দ্বিতীয় অধ্যায়টি প্রথম অধ্যায় থেকেও ছোট। অনেক পাঠকের এখন আমার ঘাড় মটকাবার অধিকার আছে। প্লট-লাইনটা নিয়ে আপনারা ভাবতে পারেন। বলাই বাহুল্য নিচে যা লেখা হয়েছে তা কাল্পনিক।


অদৃশ্য সমচ্ছেদ প্রথম অধ্যায় এখানে

দ্বিতীয় অধ্যায়

১৯৫৪:
লন্ডন থেকে লিসবন, লিসবন থেকে ফরাসী পশ্চিম আফ্রিকার ডাকার, ডাকার থেকে ব্রাজিলের রেসিফে। ব্রিটিশ যাত্রীবাহী বিমান বিওএসি’র ডে হ্যাভিল্যান্ড কমেট। মাত্র গত বছর এই পথ চালু হয়েছে। পাইলট জেমস গ্রসভেনরের বয়স বেশী নয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে রাজকীয় বিমান বাহিনীর নানাবিধ বিমান চালিয়েছেন। তাঁর সঙ্গী কোপাইলট চার্লস কেনমোরের ইতিহাস একই। আটলান্টিক মহাসমুদ্রের ওপর বিরামহীন বিমান পথের ইতিহাস খুবই নতুন, শুধুমাত্র যুদ্ধের পর নতুন নতুন বিমানের আবির্ভাবের সাথে সাথে এই সব পথ চালু হচ্ছে। তাও উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের পথটা সহজ নয়, বিশেষতঃ ইউরোপ থেকে দক্ষিণ আমেরিকার যাত্রাটা। মহাদেশগুলো উত্তর-দক্ষিণে তাদের ভূমিকে বিস্তৃত করেছে, সেখানে বিমানদের সহজে আটলান্টিক পাড়ি দেবার কোন পথ নেই।

তাই হ্যাভিল্যান্ড কমেটের জন্য একটা সংক্ষিপ্ত পথ নির্বাচিত করতে হয়েছে। আফ্রিকার আর ব্রাজিলের যে অংশটা মহাসমুদ্রে কিছুটা নাকের মত বেড়িয়ে আছে সেখানে দুটি বিমান বন্দর ডাকার আর রেসিফেকে এই পথের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। ক্যাপ্টেন গ্রসভেনর এই পথে এর আগে পাঁচবার এসেছেন। আটলান্টিকের ওপর ওড়াটা সবসময়ই রোমাঞ্চকর, সাড়ে চার ঘন্টা সময় লাগে। এর মধ্যে বিমানের গোলযোগ হলে কোন উপায় নেই।

সব মিলিয়ে ৩৬ জন যাত্রী ও ৮ জন ক্রু নিয়ে আজকের যাত্রা। দিন থাকতে থাকতে সাগর পাড়ি দিতে হবে, তাই ডাকার থেকে বেশ ভোরেই রওনা দিয়েছে তারা। যাত্রীদের প্রাতঃরাশ দেয়া হয়েছে দু-ঘন্টা আগে। পাইলটের কক্ষে সব মিলিয়ে চারজন – পাইলট, কোপাইলট ছাড়াও একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ও একজন ন্যাভিগেটর আছেন। আর বাকি চারজন যাত্রীদের খাবার দেয়া বা অন্যান্য ব্যাপারে সাহায্যে নিযুক্ত। তাঁদের মধ্যে তিনজন মহিলা ও একজন পুরুষ।

বহু নিচে নীল সমুদ্র ভেসে থাকে আর এক জগতের মত। তার ওপর দিয়ে ছোট ছোট সাদা মেঘ ভেসে যায় চলন্ত দ্বীপের মত। গ্রসভেনর যতবারই আকাশে উঠুন না কেন, তার কাছে প্রতিটি উড্ডয়নই একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। যুদ্ধের সময় যতবারই তিনি উড়েছেন, শত বিপদ ও ভয়ের মধ্যেও এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি থেকে তিনি বঞ্চিত হন নি। আর এখন শান্তির সময় দক্ষিণ আমারিকার নতুন পথে বিমান চালাতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন। তাছাড়া চার চারখানা টার্বোজেট ইঞ্জিনের এই বিমান যখন রানওয়ের মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠে ক্যাপ্টেন নিজেকে কোন কিংবদন্তীর নায়ক ভাবেন যিনি কিনা বিশাল এক দানবকে বশ করেছেন।

অনেকক্ষণ ধরে গ্রসভেনর ভাবছিলেন একটু চা পেলে খারাপ হত না। রাতে ঘুমটা পুরোপুরি হয় নি, বিশেষতঃ সকাল সকাল উঠে প্লেনকে মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে এই চিন্তা যখন মাথায় ছিল। কিন্তু পরিচারিকা ন্যান্সি ক্লার্কের দেখা নেই বেশ কিছু সময়। সাধারণতঃ ন্যান্সি প্রতি আধ ঘন্টা অন্তর খবর নিয়ে যায় – কারুর কিছু লাগবে কিনা জানতে। কিন্তু ঘন্টাখানেক হয়ে গেল, ন্যান্সির দেখা নেই। এই সময়টা অনেক যাত্রী ঘুমোয়, ক্রুরাও অনেক সময় একটু ঝিমিয়ে নেয়। গ্রসভেনর তাঁর কোপাইলট কেনমোরকে “আমি দেখি একটু চা পাওয়া যায় কিনা” বলে পাইলট ক্যাবিনের দরজা খুলে পেছনের ছোট জায়গাটায় গেলেন। এখানে ক্রুরা যাত্রীদের জন্য খাবার প্রস্তুত করে। সেই জায়গাটা যাত্রীদের অংশটা থেকে একটা পর্দা দিয়ে আড়াল করা। গ্রসভেনর সেখানে কাউকে না দেখে অবাক হলেন। একটা পাত্রে জল গরম করা থাকে। সেখান থেকে একটা পাত্রে জল ঢেলে তাতে একটা চায়ের প্যাকেট রাখলেন। কাপটা হাতে নিয়ে ভাবলেন ক্রুদের যাত্রীদের অংশে পাওয়া যায় কিনা।

পর্দা সড়িয়ে ক্যাপ্টেন গ্রসভেনর ক্রুদের কাউকে দেখলেন না। তাঁর মনে হল আরো যেন কি একটা জিনিস ঠিক নেই। তখনই বুঝলেন যে কোন যাত্রীকেও তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। হতভম্ব হয়ে গ্রসভেনর সিটের মাঝের সরু পথ দিয়ে অগ্রসর হলেন। প্রতিটি সিট ফাঁকা। অনেক সিটের সামনের ট্রে খোলা। তার মধ্যে কোনটাতে চায়ের কাপ, কোনটাতে বই। এমন যেন তাড়াহুড়ো করে সব কিছু ফেলে যাত্রীদের কোথাও পালাতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে ক্রুদের কাউকেও গ্রসভেনর দেখলেন না। বিমানের সব দরজা ভাল ভাবেই আটকানো ছিল। আটলান্টকের ওপর জুলাইএর এক সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে ৪০ জন মানুষ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যাদুমন্ত্রে যেন মিশে গেছে।

ডে হ্যাভিল্যান্ড কমেটের যাত্রী ও ক্রুদের অদৃশ্য হওয়া একটা অসম্ভব ঘটনা বলেই বিবেচিত হয়েছিল। খামারগাছার ট্রেনের ঘটনাটির সাথে মানুষ এই ঘটনার কোন যোগসূত্র পায় নি কারণ খামারগাছার কাহিনী ইউরোপ বা আমেরিকায় জানা ছিল না। তাছাড়া খামারাগাছার যাত্রী অদৃশ্য হবার ঘটনাটির একটা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু সমুদ্রের চার মাইল ওপরে মানুষ বদ্ধ বিমানের মধ্য থেকে কেমন করে অদৃশ্য হতে পারে তার কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা ছিল না। অনেকে বার্মুডা ত্রিভুজের রহস্যজনক দুর্ঘটনা বা অদৃশ্য হবার সাথে কমেট বিমানের কাহিনীকে যুক্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রথমতঃ ঐ বিমানের যাত্রাপথ বার্মুডা ত্রিভুজ থেকে অনেক দূরে ছিল, দ্বিতীয়তঃ বার্মুডা ত্রিভুজের তথাকথিত ঘটনাগুলির পর কেউই ফিরে আসে নি। কোন বিজ্ঞানীই বার্মুডা ত্রিভুজের রহস্যময়তায় বিশ্বাস করতেন না, করার কোন কারণও ছিল না। কিন্তু কমেট বিমানের মানুষ অদৃশ্য হওয়াটা রেকর্ডে থাকল। যাত্রী ও ক্রুরা হঠাৎ পাগল হয়ে দরজা খুলে নিজেদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারে, কিন্তু সেই দরজা খোলার সঙ্কেত ক্যাপ্টেন পাবেন। কিন্তু বিমানের সব দরজা বন্ধই পাওয়া গিয়েছিল। তবে মহাশূন্যের সুদূর প্রান্ত থেকে আগত অতি বুদ্ধিমান কিন্তু কুমতি প্রাণীরা যে মানুষ অপহরণ করতে পারে এই নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা হয়।

বিওএসি কোম্পানী ও ব্রিটিশ সরকার ক্যাপ্টেন, কোপাইলট, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ও ন্যাভিগেটরকে জেরা করেছিল। তাদের প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল এই চারজন বাকি ক্রু ও যাত্রীদের অদৃশ্য হবার পেছনে দায়ী। কিন্তু চারজনের পরিষ্কার বক্তব্যে ও ধস্তা-ধস্তির কোন চিহ্ন না পেয়ে তারা গ্রসভেনর ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সরকার কোন অভিযোগ আনতে পারে না, যদিও যাত্রীদের আত্মীয় ও বন্ধুরা সরকারী প্রশ্নোত্তর পর্ব নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট কখনই হতে পারে নি।

এর ৭০ বছর পরে একটি ছোট ঘটনার রেশ ধরে মানুষ খামারগাছা ও বিওএসি’র কমেট বিমানের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পায়।

চলবে… ৩য় পর্ব