“সিপাহি জনতা ভাই ভাই”?
ছগীর আলী খান
পঁচিশ ও ছাব্বিশে ফেব্র“য়ারী পিলখানায় যা কিছু ঘটেছে- যদি কোন স্কুলছাত্রকে পরীক্ষার খাতায় তার সারসংক্ষেপ লিখতে বলা হয়- তবে সে লিখবে- “সিপাহীরা ঐদিন পিলখানায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর অফিসারদেরকে কচুকাটা করিয়াছিল”। বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আরও কিছু অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তবে নাটকের মূল সুর, ইংরেজীতে যাকে বলে থিম, একটাই- “অফিসারদের গলা কাটা”। এই চক্রান্তের পেছনে কে ছিল, র’ ছিল নাকি আইএসআই ছিল- তা আলীগ-বিএনপি’র রাজনৈতিক কূটতর্কের বিষয়, উদঘাটনের বিষয় নয়। সার কথা হলো- সাধারণ জওয়ানরা এক প্রবল জিঘাংসায় তাড়িত হয়ে অফিসার, তাদের পরিবার ও কিছুসংখ্যক বিরুদ্ধবাদী বিডিআরকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল সেদিন। সাধারণ জনগণের কোন ভুমিকা ছিল না এই নাটকে, তারা ছিল উৎকন্ঠিত নীরব দর্শকমাত্র। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সকলেই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য (মিলিটারি বা প্যারা মিলিটারি)।
‘সিভিল এবং মিলিটারি’- শব্দদুইটি মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে দারুনভাবে জনপ্রিয়, বিশেষ করে পাকিস্তানে। সভ্য গণতান্ত্রিক জগতে, বিশেষ করে অমুসলিম দেশগুলিতে এই শব্দের আদৌ কোন ব্যঞ্জনা নাই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ভারত ইত্যাদি নেতৃস্থানীয় দেশগুলিতে কে কবে সেনাপ্রধান হলো- সে খবর কেউ রাখে না। তবে পাকিস্তান এবং তৎকন্যা বংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। বলা হয়ে থাকে যে পাক-সেনাবাহিনীর যে কোন সেকেন্ড লেফটন্যান্টও নিজেকে পাকিস্তানের ভাবী-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কল্পনা করতে পারে। সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক দৈত্যের হাত থেকে মুক্ত হয়ে একটি উদার-অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-শোষণহীন সমাজ কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয় যে জন্মপ্রক্রিয়ায় সমর্থন জানিয়েছিল তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের শতকরা নিরানব্বুই জন মানুষ। সাধারণ মানুষের সেই প্রত্যাশা কীভাবে মাত্র সাড়ে-তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরে এসে নিহত হলো এবং পাকিস্তানের মিলিটারিজম বাংলাদেশে আবার ফিরে এলো- সে বৃত্তান্ত কমবেশী সবার জানা। জন্মগতভাবে পাকিস্তানী মিলিটারির সাথে বাংলাদেশ মিলিটারির অনেক সাদৃশ্য থাকলেও একটা বিষয়ে এই দুই বাহিনীর মধ্যে কোন মিলই দেখতে পাচ্ছি না আমি। বিষয়টিকে আরেকটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা যাক।
১- বাংলাদেশে মিলিটারিজমের প্রথম থাবাটি আত্মপ্রকাশ করে পঁচাত্তরের আগষ্টে, জাতির জনক হত্যাকান্ডে। তবে এই ঘটনাটিতে সমগ্র মিলিটারি ইষ্টাব্লিশমেন্টের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। গুটিকয়েক জুনিয়র লেভেলের অফিসার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ক্রীড়নক হয়ে ঘটনাটি ঘটায়। সেনাবাহিনীপ্রধান শফিউল্লাহ ও অন্যান্য সিনিয়র সামরিক অফিসারগণ এই ক্যু সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একমাত্র জিয়াউর রহমান এই ঘটনা সম্পর্কে জানতেন এবং মৌন সাপোর্ট দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এই ঘটনায় আর্মির শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড স¤পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সেনাপ্রধানসহ সিনিয়র অফিসাররা ঠুটো জগন্নাথ হয়ে ক্যান্টনমেন্টে বসে থাকে, গুটিকয়েক জুনিয়র অফিসার বঙ্গভবনে বসে প্রেসিডেন্টের নামে ফরমান জারি করে দেশ চালাতে থাকে। এরকম ঘটনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কখনও ঘটেনি। সেখানে মিলিটারি ক্যু হয়েছে বহুবার, সেনাবাহিনী সিভিল গভর্নমেন্টকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। তবে খোদ্ সেনাবাহিনীর ভেতরে একদল উচ্ছৃঙ্খল জওয়ান যা খুশী তাই করে বসলো-, হাতের বন্দুকটি দিয়ে দেশের প্রেসিডেন্টকে গুলি করে মেরে নিজেদের একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ফেললো- এমন অধঃপতন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কখনও হয়নি। ইস্কান্দার মির্র্জা, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ- এরা পাকিস্তানের সামরিক শাসক ছিলেন ঠিকই, তবে এরা প্রত্যেকেই একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ফোর্সের সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন।
২- পরের দৃশ্যপট নভেম্বারে, আগষ্ট ট্র্যাজেডীর আড়াই মাসের মাথায়। সেনাবাহিনীতে কোন চেইন অব কমান্ড নাই, গণভবনে বসে ফারুক-ডালিমরা প্রেসিডেন্টের নামে নির্দেশ দিচ্ছে, ক্যান্টনমেন্টের সিনিয়র অফিসারদের তাই মেনে নিতে হচ্ছে। নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান জিয়া চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগই নিচ্ছেন না। এই পরিস্থিতি পাল্টাতে নভেম্বারের ২ তারিখে খালেদ মোশাররফ ক্যু করলেন, জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী করে নিজেকে আর্মি চীফের ঘোষণা দিলেন। গণভবনে অবস্থানরত ফারুক-ডালিমরা প্রমাদ গুনলো, মরীয়া হয়ে সেদিন রাত্রেই কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে ফেললো। খালেদ মোশাররফ যদি প্রথম রাত্রেই বিড়ালটি মারতেন- অর্থাৎ ক্ষমতা নেয়ার সাথে সাথেই বঙ্গভবন আক্রমণ করে খুনী চক্রকে হত্যা করতেন, তাহলে দেশের অবস্থা হয়তো অন্যরকম হতো, নিজের জানটাও বাঁচতো। তা না করে তিনি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলেন। সামরিক জীবনের মটো হচ্ছে- ষ্ট্রাইক এ্যাট দ্য ফার্ষ্ট ইনষ্ট্যান্স; দ্বিধা করো না, দুর্বল হয়ো না। সামরিক অভিধানে দ্বিধার অর্থ হচ্ছে দুর্বলতা-পাপ; তাৎক্ষনিকভাবে অঘাত না করে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে সময় নষ্ট করলে তা সৈনিকের জন্যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু বয়ে আনতে পারে না। খালেদ মোশাররফ দ্বিধা করেছিলেন, সুতরাং জীবন দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল তাকে। পাঠক লক্ষ্য করুন- সব ঘটনাই কিন্তু সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘটছে এবং ঘটনার বলি হচ্ছে প্রধানত মেধাবী অফিসারবৃন্দ। সাধারণ সিপাহি কিংবা জনগণের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই কোথাও। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোন পর্য্যায়েই এই ধরণের বিদ্রোহ-কাউন্টার বিদ্রোহের ঘটনা আজ পর্য্যন্ত ঘটেনি। শত বদনাম সত্ত্বেও সেখানকার একজন জওয়ান বা জুনিয়র অফিসার উপরস্থ অফিসারের হুকুম ছাড়া একটি কদমও ফেলেনি, এত যুদ্ধবিগ্রহ এত ঝড়ঝাপটার পরও চেইন অব কমান্ড অটুট আছে আজতক।
৩- পরের দৃশ্যপট ৭ই নভেম্বার, তথাকথিত সিপাহি-বিপ্লব দিবস। নায়ক কর্ণেল তাহের নামক এক সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধে যিনি পা’ হারিয়েছিলেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আর্মিতে ফিরে না গিয়ে দেশে কমুনিষ্ট বিপ্লব ঘটানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে তিনি জাসদে যোগদান করেন এবং সামরিক পন্থায় সমাজতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে গণবাহিনী নামক একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেন। তেহাত্তর-পঁচাত্তর সময়কালে গণবাহিনী দেশজুড়ে কীরূপ বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিল, তৎকালীন সংবাদপত্রগুলির পাতা খুললে এখনও তার চিত্র পাওয়া যেতে পারে। যাহোক, নভেম্বারের অস্থিতিশীল ও ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চাইলেন এই কর্ণেল। বৃটিশ ষ্টাইলের আর্মি ভেঙে চীনা ষ্টাইলের পিপলস আর্মি গঠনের শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। গণবাহিনীর সদস্যরা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর লাখ লাখ পোষ্টার ও লিফলেট ছড়িয়ে দিল। অফিসারদের তুলনায় সিপাহিদের অকল্পনীয় কম বেতন ও সুযোগ সুবিধার করূন চিত্র সম্বলিত এই সব লিফলেট পেয়ে সাধারণ জওয়ানরা সোনালি ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত হলো এবং বিপ্লব করতে রেডী হয়ে গেল। অফিসাররাই যে তাদের সমস্ত বঞ্চনার মূল, তাদের মগজে তা খুব ভালোভাবে ঢুকানো হলো। কারারুদ্ধ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া ছিলেন তাহেরের বন্ধু, জিয়াকে এই মহান মিশনে শরীক করার সিদ্ধান্ত নিলেন কমরেড তাহের। সুতরাং ৭ই নভেম্বার ঢাকা সেনানিবাসের সিপাহিরা হাতে অস্ত্র তুলে নিল, জেল থেকে তাদের ইপ্সিত লীডার জিয়াকে বের করে আনলো। উন্মত্ত শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো- “সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের কল্লা চাই”। অফিসাররা কেউ মরলো, কেউ ব্যাজ খুলে পালিয়ে বাঁচলো। খালেদ মোশাররফ ও তার সহচররা কেউ রক্ষা পেলো না। এই মহান বিপ্লবের পর সিপাহিীদের সুযোগসুবিধা কতটুকু বেড়েছিল, আর্মি ষ্ট্রাকচারে কী পরিববর্তন ঘটেছিল তা সবাই জানে। একাত্তরের পরাজিত চক্রের সগর্ব প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসন ছাড়া এই বিপ্লবের আর কোন ফল অন্তত আমার চোখে ধরা পড়ে না। সুতরাং সিপাহিদের হাতে অফিসারদের রক্ত ঝরার প্রথম দিনটি হচ্ছে ৭ই নভেম্বার-১৯৭৫। জামাত এবং বিএনপি বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে এই দিনটিকে সাড়ম্বরে পালন করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৭ই নভেম্বার হচ্ছে একটি ঘৃনার জন্মদিবস, অফিসারদের বিরুদ্ধে সিপাহীদের পুঞ্জীভুত ঘৃনা। সমাজতন্ত্রের সুদৃশ্য মোড়কে ঘৃনার বীজটি বপন করেছিলেন কর্ণেল তাহের।
৪- জিয়া খুব ধুরন্ধর লোক ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাস ছিল তার, পিপলস আর্মির চটকদার শ্লোগান হাস্যকর ছিল তার কাছে। তবুও ট্যাক্টিক্যাল কারণে তাহেরের পিপলস আর্মির দাবী মেনে নেয়ার প্রতিশ্র“তি দিতে হয়েছিল তাকে। তবে সর্বাগ্রে দরকার ছিল বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা। তিনি সেই লক্ষ্যেই অগ্রসর হলেন। বঙ্গভবনে অবস্থানরত মেজরদেরকে প্লেনে করে ব্যাঙ্কক পাঠিয়ে দিলেন, সিপাহীদের দাবীদাওয়াগুলিকে সহানুভুতির সাথে বিবেচনা করার আশ্বাস দিলেন এবং তাদেরকে অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসল তার। এরপর শুরু হলো আসল খেল্; কয়েক মাসের ব্যবধানে বন্ধু ও ত্রাণকর্তা কর্ণেল তাহেরকে জেলে পুরলেন, জেলে পুরলেন তাহেরের অনুগত সব অফিসার ও জওয়ানকে। কোর্ট-মার্শালের মাধ্যমে সবার জন্যে ফাঁসিকাঠ নিশ্চিত করলেন। পঁচাত্তর থেকে একাশি- এই ছয় বছরে কতো হাজার অফিসার ও জওয়ানকে কোর্ট-মার্শালে প্রাণ দিতে হয়েছে- তার পরিসংখ্যান সেনাবাহিনীর চিত্রগুপ্তের খাতায় আছে। বলা হয় যে জিয়ার শাসনকালজুড়ে অগনিত ক্যু, কাউন্টার ক্যু’র ঘটনা ঘটে একাশির চিটাগাং সার্কিট হাউজ ট্র্যাজেডী যার সর্বশেষ পরিনতি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সমস্ত অফিসার এর মধ্যে হয় ফাঁসিতে মড়েছে, নয়তো বাধ্যতামূলক অবসর নিয়ে সেনাবাহিনীকে ‘টা টা-বাই’ জানিয়েছে।
জিয়ার আমলে লার্জ-স্কেল অফিসার হত্যার আরেকটি বড়ো ঘটনা ঘটে ঢাকা বিমান বন্দরে সাতাত্তরের অক্টোবরে, জাপানের রেড আর্মি কতৃক ছিনতাইকৃত বিমানের রেসকিউ অপারেশনের সময়। এই ঘটনার বলি হন প্রধানতঃ এয়ার ফোর্সের অফিসাররা। একথা বলা বোধ হয় অসঙ্গত হবে না যে সিপাহিদের হাতে বেঘোরে প্রাণ দেয়ার জন্যেই বাংলাদেশ আর্মিতে একজন অফিসারের জন্ম হয়।
৫- একাশিতে ক্ষমতায় আসেন হো.মো. এরশাদ। তিনি অত্যন্ত স্মার্ট অফিসার ছিলেন, বাঙালীদের জন্যে সম্ভবত সবচেয়ে যোগ্যতম প্রেসিডেন্ট। বাঙালি মানসিকতা খুব ভালোভাবে রিড করতে পেরেছিলেন তিনি, তাই তার সময়কে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। এক ভাগ উৎসর্গ করেছিলেন ইসলাম উন্নয়নে, আরেক ভাগ ভালোবাসা ও কবিতা উন্নয়নে। দিনের বেলা টুপী মাথায় দিয়ে মসজিদে-মাজারে যেয়ে ধর্ম উন্নয়ন, রাতের বেলা কবিতার জীবন্ত মডেল সামনে নিয়ে কাব্য-উন্নয়ন। কতো কোমল প্রাণ তার ভালবাসায় উজ্জীবিত হয়েছিল তার ক্লাসিক প্রমান হচ্ছে বিদিশা রচিত ‘শত্র“র সঙ্গে বসবাস’। এই দ্বিমুখী প্রতিভার কল্যানে তিনি বাংলাদেশের লঙ্গেষ্ট সার্ভিং প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন।
উপরের আলোচনা হতে একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমানিত হয় যে জাতি হিসেবে খুবই উচ্ছৃঙ্খল জাতি আমরা। মিলিটারি জীবনের জন্যে যে সুকঠিন নিয়মানুবর্তিতা দরকার, চল্লিশ বছরেও তার কিছুই আয়ত্ব করতে পারিনি আমরা। আর্মির ভেতরে ক্যু কাউন্টার ক্যু হচ্ছে দেদার, এক দল আরেক দলকে কচুকাটা করছে, সিপাহিরা অফিসারদের মারছে, বিন্দুমাত্র বিবেকের তাড়া অনুভব করছে না। এমন অবস্থা হয়েছে যে আগামীতে কোন মা হয়তো তার ছেলেকে আর্মি অফিসার হতে দেবে না। সিপাহি ও অফিসারদের মাঝে যে বৈষম্য, তা নুতন কিছু নয়, পৃথিবীর সব দেশের আর্মিতেই তা আছে, হয়তো বাংলাদেশ আর্মির চাইতে বেশীই আছে। কিন্তু সেসব দেশে তো কদাচ এ ধরণের দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে না! শুধু আমাদের দেশেই কেন বার বার এমন ঘটনা ঘটছে?
আরেকটি বিষয়, পিলখানা ট্র্যাজেডীর পর বিদেশী চক্রান্তের থিওরী নিয়ে ঝড় তুলছি আমরা। বিদেশী শত্র“ যদি কেউ থেকেই থাকে, তারা থাকবেই, আমাদেরকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করবেই। আমাদের ছেলেরা কেন এত সহজে শত্র“র হাতের পুতুল হয়ে নাঁচবে? যারা হত্যা করেছে তারা আমাদেরই ছেলে, যারা ধর্ষণ-লুটপাট করেছে তারা আমাদেরই ছেলে, যারা বাইরে থেকে অস্ত্র এনেছে তারা আমাদেরই ছেলে। কোন পাকিস্তানী, কোন ইন্ডিয়ান তো কাজগুলি করেনি। আমরা কেন অন্যের ক্রীড়নক হয়ে নাঁচবো? বিদেশী কোন চক্র থেকে থাকলে তারা সুযোগ নিয়েছে সিপাহীদের মনে জমে থাকা পুঞ্জীভুত ক্ষোভকে। সেই ক্ষোভকে প্রশমিত করার কোন উদ্যোগ কি আমরা নিয়েছি? দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের ব্যর্থতার কোন বিচার আজ পর্য্যন্ত কেন জনগণ দেখতে পেল না?
পিলখানা ঘটনার পেছনে বিদেশী চক্রান্ত থাকতেই পারে, তবে মূল দায়ভাগ আমাদের নিজেদের। আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, আমাদের পরশ্রীকাতর মনোভাব, আমাদের নিয়মানুবর্তিতার অভাব, হঠাৎ করে জ্বলে উঠা আমাদের সর্ববিধ্বংসী মনোভাবকে কাজে লাগিয়েছে বিদেশী শত্র“রা। শুধু আর্মির ভেতরে নয়, অন্যান্য সেক্টরে যথা শিল্পাঙ্গনে, গার্মেন্টসে, শিক্ষাঙ্গনে, অফিস আদালতে সর্বত্রই এই মনোভাব তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে না আমাদের? সম্প্রতি বিদেশের মাটিতেও এই মনোভাব প্রদর্শন করে নিন্দিত হয়েছি আমরা।
আমরা আর এরূপ অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির শিকার হতে চাই না। কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে স্থায়ী মুক্তি পাওয়া যায় তার উপায় আমাদের সমাজবিজ্ঞানী ও সমরবিদদের বার করতেই হবে।
পঁচাত্তরের নভেম্বারের অফিসার হত্যাকে যদি বিপ্লব বলে গ্লরিফাই করা হয়, তাহলে মাঝে মাঝে এমন বিপ্লব করার মানসিকতা স্থায়ীভাবে দূর হবে কী করে? পিলখানা ঘটনার দিনও ‘সিপাহি জনতা ভাই ভাই’- শ্লোগান উঠেছিল। যদি বিদ্রোহীরা সফল হতো এবং হাসিনা সরকারের পতন হয়ে পচাত্তরের মতো আরেকটি নুতন সরকার আসতো, তাহলে কি আমাদের জাতীয় জীবনে আরেকটি বিপ্লব-দিবস যোগ হতো!
কে এর জবাব দেবে?
ছগীর আলী খান
সাভার-ঢাকা
২২-০৩-২০০৯
তাহের স্বাধীণতার পর অল্প সময়ের জন্য হলেও সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সন্দেহ নেই। তবে জাসদের গণবাহিনী, সর্বাহারা এদের শ্রেনী শত্রু খতমের নামে ঢালাও খুনাখুনী, লুততরাজ, আওয়ামী বাকশালীদের থেকে তেমন একটা কম ছিল না মনে হয়।
সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় গনবাহিনী গঠন মনে হয় সমর্থণ করা যায় না। সেনাবাহিনী তো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় না যে রাজনৈতিক দল খুলে বসা যাবে। তাহের কে বিপ্লবের নায়ক বলে মহিমান্বিত করা হলেও ৭ ই নভেম্বর এর পাইকারী খুনাখুনীর দায় কিন্তু তিনি এড়াতে পারেন না।
যে সময়ে কুমিল্লায় পিপলস আর্মির কাজ শুরু করেন- তখনও কর্ণেল তাহেরের সাথে জাসদের কোন যোগাযোগ তৈরি হয়নি। পদত্যাগ করার পরেই- জাসদের সাথে যোগাযোগ হয়- এবং ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন জাসদের রাজনীতিতে।
আর, রক্ষীবাহিনী, মুজিব বাহিনী, আওয়ামী নেতা- কর্মী বাহিনী, বাকশাল বাহিনী এদের ত্রাসের কথাও কিন্তু লোকে ভুলে নাই!!!!!!
ইতিহাস নির্ভর আলোচনায়, ভুল অপরাধ তুল্য। আর ইচ্ছাকৃত বিকৃতি রীতিমতন মহাপাপ। আপনার ক্ষেত্রে কোনটি জানিনা…..
যুদ্ধ শেষে কর্ণেল তাহের ব্যারাকে ফিরেন- কুমিল্লা বিগ্রেডের দায়িত্বও তিনি পান। এরপরে- ৭২ এর শেষের দিকে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
জাসদের তত্তাবধানে – তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ভিতরে গড়ে ওঠা সংগঠনের নাম পিপলস আর্মি নয়- বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। পিপলস আর্মির কাজটি তিনি শুরু করেন- কুমিল্লায় থাকতেই, কুমিল্লা বিগ্রেডের দায়িত্ব হাতে পেয়ে। এবং এখান থেকে তাকে সরিয়ে দিতে চাওয়াতেই তিনি- সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
তাহেরের সম্পর্কে- এবং ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব সম্পর্কে জানার জন্য শাহাদুজ্জামানের “ক্রাচের কর্ণেল” বইটি পড়তে পারেন।
সবাইতো শুধু ক্ষমতার খেলাই খেললো, অথচ কেউ দেখলোনা বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাত কোটি থেকে কেমন করে পনের কোটি হলো। সাস্টেইনেবল সিভিল সোসাইটি বলে একটা কথা আছে, এত জনসংখ্যার ভিড়ে সেটা কিভাবে অর্জিত হবে কেউ এটা নিয়ে ভাবেনি ভাবছেও না। চেপে ধরেছে ক্ষুধা, দারিদ্র, সন্ত্রাস। মাঝে মাঝে খুব হতাশ হই, কেউ মুল কারন খোজেনা ব্যাস্ত কার দোষ কার উপর চাপানো যায় তাই নিয়ে। ছগীর আলী সাহেবের লেখার মধ্যে অনেক বাস্তবধর্মী বিশ্লেষন দেখে ভালো লাগলো। যেটার বড় অভাব বাংগালীর চরিত্রে। ইস! আমাদের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে এই গুনটা যদি বিন্দু পরিমানও থাকত। ধন্যবাদ আপনাকে।
সুন্দর লেখা। “পিলখানা ঘটনার পেছনে বিদেশী চক্রান্ত থাকতেই পারে, তবে মূল দায়ভাগ আমাদের নিজেদের।” এটা সবাইকে বুঝতে হবে। আমাদের সব দূর্দশার পিছে বিদেশীদের হাত আছে…সব ভারত, ইসরাইল, আমেরিকা বা পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র এই জাতীয় তত্ব দেওয়া রীতিমত মানসিক রোগের মত হয়েছে। এই প্রবণতা শুধু শিশুসুল্ভ এবং হাস্যকরই না, আত্মঘাতি ও।
“জাতি হিসেবে খুবই উচ্ছৃঙ্খল জাতি আমরা” – এই সরল সত্য কথাটা কেউই স্বীকার করতে চান না। আমাদের অনেক সমস্যার মূল কারন এটা। সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ তো অনেক বড় ব্যাপার। দেখুন না মাত্র ৩ দিন আগে হাসপাতালে মরনাপ্ন্ন রোগী দেখা নিয়ে কি তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল। রোগী মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রীকে ৪ মাসের শিশু সমেত থানা হাজতে যেতে হল। অতি শিক্ষিত ডাক্তার সমাজ, মানবতা যাদের হবার কথা মূল মন্ত্র, সেই তারা রীতিমত ঢাকা মেডিকেল বন্ধ করে এই সদ্য বিধবাকে দুধের বাচ্চা সমেত জেলে পাঠালেন। এই ঘটনা এই প্রথম না, বলা যায় নিয়মিত। বছর দুয়েক আগে রাজশাহীতে এই রকম আরেক রোগীর ভাইকে ডাক্তার ভাইদের বেধড়ক মারপিটের ফলে আজীবন পংগুত্ব বরন করতে হয়েছিল। চিকিতসক বনাম রোগী আর তাদের স্বজনের মারামারি বিশ্বের আর কয়টি দেশে হয় আমার জানা নেই।
আমাদের সেনাবাহিনীর অনেক অবদান আছে। মানি। কিন্তু তারাও গ্ণ খুনাখুনি প্রচুর করেছে। দুখজনকভাবে কোন ঘটনার ই স্বছ, নিরপেক্ষ বিচার হয়নি। বিদ্রোহী বি,ডি,আর সদস্যরা এতে উতসাহিত হতেই পারে।
দোষ কার সেটা বড় কথা না। সমস্যা, অভাব অভি্যোগ আসবেই, তাই বিবেককে জিম্মি রেখে বন্য উশৃখলতা দেখাতে হবে?