( নির্ভীক রাজনীতিক নির্মল সেনের স্বরণে সুলেখক ইরতিশাদ আহমদের এই লেখাটি আবার পোষ্ট করা হলো। এখানে অধ্যাপক অজয় রায়’এর ‘আমার বন্ধু নির্মল সেন: স্বস্তিতে নেই’ এই লেখাটির লিঙ্ক’ও রয়েছে। – সম্পাদক )
রূপান্তরের রূপকার
ইরতিশাদ আহমদ
অনিকেত – যার ঘর নাই, উদ্বাস্তু।
নির্মল সেন – যার ভয় নাই, নির্ভীক।
নির্মল সেন কলাম লিখতেন দৈনিক পাকিস্তানে, পরে দৈনিক বাংলায়, অনিকেত নামে।
প্রচন্ড ক্ষুরধার লেখা ছিল তাঁর। আগুন ঝরাতেন লেখায়। রাগিয়ে দিতেন ক্ষমতাবানদের। ক্ষেপিয়ে দিতেন ক্ষমতাহীনদের। আশা জাগাতেন অধিকারহীনদের মনে।
নির্মল সেনের মতো সৎ,আদর্শবাদী, নির্ভীক রাজনীতিক বাংলাদেশের গৌরব। তিনি মানুষের জন্য নিজের জীবনকে এমনভাবে তিলে তিলে উৎসর্গ করেছেন – ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়।
জানুয়ারির আট (২০১৩) তারিখে সন্ধ্যায় নির্মল সেন ঢাকায় এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। অকৃতদার এই সংগ্রামী মানুষটির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। নির্দেশ ছিল পরিজনদের প্রতি তাঁর মৃতদেহ দেশের কোন এক মেডিকেল কলেজকে যেন দেয়া হয়। তাই দেয়া হয়েছে, এখানেও নির্মল সেন অনন্য। তাঁর বাড়িটাও দিয়ে গেছেন একটা মহিলা কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্যে। আর বলে গেছেন, মরণোত্তর কোন পুরষ্কার যদি তাঁকে দেওয়া হয়, তা গ্রহণ না করতে।
বছর দুয়েক আগে ‘মুক্তমনা’য় তাঁর বন্ধু অধ্যাপক অজয় রায় লিখেছিলেন, আমার বন্ধু নির্মল সেন : স্বস্তিতে নেই
ভীষণ অসুস্থ ছিলেন নির্মল সেন জীবনের শেষ দিকে। হুইল চেয়ারে বসে কোনরকমে চলাফেরা করতেন। আমরা মুক্তমনার সদস্যরা তাঁর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের অমোঘ নিয়মেই মৃত্যু আসে – আসবে। নির্মল সেনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় নি।
নির্মল সেনের ঘর থেকেও ঘর ছিল না। প্রায় রাতই তাঁর কেটে যেত প্রত্রিকার বা পার্টির অফিসে।
দেশ থেকেও ছিল না সেই দেশ – যে দেশের স্বপ্ন তিনি দেখতেন, যে সমাজের রূপরেখা তিনি আঁকতেন।
পাকিস্তানী আমলে তাঁর পাসপোর্ট ছিল না। নিষেধাজ্ঞা ছিল সরকারের। মা’কে দেখেন নি তেইশ বছর। মা’সহ তাঁর পরিবারের প্রায় সবাই আটচল্লিশে দেশভাগের পরপরই চলে গিয়েছিলেন ভারতে। নির্মল সেন যান নি। আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এই চার বছর ছিলেন স্বাধীন পাকিস্তানের কারাগারে। তার পরেও আরো অনেকবার। স্বাধীনতা তাঁর জন্য আসে নি সাতচল্লিশে।
একাত্তরেও আসে নি। দেশের, সমাজের যে রূপান্তর তিনি চেয়েছিলেন, তা আসে নি। যুদ্ধের প্রকৃতি আর তার পরিণতি নিয়ে সংশয়ী ছিল তাঁর মন। দেশটা গুন্ডার দেশ হবে, স্বাধীনতার পরে কথায় কথায় বলেছিলেন শেখ মুজিবকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অধিকারে।
‘আমার ছোট কাকা ১৯৬৫ সালে কোলকাতা চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ছোট মামাকে নিয়ে আসুন। আমি বলেছিলাম তাকে আনা ঠিক হবে না। দেশটা হবে গুন্ডার দেশ। কাকা ভারতের নাগরিক, বিপদ হবে’।
একাত্তরে মা’কে দেখেছেন। তা’ও ষোলই ডিসেম্বরের পরে। তেইশে ডিসেম্বর। যুদ্ধের মধ্যে সময় পান নি।
‘মা বললেন, কিছুদিন থাকবি তো? আমি বললাম, আমি পরশু চলে যাবো’।
স্বাভাবিক জীবন ছিল না তাঁর নিজের। জেলে বসে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। একটানা চল্লিশ দিন অনশন করেছেন।
নির্মল সেন ভয় পেতেন না কাউকে। প্রভোস্ট, ভাইস চ্যান্সেলর, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট কারোরই তোয়াক্কা করতেন না। সবার মুখের ওপরে কথা বলতেন, বলতে পারতেন।
সবার জন্য চেয়েছিলেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। সমাজের নিম্নস্তরের খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য চাইতেন নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা, চাইতেন মানুষের মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন।
শুধু চাইতেন না – লড়াই করতেন। জীবন বাজি রেখে।
নির্মল সেন সাংবাদিক ছিলেন। হ’তে চান নি। হ’য়ে গেছেন। আসলে ছিলেন রাজনীতিক। ছিলেন ছাত্র আন্দোলনে, পরে শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয়। তার চেয়েও বেশি ছিলেন রূপান্তরের রূপকার – সমাজের, দেশের।
সত্তর দশকের শেষার্ধে তাঁকে দেখতাম হঠাৎ হঠাৎ। ধূলামলিন লম্বা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরিধানে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে। একগাদা কাগজ পত্রপত্রিকা বগলদাবা করে নিয়ে একাকী ঢাকার রাজপথে হেঁটে যাচ্ছেন। দেখলে কারো মনে হবে না কি অসম্ভব ধরনের মেধাবী, জেদী, একরোখা আর দুর্দান্ত সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। ছোটখাট দৈহিক গড়নের শরীরটার মধ্যে ছিল বিরাট এক বুকের পাটা, আর ছিল তার চেয়েও বড় একটা সংবেদনশীল হৃদয়।
নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন – তবু চাইতে হলো স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। ওই দাবীটাই সামনে চলে আসলো। সমাজ-রূপান্তরের বিশাল কর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছিলেন – তবুও সাংবাদিকের দায়িত্বটাই ঘাড়ে চেপে বসলো।
কিন্তু নির্মল সেন সমাজ রূপান্তরের আশা ছাড়েন নি। সারাজীবন নিয়োজিত ছিলেন সেই কাজেই।
লিখেছিলেন, ‘হাশেম চৌধুরী একটি লাশ চায়’। সত্তরের বারোই নভেম্বরের সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের সংবাদ রিপোর্ট। মৃত্যুপুরীতে খুঁজতে গিয়েছিলেন জীবন। শুনতে হলো লাশের জন্য হাহাকারের কাহিনি। বেঁচে গিয়েছিলেন হাশেম চৌধুরী। মারা গিয়েছিলেন তার তিন পুত্র আর এক কন্যা। নির্মল সেন যখন তার কথা শোনেন, তখন হাশেম চৌধুরী ঘুরে বেড়াচ্ছেন নদীর তীরে।
‘হাশেম চৌধুরী অন্তত একটি লাশ চায়। সেই লাশটি নিজের বাড়িতে কবর দেবে। ওই কবর কেন্দ্র করে স্মৃতি ধরে রাখবে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের’।
নির্মল সেনের রিপোর্ট পড়ে এক দম্পতি গভীর রাতে ফোন করেছিলেন পত্রিকা অফিসে। ‘তাদের আবেদন হচ্ছে আপনার কলম বন্ধ করুন। আপনার লেখা পড়ে প্রতিরাতে আমাদের কাঁদতে হয়’।
লেখা বন্ধ করেন নি নির্মল সেন। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ লিখেছিলেন দৈনিক বাংলায়, তিয়াত্তরের মার্চের ষোল তারিখে। মাত্র নয়দিন আগে হয়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন। হত্যা, গুম, খুন, গণপিটুনিতে মৃত্যু ছিল তখন নিত্যদিনের খবর।
আজকের মতোই। অবাক কান্ড। রূপান্তরের রূপকারকে মৃত্যুর কিছুদিন আগেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে বলতে হলো ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’।
নির্মল সেনের কলাম পড়ে বিচলিত হতেন শাসকগোষ্ঠি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজিবর রহমান) পড়তেন তাঁর লেখা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে। দেশের হালহকিকত, মানুষের ‘মুড’, রাজনীতির ‘পালস’ বুঝতে হলে নির্মল সেনের কলাম পড়া চাই। বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী জানতেন এবং তাই করতেন। নির্মল সেনও জানতেন, তাই বিশেষ বিশেষ বিষয় বেছে নিতেন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু গোল বাধতো মাঝে মাঝে। কারণ নির্মল সেন শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেই ক্ষান্ত হ’তেন না। তীক্ষ্ণ সমালোচনার আঘাতে জর্জরিত করতেন কর্তৃপক্ষকে। প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন, ‘নির্মল সেনের লেখার শেষে হুল থাকে’। ক্ষিপ্ত হতেন তিনি। প্রায়শই ‘মেসেজ’-এর জন্য রাগটা গিয়ে পড়তো ‘ম্যাসেঞ্জার-এর ওপরে।
কিন্তু, নির্মল সেন সরকারী নীতির সমালোচনা করতে পিছপা হ’ন নি কখনো। শেখ মুজিব জানতেন, সবাইকে বাগে আনতে পারলেও নির্মল সেনকে আনা যাবে না। তাই যখন বলে দিলেন বাকশালে যোগ দেবেন না শেখ মুজিবের মুখের ওপরে, শেখ মুজিবও সবাইকে পরামর্শ দিলেন নির্মল সেনকে যেন না ঘাঁটায়।
শেখ মুজিবের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল নির্মল সেনের। পড়েছেন গোপালগঞ্জের স্কুলে। তাঁর কাকাদের শেখ মুজিব মামা বলে ডাকতেন।
প্রাণখোলা প্রশংসা করেছেন তিনি মানুষ শেখ মুজিবের। লিখেছেন,
‘উল্লেখ করলে অন্যায় হবে না, এ একটি মানুষের আমলেই লিখে বা কথা বলে সাড়া পাওয়া যেত। পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের লেখা বা বক্তব্য মনে হয় তিনি খুটে খুটে পড়তেন। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে আমার প্রতিটি লেখা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলো। সে লেখার ভিত্তিতে নির্দেশ গিয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একথা ঠিক, তার আমলের শেষের দিকে তিনিই নির্দেশ দিয়ে আমার লেখা বন্ধ করেছিলেন তবুও বলবো তার আমলে লেখায় সুখ ছিলো। লিখলে ফল হতো’।
কিন্তু সে ফল বিস্বাদ ঠেকতো কারো কারো কাছে। নির্মল সেনের কলাম বন্ধ করা হয়েছিল শেখ সাহেবের নির্দেশে। চুয়াত্তরে জরুরী অবস্থা জারীর পরপর তাঁর লেখা বন্ধের নির্দেশ এসেছিলো।
‘দৈনিক বাংলার সম্পাদক তখন নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, প্রধানমন্ত্রী আপনার লেখা বন্ধ করেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন অনিকেত ছদ্মনামে নির্মল সেনের উপসম্পাদকীয় আর দৈনিক বাংলায় ছাপা হবে না’।
মাথা বিগড়ে গেল নির্মল সেনের। সরাসরি চলে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে গণভবনে।
‘আপনি আমার লেখা বন্ধ করলেন কেন। আর সে কথা আমাকে না জানিয়ে সম্পাদক সাহেবকে জানালেন কেন। তারাতো আপনার সামনে ভয়েই কথা বলে না। তাদের কাছে এই কথা বলে লাভ আছে। তবে আপনার কথা আমি মানবো না। আমি আজকেই এই গণভবন থেকে ফোনে দৈনিক বাংলায় আমার লেখা দেবো’। ‘প্রধানমন্ত্রী খানিকটা গম্ভীর হলেন, ইংরেজিতে বললেন – নির্মল সেন, আপনাকে আমি জেলে পুরবো না। আপনি জনপ্রিয় হবেন। আপনার জন্য একটি সিসার গুলিই Sufficient (সাফিশিয়েন্ট),আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী, একই কথা আপনার জন্যও প্রযোজ্য। আপনার জন্যও একটি সিসার গুলিই Sufficient (সাফিশিয়েন্ট)’।
শেষ পর্যন্ত হাস্যরসের মধ্য দিয়ে এই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। নির্মল সেন সেদিন গণভবন থেকেই ফোনে দৈনিক বাংলার জন্য লেখা দিয়েছিলেন।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। বাকশাল গঠনের পর নির্মল সেনের লেখা আবার বন্ধ করা হয়। এ নিয়েও বাকবিতন্ডা হয় প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সাথে নির্মল সেনের।
বাকশালের সময় সরকারী নিয়ন্ত্রণে মাত্র চারটি দৈনিক রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে সাংবাদিকদের নেতা নির্মল সেন গিয়েছিলেন শেখ মুজিবের কাছে। সেদিনও বাদানুবাদ হয় দুজনের মধ্যে প্রচন্ড। ‘you are going too far (ইউ আর গোয়িং টু ফার) নির্মল সেন!’ শেখ মুজিব ধমক দিয়েছিলেন। নির্মল সেন বলেছিলেন,‘ you are a liar (ইউ আর আ লায়্যার)’।
ফেরার সময় শেখ সাহেব অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নির্মল সেনকে বলেছিলেন, ‘নির্মল সেন, সত্যি সত্যি দেশটা গুন্ডার দেশ হয়ে গেছে। কিছু করতে পারলাম না। আপনি ঠিক বলেছেন, দেশটা হবে গুন্ডার দেশ’।
আমাদের সৌভাগ্য নির্মল সেন লিখে গেছেন তার স্মৃতিচারণমূলক রচনা, আমার জবানবন্দী*। অনেক কথাই লিখেছেন তিনি আমার জবানবন্দীতে। কিংবদন্তীর মতো মনে হয় তাঁর বর্ণিত ঘটনাগুলোকে। ইতিহাস, স্মৃতিচারণ, আত্মকথা সবই আছে তাঁর জবানবন্দীতে। অবিশ্বাস্য মনে হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু নির্মল সেন মানুষটাইতো ছিলেন অবিশ্বাস্য – রূপান্তরের এক বিস্ময়কর রূপকার। গুন্ডার দেশে বিরল এক ব্যাক্তিত্ব।
*নির্মল সেন, আমার জবানবন্দী, তরফদার প্রকাশনী, ২০০৬।
জানুয়ারি ২০১৩
likhata pore khub valo laglo-mon sue gelo. nirmol sener dirgo akta interview ami nea silam. kintu seta amar nij basa theke haria gese. seta r sapte parini. ami bohudin unar kase gesi. ki j bolten ami bujtum na. akta sele se amake bujia dito. ami jotobar gesi totobar unake dekhe mon karap kore chole assi.maje maje mone hoto unake amar basae ane porichorja kori.
পরবর্তীতে বাঙরেজি মন্তব্য প্রকাশ হবার নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। 🙂
-মুক্তমনা মডারেটর
ইরতিশাদ ভাই,
আপনাদের সবার সাথে আমার আন্তরের শ্রদ্ধাটুকুও রইলো তাঁর প্রতি। তাঁর আকাঙ্খা গুলো আমাদের আচ্ছন্ন করুক।
@কেশব অধিকারী,
সুন্দর বলেছেন।
ধন্যবাদ চমৎকার ব্লগটি লেখার জন্য। (Y)
নীচে বইটার নাম দেয়ায় ভাল হলো। আমি এই নামটাই খুঁজতে ছিলাম।
অনেক দিন ব্লগের বাইরে ছিলাম। এই লেখাটা পড়ে আবার ফিরে এলাম।
নির্মল সেনের নাম তরুণ প্রজন্মের তরুণেরা ভুলে গেছেন, ভুলে যাবেন। কিন্তু আমি ভুলতে পারব না এই দৃঢ় আত্মচেতা মানুষের প্রতিচ্ছবিটুকু। আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন তিনি। কাউকেই পরোয়া করতেন না, এমনকি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানকেও নয়, যদিও মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কমতি ছিল না তার। তাকে ঘিরে আমার এবং আমাদের কত টুকরো টুকরো স্মৃতি আছে তা বলার নয়। শেষ বার তাকে দেখেছিলাম যখন আমি সিঙ্গাপুর ছিলাম। দারুণ অসুস্থ ছিলেন তিনি সেসময়। হয়ে গিয়েছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ। আমাকে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে দেখে চিনতে পারেননি। আমিও পরিচয় দেইনি, কি দরকার পারিবারিক পরিচয়ের। বলেছিলাম আমার নাম ‘চেগুয়েভারা’। এর পর থেকে তিনি আমাকে ‘চে’ নামেই ডাকতেন, সবাইকে ‘চে’ নামেই পরিচয় করিয়ে দিতেন। 🙂 …
মুক্তমনা থেকেও একটা সময় তার চিকিৎসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কতটুকু লাভ হয়ছিল জানি না, কিছু করতে না পারি, রোগাকীর্ণ শরীরে স্বস্তি হয়তো খানিকটা দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যু তার স্বাভাবিক নিয়মেই এসেছে, আসবে। … হ্যা, চলেই গেলেন তিনি শেষ পর্যন্ত। তিনি চলে গেলেও রয়ে যাবে তার প্রেরণাটুকু, অন্ততঃ আমার কাছে তো বটেই।
এই নির্লোভ, আত্মত্যাগী, সাহসী আর চিরকুমার মানুষটিকে নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ ইরতিশাদ ভাইকে (ডঃ ইরতিশাদ আহমদ)। সত্যই তিনি ছিলেন আমাদের রূপান্তরের রূপকার।
@অভিজিৎ,
কৃতজ্ঞতা জানাই আমার লেখায় মন্তব্যের জন্য। তোমার বাবা অধ্যাপক অজয় রায়-এর কথা ‘আমার জবানবন্দী’-তে বেশ কয়েকবার এসেছে। বোঝাই যায়, বেশ ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন তাঁরা। তোমার বাবার জন্য সমবেদনা রইলো।
অসাধারণ এই লেখাটি পড়ে নির্মল সেনের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল!
নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন – তবু চাইতে হলো স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি।
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আর নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তার মাঝের পার্থক্যটুকু ধরতে পারলাম না, ইরতিশাদ ভাই।
সমাজ-রূপান্তরের বিশাল কর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছিলেন – তবুও সাংবাদিকের দায়িত্বটাই ঘাড়ে চেপে বসলো।
একজন সাংবাদিক কি সমাজ-রূপান্তরের নেতা হতে পারেন না?
‘হাশেম চৌধুরী অন্তত একটি লাশ চায়। সেই লাশটি নিজের বাড়িতে কবর দেবে। ওই কবর কেন্দ্র করে স্মৃতি ধরে রাখবে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের’।
বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল! শব্দের শক্তি যে কি বিশাল, তা এই লাইনটি পড়লেই টের পাওয়া যায়।
প্রধানমন্ত্রী খানিকটা গম্ভীর হলেন, ইংরেজিতে বললেন – নির্মল সেন, আপনাকে আমি জেলে পুরবো না। আপনি জনপ্রিয় হবেন। আপনার জন্য একটি সিসার গুলিই Sufficient (সাফিশিয়েন্ট),আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী, একই কথা আপনার জন্যও প্রযোজ্য। আপনার জন্যও একটি সিসার গুলিই Sufficient (সাফিশিয়েন্ট)’।
লেখাটার সেরাংশ! সবচেয়ে চমকপ্রদ অংশ!
@কাজি মামুন,
সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
পার্থক্যতো তেমন নাই। জীবন একটা চলমান প্রক্রিয়া, আর মৃত্যু হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার অধীন একটা ঘটনা। বলতে চেয়েছি, নির্মল সেন আর তাঁর মতো মনিষীরা যাঁরা মানুষের জীবনে রূপান্তর চেয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের তো মৃত্যু নিয়ে লেখার কথা ছিল না। তবুও লিখতে হয়েছিলো। স্বাভাবিক মৃত্যুটাও কেমন অস্বাভাবিক চাওয়ার বস্তু হয়ে উঠলো।
কি জানি, বোঝাতে পারলাম কি না।
অবশ্যই পারেন – পারেন যে তার প্রমাণ নির্মল সেন নিজেই। কিন্তু সাংবাদিকের কাজ একটা বিশেষ পেশার কাজ। অন্য যে কোন পেশা – যেমন শিক্ষকতার কাজও তিনি নিতে পারতেন (নিয়েছিলেনও, গৃহশিক্ষকতা করতেন তিনি)। কিন্তু তাঁর আসল কাজ ছিল রাজনীতিকের – সমাজ-রূপান্তরের। সাংবাদিকের কাজটা অনেকটা তাঁর ঘাড়ে চেপে বসেছিল। তিনি নিজেই ‘আমার জবানবন্দী’তে লিখেছেন – সাংবাদিকের পেশাটা তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না।
মামুন, আপনার মত চিন্তাশীল পাঠক মুক্তমনার প্রাণ। ঔৎসুক্য এবং জানার আগ্রহের জন্য প্রশংসা আপনার প্রাপ্য।
এমন মহৎ মানুষগুলো যদি যুগ যুগ ধরে বাঁচতো, তাহলে দেশ আরো অনেক কিছুই পেতো । আমরা মহৎ মানুষদের গুরুত্ব বুঝি না, যখন বুঝি তখন তারা চলে যান । আমাদের উচিৎ তারা বেঁচে থাকা অবস্থায় তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া আর মৃত্যু বরণ করলে ভুলে না যাওয়া, তার মতো আলোকিত পথ অনুসরণ করা । দেশটা আমাদের সবার, সবারই দেশের প্রতি দায়িত্ব আছে ।
@ফাহিমা কানিজ লাভা,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
নির্মল সেনের সাথে শেখ মজিবের যোগাযোগের যে ধরণ, একজন নির্ভীক সাংবাদিকের সাথে সরকার প্রধানের যে কথোপকথন আজকালকে তা কল্পনাও করা যায় না। ধন্যবাদ ইরতিশাদ ভাই নির্মল সেনের জীবনের মূল্যবান ঘটনাবলি জানানোর জন্য ও তাকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
@গীতা দাস,
আসলেই, সময়টা অনেক পালটে গেছে। দেশটা এখন অনেক বেশি নষ্টদের অধিকারে। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি মহলে সত, নিস্বার্থ, নির্ভিক, নিরপেক্ষ বলতে প্রথমেই মনে চলে আসে নির্মল সেনের নাম। এ ধরনের মানুষ বিরল, যুগে যুগে আরো বিরল হবে।
বংগবন্ধুর চাটুকারিতা করে অনেকেই আখের গুছিয়েছে, সাংবাদিকদেরই কেউ কেউ চামচামি করে বিদেশের নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে, কেউ দেশেই দুই হাতে কামিয়েছে; নির্মল সেনও অনায়াসে কাজটি করতে পারতেন বংগবন্ধুর সাথে ব্যাক্তিগত সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে। ন্যায়ের সাথে কোনদিন আপোষ করেননি, ফলাফলও হয়েছে সেরকম, দারিদ্র অবহেলার মাঝেই জীবনাবসান ঘটেছে।
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেশের লোকে কোনদিন হয়ত পাবে না, তবে অন্তত সরকার প্রধানের মুখের ওপর কেউ কথা বলতে পারে এমন লোক আশে পাশে থাকলে শত হতাশার মাঝেও সান্তনা পাওয়া যায়।
নির্মল সেনকে নিয়ে বই লেখার মত মনে হয় কেউ নেই, লেখা হলেও পড়বেই বা কয়জনা। ধন্যবাদ এই দেবতূল্য মানুষটিকে নিয়ে লেখার জন্য।
@আদিল মাহমুদ,
অনেক ধন্যবাদ পড়ার এবং মন্তব্যের জন্য।
হতাশাব্যঞ্জক, তবে বাস্তবিক।
আমার এই ছোট পরিসরের আলোচনায় নির্মল সেন-এর ব্যাক্তিত্বের কয়েকটা দিক হাইলাইট করার চেষ্টা করেছি। করতে গিয়ে চোখে জল এসেছে। কিন্তু দরকার চোখের জল নয়, বুকের আগুন। আর তাই নির্মল সেন-এর ব্যাক্তিত্ব শুধু নয় তাঁর আদর্শিক অবস্থানটাকেও বোঝা দরকার।
@ইরতিশাদ,
খুব ভালো বলেছেন। আদর্শিক অবস্থান ধরে রাখতে জীবনভর যে কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা করবার মত মানুষ পাওয়া ভার। যারা আছে বা থাকবে ওদের কজনাই বা আমাদের দৃষ্টির সীমানায় ধরা দেবে? আমরাও কি আর সত্যি খুঁজবো তাদের? আজকের স্বার্থপর লোভী জীবনে কোথায় পাবো তাদের? নির্মল সেনদের মত আলোধরারা বারবার ফিরে আসুক পথহারাদের বাতিঘর হয়ে (F)
@কাজী রহমান,
সুন্দর, কাব্যময়। ধন্যবাদ।
জানতাম নির্মল সেন একজন বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, একজন শক্ত কলাম লেখক কিন্তু তাঁর ঘটনা বহুল জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ছিল না পূর্বে। আপনার লেখা পড়েই জানতে পারলাম তিনি শুধু নামেই ‘নির্মল’ ছিলেন না কাজেও ছিলেন নির্মল।
@রাজেশ তালুকদার,
ধন্যবাদ।
এবং ‘৭৩ এ ডাকসু নির্বাচনে একটি ঘটন ঘটেছিল, ঐ রেকর্ড আজ অব্দি কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। সেটি ছিল ছাত্রলীগ কর্তৃক ব্যালেট বক্স ছিনতাই। ডাকসু-র ইতিহাসে এ বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ছাত্রলীগ অনন্য।
প্রধানমন্ত্রী এতটাই বিচক্ষণ ছিলেন যে, তাজউদ্দীন আহমেদকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, খন্দকার মুশতাককে কাছে টেনে নিলেন। রাজনীতিতে হৃদয় দরকার, কিন্তু প্রজ্ঞাহীন হৃদয়ের উজ্জ্বলতর উদাহরণ শেখ মুজিব।
ভুট্টোকে লাল গালিচায় বরণ করে নিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থাপন করলেন। ইসলামিক সম্মেলন সংস্থায় যোগ দিলেন……আরো আরো আরো…।।
নির্মল সেনদের মত শুধু মুক্ত চিন্তক নন, শুভ বুদ্ধির মানুষ দিন দিন মনে বিরল হয়ে ওঠছে।
আপনি শুভ-বুদ্ধির উদয়ক, অগ্রসর চিন্তক নির্মল সেনকে সামনে এনে, মুক্তমনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, শুভ-বুদ্ধির উদয়ণ কতটা জরুরী। এখানেই এ লেখার সার্থকতা।
অনেক দিন পর আজ আবার বৃষ্টি হলো।
@স্বপন মাঝি,
ধন্যবাদ আলোচনার জন্য।
নির্মল সেন(১৯৩০-২০১৩) চলে গেলেন পরপারে না ফেরার দেশে কিছুদিন পূর্বে (গত ০৮/০১/২০১৩) খুব আশা করেছিলাম এবং প্রতিক্ষায় ছিলাম প্রিয় ‘মুক্তমনা’য় তাঁকে নিয়ে লেখা হবে, অবশেষে তাঁকে নিয়ে আপনার চমৎকার লেখাটি পড়ে খুবই ভাল লাগল, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ……’আশাপূর্ণ হল আমার মনের বাসনা’
নির্মল সেনকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই, ইতিমধ্যে সচেতন পাঠক মাত্রই তাঁকে প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক, বাম রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে
চিনেন-জানেন। তিনি আমরণ সংগ্রামী বিপ্লবী দৃঢ় নির্ভীক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন সুবিধাবঞ্চিত, অভাগা গরীব দুঃখী শ্রমিক শ্রেণীর। লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তার বনাঢ্য জীবনকে অতিবাহিত করেছেন মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত। সংগ্রামমুখুর জীবনে আজীবন লড়াই করে বেঁচে ছিলেন তিনি এক বীর সেনানী লড়াকু সৈনিক!জেলজুলুম, দারিদ্র্য আর ব্যাধির কাছে কখনও হার মানেনি! ত্যাগের অনলে জ্বলেছেন সারা জীবনভর। দেশভাগের পূর্বে পরিবারের সবাই পাড়ি জমালো ওপারে, দেশমাতৃকার প্রবল প্রেমের টানে রয়ে গেলেন তিনি প্রিয় জন্মভুমিতে, নিজেকে উজাড় করে দিলেন মাতৃভুমিকে ভালোবেসে, জীবন যৌবনকে তিলে-তিলে নিঃশেষ করে।
মানুষ বাঁচে তাঁর কর্মগুণে, নির্মল সেন এমনই একজন মহান কর্মবীর সৎ আদর্শবান ব্যক্তি ছিলেন যিনি বরণীয়, স্মরণীয় এবং অমর হয়ে থাকবেন আমাদের মানসপটে অনাদিকাল………
@শামিম মিঠু,
অনেক ধন্যবাদ। আসলে আমিও আশা করছিলাম, নির্মল সেন-এর মৃত্যুর পরে মুক্তমনায় তাঁকে নিয়ে কেউ লিখবেন। নির্মল সেন কে আমাদের আরো বেশি করে জানা এবং জানানো দরকার – নতুন প্রজন্মের কাছে এঁরা যেন অপরিচিত থেকে না যান, যেন হয়ে না যান প্রগৈতিহাসিক।
লেখাটা বেশ পছন্দ হলো ইরতিশাদ ভাই। সেই সাথে শিরোনামটাও।
আমি উনার নাম শুনেছি, কিন্তু, খুব বেশি জানতাম না উনার সম্পর্কে। আর জানবোই-বা কি করে, পত্রিকার পাতাগুলোতো ভরে থাকে শুধু উকিল-ব্যারিস্টারদের হানাহানির খবরে দিয়ে। মৃত্যুর আগে উনার শেষ চারটা ইচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সেটা পড়ে মনে হয়েছে বাঙালি জাতি যে জীবিত অবস্থায় কাউকে সন্মান দিতে জানে না, সেটা ভালো করেই টের পেয়েছিলেন তিঁনি।
এই লিঙ্ক থেকে নীচের লাইনগুলো তুলে দিলাম।
@মইনুল রাজু,
রাজু, অনেক ধন্যবাদ। নির্মল সেন-দের মতো মানুষের সংখ্যা দেশে কমে যাচ্ছে, এটা একটা চিন্তার বিষয়। লিঙ্কটা দিয়ে ভাল করেছ। মওলানা ভাসানী কি বলেছিলেন নির্মল সেনকে, জানার খুব কৌতুহল আমার। আরো জানতে ইচ্ছে করে কেন তিনি কথাগুলো তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশ করতে চেয়েছেন, আগে নয়।