

বোমাবর্ষণের খবর (১)

 বোমাবর্ষণের খবর (২)

তেজগাঁ বিমানবন্দর থেকে মাত্র একমাইল দূরে ছিল এতিমখানাটা।  প্রায় সাতশ’র মতো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের আবাসস্থল ছিল ওই এতিমখানায়।  বোমা ফেলা হয় বালকদের বাসস্থানের ওপরে।  ভোর চারটার দিকে যখন এই পিতামাতা হারা বালকেরা ঘুমে নিমগ্ন ছিল তখনই এই বিমান হামলা হ্য়।

বোমা হামলার ফলে বিরাটাকার গর্তের সৃষ্টি হয় এতিমখানাটা যেখানে ছিল সেই জায়গায়।  কমপক্ষে চল্লিশ গজ চওড়া আর বিশ ফুট গভীর ছিল একটা গর্ত।

গত কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় বিমান হামলার এটি ছিল দ্বিতীয় ঘটনা।  তার আগেই আরেকটা বোমা হামলায় প্রাণ হারায় তিনশত শ্রমিক – যখন ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলে একটা পাটকলের ব্যারাকে একসাথে চারটা বোমা ফেলা হয়।

নিউজউইকে প্রকাশিত খবরের সাথে মানচিত্র [৩]।

বোমা ফেলার জায়গাটা লাল তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে

ইচ্ছে করে ভারতীয়রা এতিমখানার ওপরে বোমা ফেলতে যাবে কেন?  লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে সম্ভবত – টার্গেট ভুল করেছে অনভিজ্ঞ ভারতীয় বৈমানিক। এমন একটা ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলো তাদের নিজেদের যুক্তি দিয়ে।  বলা হয় যে রেললাইন ধংশ করাই ছিল ভারতীয় হামলার উদ্দেশ্য। এমন কি, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নিউজউইকের প্রতিবেদনে ধারণা দেয়া হয় হামলাটা ছিল ভারতীয় বিমানের।

আর পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম থেকে ক্রমাগত প্রচার চালানো হচ্ছে – ভারতীয় নৃশংসতার ফিরিস্তি দিয়ে।  একদিকে তারা বলছে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র বিভিন্ন রণাঙ্গনে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের বীর সেনারা – ভারতীয়রা কোন সুবিধাই করতে পারছেনা, এখানে-ওখানে ভারতীয় বিমান ভুপতিত করা হয়েছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।  আবার অন্যদিকে বলা হচ্ছে, ঢাকার কেন্দ্রস্থলে ভারতীয় বিমান হামলায় এতিমখানার কয়েক’শ বালকের দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ঘটেছে।  এবং এ জন্যে ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতাই দায়ী – পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জানমালের জন্য যে ভারতীয়দের কোন দয়ামায়া নাই, এই বিমান হামলা তাই প্রমাণ করে।

উল্লেখ্য যে, এতিমখানাটা তেজগাঁ বিমানবন্দর থেকে মাত্র এক মাইলের মধ্যে অবস্থিত, আর তেজগাঁ বিমানবন্দরেই রয়েছে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর বিমানবহর আর এন্টি-এয়ারক্রাফট গানগুলো।  তাদের নাকের ডগার ওপর দিয়ে ভারতীয়রা বোমা ফেলে চলে গেল, আর তারা একটা এন্টি-এয়ারক্রাফট গানও ফায়ার করলো না।  রহস্যটা কী?   আসলে কী ঘটেছিল?

দেখি স্পিভাক কি লিখেছিলেন তাঁর বার্তায়।  তাঁর গোপনীয় বার্তা এখন আর গোপন নয়।  অ্যান্ডারসন সেই তিয়াত্তরেই এই বার্তাটা হুবুহু তাঁর লেখা অ্যান্ডারসন পেপারস-এ [৪] ছাপিয়ে দিয়েছিলেন।  আর এখনতো ইন্টারনেটেই পাওয়া যায় এই বার্তার ফটোকপি।

বার্তার প্রথম পাতাটা এখানে দেয়া হলো, যদিও খুবই অস্পষ্ট এসেছে ছবিটা।  আগ্রহী পাঠকেরা তথ্যসূত্র [৫]-এর লিঙ্ক থেকে পুরো বার্তাটা ইংরেজিতে পড়তে পারবেন।

স্পিভাকের বার্তার অনুলিপির প্রথম পাতা

স্পিভাক লিখেছিলেন,

“১। জাতিসঙ্ঘের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল (পল মার্ক হেনরি) আর আমি প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়েছি যে, গতরাতে ঢাকার বেসামরিক অঞ্চলে বোমাবর্ষণ ( ডিসেম্বরের ৮-৯ এর রাতে এতিমখানার ওপরে বোমানিক্ষেপের ঘটনাসহ) করা হয়েছে ঢাকা বিমানবন্দরে অবস্থিত পাকিস্তানী প্লেন থেকে, এবং এই হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে অপদস্থ করা।

 “২। আমাদের এই উপসংহার টানার পেছনে অনেক প্রামাণ্য কারণ রয়েছে, মোটাদাগে তা হচ্ছে –

ক। বোমাবর্ষণকারী প্লেনের ইঞ্জিন থেকে যে শব্দ পাওয়া গেছে তা আগে শোনা  ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের জেটপ্লেন থেকে আসা শব্দের চেয়ে অনেক ভিন্ন ধরনের।  জাতিসঙ্ঘের বিমান-বিশেষজ্ঞের মতে শব্দটা ছোট টুইন-ইঞ্জিনসম্পন্ন বিমানের, প্রায়-নিশ্চিত এটা ছিল Piaggio P-136-L, যার অন্তত একটা ঢাকা বিমানবন্দরে সপ্তাহখানেক আগে দেখা গেছে।  বোমা বিষ্ফোরণের ঠিক আগে কনস্যুলেট জেনারেলের একজন কর্মচারী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দশ তলা থেকে দেখেছে একটা বিমানকে এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে যেতে। আরো একজন কর্মচারী প্লেনের শব্দ শুনেছেন এবং ধারণা করছেন যে তিনি বোমা পড়তে দেখেছেন এবং পরে বিমানটা খুব সম্ভবত ঢাকা বিমানন্দরে ল্যান্ড করেছে।  একজন স্থানীয় সিনিয়র কর্মকর্তা দেখে চিনতে পেরেছেন একটা টুইন-ইঞ্জিন বিমানকে, যেটা সাধারণত ভিআইপি-দের জন্য বিমানবন্দরে রাখা থাকে।  তিনি আরো দেখেছেন প্লেনের ক্যাবিন লাইটটা জ্বলছিল।

খ। পূর্বে ভারতীয় বিমানের প্রতি যেভাবে এন্টি-এয়ারক্রাফট ফায়ার করা হয়েছিলো তার কিছুই এবারে ঘটেনি।  শুধু দুটো ছোট ট্রেসার রাউন্ড ছুড়তে দেখা গেল, তাও যেদিকে বোমাহামলা হচ্ছিল সেদিকে নয়, অন্যদিকে।

গ। ঘটনাস্থলের কাছে যেখানে বোমাগুলো ফেলা হয়েছে তার একটার কাছে, এমন একটা বস্তু পাওয়া গেছে যাকে তড়িঘড়ি করে বানানো  বম্ব র‍্যাক (bomb rack) ছাড়া আর কিছু ভাববার উপায় নেই।  এটা এখন জাতিসঙ্ঘের     UNEPRO  (ইউনাইটেড নেশন্স ঈস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশন্স) হাতে আছে।  এই বস্তুটা পেরেক দিয়ে সাঁটা বোর্ডের তৈরি একটা আয়তাকার কাঠামো – Piaggio এয়ারক্রাফটের কেবিন আর ফ্লোট সাপোর্টের মধ্যবর্তী জায়গাটার সমানাকৃতির।  দুটো ধাতুনির্মিত অর্ধবৃত্তাকার ব্রাকেট নীচের দিকে মুখ করে বোর্ডটার সাথে লাগানো ছিল।  বোঝাই যায় যে Piaggio এয়ারক্রাফটে ব্যবহার করার জন্য তড়িঘড়ি করে এই ‘বম্ব র‍্যাক’ বানানো হয়েছে গত রাতের মিশন কার্যকর করার প্রয়াসে।  এটির মাটিতে পড়ে যাওয়া আর পরবর্তীতে UNEPRO-র হাতে পড়াটা দূর্বিপাক বৈ কি।

 ঘ। ৮-৯ ডিসেম্বরের রাতে এতিমখানায় বোমাবর্ষণ সম্পর্কে আমাদের ধারণার পেছনে কারণ হচ্ছে এয়ারক্রাফট থেকে আসা শব্দটা পরিচিত, আর এন্টি-এয়ারক্রাফট থেকে কোন গোলাবর্ষণ না হওয়া।

প্রবীণ, অভিজ্ঞ, কর্তৃপক্ষের-সাথে-মানিয়ে-চলতে-সদা-ইচ্ছুক স্পিভাক তাঁর বার্তার শেষাংশে নিজের বিবেকের সাথে মনে হয় একটা বোঝাপড়ায় আসতে পেরেছেন। লিখেছেন –

“৩। হেনরি জরুরীভিত্তিতে এই ঘটনা সম্পর্কে তার ধারণা সেক্রেটারি জেনারেলকে জানাচ্ছেন এবং আর কি ব্যাবস্থা নেয়া যায় তা বিবেচনা করছেন।  তাঁর ভয় হচ্ছে, UNEPRO-র হস্তগত আলামত (বম্ব র‍্যাক) ধংশ করার জন্য পিএএফ (পাকিস্তান এয়ার ফোর্স) জাতিসঙ্ঘ কম্পাউন্ডে হামলা চালাতে পারে।  তিনি রেডক্রস নির্ধারিত নিরপেক্ষ এলাকার  (ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল – যেখানে প্রায় ৫০০ বিদেশী নাগরিক উদ্ধারের অপেক্ষায় আছেন – আর হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল) নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত, কারণ তাঁর ধারণা, পিএএফ এই ধরনের ঘটনা আরো ঘটাতে পারে, ইন্ডিয়ান এয়ায় ফোর্স-এর বিরুদ্ধে অভিযোগকে শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানার চেষ্টায়।  জাতিসঙ্ঘের কর্মীরা পল মার্ক হেনরিকে পরামর্শ দিয়েছে ঢাকা কর্তৃপক্ষের গোচরে এ ঘটনাটাকে না আনার জন্য।  তাদের ভয় যে’ই এই খবরটা তাদেরকে দেবে তাকে বন্দী করা হবে, অথবা গুম করে দেয়া হবে।  জাতিসঙ্ঘ ‘বম্ব র‍্যাক’-টার ছবি তুলে রেখেছে এবং ঝামেলা এড়ানোর জন্য আর কিছু না করে এটাকে স্রেফ রাস্তায় ফেলে রাখার কথা ভাবছে।

 “৪। আমি রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড আর রাষ্ট্রদূত বুশের কাছে (জর্জ বুশ তখন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত, পরবর্তীতে আমেরিকার একচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট – লেখক।) জোর আবেদন জানাচ্ছি, (দরকার হলে, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেলের সাথে আলোচনা করে) তাঁরা যেন কালবিলম্ব না করে ‘গোপন কূটনৈতিক প্রক্রিয়া’র (demarche-ডি’ইমা) মাধ্যমে তথ্য-প্রমাণ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর জাতিসঙ্ঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত শাহীর মুখোমুখি হন এবং তাদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তা আর গোপন থাকবে না, প্রচারিত হবে পুরোটাই।  ইতোমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বাঙালি আর বিদেশিরা সবাই বলাবলি করছে, বোমাবর্ষণের কাজটা পাকিস্তানিদেরই। যদিও, আমি আর হেনরি (পল মার্ক হেনরি) এব্যাপারে একমত হয়েছি যে, আমরা কেউই এ’নিয়ে কোন মন্তব্য করবো না।

 “৫। আমরা বুঝে শুনেই এই অভিযোগ আনছি এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে, আমি আর পল মার্ক হেনরি, সম্পূর্ণ সচেতন।  এটা বোঝা দরকার, প্রশাসনকে যে পদক্ষেপটা (demarche-ডি’ইমা) নিতে আমি পরামর্শ দিচ্ছি তা শুধুমাত্র এই ধরনের পৈশাচিক বর্বরতা – যা ইতোমধ্যে ঢাকায় কয়েক’শ এতিম বালকের মৃত্যু ঘটিয়েছে, তা – বন্ধ করার লক্ষ্যে”।

স্পিভাকের বার্তাটা ছিল ‘সাপ মরুক কিন্তু লাঠি না ভাঙ্গুক’ গোছের।  স্পিভাক আর হেনরি-র পরামর্শ ছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে সম্পর্ক খারাপ না করে যেন মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে সাবধান করে দেয়।

কিন্তু তা সত্বেও ইসলামাবাদে অবস্থানকারী রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের পছন্দ হলো না স্পিভাকের বার্তার বিষয়বস্তু।  ফারল্যান্ড প্রশ্ন তুললেন, স্পিভাক এত নিশ্চিত হলেন কি করে যে এটা পাকিস্তানীদের কাজ।

তিনি পরামর্শ করলেন ইসলামাবাদে অবস্থানরত বিশেষজ্ঞদের সাথে।

ডিআরপিএন (ডিফেন্স রিপ্রেজেন্টিটিভ টু পাকিস্তান) জেনারেল চার্লস ই. ইয়েগার এবং ডিফেন্স এটাচি কলোনেল রবার্ট এ. নোলান প্রশ্ন ওঠালেন, একটা ছোট Piaggio বিমান দিয়ে এমন বিরাটাকারের বোমা হামলা সম্ভব নয় [৬]।

তাঁরা আরো বললেন, বোমা হামলার আগে বা পরে কেউ যদি একটা Piaggio বিমানকে আকাশে দেখেও থাকেন, সেটা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বোমায় বিধ্বস্ত জায়গাটা দেখার জন্য এই বিশেষজ্ঞদের কেউই ঢাকায় যাওয়াটা প্রয়োজনীয় মনে করেন নি।  ঘটনাস্থলে পাওয়া ‘বম্ব র‍্যাক’টাও তাদের কেউ দেখেন নি।

পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যে তথ্য সরবরাহ করেছে তার ভিত্তিতেই তাঁরা স্বচ্ছন্দে তাঁদের মতামত দিয়েছেন।

তবুও ফারল্যান্ড তার বিশেষজ্ঞদের মতামতকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন মনে করলেন এবং তা’ই ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানিয়ে দিলেন।  ওয়াশিংটনও স্পিভাকের টেলিগ্রামকে কোন পাত্তাই দিলো না।

পাকিস্তানীরা নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জনসাধারণের ওপরে বোমা ফেলছে, ছোট ছোট এতিম শিশুদের মেরে ফেলছে, এবং এখনই না থামালে এই ধরনের জঘন্য বর্বর হত্যাকান্ড তারা আরো ঘটাতে পারে – এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও হোয়াইট হাউস এবং ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার।

কারণ সেই এপ্রিলের শেষের দিকে, মার্চের গণহত্যার পরেও, নিক্সন তার হাতে লেখা নোটে কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, ‘ডোন্ট স্কুইজ ইয়াহিয়া আ্যট দিস টাইম’ [৭]।

 

নিক্সনের হাতে লেখা নোট, এপ্রিল ১৯৭১

ডিসেম্বরেও ইয়াহিয়াকে চাপে না ফেলার নীতি নিক্সন প্রশাসন অব্যাহত রেখেছিল। ইয়াহিয়াকে ‘স্কুইজ’ না করলেও ভারত সরকার আর বাংলাদেশের যুদ্ধরত জনগণকে ‘স্কুইজড’ রাখার আয়োজনে (বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে) নিক্সন প্রশাসনের কোন ঘাটতি ছিল না [৮]।

 

বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর, ডিসেম্বর ১৯৭১

 

তথ্যসূত্র

[১] Indian planes bomb Dacca orphanage, hundreds die

http://news.google.com/newspapers?nid=799&dat=19711209&id=qo9PAAAAIBAJ&sjid=7lEDAAAAIBAJ&pg=1725,4672804

[২] Orphanage in Dacca Bombed

http://news.google.com/newspapers?nid=2209&dat=19711209&id=tZ0rAAAAIBAJ&sjid=HvwFAAAAIBAJ&pg=5996,1343649

[৩] War!

http://newsweekpakistan.com/features/685

[৪] Anderson, J., The Anderson Papers, Ballantine Books, New York, 1974.

[৫] Subj: Villainy by night

http://www.nixonlibrary.gov/virtuallibrary/releases/jul11/declass18.pdf

[৬] Anderson, J., The Anderson Papers, Ballantine Books, New York, 1974.

[৭] Subject: Policy Options Toward Pakistan

http://www.gwu.edu/~nsarchiv/NSAEBB/NSAEBB79/BEBB9.pdf

[৮] US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in 1971

http://defenceforumindia.com/forum/military-history/5943-1971-indo-pak-war-us-involvement-5.html