হাসিনার পতনের পরের পরিস্থিতি

হাসিনার পতনের পর ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে কার্যত কোন সরকার ছিল না। সারা দেশে ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দেখা যায়। সেই সময় সহিংসতায় ২৩২ জন খুন হন (প্রথম আলো, ৭ আগস্ট ২০২৪)। অভ্যুত্থান পরবর্তিতে সেই অবস্থা মেনে নেওয়ার যুক্তি দেয়া হলেও গত একবছরে সেই পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি। বণিকবার্তার এক প্রতিবেদন বলছে, জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয়মাসে খুন হয়েছে ১ হাজার ৯৩০ জন, ডাকাতি ৩৬৬, ছিনতাই ৯৭০, নারী নির্যাতন ১১ হাজার ৮টি। তারমানে ২০২৪ এর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর এই ৫ মাস ও ২০২৫ সালের জুলাই মাসের মিটফোর্ড ও গোপালগঞ্জের খুনসহ অন্যান্যগুলা যুক্ত করলে এই অংক বাড়বে। ১০ মাসে গ্রেফতার হয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার (সমকাল, ১ জুন ২০২৫)।

 

প্রায় দুই হাজার মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্মারক-ভাষ্কর্য ও শিল্পগুলো ধ্বংস করা হয়। একশোর মত মাজার গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। ৩২ নম্বারসহ লীগের শতশত নেতাকর্মীর বাড়ীঘর ভাঙ্গা হয়েছে ও বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের কয়েকটি শীর্ষ স্থানীয় শিল্প ও ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও মিডিয়া হাউস দখল করা হয়েছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলের যে পূর্বে সংস্কৃতি ছিল তার হাতবদল হয়েছে। ব্যাংক খাতের কিছু পরিবর্তন ছাড়া আইন-আদালত, বিচার, হামলা-মামলা, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতির কোন পরিবর্তন হয়নি।

অভ্যুত্থানের আকাঙ্খা, সংস্কার ও বাস্তবতা
জুলাই অভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে আমাদের অর্জন কি, সে প্রশ্ন আজ সবার। জুলাই আন্দোলনের সময় কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য না থাকলেও শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্খা তৈরী হয়েছিল, রাষ্ট্রের যে পদ্ধতি শাসককে কর্তৃত্বপরায়ন, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টে পরিণত করে সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নতুন বন্দবস্ত ও সংস্কার-মেরামত লাগবে।

সেই লক্ষ্যে অন্তর্বতীকালীন সরকার প্রশাসন ও রাজনীতিতে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে ৬টি কমিশন গঠন করেনঃ নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশনগুলো ইতোমধ্যে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছেন যার পরিমান প্রায় সাত হাজার পৃষ্ঠা।

কিন্তু সেই সংস্কার কি মানুষের আকাঙ্খাকে ধারণ করে অগ্রসর হতে পারছে? এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, ”৫ আগস্টের পর দেশে সংবিধান, পুলিশ, স্থানীয় সরকার, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের আলাপ হয়েছে। কিন্তু গত ছয়-সাত মাসে অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে খুব বেশি কিছু করা হয়েছে কি?” (বণিক বার্তা)

বিডিনিউজের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ ”পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমার দেড় মাস পার হলেও তার বাস্তবায়ন শুরু না হওয়ায় খেদ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তাদের সুপারিশ যে সামনে বাস্তবায়ন হবে তার কোনো লক্ষণও দেখছেন না তিনি। তবে এর একটা আর্কাইভাল ভ্যালু হবে বলে মন্তব্য করেন।” (বিডিনিউজ, ৯ জুন ২০২৫)

প্রথম আলোর এক সাক্ষাৎকারে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “আমাদের কাছে আকাঙ্ক্ষাটা ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থার পতন বা বিলোপ ঘটেনি। সেই ব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে। সেই ব্যবস্থার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরে গেছে, আরেকটা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।”

অভ্যুত্থানের অন্যতম নেত্রী উমামা ফাতেমা, তার এক দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে হতাশা নিয়ে বলেন, “সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্ররাই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সবার সঙ্গে শুধু ছলনা হয়েছে।”

তারমানে যে সংস্কার ও নতুন বন্দবস্তের কথা বলা হয়েছিল, এক বছরেও তার কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। বরং সংস্কারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট ও বিভেদ-বিভক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো কি সংস্কার চায় না? চায় কিন্তু সেই চাওয়া যে যার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও অভিসন্ধি অনুযায়ী। সংকট সেখানেই।

সংস্কারের কোন বিষয় দূরভিসন্ধি মুক্ত নয়, বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারের মৌলিক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই আছে প্রচন্ড মতভিন্নতা। বিএনপি ও বামদলগুলোর অভিযোগ কথিত ’নতুন বাংলাদেশ ও দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ কথা বলে সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন ও একাত্তরকে ছাপিয়ে ২৪কে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা। এমন কি যে ব্যক্তিকে সংবিধান সংস্কারে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাঁকে নিয়েও তাদের বিতর্ক-আপত্তি আছে।

ছাত্রদের সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী চরিত্র
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই সংগ্রাম হলেও তাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধের বক্তব্যটি ছিল নিছক প্রচারণা, আদর্শিক নয়। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব, গ্রাম-শহরে, পাহাড়-সমতলে, আয়-উপার্জনে, চাকরিতে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে আছে ব্যাপক বৈষম্য ও বঞ্চনা। বৈষম্যের ব্যানার নিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলে যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল তারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি বোঝেন কিনা সন্দেহ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্যেই পরিষ্কার হতে থাকে তাদের এই বৈষম্যবিরোধিতা আসলে একটা স্ক্যাম বা কথার কথা। তারা সমাজের মূল বৈষম্যগুলোকে আড়াল করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক অভিলাসকেই প্রধান্য দিয়েছে।

বাংলাদেশের সকল আন্দোলনেরই প্রাণশক্তি ছিল ছাত্র-তরুণ কিন্তু তারা কখনো ক্ষমতা, স্বার্থ ও সুবিধার অংশীদার হয়নি, দাবীও করেনি। সেক্ষেত্রে ২৪ এর আন্দোলনের নেতৃত্বের চরিত্র ব্যতিক্রম। চাকুরীতে কোটা সংস্কারের দাবীতে যে ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল তাদের চাওয়া ছিল সরকারের অভিজাত কর্মচারি হওয়া। এটা হতে চাওয়ার উদ্দেশ্য ও মনস্তত্ত্ব হচ্ছে ক্ষমতা ও অর্থ উপার্জন। এই তারাই যখন সরকারের শীর্ষ পদে চলে গেল- তখন তাদের মধ্যে ক্ষমতার স্বাদ তৈরী হলো। সরকারী পৃষ্টোপোষকতায় তারা দল গঠন করলো এবং প্রচলিত রাজনৈতিক ধারাকেই অনুসরণ করলো। ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজি, ক্ষমতাবাজির অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে এই আন্দোলনের যে বিপুল সম্ভবনা তৈরী করেছিল তা কয়েক মাসের মধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে।

জুলাই বিপ্লব (?) কি বেহাত হলো?
নাহিদ ইসলাম তার এক বক্তব্যে বললেন, বিপ্লব বেহাত হয়েছে। যে কথা এই সংগ্রামে অংশ নেয়া অধিকাংশ মানুষও বলছে। যদিও এটা কোন বিপ্লব ছিল না। আমি মনে করি বিপ্লব বেহার হয়নি, যাদের হাতে থাকার কথা ছিল তাদের হাতেই আছে। সেটা আমাদের বুঝতে না পারার অক্ষমতা। ৫ আগস্ট হাসিনা পলানোর পরই তার শুরু হয়েছিল যখন সরকার গঠনে সেনাপ্রধান প্রথমেই জামায়াতের নাম প্রথম উচ্চারণ করলেন। তারা তাদের আঘাতটা শুধু হাসিনা ও লীগের উপর রাখেনি, তাকে উপলক্ষ করে- মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, মুক্তচিন্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী, সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর এনেছে। এগুলোকে কি বলতে হবে মানুষের স্বতস্ফুর্ত ক্ষোভ ও মনের খেয়ালের বিষয়, পরিকল্পিত নয়? তারচেয়ে বড় বিষয় এই আঘাতে কোথা থেকে, কোন শক্তির দ্বারা, কাদের প্ররোচনায়, কোন ছকে হয়েছে তাও কারো অজানা নয়।

বৈবিছাআ’র সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার তার এক আলোচিত ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ’বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্মটা একটা বিশেষ গোষ্ঠী জোর করে দখল করে নিয়েছে। একে ব্যবহার করে একটি দলও গঠন করা হয়েছে। এরা ভাই-ব্রাদার মিলে শুধু যে কোরামবাজী-লুটপাট করে বেড়াচ্ছে; বিষয়টা শুধু এমনই না! এরা নিজেদের প্লাটফর্মের লোকজনদের মাইনাস করতে- হেয়ার রোড থেকে আদিষ্ট হয়ে একে-ওকে হুমকিও দিয়ে বেড়াচ্ছে, ভয়ভীতিও প্রদর্শন করছে।” তিনি আরো বলেছেন, ”বিপ্লব, জুলাই, শহিদ এইসব কিছু না; এইসব শব্দ ব্যাবহার করে এরা আসলে নিজেদের ফায়দা লুটছে।“ অভ্যুত্থানের নেতাদের মুখ থেকেই হতাশা ও ক্ষোভের কথা বেড়িয়ে আসছে, সাধারণ মানুষের কথা তো বলাই বাহুল্য।

অতি দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক ধারার উত্থান
এবছর এপ্রিলে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল, ”বাংলাদেশে ইসলামী কট্টরপন্থীরা বর্তমান পরিস্থিতিকে নিজেদের ক্ষমতায়নের সুযোগ হিসেবে দেখছে।” পত্রিকাটি বাংলাদেশে ইসলামি শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাব ’মোটামুটি ঠিকভাবে তুলে ধরেছে’ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের মতে, “আওয়ামী লীগের পতনের ফলে যে রাজনৈতিক শূণ্যতা তৈরী হয়েছে, তা এতদিন দমন-পীড়নের শিকার হওয়া ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর- বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর- শক্তি পুর্নসঞ্চয়ের সুযোগ করে দিয়েছে।

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী হয়েছে। দেশে দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে। তাদের একটা উত্থান হয়েছে এখন। ছাত্রদের নেতৃত্বে যে পার্টি হয়েছে, সে পার্টির বক্তব্যে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ নিয়ে কোনো কথা নাই। তারা ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করবে। সে জন্য তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’

দিবসের প্যাকেজ ও নতুন বাংলাদেশ
জুলাই অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে সরকার একটি ’দিবস প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছিলেন। তারমধ্যে একটি হচ্ছে ”নতুন বাংলাদেশ দিবস”। আমাদের দেশে অনেক দিবস আছে, দিবসগুলো উদযাপন ছাড়া এর কোন গুরুত্ব আছে এমনটা নয়। যেমন রাষ্ট্রভাষা, বিজয়, স্বাধীনতা দিবসসহ আরো অনেক দিবস পালন হয়ে আসছে, কিন্তু তার কি কোন ব্যবহারিক দিক আছে? যেমন বিশ্ব মানবাধিকার দিবস প্রতিবছর পালিত হয় কিন্তু তা কি মানবাধিকার উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখছে? সমাজ রাজনীতিতে যখন নীতি-আদর্শের জায়গা শূণ্য থাকে’ তখন সবকিছু দিবস নির্ভরনির্ভর হয়ে ওঠে।

এখন নয়াবন্দবস্তের নামে চলছে ২৪এর জুলাই চেতনাবাজি, যা আগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের নামে। গণভবনে জুলাই যাদুঘর, ৬৪ জেলায় স্মৃতিস্তম্ভ, আন্দোলনে নিহত পরিবার ও আহতদের চাকরির কোটা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। জুলাইকে মনে রাখতে এত কিছুর দরকার নেই। জুলাইকে মনে রাখতে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করলে মানুষ এমনিতেই তাকে স্মরণ করবে। কিন্তু দেশ কি সে পথে হাটছে? হাসিনা যেভাবে মুজিব-মুক্তিযুদ্ধকে হেয়ো করেছেন, এরাও জুলাইকে নিয়ে তাই করছে।

আমরা কি আবারও প্রতারিত হলাম?
ড. ইউনূসের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক কিন্তু তিনি তার কিছুই করতে পারেননি বরং ক্ষমতায় থেকে তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এনসিপি নামের কিংস পার্টি গঠন করে- তাকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে ক্ষমতায়িত করার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে গণতান্ত্রিক মনোভাব ও সহনশীলতা চর্চার কথা ছিল সেটা হয়নি বরং বৈরীতা বাড়ছে। বিপুল রক্তক্ষয়ের জুলাই অভ্যুত্থানেও পূর্বের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। শেখ হাসিনার শাসনামলকে বলা হতো ”মগের মুল্লক” এখন ড. ইউনূসের শাসনামলকে বলা হচ্ছে ’মবের মুল্লুক”। মগের মুল্লুক তো রয়েই গেছে, সাথে যুক্ত হয়েছে মগটাও! অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ভাষায়, ”বাংলাদেশ এখন স্বৈরতন্ত্রের খোলা থেকে অজানাতন্ত্রের আগুনে পড়েছে।”

জুলাই অভ্যুত্থান গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার এক অপার সুযোগ তৈরী করেছিল কিন্তু সেই সুযোগ উপযুক্ত ও দৃশ্যমান রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতিতে হাতছাড়া হলো। শূণ্যতার সেই স্থানটি দখল করতে প্রবল তৎপর দেশের অতি দক্ষিণপন্থী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। কিন্তু মধ্য ও বামপন্থী দলগুলো যদি সামাজিক শক্তির সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক বলয় গড়ে তুলতে পারতো তাহলে হয়তো সেই সম্ভবনা তৈরী হতো। সেটা না করে এই শক্তি আরো অনাহুত বিরোধ-বিতর্কে লিপ্ত ও কর্তব্য নির্ধারণে ব্যর্থ। পাশের রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা বছর দুই আগে একই পরিস্থিতির মধ্য গেলেও দেশটি বামপন্থীদের নেতৃত্বে ঘুরে দাড়িয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রতিবেশির পরিবর্তন আসলে আমাদের কিছুই শেখাতে পারেনি।

তাহলে কি আমরা আবারো প্রতারিত হলাম। বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলছেন, “এই ছেলেমেয়েরা যে গান-স্লোগান-বক্তৃতা দিয়ে এই আন্দোলন করেছিল এখন তার উল্টা পথে হাঁটছে। এই আন্দোলনে সক্রীয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার করে এখন প্রতারিত বোধ করছি।” প্রতারিত হবার কথা শুধু তিনি নয় অনেকেই বলছেন, কিন্তু এত অল্প সময়ে জুলাই এতটা বিতর্কিত ও কলঙ্কিত হবে সেটা ছিল অভাবনীয়। শুধু জুলাই নয় মহান স্বাধীনতা, ৯০এর গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতাও এমন বেদনাদায়ক। তারমানে কি ৭১, ৯০ ভুল ছিল? বিষয়টি তেমন নয়। আমাদের আকাঙ্খা, আত্মদান ছিল সৎ-মহৎ কিন্তু ভুল নেতৃত্ব ও অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে বার বার তা একই পরিণতি বরণ করেছে।
————————————————————————————–
ড. মঞ্জুরে খোদা, কলামিস্ট, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।