বাঙালি জাতির সবচাইতে গর্বের, সবচাইতে অহংকারের অধ্যায়টির নাম হচ্ছে আমাদের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন কোন বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ বা কোন আটপৌরে আন্দোলন ছিল না, একটা ভাষাভিত্তিক জাতিসত্ত্বার অসাধারণ এক উত্থান ছিল এই ভাষা আন্দোলন। তাই ভাষা আন্দোলন অনেক বেশি গর্বের, অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ পৃথিবীর প্রতিটি বাঙলা ভাষাভাষীর কাছে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণভাবে একটি ধারণা রয়েছে যে এটি হচ্ছে নিছক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন। বদরুদ্দীন উমর তার তিনটি বিশাল খন্ডে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস (পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি) লিপিবদ্ধকরে আমাদের জানিয়েছেন যে, সেই সময়কার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা যাতে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলনে শ্রমিক-কৃষকসহ সাধারণ মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল স্বতস্ফূর্ত।

পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যতগুলো জাতিরাষ্ট্র দেখা গিয়েছে, ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি সব সময়ই অন্যান্য সকল জাতিরাষ্ট্রের চাইতে উন্নত বলে দার্শনিক সমাজে স্বীকৃত। ভাষা মানুষের এক ধরনের আত্মিক বন্ধন তৈরি করে, যেই বন্ধন অন্য যেকোন ধরনের বন্ধন থেকে শক্তিশালী। মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শিখেছে যে ধর্ম কখনও একটা রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না, রাষ্ট্রকে একত্র রাখতে পারে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার; রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক, তা সে যেই ধর্মেরই হোক না কেন, রাষ্ট্রে সে সমান সুবিধা ভোগ করবে। একটা জাতিকে একত্র রাখার জন্য চাই অভিন্ন জাতীয়তাবোধ, যা একমাত্র ভাষাই দিতে পারে। একক সংস্কৃতি, একক জাতিগত চেতনাই মানুষকে একত্র করতে পারে, ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।

দেশকে নিজের ভাবা, রাষ্ট্রকে আপন ভাবাটা প্রতিটা নাগরিকের মনস্তত্বে গভীর প্রভাব ফেলে। এই আপন ভাবাটা কোন চাপিয়ে দেয়া তত্ত্বের কাছে নত হয় না, স্বতস্ফূর্তভাবেই বের হয়। আর এই মনস্তত্ব গঠনে যুগে যুগে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তাই প্রমাণ করেছে নিজেদের স্থায়িত্ব, নিজেদের শক্ত ভিত্তি।

মানুষের জন্ম ও বিকাশের সাথে তার মাতৃভাষার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। একটি শিশু পৃথিবীতে এসেই প্রথম যেই ভাষার সাথে পরিচিত হয় তাই তার মাতৃভাষা। মায়ের সাথে সাথে মায়ের মুখের ভাষাটিকেও সে আপন করে নেয়, এই সন্তান এবং মায়ের সম্পর্ক তার সারাজীবনের, এই বন্ধন ছিন্ন করা যায় না।

মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে, নাগরিকত্ব পালটাতে পারে, কিন্তু “বৃষ্টি” শব্দটা শুনলে এই বাঙলার নরম মাটিতে বৃষ্টি হবার যেই অসাধারণ অনুভূতি তার মনে হবে, সেটা সে কখনই ভুলতে পারবে না। সে যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, তার চিন্তা করতে হবে নিজের মাতৃভাষাতেই। এই অবিচ্ছেদ্য বন্ধন কোন বুলেট বা কোন পেশি শক্তি ছিন্ন করতে পারে না।

আমরা ভেতো বাঙ্গালী, কখনই আমাদের মহামানবদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি নি, বা মাত্রাতিরিক্ত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে গিয়ে তাকে হাস্যস্পদ করে তুলেছি। আমাদের মহান ভাষা সৈনিকেরা অবহেলায় অনাদরে জীবন পার করেছেন, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ৭১ এর ঘাতক রাজাকারের গাড়িতে ড্রাইভারের চাকুরী করেছেন। অন্যদিকে আমরা আমাদের স্বাধীনতার মহান পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছি, আবার তার নাম আমরাই হাস্যকর করে তুলেছি যত্রতত্র তার নামে দালান করে।

আমাদের এই অকৃতজ্ঞতার শাস্তি হিসেবেই বোধহয় আমাদের এত বেশি দুর্যোগ, এত বেশি অব্যবস্থাপনা; এর শাস্তি হিসেবেই বোধহয় এই সেদিনও রাজাকার আলবদরের গাড়িতে পতাকা উড়েছে, আর আমরা বোকার মত চেয়ে চেয়ে দেখেছি।

এই ঘটনাটার শুরু সেই ৪০ দশকে। কলিকাতার জজ রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরী (পরবর্তীতে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারক) এর একমাত্র কন্যা পরিবারের নয়নেরমণি, আদরের ধন ছিল কল্যাণী রায় চৌধুরী। সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মের কারণে চালচলনে এবং কাজকর্মে তার ছিল মার্জিত এবং সম্ভ্রান্ত ভাব। পিতার কাছ থেকে একটা অমূল্য সম্পদ তিনি পেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে কোন অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা।

তার পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজশাহীর রঘুন্দনপুরের জমিদার। মা বাঙলাসাহিত্যে অন্যতম পথিকৃৎ প্রমথনাথ বিশীর বোন স্কুল শিক্ষিকা মাখন মতি দেবী। মামা প্রমথনাথ বিশীর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা কল্যাণী রায় চৌধুরী রক্ষণশীলতার শিকল ভেঙে ভালোবেসে ফেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র গোপালগঞ্জের আবদুল মান্নাফকে।

কিন্তু তাতে কি হবে, কল্যানী ছিলেন হিন্দু আর মান্নাফ মুসলিম! দুই ধর্মের ভেতরে সে সময় বিয়ে করার কথা চিন্তা করাটাও বিপদজনক ছিল।

কিন্তু ভালবাসা ধর্মের বিভেদের দেয়াল মানলো না, ধর্ম তাদের ভেতরে যেই দেয়াল তুলে দিয়েছিল, তা তারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেখিয়ে দিলেন ধর্মের চাইতে ভালবাসা অনেক বড়, অনেক মহৎ। ধর্ম শুধুই বিভেদ তৈরি করে দেয়, আর ভালবাসা, প্রেম সকল বিভেদ ভুলিয়ে মানুষকে এক করে।

ভালবাসা বাধ মানলো না, ঘর সংসার সব কিছু ফেলে পালিয়ে এলেন কল্যাণী রায় চৌধুরী, মমতাজ বেগম নাম ধারন করে। কি নাম ধারন করলেন তাতে কি আসে যায়, ভালবাসার মানুষটির পাশে সারাজীবন থাকার জন্য নিজের সর্বস্ব ছেড়েই চলে এলেন তিনি। তার ধনী পিতা, তার জাত, তার সমস্ত অতীত পিছনে ফেলে চলে আসলেন স্বামী মান্নাফের সাথে, সেই সময়টা ১৯৪৬ সাল।

সে সময়টা পুরো ভারত জুড়ে বিখ্যাত দাঙ্গার সময় হিসেবে। সেই সময়ে একটা হিন্দু মেয়ে একটা মুসলিম ছেলের সাথে পালিয়ে এসেছে, এটা কি ভয়াবহ ঘটনা, তা বোধহয় আজকের এই সময় কল্পনাও করা যাবে না।

হাওরা থেকে চলে এলেন গোয়ালন্দে, সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জ। সেখানেই থেকে গেলেন স্বামী স্ত্রী, দুজনে মিলে বানিয়ে নিলেন সুখের সংসার।

এর মধ্যে কোল জুড়ে চলে এসেছে একটি শিশুকন্যা, নাম রেখেছেন খুকু। মর্গান গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি।

এরপরে চলে আসল ১৯৫২, কি উত্থাল সময়, কি ভীষণ আবেগে দেশের ছাত্র শিক্ষক সকলে ভাষার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে।

ঢাকার একদম কাছে নারায়ণগঞ্জেও ভাষা আন্দোলনের আগুন লেগে গেল সাংঘাতিকভাবেই। চারিদিকে তখন বারুদের মত চাপা তারুন্য ফুঁসে ওঠার অপেক্ষায়।

ঢাকা থেকে খবর এলো ২১ ফেব্রুয়ারিতে মিছিল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিলে যাবে। রহমতউল্লা মুসলিম ইন্সটিটিউটের সামনে তখন সভা চলছে, সভা চলাকালীন তারা জানতে পারলেন, ঢাকায় বহু ছাত্র মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়েছে।


(গুলির অল্প কিছুক্ষণ আগের ছবি)

পুরো নারায়ণগঞ্জ তখন তোলপাড়, চারিদিকে উত্তেজিত জনগণ ভাষার দাবীতে শ্লোগান দিচ্ছে। ছাত্রদের উপর পুলিশের বর্বর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মর্গান হাইস্কুলের ৩০০ ছাত্রী নিয়ে পথে বেড়িয়ে পরলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম।

২২ ফেব্রুয়ারিঃ

চাষাঢ়া মাঠে এক বিশাল প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে মর্গান স্কুলের ৩০০ ছাত্রী, শিক্ষিকা এবং মহিলাদের একটি বিরাট মিছিল শোভাযাত্রাসহ সভায় এসে যোগ দেয়। করাচি থেকে ‘ইভিনিং টাইমস’ নামে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকায় পরদিন প্রথম পাতায় নারায়ণগঞ্জের সে সভার সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল “নুরুল আমীন মাস্ট গো নারায়ণগঞ্জ মিটিং ডিমান্ড”

ভাষা আন্দোলনে সে সময় যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে একজন নারীর ভূমিকা গোটা দেশকে আলোড়িত করে। এরপরের পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়েই নারায়ণগঞ্জে চলে বিক্ষোভ, মিছিলের পর মিছিল আর শোভাযাত্রা।

“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনিতে পুরো নারায়ণগঞ্জ কম্পিত, আর সেই আন্দোলনের মূল ভূমিকায় ছিলেন মমতাজ বেগম এবং তার ছাত্রীরা।

নারায়ণগঞ্জের আগুন চাপা দেবার জন্য মুসলিম লীগ এবং তাদের পোষা কুকুরেরা তখন নানা রকম পায়তারা করছে। প্রশাসনের নজর তখন মমতাজ বেগমের দিকে। তারা বুঝে গেছে নারায়ণগঞ্জের আন্দোলন থামাতে হলে মমতাজ বেগমকে থামাতে হবে, নয়তো এই আন্দোলন সবে শুরু। এবার হার মেনে নিলে বাঙালি কদিন পর পর নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য পথে নামবে, সকল অধিকার ছিনিয়ে নেবে।

২৭ ফেব্রুয়ারী প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয় মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করার। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়, বলা হয় স্কুলের তহবিল আত্মসাৎ করেছেন মমতাজ বেগম। ২৯ তারিখ গ্রেফতার করা হল তাকে, তার কন্যাটি তখন চার বছরের। বিভিন্ন মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হল।

মর্গ্যান হাইস্কুলের শিক্ষক এবং ছাত্রীরা স্কুল বয়কট করলো কর্তৃপক্ষের এই নোংরা সিদ্ধান্তে, মিছিল করে তারা কোর্টে হাজির হল। মুহূর্তে সব জায়গায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে নারায়ণগঞ্জের সবক’টি স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে মিছিল নিয়ে কোর্ট প্রাঙ্গণে হাজির হয়।

পুরো নারায়ণগঞ্জবাসীর মুখে তখন একই কথা, “মমতাজ আপাকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ, তাকে যে করেই হোক বের করতে হবে”।

হাজার হাজার মানুষ তখন ঘিরে ফেলেছে নারায়ণগঞ্জ থানা। সকাল নয়টা বাঁজতে বাঁজতে বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তাঘাট মানুষের ভীড়ে। মহকুমা পুলিশ অফিসার মানুষের এই স্রোত দেখে উত্তেজনা কমাবার জন্য ঘোষণা দিলেন কোর্ট থেকে তাকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হবে।

১০ হাজার টাকা জামিনের আবেদন করলেও জামিন নামঞ্জুর হয়, ঢাকার কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেয় সরকারের পা চাটা বিচারক।

ক্ষোভে ফেঁটে পড়লো মানুষ। সারা শহর জুড়ে শুরু হলো মানুষের বিক্ষুব্ধ আলোড়ন। পুলিশের সাধ্য রইলোনা সেই আলোড়ন থামানোর।

লোকে লোকারণ্য কোর্ট প্রাঙ্গণ আর নারায়ণগঞ্জের উত্তাল অবস্থা দেখে মহকুমা প্রশাসক ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে ইপিআর পাঠানোর আহ্বান জানান। সংবাদ পেয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথে বড় বড় ১৬০টি গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করে ছাত্রছাত্রীরা।

একপর্যায়ে শুরু হলো পুলিশের নির্মম অত্যাচার। লাঠির আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হলো হাজারো মানুষ, গ্রেফতার হলো বালক, বৃদ্ধ। এমন কি নারী এবং ছাত্রীদেরও ছাড়েনি পুলিশ। খান সাহেব ওসমান আলীর বাসায় হামলা করে তাকে গ্রেফতার করা হলো। ধরে নেয়া হলো শফি হোসেন, জামিল সহ সকল নেতাদের। সরকার নিজেই একজন পুলিশকে খুন করিয়ে প্রচার করে দিল ভারতের দালাল আর কমিউনিস্টরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, জনস্রোতকে ভিন্ন দিকে ঘোরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করা হল। আর ট্রাকের পর ট্রাক পুলিশ এসে ঢাকার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হল মমতাজ আপাকে।

এরপরের ইতিহাস আরও করুণ। মমতাজ বেগমকে সরকার ক্ষমাপ্রার্থণা এবং মুচলেকার মাধ্যমে মুক্তির প্রস্তাব দেয়। মমতাজ বেগম তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তার স্বামী ঢাকার খাদ্য পরিদর্শক আবদুল মান্নাফ তাকে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানালে তিনি তাতেও অস্বীকৃতি জানান।

স্বামী আবদুল মান্নাফ মমতাজ বেগমের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবেন বলে হুমকি দেন, কিন্তু সেই হুমকিও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন অসীম সাহসী মমতাজ বেগম। যে মানুষটির জন্য একদিন নিজের ঘর, নিজের পরিবার, নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন, ভাষার প্রতি মমতার জন্য, নিজের আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সেইটুকুও বিলিয়ে দেন মমতাজ বেগম। স্বামী আবদুল মান্নাফ তখন সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তালাক দেন মমতাজ বেগমকে।

১৯৫৩ সালের শেষদিকে দেড় বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান মমতাজ বেগম।

কোথায় ফিরে যাবেন, ঢাকাতেই আনন্দময়ী গার্লস স্কুল ও আহমেদ বাওয়ানী একাডেমীতে শিক্ষকতা শুরু করলেন। প্রচন্ড অর্থকষ্টে আর রোগশোকে ভুগতে লাগলেন, জেলের অত্যাচার তার শরীর মন দুইই ভেঙ্গে দিয়েছে। স্থান হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই। কন্যা খুকু তখন পশ্চিম পাকিস্তানে, স্বামীর সংসারে। তাকে কবর দেওয়া হলো আজিমপুর কবরস্থানে। কেউ জানলো না কোন কবরটি তার। হারিয়ে গেলেন মমতাজ বেগম কোন চিহ্ন না রেখেই।

নারী ও শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন এ মহীয়সী নারী। নারীর শিক্ষাকেই অমূল্য সম্পদ মনে করতে তিনি, নারীশিক্ষা কার্যক্রমে তাই জীবনের শেষ বিন্দুটিও দিয়ে দিয়েছেন অকাতরে।

ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে মমতাজ বেগম একটি অনন্য নাম, একটু আগুনের স্ফুলিঙ্গ। ভাষার জন্য, দেশের জন্য তিনি তার পরিবার-সংসারকে বিসর্জন দিয়েছেন। এ ভাষাসৈনিকের জন্য আমরা কি করেছি? শর্ষিনার পীরদের মত চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রীয় সম্মান, সংবর্ধনা, স্বাধীনতা পুরস্কার আর একুশের পদক পাচ্ছে, নিজামীরা গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, সেখানে মমতাজ বেগমের নামটি আজ পর্যন্ত কেউ মনেও করেনি।

মন্দের ভাল এই যে, দীর্ঘ ৬২ বছর পরে কর্তৃপক্ষের একটু হুশ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। নারায়নগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের সামনের সড়কটির নাম এখন ‘ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’।

বাঙলা ভাষার জন্য সব কিছু হারানো, আক্ষরিকভাবেই সবকিছু হারানো এই মহান ভাষা সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

বাঙলাদেশ যেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্বাধীন হয়েছিল, ভাষা আন্দোলনের যেই মূল চেতনা ছিল ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ভেদে সকল বাঙ্গালীর একটি ভাষা, সেই ভীষণ আবেগের জায়গাটি যেন আমরা দলাদলি করে কলংকিত না করি। এই ফেব্রুয়ারীতে এটাই হোক আমাদের কাম্য।

তথ্যসুত্রঃ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনীতি।
শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ওয়াসিম বাবু, যার কাছে মমতাজ বেগমের কিছু গুরুত্বপুর্ণ নথিপত্র ছিল, যা হারিয়ে গেছে।

[মুক্তমনাতে ওয়ার্ডপ্রেসে লিখতে আমি কম সাচ্ছন্দ্যবোধ করি বলে অনেক লেখাই মুক্তমনাতে দেয়া হয়ে ওঠে না। এই কারনে মুক্তমনার পাঠকদের কাছে আমি লজ্জিত। লেখাটি অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে]