লিখেছেনঃ মোঃ মারুফ হাসান
“প্রায়োগযোগ্য প্রমাণ অনুসারে, আমাদের সৌরজগতে ডানা–যুক্ত কোনো ঘোড়া বা পক্ষীরাজের অস্তিত্ব নেই; এবং এমনকি এটি যদি দৃশ্যমান মহাবিশ্বে তা থেকেও থাকে, তবুও আমাদের কাছে তার কোনো প্রমাণ নেই।“
এখন ধরুন, তসলিমা নাসরিন তার বর্তমান জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে এই বাক্যটি তার উপন্যাসে লিখেছেন। তাহলে সেই উপন্যাস কি নিষিদ্ধ করা উচিত? তসলিমা নাসরিনকে কি হত্যা করা উচিত? তার জ্ঞান, লেখনী ও প্রকাশনার জন্য কি তাকে বাংলাদেশের আইনে শাস্তি দেওয়া উচিত?
বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এর উত্তর হলো ‘হ্যাঁ‘।

Source : https://www.aljazeera.com/news/2021/2/16/bangladesh-court-sentences-five-to-death-for-killing-us-blogger
আপনাদের এটা মনে থাকবার কথা যে লেখক ড. অভিজিৎ রায়ের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল বাংলাদেশি জনগণের দ্বারা সংঘটিত রক্তপাতের মাধ্যমেই। বাংলাদেশে লেখকরা সবচেয়ে অনিরাপদ এবং সরকার তাঁদের সুরক্ষা দেয় না।
হাসিনা সরকার হোক বা ইউনুস সরকারি হোক, মুক্তচিন্তকদের জন্য এই বাংলাদেশে তাদের মত প্রকাশের কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। প্রকৃতপক্ষে, ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক, যদি তারা সত্য কথা বলে। এখানকার সংশ্লিষ্ট আখ্যানগুলো ক্ষমতার মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং সত্যকে মিথ্যার আকারে উপস্থাপন করা হয়।
হাসিনা শাসনামলে ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছিল, এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদী ঘটনাপ্রবাহের উত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এমনকি জনপ্রিয় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদরাও এখন কট্টর ধর্মীয় কার্যকলাপের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।
ধর্মচর্চায় ও জীবন যাপনে বড়সড় কিছু ভুল যে হচ্ছে তা আপনি কিন্তু জানেন, অথচ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনাকে চুপ থাকতে হবে। এখানে সবসময়ই জীবন হারাবার হুমকি রয়েছে। সবসময়ই হয়রানি ও নিপীড়ন বিদ্যমান।
যারা অভিজিৎ রায়ের মতো লেখেন, তাদের পরিণতি আপনি মিডিয়ায় দেখতে পান। সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলো ধর্মীয় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে গেলে সেগুলো এখানে প্রকাশের অনুমোদন পায় না। তথাকথিত গণ জনতা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকছে আপনাকে অমানবিকভাবে পেটানোর জন্য।
বাংলাদেশে কী ধরনের সাহিত্য লেখা উচিত, তা পরোক্ষভাবে লেখকদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলে দেওয়া হচ্ছে কী কী বিষয় লেখা যাবে যাতে লেখকের প্রাণসংশয় না হয় বা তারা নিরাপদ থাকেন। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে চিন্তার স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
“আপনি যদি মারিজুয়ানা গ্রহণ করেন, তাহলে আপনি বিভ্রমের মধ্যে পড়বেন“ এই সাধারণ সত্যটি বলার জন্যও আপনাকে সম্ভবত রক্ত বা জীবন দিয়ে মূল্য চুকাতে হবে।
বইমেলার যে স্টলটি ভাঙচুর করা হয়েছিল সেটিতে সৌভাগ্যবশত লেখিকা তসলিমা নাসরিন উপস্থিত ছিলেন না, যেমন অভিজিৎ রায় কয়েক বছর আগে ছিলেন।
অভিজিৎ রায়ের ভুল ছিল বইমেলায় স্বশরীরে যোগদান করা, অথচ তিনি ছিলেন, তিনি বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের জন্য তার কাজকে নির্ভয়ে উৎসর্গ করেছিলেন।

Source : https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/news/bookstall-attack-its-assault-freedom-expression-3821786#lg=1&slide=0
কিছু কিছু শিক্ষক সত্যিই অসাধারণ, তারা ৪.৫ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে আমাদের সৌরজগতে উপস্থিত হয়েছিলেন, এবং আমরা তাদের এক ঝলকের জন্য দেখেছিলাম। তারা সামান্য সময়ের জন্য বেঁচে ছিলেন, এবং হয়তো আমাদের জন্য আরও কিছুটা সময় বাঁচতে পারতেন, কিন্তু তাদের সত্যবাদিতার জন্য হত্যা করা হয়, কারণ তাদের উল্লেখিত কঠিন সত্যগুলো আরোপিত ধর্মীয় গণবিভ্রমের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশের মানুষ প্রতারণার মধ্যে থাকতে ভালোবাসে। তারা বিভ্রম ও মিথ্যার মধ্যে জীবনযাপন করে। তসলিমা নাসরিন ও অভিজিৎ রায়ের মতো কিছু লেখক এই প্রতারণা ও মিথ্যার ব্যাপারে কথা বলেছেন, তাঁরা দেশছাড়া হয়েছেন, খুন হয়েছেন। আপনি বিশ্ব মিডিয়ায় যে কোঁ সময়ে এই সব সংবাদ দেখতে পারেন।
যারা গত দশকে ব্লগারদের হত্যা করেছে, তারা ‘গাজী’ (ইসলামের জীবিত যোদ্ধা) হিসেবে মুক্তি পাচ্ছে ও পাবে। অন্যদিকে, সরকার বা শাসক সমর্থিত স্থবির ধর্মীয় অনুশাসন ও আখ্যানগুলো যেমন আছে, তেমনই থাকবে। এই ক্ষতিকর স্থিতাবস্থা বদলাবে না।
তসলিমা ও অভিজিৎদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হবে, কারণ তারা বিভ্রম ও প্রতারণার বিরুদ্ধে কিছু কঠিন সত্য বলেছিলেন যা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রচলিত। তারা অনুরোধ করেছিলেন প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বয়সী মহাবিশ্বকে কোনো মেটাফিজিক্যাল এবং বিভ্রান্তিকর বাস্তবতা ছাড়া গ্রহণ করতে, যা ধর্মীয় কাহিনীগুলির মাধ্যমে হোমো স্যাপিয়েন্স তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নতুনভাবে উদ্ভাবন করেছে।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, নতুন সরকার কি ভবিষ্যতের গণমাধ্যম, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও লেখকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে?
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই সাধারণ মানুষগুলো তাদের চিন্তার স্বাধীনতার জন্য নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য কারণ, অন্তত তথাকথিত কলম এবং কাগজে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ।
অতিথি লেখক: মোঃ মারুফ হাসান
পিএইচডি গবেষক, উসুল আদ–দীন ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া
মাস্টার্স, উসুল আদ–দীন ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া
ডিগ্রি, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া
ই–মেইল: [email protected]
Leave A Comment