বহুবার রঙ বদলেছে সেকেলে দেয়ালটার, ঘষামাজা সেই রঙটাকে এবার গোলাপি ভাবা যেতে পারে, তাতে আটকানো একটা দেয়াল ঘড়ি; সেকেলে নয়-আবার ঝাঁ-চকচকে আধুনিক ও নয়, কোনমতে কাজ চলে যায়। ঘরের বাসিন্দা একজন, কেননা সঙ্গী হিসেবে দেয়াল ঘড়িকে কেইবা মানে। স্ফটিক জানালা জুড়ে আলো-হাওয়া যতটুকু আসে তাতে, চোখে দেখা কিংবা নিঃশ্বাস নেওয়ার কোনটাই ঠিকঠাক হয়ে ওঠেনা। স্ফটিকের ওপাশে রৌদ্র-প্রখর গ্রীষ্ম বারোমাস, সেই আগুনে ঘেমে-নেয়ে বৃহৎ পৃথিবীটা সুবিশাল সরীসৃপের মতন ঠেলে-গুতিয়ে-গ্রাসের আচ্ছাদনে জীবনের পথে গড়িয়ে চলেছে অবিরত আর এপাশে অবরুদ্ধ চার-দেয়ালের মাঝে কনকনে প্রখর শীত; সেই শীতে জমে থাকে শৈশব-জমে থাকে কৈশোর। সেই নিস্তব্ধতায়, টুকরো-টুকরো মৃত্যুর মতন শীতল নিদ্রা-নিমগ্নতা থেকে জাগিয়ে তোলার অরূপ-সোনার কাঠি সে ঘরে একটাই, সেটা গল্পগুচ্ছ। সেই গল্পগুচ্ছটা একবার ছুঁয়ে দেখলেই চিত্রপটটা একেবারেই যায় পাল্টে, দেয়ালের ঘড়িটা বদলে গিয়ে রূপ নেয় মহাকালে আর সেখান থেকেই উঠে আসে অদূর অতীতের ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনি, সৃষ্টি হয় দক্ষিণমুখী নিবিড় জানালা আর অবারিত হয় দুয়ার। সেই দুয়ারে নিত্য আমন্ত্রণ সুখ-শোকের, জানালার ধার বেয়ে হাঁকডাক জুড়ে দেয় কল্পপাহাড় থেকে দই নিয়ে নেমে আসা ফেরিওয়ালারা আর তখন, তখন নবপ্রাণ হৃদয়ের আঙিনা সিক্ত করে নেমে আসে ঝরঝর বরষা, সেই বরষা যে মনে করিয়ে দিতে পারে বহু-বহু কাল আগের ফেলে আসা শৈশব-ভুলে যাওয়া কৈশোর। জীবনের অমল আলোকমালায় এক নিমিষেই সহস্র মৃত্যুকে নবনিত্য-সুবর্ণ ধরণীর বুকে মিলিয়ে দেয়, প্রাণ মেলে অঙ্কুরিত হয় আরক্ত বাসনারা, স্ফটিকের এপাশ আর ওপাশের ভেদ একেবারেই যায় ঘুচে, ভেঙে পরে আধুনিকতার দেয়াল আর চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় সংস্কারের অভেদ্য প্রাচীর। সেই সজীবতার সুরে নিদ্রাভঙ্গ রাঙা রাজকন্যার অপূর্ব আঁখিতে সন্ধ্যা আকাশ মেলে ধরে নক্ষত্রের রূপ, স্বর্ণালী চাঁদরে মোড়া অপরূপা-রূপসী বাঙলার শাশ্বত রূপ, ফুলের নরম রেণুর মতন ফসল আর নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল-উচ্ছ্বাসের প্রাণবন্ত জীবন।

ছোটগল্পের ক্রমবিকাশঃ
সময়টা ছিল পরিবর্তনের-বিকাশের, শত বরষের ভাব-উচ্ছাস তখন এক নতুন সৃষ্টির উৎসবে আলোর পথ খুঁজছে, প্রাচীনতার ঐতিহাসিক সোপান পেরিয়ে বাঙলা সমাজ-ভাষা সুবিকশিত নব্যযুগের পরিপুর্ণা নারীত্বে। ভোল্‌গার তীর থেকে গঙ্গা অবধি প্রবাহিত পলি মাটিকে করেছে কাজল আর ভাষার-বর্ণের দ্যোতনার অপ্সরী অলঙ্কার থেকে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ গুটির মত ছেঁকে পরিস্রুত করলেন বিদ্যাসাগর আর যেই ‘বাঙলার সমাজকে’ বাঙালির প্রাণ বলে মানতেন রবিঠাকুর সেই সমাজের দীর্ঘকালের প্রস্তরীভূত সংস্কার-কুসংস্কারের শিলা ভাঙ্গার পথে ব্রতী হলেন রামমোহন রায়। সেই ভাঙ্গনের গানে, করুনাধারায়, আশ্চর্য নবীনতায় উন্মুখ আঁখি মেলে অঙ্কুরিত হল স্বাধীনতা স্বপ্নের শ্যামপত্রপুষ্প। এমন এক আশ্চর্য সুবর্ণ সময়ে সাহিত্য ভূবনে এলেন রবীন্দ্রনাথ।

সভ্য মানুষের প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি কাব্য, সেকথা সবাই জানি কিন্তু গল্প এলো কবে থেকে? সে উৎসের সন্ধান করতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে দুই লক্ষ বছর আগের বরফযুগের হাইডেলবার্গ গুহায়, তখনো আবিষ্কৃত হয়নি লিপি কিংবা বর্ণমালার। তারো অনেক পরে এক লক্ষ বছর আগের নিয়ান্ডাবথাল মানুষের অঙ্কিত গুহাচিত্রে আমরা উপাদান খুঁজে পাই গল্পের, কাহিনীর। তাই হাইডেলবার্গের গুহায় গল্পের উৎস সন্ধান করাটা নিতান্তই অবান্তর বলে মনে হয় না। এতো গেলো কথ্য গল্পের কথা, এরপর বলা যেতে পারে উপকথার কথা। মানুষ আর পশুতে সেই সময়ে জীবন ও আচরণের হাজার মাইলের ব্যবধান গড়ে ওঠেনি, তাই উপকথা পরিপূর্ন পশুত্বে, মানুষ ও পশুর নিবিড় বন্ধন আর শত্রুতায়, যার বড় উদাহরণ খ্রিষ্টপূর্ব চারশত শতাব্দী পূর্বে সংকলিত ঈশপের গল্প। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩০-৩৫০ এ রচিত বৌদ্ধজাতকের গল্প, পঞ্চতন্ত্র ও হিতপদেশে, আরব্য উপন্যাসের গল্প। এরপর এলো সমাজশাসন, নীতিশাস্ত্র ও ধর্মশিক্ষামূলক গল্প; বাইবেলে, ওল্ড টেস্টামেন্টে আর ভারতবর্সে তখন বানভট্ট, কালিদাস, ভাসের গল্পে রাজা-মহারাজার কাহিনী। এরপর সে ধারাও বিলুপ্ত হয়ে এলো মঙ্গলকাব্য, পুরাণ কাহিনী যা পরিপূর্ণ ছিল ভক্তিরসে, দেব-দেবীর স্তুতিতে। পরবর্তী সময় মধ্যযুগের ইউরোপীয় প্রচলিত কাহিনী ‘রোমান্স’ এর কল্পলোক, মানবীয়-দানবীয় আচরণ আর রাজকীয় পুরুষাকায়ের গল্পে পরিপূর্ন, এ সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘হোলি গ্রেইলের’ গল্প। পরবর্তি সময় রেনেসাঁসের, খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে, এই সময়েই গল্পগুলো কল্পলোকের অতিদিপ্যমান রঙিন আকাশ থেকে নেমে এলো ভাল-মন্দ মেশানো মানবীয় বাস্তবলোকে। অমৃতের সুধা নয়, নয় অমরত্ত; পৃথিবীর বুকে মানুষের ব্যথা-স্বপ্ন-ক্লান্তি এলো ছোটগল্পে, এলো বুদ্ধি-চেতনা; সুতীব্র জ্বালামোয়ী ব্যাঙ্গ-অট্টহাস্যে ‘রোমান্স’এর কল্পবেলুন চুপসে গেলো এক অনন্য রচনা ‘ডন কিহোতি’র আগমনে। এর পর চতুর্দশ শতাব্দীর কাব্য-গ্রন্থ, চসার এর ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’, বোকাচ্চিওর ‘ডেকামেরন’ দেখালো সাদাকালোর দ্বন্ধ ও পারস্পারিকতা মানুষের জীবনে। এভাবেই কেটে গেলো আরো কিছু শতাব্দী-মধ্যযুগ, এলো আধুনিকতার কাল, এলো শিল্পবিপ্লবের সময়। উনবিংশ শতাব্দীর আশ্চর্য দ্বন্দ্বমুখর মনস্তত্বের কালে জন্ম হলো এক সতন্ত্র-আধুনিকতর সৃষ্টি, ছোটগল্পের; আধুনিকতার নতুন পৃথিবীর রূপক আমেরিকায়। মোপাসাঁ, এডগার আল্যান পো, নাথানিয়েল হর্থন আর নিকোলাই গোগোল এর কিছু অনবদ্য সৃষ্টিতে সাহিত্যে খুঁজে পেলো জীবনকে, একেবারে নিখাদ, নিরাবরণ যাপিত জীবন। ফ্রান্স-রাশিয়া ও উত্তর আমেরিকার মত আধুনিক রাষ্ট্র তথা পৃথিবীবাসী প্রাণভরে উপভোগ করেছিলো সেই অবিনাশী নব সৃষ্টিকে কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যশাখায় আম্রপলি ফলানো দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল? কি হচ্ছিলো তখন সেখানে? বঙ্কিমচন্দ্র তখন বৌদ্ধিক ও সাহিত্য রস জড়িয়ে নতুন এক ভাষারীতিতে লিখছিলেন বটে তবে সেই সাহিত্যকে ঠিক আধুনিক-চিরনবীনা বলে ভাবা যায় না, তাছাড়া রোমান্সের মোটা তুলিতে লেপা রাজপুত, ব্রাহ্মণ, ধর্মীয়, ইতিহাস-ঐতিহাসিকতার রক্ষণ-সংস্কারের সুর সে সাহিত্যে বড় বেশি চড়া। এমনকি তা ছোটগল্পও নয়। সাহিত্যে ঐতিহাসিক সুর ও পটভূমিটাই ছিলো বড় বেশি রাঙানো; বাঙালির বিশেষত সাধারনের জীবন-রঙ সেখানে ছিল ধূসর ছায়ালোকের মতন অস্পষ্ট, স্তিমিত। রবীন্দ্রনাথ তখন লিখছেন ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ, তাই বলে বাংলা সাহিত্যে, জীবনের এই ধূসর-মালিন্যময় অবহেলা তার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। ১৮৮৮ সালে ‘শ্রীশচন্দ্র’কে তিনি লিখলেন,

“আপনি কোনোরকম ঐতিহাসিক বা ঐপদেশিক বিড়ম্বনায় যাবেন না-সরল মানবহৃদয়ের মধ্যে যে গভীরতা আছে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখদুঃখপূর্ন মানবের দৈনন্দিন জীবনের যে চিরানন্দময় ইতিহাস তাই আপনি দেখাবেন।… বাংলার অন্তর্দেশবাসী নিতান্ত বাঙালিদের সুখদুঃখের কথা এ পর্যন্ত কেউই বলেন নি…।”(১)

এই কথাগুলো বলবার ভার শেষমেশ রবীন্দ্রনাথই তুলে নিয়েছিনেন তার উৎসরিত স্বর্নকলমে; মানবিক ভিত্তির দৃঢ়তা ও মমতার ছাউনিতলে তিনি দেখালেন বাংলার জীবন, নরনারী, বাল্য-কৈশর; সুতীব্র মমতায়-আবেগে তিনি দেখালেন বাংলার রূপ, নিবিড় স্পর্শকাতরতায় দেখালেন, ভালবাসা, অভিমান, অবমাননার অনুপুঙ্খ, অসঙ্কোচে ফুটিয়ে তুললেন কামরাঙা কামনাগুলো; অবিনশ্বর প্রাণ কালের, সময়ের, জীবনের, প্রকৃতির। দেখালেন সংস্কারের সূচীভেদ্য জাল, আর তার ফাঁকে সঙ্কুচিত রক্তাক্ত হৃদয়, ক্রন্দিত মুখ আর পশুত্বের পরাভব। তিনি একাধারে বাৎসল্যসিক্ত জনক, ঐশ্বরিক নির্মাতা, উদ্ভাবক, সুরকার ও রূপস্রস্টা বাংলা ছোট গল্পের। কতশত জীবনসত্যের শিল্পরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পগুচ্ছ জুড়ে, অকৃত্তিম সবুজ, সুগন্ধি বাতাস, ঘন ঘাস আর ফুলের রঙে মেখে, শ্রাবণের জল-অঘ্রানের ক্ষেত, জীবনজুড়ে নেমে আসা ঘন অনামিশার কৃষ্ণকালো মেঘে, চকিত বিদ্যুৎ এ। তবে যে রূপটি তিনি এঁকেছেন জোঁনাক হৃদের স্নিগ্ধ মমত্ব আর নিখাদ অসহায়ত্বের ধূপ জ্বেলে দিয়ে, সে অন্তর্লীন বাল্যকালের।

গল্পগুচ্ছে শৈশবঃ
হাতের মুঠোয় ভরে আনা জলের অঞ্জলির মতন নৈকট্য ও স্বচ্ছটায় দেখিয়েছেন শৈশব, সে শৈশবকে আটকে রাখা যায় না, বন্দী করা যায়না, আঙুলের ফাক গলে সে আবার গড়িয়ে পরে, গহীন জলে কিন্তু চাইলেই তাকে ছুঁয়ে দেখা যায়, জীবন দিয়ে অনুভব করা যায়, সেই জলে মাখামাখি হয়ে স্নিগ্ধ হওয়া যায়। সেই গল্প যতটা না আনন্দ যোগায় তার চেয়ে বেশি গোধূলির মন খারাপের রাঙা আলো জ্বেলে দেখিয়ে দেয় শৈশবের বেদনা ও যন্ত্রণাগুলোকে, দেখায় কৈশোর পেরোনো শরীর ও মনোজগত জুড়ে ঘটতে থাকা আধো আলো-আধো ছায়ার মতন পরিবর্তনগুলোকে, বুঝে উঠতে আবার না উঠতে পারার যাতনাগুলো, স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ভূবনের দ্বন্ধগুলো। ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকের সেই সব গল্পে শৈশব অভিমান, অসহায়ত্ব, সর্বশেষে মৃত্যু জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ শৈশব আনন্দকে যতটা না আলোয় এনেছেন তারচেয়ে অনেক বেশি গভীর অন্ধকারের ছায়া এঁকেছেন শৈশবের মৃত্যুর- ভয়ানক করুন রসে। কখনো ‘ছুটির ফটিক’এর মধ্যে দিয়ে একেবারেই নির্মম তীক্ষ্ণ ছুরির ফলায় পাঠক হৃদয় চীড়ে ফেলে, কখনো বা ‘কাবুলিওয়ালার মিনি’র মাধ্যমে মমতার তুলিতে ছায়ার গায়ে আঁচর কেটে যায় অস্পষ্ট ধূসর অঙ্কনে, কখনো বা ‘গিন্নির আশু’কে কেন্দ্র করে দেখিয়েছেন শৈশবের লালিত্যকে নিষ্ঠুর ব্যাঙ্গ অপমানে ধ্বংসের নির্মম প্রক্রিয়াকে। ‘ঊমার খাতা’ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যে উমার শৈশবকেই দলে মুচরে ধ্বংস করে দেয়া হল, নির্মম ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণ হূল ফুটিয়ে তা দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘সমাপ্তির মৃন্ময়ী’র মতোন অকৃপণ হাতে ‘পোস্টমাস্টারের রতন’কে গড়েননি প্রকৃতি, ঈশ্বর কিংবা রবীন্দ্রনাথ। অমন তীক্ষ্ণ তরবারি দিয়ে দেননি নিখুঁত পৃথক করে কৈশোর আর যৌবনের অনুভবগুলোকে, তাই বুঝি রতন, শৈশব আর যৌবনের ফারাকটুকু স্পষ্ট ধরতে না পেরে পোস্টআপিসের চারধারে এক ভ্রান্তির মোহপাশে অবিরাম বৃত্তাকার পথে ঘুরছে, ওই ঘুর্নন পথের বাঁকে বাঁকে অনুভূতিগুলো জন্ম নিয়ে আবার যেন তা হারিয়ে যাচ্ছে। ‘আপদের নীলকান্ত’র অবস্থাটাও রতনের মতই। পার্থক্যটুকু শুধু আদর আর অনাদরের। ‘অতিথির তারাপদ’কে তো শৈশবত্ব অক্ষুন্য রাখতে গিয়ে সামাজীক জীবনের বন্ধন থেকেই মোহমুক্ত করে রাখলেন লেখক। শৈশব নিদাগ পরিপূর্ন ও বিকশিত কেবল ‘সমাপ্তির মৃন্ময়ী’তে।

কাবুলিওয়ালাঃ
এই গল্প বাৎসল্যরসের গল্প, দেশ-জাত-কাল অতিক্রমকারী পিতৃহৃদয়ের সামুজ্যতার গল্প। আফগানী কাবুলিওয়ালার শৈশবের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ আর তার ক্ষুদে মেয়েটির কাগজে ভুসা কালিতে অঙ্কিত হস্তচ্ছাপের পিছনে লুকিয়ে থাকা মমত্বটুকু যখন আলোর মুখ দেখে তখন পাঠকের চোখে জল এনে দেয়। কিন্তু এ গল্প কি শুধুই তাই দেখিয়েছে? এই গল্পের পাতা জুড়ে ছড়িয়ে নেই কি এক সাদামাঠা বাঙালি ঘরের কন্যা ‘মিনি’র চিরপরিচিত শৈশব, পাঠকের কল্পলোকে নেই কি নাম না জানা আফগানী এক বালিকার শৈশব।
মিনির শৈশবের উচ্ছ্বাস, প্রানবন্ততা কাবুলিওয়ালা রহমতের পিতৃহৃদয়কে বাৎসল্যরসে সিক্ত করেছিল। তার দূর আফগানিস্তানে ফেলে আসা কন্যাসম আদরটুকু নিঃশেষে পেয়েছে মিনি। নির্বান্ধব পরবাসী রহমত, জেলের দীর্ঘ দিন-রাতগুলো অতিক্রম করে মুক্তির আলো পেয়েই ছুট দিতে পারতো দেশের পথে, অথচ সে এসেছিলো তার বাঙালি মেয়ে ‘খোঁখি’কে দেখতে। অথচ, শৈশবের সেই মিনি তখন অনেকটাই পাল্টে গেছে, পারিবারিক সংস্কারের মাধ্যমে, যার মূল অন্তর্নিহিত শিক্ষা শৈশবের উচ্ছ্বাস বিসর্জন। কাজেই সেই গুটিয়ে যাওয়া, জড়সড় মিনিকে দেখে, নির্ভয়ে-শ্বশুরবাড়ির সকৌতুকে জেল খেটে আসা প্রবল পরাক্রমী রহমত বাস্তবতার-রূপান্তরের নির্মম আঘাতে-অবিশ্বাসে মাটিতেই বসে পরে।

“মিনি চলিয়া গেলে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রহমত মাটিতে বসিয়া পড়িল। সে হঠাৎ স্পষ্ট বুঝিতে পারিল , তাহার মেয়েটিও ইতিমধ্যে এইরূপ বড়ো হইয়াছে, তাহার সঙ্গেও আবার নূতন আলাপ করিতে হইবে — তাহাকে ঠিক পূর্বের মতো তেমনটি আর পাইবে না। এ আট বৎসরে তাহার কী হইয়াছে তাই বা কে জানে। সকালবেলায় শরতের স্নিগ্ধ রৌদ্রকিরণের মধ্যে সানাই বাজিতে লাগিল, রহমত কলিকাতার এক গলির ভিতরে বসিয়া আফগানিস্থানের এক মরু পর্বতের দৃশ্য দেখিতে লাগিল।” (২)

এখানেও আছে শরতের কথা, কিন্তু রহমতের পিতৃহৃদয়ে শরত শারদীয়ার সুর আনে, কাশের বনে, কন্যার শুভাগমনের কাল শরত, পৌরাণিক পর্বতনন্দিনী পার্বতী এই সময়েই কৈলাস ছেড়ে আসেন পিতৃগৃহে, সেই উপলক্ষে মর্তলোকের কন্যারাও সুযোগ পান, পিতৃভবন ঘুরে আসার। রহমতের শরৎকাল বার্ধক্যের বার্তাবাহী নয়, বরং কন্যার প্রত্যাগমনের, সাক্ষাতের ইঙ্গিতবাহী।
ফিরে আসা যাক শৈশবের কথায়, কেমন ছিলো শৈশবের মিনি? গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ ব্যাক্ত হয়েছে, মিনিকে ঘিরে। তার শৈশব, আচরণের ছাপ এখানে স্পষ্ট।

“আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না। তাহার মা অনেকসময় ধমক দিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেয়, কিন্তু আমি তাহা পারি না। মিনি চুপ করিয়া থাকিলে এমনি অস্বাভাবিক দেখিতে হয় যে, সে আমার বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। এইজন্য আমার সঙ্গে তাহার কথোপকথনটা কিছু উৎসাহের সহিত চলে।” (৩)

কাবুলিওয়ালা ডায়েরীধর্মী লেখা, নিঃসন্দেহে এই লেখা তার লেখক পিতার স্মৃতিচারণ কন্যাকে ঘিরে। গল্পের পরবর্তী অংশ দেখিয়েছে, মিনির সাথে তার লেখক পিতার ভাব-মধুর সম্পর্ক, লেখকের ব্যাস্ততা, ফলশ্রুতিতে মিনির রহমতের সাথে ভাব স্থাপন। সেই সম্পর্ক যে অত্যন্ত প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিলো তার সরল বর্ননাও আছে। গিন্নীর অমূলক ছেলেধরা ভীতি সত্ত্বেও লেখক যে তাদের বন্ধুত্বে বাগড়া দিতে আসেন নি কারন একে তো ক্ষুদে ও বৃহতের সেই সম্পর্কটি ছিলো বড় মনোরম, “কিন্তু, যখন দেখি মিনি ‘কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা’ করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া আসে এবং দুই অসমবয়সী বন্ধুর মধ্যে পুরাতন সরল পরিহাস চলিতে থাকে তখন সমস্ত হৃদয় প্রসন্ন হইয়া উঠে।” সেই সাথে লেখকের নিজস্ব কিছু সুবিধেও ছিলো তাতে, লেখক পিতা তার অকপট স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন গল্পে,

“আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে। একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছুটিয়া যায়, তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী পর্বত অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরের দৃশ্য মনে উদয় হয়, এবং একটা উল্লাসপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাত্রার কথা কল্পনায় জাগিয়া উঠে। এ দিকে আবার আমি এমনি উদ্ভিজ্জপ্রকৃতি যে, আমার কোণটুকু ছাড়িয়া একবার বাহির হইতে গেলে মাথায় বজ্রাঘাত হয়। এইজন্য সকালবেলায় আমার ছোটো ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া এই কাবুলির সঙ্গে গল্প করিয়া আমার অনেকটা ভ্রমণের কাজ হইত। দুইধারে বন্ধুর দুর্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রেণী, মধ্যে সংকীর্ণ মরুপথ, বোঝাই-করা উষ্ট্রের শ্রেণী চলিয়াছে; পাগড়িপরা বণিক ও পথিকেরা কেহ-বা উটের’ পরে, কেহ-বা পদব্রজে; কাহারো হাতে বর্শা, কাহারো হাতে সেকেলে চক্ মকি-ঠোকা বন্দুক — কাবুলি মেঘমন্দ্রস্বরে ভাঙা বাংলায় স্বদেশের গল্প করিত আর এই ছবি আমার চোখের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইত।” (৪)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই বর্ননাটি শরৎকালের।

এছাড়া কাবুলিওয়ালা থাকাতে বোধকরি পরবর্তীতে নভেলের সপ্তদশ পরিচ্ছেদের দূর্দান্ত মুহূর্তগুলোতেও মিনির আর আগডুম-বাগডুম গল্প করতে আসতে হয়নি, মিনি তার বাবার চাইতেও ভালো সঙ্গী খুঁজে নিয়েছিলো।
কিন্তু কাবুলিওয়ালার জেলঘরের শ্বশুরবাড়ি প্রস্থানের পর মিনি কেন তার বাবার সাথে বন্ধুত্বটি ঝালাই না করে নবী সহিসের সহিত সখ্য স্থাপন করলো? বোধ করি মিনি বুঝে নিয়েছিলো বাবার হৃদয়জুড়ে বাৎসল্য প্রবল হলেও মিনির সকল কথা বসে বসে শোনার মতন সময় নেই। পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটলো সময়ের সাধারন রীতিতেই,

“পরে ক্রমে যত তাহার বয়স বাড়িয়া উঠিতে লাগিল ততই সখার পরিবর্তে একটি একটি করিয়া সখী জুটিতে লাগিত। এমন-কি , এখন তাহার বাবার লিখিবার ঘরেও তাহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায় না। আমি তো তাহার সহিত একপ্রকার আড়ি করিয়াছি।” (৫)

লেখক এখানে বলেই দিলেন, মিনির সাথে তার আড়ির কথা, এই আড়ি কি শুধুই মিনির সাথে? মিনির চঞ্চল সভাবের প্রতি রাগ করে নাকি এই আড়ি মিনির শৈশবের সাথে, সে শৈশবকে তার স্বভাবধর্ম অনুযায়ী চলবার পক্ষের যথাসাধ্য সহযোগিতাটাটুকু লেখক দিতে পারেন নি তার সময়স্বল্পতার কারনে। লেখক মিনির শৈশবকে এতো দিন ভুলেই ছিলেন, যার প্রমান মেলে এই কথাটায়, “কত বৎসর কাটিয়া গেল । আর একটি শরৎকাল আসিয়াছে” এতদিনে আর মিনির উল্লেখ করবার মতন কোন প্রসঙ্গই আসেনি, কেননা, লেখকের সাথে তার সম্পর্কটা বাস্তবিকই আড়ির ছিলো, প্রসঙ্গ এলো তখন যখন মিনির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মিনি তার শৈশবকে পার করে এসেছে, রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে মানতেন বাল্যের কাল। তার মতে

“যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা।” (৬)

গল্পের শুরুতে যখন পাঁচ বছরের মিনির উল্লেখ করা হয়, তখন কিন্তু লেখক সরাসরি বলেন নি বর্ষার কথা, তবে মিনির কথায় বর্ষার আচ করা যেতে পারে।

“দেখো বাবা, ভোলা বলছিল আকাশে হাতি শুঁড় দিয়ে জল ফেলে, তাই বৃষ্টি হয়।”(৭)

সংগত কারনেই ভাবা যায় যে,বৃষ্টি দেখেই মিনির মনে প্রশ্ন জন্মেছে বৃষ্টি কোথা থেকে আসে; তাছাড়াও খানিক সময় বাদের পরবর্তী পরিচ্ছেদে, এসেছে শরৎকালের প্রসঙ্গ, যখন লেখক নিজের কথা বর্ননা করেছেন; যেখানে নিজেকে তিনি ‘ঊদ্ভিজ্জপ্রকৃতির’ বলে উল্লেখ করেছেন। লেখকের নিজ সম্পর্কে এ বর্ননা তার মানসিক বার্ধক্যেরই ইঙ্গিত বহনকারী। অর্থাৎ ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে সচেতনভাবেই বাল্যকালকে মনে করিয়ে দেয়া বর্ষার বর্ননা এড়িয়ে গেছেন লেখক, অথচ বারবার এনেছেন শরতের প্রসঙ্গ যেই ঋতু কিনা বার্ধ্যক্যের। কিন্তু কেন? এই গল্প তো মিনির শৈশবের, লেখকের বার্ধক্যের নয়, তবে? এর উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে গল্পের শেষে। যেখানে দেখা যাচ্ছে; শিশু মিনিকে তার লেখক বাবা ভুলে গেলেও রহমত ভোলেনি, শিশুর মন জয়ের কিছু উপকরণসামগ্রী (পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ)সযত্নে সংগ্রহ করে, সে এসেছে সেই ক্ষুদে মিনিকেই দেখতে।

“তখন, সে যে একজন কাবুলি মেওয়াওয়ালা আর আমি যে একজন বাঙালি সম্ভ্রান্তবংশীয়, তাহা ভুলিয়া গেলাম – তখন বুঝিতে পারিলাম, সেও যে আমিও সে, সেও পিতা আমিও পিতা। তাহার পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন আমারই মিনিকে স্মরণ করাইয়া দিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহাকে অন্তঃপুর হইতে ডাকাইয়া পাঠাইলাম। অন্তঃপুরে ইহাতে অনেক আপত্তি উঠিয়াছিল। কিন্তু, আমি কিছুতে কর্ণপাত করিলাম না।” (৮)

লক্ষণীয়, এখানে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “তাহার পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন আমারই মিনিকে স্মরণ করাইয়া দিল”। স্মরণ-বিস্মরণ, স্মরণের পরবর্তী ধাপ বিস্মরণ, বিস্মরণের পরবর্তী ভাব স্মরণ। তবে কি রহমতের এই ‘স্মরণ’ করিয়ে দেবার আগে মিনিকে বিস্মৃত হয়েছিলেন লেখক? রহমতের জেলঘরে প্রস্থান ও সেখান থেকে আগমনের মদ্ধ্যবর্তী সময়ে মিনির শৈশব ঘিরে কোন স্মৃতিচারণা না থাকায় বুঝে নিতে হয়; হয় লেখক বিস্মৃত ছিলেন, নতুবা এই নিয়ে লেখাটা তার সংগতিপূর্ন মনে হয় নি। এইখানেই আসে প্রশ্নের উত্তর; কেননা এই গল্পটা আদৌ মিনির শৈশবকে কেন্দ্র করে নয়, গল্পটা রচিত হয়েছে এমন এক পিতাকে ঘিরে যিনি কিনা তার শিশুর শৈশবকে ভুলেই বসে আছে, যে পিতার কল্পলোকে প্রতাপসিংহ কাঞ্চনমালাকে নিয়ে অবরুদ্ধ কারাগার থেকে মুক্তির জলে ঝাপ দিয়ে পড়তে পারে। অথচ, বাস্তব জীবনে শ্যালিকাসুলভ স্ত্রীকে (যার ধারনার জগত এই যে, “এই পৃথিবীটা যে সর্বত্রই চোর ডাকাত মাতাল সাপ বাঘ ম্যালেরিয়া শুঁয়াপোকা আরসোলা এবং গোরার দ্বারা পরিপূর্ণ”) পৃথিবীর প্রকৃত রূপটিও বোঝাতে সক্ষম নন।

অথচ রহমত; সে তার ক্ষুদে শিশুটির ভুষাকালিতে মাখানো ক্ষুদ্র হস্তচিহ্নের শৈশব স্মৃতিটুকুকে বুকে ধরে রেখেই কাটিয়ে দিয়েছে বহু বছর, মিনির শৈশবের শাশ্বত রূপটিই সত্য তার কাছে; তাই ছেলেবেলার হাস্য-কলরবে ছুটে আসা প্রগলভ মিনির সাথে, রাঙা-চেলি-পরা কপালে-চন্দন-আঁকা বধূবেশিনী সলজ্জ মিনিকে মেলাতে না পেরে গভীর দীর্ঘনিশ্বাসে, থতমত রহমত মাটিতে বসে পড়ে। এই সুকরুন দৃশ্যকি লেখক পিতার স্মৃতিকেও আহত করেনা? তার ছোট্ট মিনির শৈশব স্মরণে। সেই প্রাণচঞ্চল ছোট্ট মিনির শৈশবের অবসানে জড়পুত্তলি পরিণতি দেখে।
“রহমত কলিকাতার এক গলির ভিতরে বসিয়া আফগানিস্থানের এক মরু পর্বতের দৃশ্য দেখিতে লাগিল।” সেই সাথে পাঠকমন ও স্বাধীনভাবে ভেবে নেবার অবকাশ পায়; সেই ভাবনার পরস্পরায় পর্বত নন্দিনী যে গান্ধারকন্যার কল্পনা মানসলোকে ফুটে ওঠে, সে হরিণীর মতন প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল, শৈশব জড়িয়ে থাকে তার আঁখিপল্লব জুড়ে। বাঙালি মেয়ের চার দেয়ালে চাপা পরা সঙ্কুচিত বেঁড়ে ওঠা নয়, প্রকৃতির কোমল-কঠিন কোল ঘেঁসে আফগানদুহিতা ওঠে উচ্ছ্বসিত চিনারের মতন বিকশিত হয়ে, নার্গিসের মতন সৌরভ ছড়িয়ে, আপন হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে।

খাতাঃ
‘খাতার উমাশশি’ আর কাবুলুওয়ালার মিনি একেবারেই বিপ্রতিপ; সেটা কথকতায়। মিনির বকুনিতে সকলে অস্থির হয়ে যেত, অথচ খাতা গল্পে উমার কণ্ঠ থেকে কেবল একটিমাত্র বাক্যই নিঃসৃত হতে দেখা গেছে, পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীর সাথে যোগাযোগের তার একটি মাত্র মাধ্যমের সংবাদই কেবল জানা যায় গল্পজুড়ে, সেটা ওই খাতাটাই। উমার মনে যে কথা ছিল, যে প্রশ্ন ছিল, স্বীকারোক্তি কিংবা অভিযোগ সবকটার খোঁজ করতে গেলেও উৎস হিসেবে শুধু খাতাটাই পাওয়া যায়।

“লিখিতে শিখিয়া অবধি উমা বিষম উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছে। বাড়ির প্রত্যেক ঘরের দেয়ালে কয়লা দিয়া বাঁকা লাইন কাটিয়া বড়ো বড়ো কাঁচা অক্ষরে কেবলই লিখিতেছে — জল পড়ে, পাতা নড়ে।”(৯)

কাবুলিওয়ালা আর খাতা গল্পের লেখন সমধর্মী, উভয় গল্পেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মিনি আর উমার শৈশবের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে, তারপর তাদের শৈশবের অবসানের এক স্থিরচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মিনির গল্প লিখেছিলো মিনির লেখক বাবা, কিন্তু উমা আর উমার খাতার গল্পটা লিখলো কে? প্যারীমোহন নিশ্চয়ই নয়, সেতো দেখেছে কেবল বিবাহিত উমাকে, তার শৈশবের এতো খুঁটিনাটি তার জানবার কথাও নয়, আর জানলেও এতটা দরদ দিয়ে উমার মনস্তত্বকে সে বুঝেছিলো সেকথাটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনা, বাকি রইলো উমার দাদা গোবিন্দলাল, কিন্তু যেহেতু তার প্যারীমোহনকে অনুকরণ করবার একটা প্রবলিচ্ছা বরাবরই ছিলো কাজেই এই লেখনী তার নাই হবার কথা।

“বরটির নাম প্যারীমোহন, গোবিন্দলালের সহযোগী লেখক । বয়স যদিও অধিক নয় এবং লেখাপড়া কিঞ্চিৎ শেখা আছে, তথাপি নব্যভাব তার মনে কিছুমাত্র প্রবেশ করিতে পারে নাই। এইজন্য পাড়ার লোকেরা তাকে ধন্য ধন্য করিত এবং গোবিন্দলাল তাহার অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু সম্পূর্ণ কৃতকার্য হইতে পারে নাই।” (১০)

বাকি রইলো গল্পে বর্নিত ছায়ার মতন লুকিয়ে রাখা প্রচ্ছন্ন একজন মানুষ, যার বিশিষ্টতা সম্পর্কে কোন উল্লেখ না থাকলেও গল্প থেকেই স্পষ্টভাবে অনুমান করে নেয়া যেতে পারে। যার হিসাবের খাতার মতন গুরুত্বপূর্ন স্থানে উমাশশি দিব্যি আবোলতাবোল লিখতে পারে, অথচ এই উপদ্রবের বিনিময়ে কোন বাঁধা কিংবা গঞ্জনা পেতে দেখা যায়না; সে উমার বাবা।

“বাবার দৈনিক হিসাবের খাতায় জমাখরচের মাঝখানে লিখিয়া রাখিয়াছে — লেখাপড়া করে যেই গাড়িঘোড়া চড়ে সেই। এ প্রকার সাহিত্যচর্চায় এ পর্যন্ত সে কোনো-প্রকার বাধা পায় নাই” (১১)

অর্থাৎ উমার প্রতি, উমার শৈশবের এই উপদ্রবটি খুশি মনে যিনি মেনে নিয়েছিলেন, এবং খুব সম্ভবত যার প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে তৎকালীন আপাদরক্ষণশীল সমাজে উমার লেখাপড়া শিখবার সুবর্ন সুযোগটি হয়েছিলো, তিনি উমার বাবা।
উমার শৈশবের যে পরিচয় আমরা পাই, তাতে এই শিশুটির অন্তর্মুখিতার আভাষ মেলে, শৈশবসুলভ আবোল-তাবোল অনেক কথা সে ঘরজুড়ে লিখে বেড়াচ্ছে, শুধু তাই নয়, এমনকি যে কথাগুলো মৌখিক হবার কথা ছিলো, কণ্ঠে সুর তোলা গান এমনকি তাও লিখে রাখছে খাতায়। অর্থাৎ ভাব-আদান প্রদানের পদ্ধতি তার এটাই, তার শৈশবজুড়ে শুধু লেখালেখির এই গল্প, দেয়ালজুড়ে, মেঝেজুড়ে, খাতার পাতায়। বিয়ের সময় তার মায়ের শঙ্কা,

“মা বলিয়া দিলেন , “ বাছা , শাশুড়ীর কথা মানিয়া চলিস , ঘরকন্নার কাজ করিস , লেখাপড়া লইয়া থাকিসনে।” (১২)

উমার শৈশবে নেই কোন সখীর স্থান, চীনে-গন্ধের শিশি কিংবা কাঁচের পুতুল। খাতাটাই ছিল উমার শৈশবের অন্যতম স্মৃতি, একমাত্র অবলম্বল। খাতাটি সঙ্গে করে দেবার কারন উল্লেখে লেখক যশিকে দিয়ে বলিয়েছেন, অথচ এই গভীর জীবনবোধের ধারণা কি সত্যিই যশির উপযুক্ত ভাবনা? যশির ভাবনায় লেখকের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ এখানে একেবারেই স্পষ্ট।

“স্নেহশীলা যশি অনেক বিবেচনা করিয়া উমার খাতাটি সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল । এই খাতাটি তাহার পিতৃভবনের একটি অংশ; তাহার অতিক্ষণিক জন্মগৃহবাসের স্নেহময় স্মৃতিচিহ্ন; পিতামাতার অঙ্কস্থলীর একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, অত্যন্ত বাঁকাচোরা কাঁচা অক্ষরে লেখা। তাহার এই অকাল গৃহিণীপনার মধ্যে বালিকাস্বভাবরোচক একটুখানি স্নেহমধুর স্বাধীনতার আস্বাদ।” (১৩)

অথচ, উমার সেই শৈশবকে স্বভাবের ধর্ম পেড়িয়ে বেড়ে উঠবার, যৌবনত্বে বিকশিত হবার সুযোগটিও পায়না, স্নেহমধুর স্বাধীনতার আস্বাদন তো বহু দূরের, কোমল ও অনুভূতিপরায়ণ হৃদয়ের দুর্দশাই যেন সব কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠলো গল্পে।

“প্যারীমোহন এই সংবাদ অবগত হইয়া বিশেষ চিন্তিত হইল। পড়াশুনা আরম্ভ হইলেই নভেল-নাটকের আমদানি হইবে এবং গৃহধর্ম রক্ষা করা দায় হইয়া উঠিবে।…প্যারীমোহন সন্ধ্যাকালে ঘরে আসিয়া উমাকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করিল এবং কিঞ্চিৎ উপহাসও করিল- বলিল, “শামলা ফরমাশ দিতে হইবে, গিন্নী কানে কলম গুঁজিয়া আপিসে যাইবেন।” উমা ভালো বুঝিতে পারিল না । প্যারীমোহনের প্রবন্ধ সে কখনো পড়ে নাই, এই জন্য তাহার এখনও ততদূর রসবোধ জন্মে নাই । কিন্তু, সে মনে মনে একান্ত সংকুচিত হইয়া গেল; মনে হইল, পৃথিবী দ্বিধা হইলে তবে সে লজ্জা রক্ষা করিতে পারে।”

এই নিষ্ঠুরতা, অমর্যদা যতটা না উমার নারীত্বের তার চেয়ে ঢের বেশি শৈশবের অনুভুতির, কেননা, শৈশব ছাপিয়ে উমার বিকশিত হবার কোন ঘটনাই লেখক উল্লেখ করেন নি, বরং তিনি জানিয়েছেন,

“উমা ভালো বুঝিতে পারিল না। প্যারীমোহনের প্রবন্ধ সে কখনো পড়ে নাই, এই জন্য তাহার এখনও ততদূর রসবোধ জন্মে নাই।” (১৪)

এভাবেই গৃহরক্ষা ধর্মকে রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র উমার শৈশবধর্মের নিষ্ঠুর বিসর্জন হল, শৈশবের মতন এলোমেলো সাধ ও স্বাধীনতার প্রতীক খাতাটি ধ্বংসের মাধ্যমে। উমার সুক্ষতত্ববোধবিশিষ্ট স্বামী গৃহরক্ষা ধর্ম রক্ষার যজ্ঞে খাতাটিকে আহুতিই না দিয়ে কিছুতেই যজ্ঞের সার্থকতা খুঁজে পেলেন না। “প্যারীমোহন আসিয়া গম্ভীরভাবে খাটে বসিল । মেঘমন্দ্রস্বরে বলিল, “খাতা দাও।” আদেশ পালন হইল না দেখিয়া আরও দুই-এক সুর গলা নামাইয়া কহিল , “দাও।”…সেই হইতে উমা আর সে খাতা পায় নাই। প্যারীমোহনেরও সূক্ষ্মতত্ত্বকণ্টকিত বিবিধ প্রবন্ধপূর্ণ একখানি খাতা ছিল, কিন্তু সেটি কাড়িয়া লইয়া ধ্বংস করে এমন মানবহিতৈষী কেহ ছিল না।”

এরপর পাঠক মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, খাতাটি ধ্বংস করবার পর উমার কি হোল, সেকথাটা লেখক আর লিখলেন না কেন? এর উত্তরে বলা যায়, লেখক, ‘ছুটি’তে বিরূপ পরিবেশে ফটিকের, সর্বোপরি ফটিকের মৃত্যুকে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন, সময়ের সাথে পারিবারিক নিয়মের অধীনে উচ্ছল মিনির শৈশবের জড়তায় রূপান্তর; কাজেই উমার পরিনতি ভেবে নেয়াটা এমন আর কঠিন কি।

সুভাঃ
ছোটগল্পে যে দুই ধরনের প্রকৃতি-পরিবেশ তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথঃ নিসর্গ ও সমাজ পরিবারের তার এক আশ্চর্য মেলবন্ধন সুভা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “প্রকৃতিকে বাদ দিলে জীবনের স্বরূপটাকেই খণ্ডিত করা হয়, বাস্তবের চিত্র সম্পূর্ন পরিস্ফুট হতে পারেনা।” সুভায় পরিবেশ যতটা না অলংকারণধর্মী তারচেয়ে বেশি অপরিহার্য।

“মুখের ভাব বৈ আজন্মকাল যাহার অন্য ভাষা নাই তাহার চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর— অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়াস্ত এবং ছায়ালোকের নিস্তব্ধ রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালকবালিকারা তাহাকে একপ্রকার ভয় করিত, তাহার সহিত খেলা করিত না। সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন।” (১৫)

প্রকৃতি বর্ননায় ফুটে উঠেছে বিশুদ্ধ লিরিক সুর। কিন্তু ‘সুভা’র পটবিন্যাস উপমাশ্রয়ী নিসর্গের কাব্যসৌন্দর্য রচিত হয়নি বরং সুভার করুন শৈশবের, জীবনবোধের সাথে মিলিয়ে সযত্নে রচিত। তাইতো পরিবেশকে ঘিরে সুভা নয় বরং সুভাকে ঘিরে পরিবেশ ধ্বনিত হয়।

“সুভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সুদীর্ঘপল্লববিশিষ্ট বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ ছিল— এবং তাহার ওষ্ঠাধর ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতো কাঁপিয়া উঠিত।” (১৬)

কচি কিশলয় নির্মল শৈশবের সূক্ষ্ম শিল্পচেতনাই মনে করিয়ে দেয়, গ্রামের ছোট নদীটিও যেন সুভার প্রতিচ্ছবিই রচনা করে যায়।

“প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর— সমস্ত মিশিয়া চারি দিকের চলাফেরা-আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয়-উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা— বড়ো বড়ো চক্ষুপল্লববিশিষ্ট সুভার যে ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার; ঝিল্লিরবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গী, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস।” (১৭)

সব মিলে সুভা ও গ্রামীণ নৈসর্গ হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। সুভার সাথে প্রকৃতির এই সংযোগকে লেখক আদিম প্রাণশক্তি করে নয় বরং দেখিয়েছেন, অপরূপ এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সজীবতায়, সে সজীবতা শৈশবের। সুবিস্তীর্ণ রৌদ্র, ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়া, গৃহস্থঘরের মেয়েটির মত ছোটো নদী সব কিছুই যেন একযোগে সুভার প্রতিবিম্ব হয়ে উঠছে, পাঠকমনে ছবি আঁকছে স্নিদ্ধ শৈশবের। তারপর সেই নিবিড় মমত্বের কোলে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে সুভা, প্রকৃতির মতন, সুষমামণ্ডিত হয়ে।

“যেন কোনো-একটা পূর্ণিমাতিথিতে কোনো-একটা সমুদ্র হইতে একটা জোয়ারের স্রোত আসিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে এক নূতন অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে। সে আপনাকে আপনি দেখিতেছে, ভাবিতেছে, প্রশ্ন করিতেছে এবং বুঝিতে পারিতেছে না। গভীর পূর্ণিমারাত্রে সে এক-একদিন ধীরে শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখে, পূর্ণিমাপ্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া— যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমন-কি, তাহা অতিক্রম করিয়াও থম্থম্ করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া।” (১৮)

নিসর্গের সাথে জীবনপটের অনুভবের সাদৃশ্যের এমন অন্তর্গূঢ় মুহূর্তে; পোস্টআপিসের চারধারে এক ভ্রান্তির মোহপাশে অবিরাম বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকা ‘রতন’, কাঁচা-আকাঁচা কাপড়ের নিচে হংসদোয়াত চাঁপা দিয়ে রাখা ‘নীলকান্তের’ শৈশব থেকে পরিণতির পথে রচিত আশ্চর্য মুহূর্তগুলো এক হয়ে যায়, বোধে অস্তিত্বের নিমগ্নতায়।
প্রকৃতি সুভার শৈশবের মুহূর্তগুলো করে নান্দনিকতায় অনন্য, শৈশব থেকে দূরব্যাপ্তির পথে জীবনচেতনার উদ্ভাসিত। কিন্তু সেই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছেদের আশঙ্কা সুভার শৈশবকে করে স্তিমিত, প্রকৃতির নান্দনিক অংশ থেকে তার ক্রমশ রূপান্তর ঘটতে থাকে, জীবের মত করে।

“বিদেশযাত্রার উদ্যোগ হইতে লাগিল। কুয়াশা-ঢাকা প্রভাতের মতো সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাষ্পে একেবারে ভরিয়া গেল। একটা অনির্দিষ্ট আশঙ্কা-বশে সে কিছুদিন হইতে ক্রমাগত নির্বাক্ জন্তুর মতো তাহার বাপ-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত— ” (১৯)

“সেদিন শুক্লদ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চিরপরিচিত নদীতটে শষ্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল— যেন ধরণীকে, এই প্রকাণ্ড মূক মানবমাতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে, ‘তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না মা, আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।’”
পরিশেষে প্রকৃতি থেকে সুভার এই বিচ্ছিন্নতা তাকে বিচ্ছিন্ন করে জীবন থেকে শৈশব থেকে, সর্বশেষে সুভার যে দহন, শৈশবের যে অস্পষ্ট আঁচড়ে আঁকা নিষ্ঠুর পরিণতি অমঙ্গল আশঙ্কায় হৃদয় বিবশ করে দেয়। ‘ছুটি’তে ফটিকের শৈশব ও কায়িক উভয় মৃত্যুকেই ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। আর প্রকৃতি পরিবেশের সাথে শিকড় জড়িয়ে থাকা সুভার, প্রাণের মূলচ্ছেদ করলো নিষ্প্রাণ শহর, নিষ্ঠুর মানুষ। সেই মুহূর্ত থেকেই বোবা মেয়েটি সত্যিকার মুঢ় হয়ে উঠলো আর ঠিক তখন থেকেই মৃত্যু হল তার অস্তিত্বের, মৃত্যু হল নির্মল শৈশবের।
আধুনিক যন্ত্রমুখর নির্জনতা, আর সভ্যতার সিঁড়িগুলো হয়তো আমাদের পৌঁছে দিয়েছে বোধহীন-শূন্য নিস্তব্ধতায় কাঙ্ক্ষিত কোনটিতে। তারপর কর্মমত্ততার নিগুঢ় অভিনয়ে, মৃত্যুর হাড়গোড় গুছিয়ে সিন্দুক ভরা, গাঢ় অন্ধকারের আবেষ্টনীতে বিলীন হওয়া বহুকাল। এরপর, কোন একদিন যখন জীবনটাকে হাতড়ে খুঁজতে গিয়ে অচেতনতার সুদৃশ্য মোড়কে আত্মাটাকেই আগাগোড়া আচ্ছাদনে আবিষ্কার। তখন সোনার কাঠি হয়ে সেই নিদ্রিত আত্মাকে জাগিয়ে তুলতে পারে যেই শৈশব, জীবনের অবসন্ন দেয়ালজুড়ে জ্বালতে পারে কল্পলোকের মায়াবী আলো সেই শৈশব খুঁজে পেতে হয় গল্পগুচ্ছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন সোনালী শৈশব আর ধূসর মৃত্যুর আশ্চর্য মেলবন্ধন।

তথ্যসূত্র
১। ৫-সংখ্যক পত্র, ছিন্নপত্র, বিশ্বভারতী, পৃ. ১৫-১৬
২। কাবুলিওয়ালা, গল্পগুচ্ছ, পৃ. ৯৩-৯৮
৩। অনুরূপ
৪। অনুরূপ
৫। অনুরূপ
৬। বর্ষার চিঠি, বালক, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রিংশ খণ্ড, পৃ. ৪৫১
৭। কাবুলিওয়ালা, গল্পগুচ্ছ, পৃ. ৯৩-৯৮
৮। অনুরূপ
৯। খাতা, গল্পগুচ্ছ, পৃ. ১৫৬-১৬০
১০। অনুরূপ
১১। অনুরূপ
১২। অনুরূপ
১৩। অনুরূপ
১৪। অনুরূপ
১৫। সুভা, গল্পগুচ্ছ, পৃ. ১০৩-১০৭
১৬। অনুরূপ
১৭। অনুরূপ
১৮। অনুরূপ
১৯। অনুরূপ