লিখেছেনঃ মোঃ মারুফ হাসান

এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্র আছে যারা জানেই না আমাদের যে পৃথিবী, এটি প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছরের পুরোনো। সেদিন এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ পৃথিবীর বয়স নিয়ে কথা উঠলো। সে পিএইচডির প্রায় শেষ পর্যায়ে। যখন আমি পৃথিবীর সাড়ে চারশো কোটি বছরের বয়স বললাম, সে বলে উঠলো, “বিজ্ঞানীরা কীভাবে জানলো? সবই তো ধাপ্পাবাজি দাবি।” আমি তার জ্ঞানের গভীরতা দেখে আর কথা বাড়ালাম না। চুপ করে গেলাম।

এখন বিজ্ঞান যে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সাধারণ মানুষের কথা তো বাদই দিলাম, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্ররাও কখনো কখনো জানে না। আমি শিক্ষা ব্যবস্থাকেই দোষ দিচ্ছি এখানে। আমাদের বাংলাদেশে মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিটাই জোর করেই সবার মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হয়, বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরাই কনফার্মেশন বায়াসে যে কোনো বিষয়কে নিয়ে নেয়।

God of the Gaps যে পরিমাণে বিজ্ঞান পূরণ করেছে ১৯শ বা ২০শ শতকের তুলনায়, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এখনও অনেক “missing link” আছে, কিন্তু সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সেইসব এলাকায়। দেশের মানুষের এসব নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে একে তো আপডেট নেই তার উপর আবার গবেষণাকেও তাঁরা একেবারে অকাজের জিনিসই মনে করে। এই যে বিশাল ফাঁক তৈরি হচ্ছে, এটার জন্যই কিন্তু বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষই রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত।

রিচার্ড ডকিন্স (ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে)

রিচার্ড ডকিন্স তাঁর Science in the Soul বইয়ের ভূমিকায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন “কসমিক রোমান্টিসিজম” নিয়ে একটি অভিজ্ঞতা। তিনি লিখেছেন:

“এক অন্ধকার রাতে আমি ক্যানিয়নের দক্ষিণ প্রান্ত ধরে হেঁটে গিয়ে একটা নিচু দেয়ালের ওপর শুয়ে পড়লাম এবং তাকিয়ে রইলাম আকাশগঙ্গার দিকে। আমি যেন সময়ের পেছনে তাকাচ্ছিলাম—এক লক্ষ বছর আগের একটি দৃশ্য দেখছিলাম, কারণ সেই আলো তখনই বের হয়েছিলো তার দীর্ঘ যাত্রায় আমার চোখে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে। পরের দিন সকালে আমি আবার সেই জায়গায় ফিরে গেলাম। ভয়ঙ্কর এক মাথা ঘোরা অনুভূতি নিয়ে বুঝতে পারলাম রাতে আমি কোথায় শুয়ে ছিলাম! আমি নিচে তাকিয়ে দেখলাম অনেক নিচে ক্যানিয়নের মেঝের দিকে। আবারও আমি সময়ের গভীরে তাকাচ্ছিলাম—এইবার প্রায় দুই বিলিয়ন বছর পেছনে, যখন পৃথিবীতে শুধু অন্ধ অণুজীবেরা আকাশগঙ্গার নিচে নড়াচড়া করতো। যদি হোপি আত্মারা সেই মহাসুনসানে ঘুমিয়ে থেকেও থাকে, তাহলে তাদের সঙ্গে ছিলো ট্রাইলোবাইট, ক্রিনয়েড, ব্র্যাকিওপড, বেলেমনাইট, অ্যামোনাইট এমনকি ডাইনোসরের পাথরে বন্দী আত্মারাও।”

ডকিন্স এই কথাগুলো কবিতার মতো করে লিখেছেন কারণ “Poetry of Reality” আমাদের এমন এক বাস্তব সৌন্দর্য উপস্থাপন করে যা ধর্মীয় কল্পকাহিনির চেয়ে অনেক বেশি বিস্ময়কর এবং মনোমুগ্ধকর—যেগুলো আমাদের সত্য হিসেবে শেখানো হয়েছিল, অথচ সেগুলো আসলে সত্য নয়।

এই যে আমাদের সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বটা কালের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে—ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তারা আর গ্রহ নিয়ে, আর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের ব্যাপ্তি—কখনো কি মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে না, কিভাবে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো ভুলভাল গল্পে ভর্তি, যেগুলো মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল?

একটু সমালোচনামূলক মানসিকতা নিয়ে পড়লেই দেখা যায় অনেক লোককথার মতো গল্প ধর্মগ্রন্থে স্থান পেয়েছে, যেগুলোর অসারতা আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা যায়।

ধরো দাজ্জালের গল্পটা—যেটা সহীহ বুখারীতে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একজন সমুদ্রে গিয়ে পথ হারিয়ে একটা দ্বীপে পৌঁছায়, যেখানে সে এক হিংস্র বন্দী জীবের দেখা পায়। সেই জীবটা মানুষের মতো কথা বলে এবং বলে “আমি দাজ্জাল।” এধরনের উদ্ভট গল্পগুলো এখনো ছাত্ররা গিলে নিচ্ছে শুধু এই কারণে যে এগুলো ধর্মীয় গ্রন্থে লেখা আছে।

J.K. Sheindlin ২০১৫ সালে একটি বই লেখেন যার শিরোনাম The People vs Muhammad: The Trial Which Challenges the Founder of Islam’s Authority Over All Mankind। এটি মূলত মুহাম্মদের জীবনের ওপর একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এই বইতে মুহাম্মদের অনেকগুলো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার কথা বলা হয়েছে, এমনকি সে সিফিলিসে আক্রান্ত ছিলেন—এই দাবিও তোলা হয়েছে।

লেখক যুক্তি দিয়েছেন যে, সিফিলিস রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে। মুহাম্মদের শিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে দেখা যায় তাঁর বিয়ের ১৫ বছর পর এবং তখনই তাঁর স্ত্রী ও চাচা তাঁকে বলেন, “তুমি সত্যিকারের বার্তাবাহক।” এই বিশ্বাসটা বাইরের উৎস থেকে তাঁর মস্তিষ্কে ঢুকে পড়েছিল—এই ধারণা তিনি বিশ্লেষণ করেছেন।

বইটিতে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে—মুহাম্মদের পিঠে যেটিকে “নবুয়তের সীল” বলা হয়, সেটি আসলে এসটিডির সেকেন্ডারি উপসর্গ হিসেবেই দেখা যায়।

যদিও আমি লেখকের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নই, তবুও যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—তিনি সমালোচনামূলক মানসিকতা নিয়ে ইসলামি সাহিত্য পর্যালোচনা করেছেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেছেন। এই ধরণের মুক্তচিন্তা মুসলিম ছাত্রদের জন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই গ্রহণযোগ্য নয়।

যদি ধর্ম বা ইসলাম সত্যিই কোনো divine উৎস থেকে এসে থাকে, তাহলে সেখানে এতো অসংগতি থাকা উচিত নয়। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অসংগতি অনেক। এই কারণেই কিছু কিছু মুসলিম পণ্ডিত কেবল কোরআনকেই রক্ষা করার চেষ্টা করেন—হাদীসগুলোকে বাদ দিয়ে।

আর মুসলিম নারীবাদীরা ধর্মীয় শ্লোকগুলোর নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছেন। এই ঘটনাগুলোই আসলে প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় গ্রন্থগুলো আধুনিক সমাজে কার্যকর নয়।

বিজ্ঞানই একমাত্র ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে পারে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দিন দিন আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে।