“ঈশ্বর যে নেই” – তার প্রমাণ কী?

এমন প্রশ্ন অনেক ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষকেই করতে শুনি। বিভিন্ন সময়ে এর জবাবে বার্ডেন অব প্রুভের যুক্তি নিয়ে এসেছি, তারপরেও ঈশ্বর-বিশ্বাসীরা দমে যান না, রায় ঘোষণার মত করে বলে দেন, “ঈশ্বরকে প্রমাণ যেমন করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না। বস্তুত তিনি প্রমাণ-অপ্রমাণের উর্ধ্বে একটা সত্ত্বা”। একমাত্র অবাস্তব – অলীক – কাল্পনিক কোন কিছুই যে প্রমাণ-প্রমাণের অতীত হতে পারে, সেটি অবশ্য তারা বুঝতে পারেন না বা মানতে চান না! যাই হোক, আমি সংশয়বাদী নই, আমি নাস্তিক। মানে, আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে কেবল সন্দিহানই নই, আমি ঈশ্বরের অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত। সে কারণে, ঈশ্বরের অনস্তিত্বের প্রমাণাদি দেয়াটাও আমি কর্তব্যজ্ঞান করি বিধায়, সেই প্রমাণগুলোর একটা তালিকা তৈরিতে আগ্রহী হয়েছি। সেই তালিকাটিই এক্ষণে বর্তমান লেখাটিতে তুলে ধরছি।

১। ঈশ্বর নামে কোন কিছুর দেখা পাইনি বা অন্য কেউ কোনকালে দেখেছে বলে প্রমাণও করতে পারেনি, জীবনে তার অস্তিত্ব অনুভব করিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন ঘটনার ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের উপস্থিতির দরকার পড়েনি। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই।

২। এই যে আমি সহ দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ বলছি, ঈশ্বর নেই, কিন্তু ঈশ্বর কিছু করতে পারছেন না। শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকারই নয়, অনেকেই ঈশ্বরকে নিয়ে হাসি-তামাশা, গালাগালি যা ইচ্ছে করছে, এমনকি দুনিয়ার ঈশ্বরবিশ্বাসীরাও যুগে যুগে নিজ নিজ কল্পনা মোতাবেক ঈশ্বরকে নিয়ে ইচ্ছে মত গল্পকথা, কিচ্ছা কাহিনী ফেঁদেছে, এক কাহিনীর সাথে আরেক কাহিনী কেবল বিপরীতই নয়, বিরোধাত্মকও। তারপরেও, ঈশ্বরের তরফ থেকে কোন রকম কোন উদ্যোগ দেখা যায় না! ঈশ্বর যদি প্রকৃতই থেকে থাকতেন, তাহলে অন্তত তাকে নিয়ে যত ভুল-ভ্রান্তি, গুজব, মিথ, মিথ্যা – প্রচলিত আছে, সেগুলো দূর করতে তো তিনি করতে পারতেন, নয় কি? ঈশ্বর কিছুই করেন না, ঠুঁটো জগন্নাথের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা বাদে। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই।

৩। দুনিয়ার যতগুলো ধর্মের যতসব ঈশ্বর আছে, তার একটি বাদে বাঁকিগুলোকে সবসময়ই ভুল এবং ভুয়া বলে ধর্মগুলো মনে করে ও প্রচার করে। মানে, কেবল নিজ ধর্মের ঈশ্বর সঠিক, বাঁকি সব ঈশ্বর ভুল। বস্তুত নিজ ধর্মের ঈশ্বরটিকে সঠিক মনে করা মানুষের চাইতে সেটিকে ভুল ও ভুয়া মনে করা মানুষের সংখ্যাই দুনিয়ায় সবসময় সবচেয়ে বেশি। সবযুগের, সব ধর্মের ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, তাকে অবিশ্বাস করা মানুষই বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ, আপনার ঈশ্বরটিকে কেবল নাস্তিক বা অবিশ্বাসীরাই নয়, দুনিয়র বেশিরভাগ ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষও অবিশ্বাস করে! অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই।

৪। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু অস্তিত্বশীল, তার ব্যাপারে দুনিয়ার মানুষ নিশ্চিতভাবে জানতে পারে। ফলে একেক জায়গার, একেক সমাজের মানুষের কাছে সেটি একেক রকম হয় না। কখনো কোন একটা জিনিসকে একেক মানুষ একেকভাবে দেখতে পারে, একেকজনের পারস্পেক্টিভ আলাদা হতে পারে (অন্ধের হাতি দেখার মত), কিন্তু একই পারস্পেক্টিভ থেকে দেখাটা আলাদা হয় না, আবার অনেকগুলো পারস্পেক্টিভ মিলিতভাবে একটা সম্পূর্ণ চিত্রও পাওয়া সম্ভব হয়! নিজ চোখে কখনো সরাসরি না দেখা (ছবিতে বা ভিডিওতে দেখা) মরু অঞ্চলের সাদা ভাল্লুক, দুনিয়া থেকে খালিচোখে দেখতে না পারা সৌরজগতের গ্রহ নেপচুন বা তার উপগ্রহ সমূগ, কিংবা অদৃশ্য বাতাস ও বাতাসে থাকা অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড – থেকে শুরু করে যা যা কিছু অস্তিত্বশীল, তার ব্যাপারে দুনিয়ার যেকোন প্রান্তের মানুষের মাঝে কোন রকম মতভিন্নতা নেই, সেসবের অস্ত্বিত্বের ব্যাপারে নানারকম কিচ্ছাকাহিনীও প্রচলিত নেই। আবার, যা কিছুর বাস্তবে কোন রকম অস্তিত্ব নেই, কিন্তু মানুষের কল্পনায় পেখম মেলেছে – তাদের সম্পর্কে গোটা দুনিয়ার নানা রকম কাহিনী, কিচ্ছা পাওয়া যায়। দুনিয়ায় হাজার – লক্ষ রকমের দৈত্য-দানব রয়েছে, লক্ষ লক্ষ ড্রাকুলা, রাক্ষস-খোক্ষস রয়েছে, জ্বিন-পরী রয়েছে; কোটি রকমের ভূত-প্রেত রয়েছে। যে যেমন কল্পনা করবে, সেরকমই ভূত তৈরি হবে। কবি সাহিত্যিক, রূপকথা-লেখক কল্পনায় কথা বলতে পারা পশুপাখির গল্প বলেন, মানুষের মত বাসাবাড়িতে বাস করা, কাপড়-চোপড় পরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জন্তু-জানোয়ারের গল্প বলেন, লিলিপুট – গালিভারের গল্প শোনান, এলফ – হোবিট কিংবা নেকড়ে-মানুষ, বাদুড়-মানুষ, উড়ন্ত মানুষ, বিদ্যুতের গতিতে ছুটতে পারা মানুষ, প্লাস্টিক-মানুষ, মৃত-সচল-মানুষ- এমন অসংখ্য “জিনিস” এর গল্প শোনান। এর সব কিছুই কাল্পনিক। বিউটি এণ্ড বিস্ট মুভিটা দেখতে দেয়ার পরে – যদি দশটা বাচ্চাকে বিস্ট আঁকতে দেয়া হয়, বিস্টের দশ রকম বৈশিষ্ট পাওয়া যাবে, কিন্তু বিউটির ছবি আঁকতে দেয়া হয়, তাহলেও দশ রকম ছবি পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু সবগুলো ছবিতেই একটা মানুষের (বা মেয়ের) প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিকই বিদ্যমান থাকবে। একইভাবে দেব-দেবী গোটা দুনিয়া জুড়েই যুগে যুগে বিভিন্ন রকম, ব্যাপক বৈচিত্রপূর্ণ। ঈশ্বরের ধারণার মাঝেও আছে এই বিশাল – বিপুল বৈচিত্র, কার দেব-দেবী বা ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ, তা নিয়ে মানুষে মানুষে কম মারামারি – হানাহানিও হয়নি! দুনিয়াজুড়ে ঈশ্বরের কোন রকম সাধারণ (কমন) ও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট পাওয়া যায় না, কেননা এসব কিছুই আসলে মানুষের কল্পনাজাত। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

৫। বস্তুত, কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে যে ব্যক্তিটি দাবি তুলে, এটা তারই দায়িত্ব যে – সেটার অস্তিত্ব প্রমাণ করা। প্রমাণ করতে না পারলে, অটোমেটিক সেই দাবিটি খারিজ হয়ে যায়, অর্থাৎ দাবির সেই “কোন কিছু”র অনস্তিত্ব প্রমাণিত হয়ে যায়। বিজ্ঞানে ইথার নামক মাধ্যমের কথা বলা হতো, আজ কেউই ইথারের কথা বলে না। ইথার যে নাই, সেটা আলাদা প্রমাণ করতে হয়নি, ইথার থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি মানেই হচ্ছে, ইথার বলে কোন মাধ্যমের অস্তিত্ব নেই। আজ পর্যন্ত যারাই দাবি করেছে যে, ঈশ্বর আছে; তাদের কেউই ঈশ্বরের কোন রকম নিশ্চিত প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

৬। গাণিতিকভাবে বা যুক্তবিদ্যায় আমরা জানি যে, কোন একটা দাবির স্বপক্ষে দেয়া যুক্তিকে ভুল দেখানোর মাধ্যমেও সেই দাবিকে ভুল প্রমাণ করা যায়, তেমনি কোন একটা দাবির ঠিক বিপরীত কোন সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণের মাধ্যমেও দাবিটির সঠিকতা প্রমাণ করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, জ্যামিতির উপপাদ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোন একটা উপপাদ্যের ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তটি যদি ভুল দেখানো যায়, তাহলে সেই উপপাদ্যটি প্রমানিত হয়ে যায়। যেমনঃ “একটি বিষমবাহু ত্রিভুজের তিনটি কোণের কোনটাই কোনটার সমান নয়” – এটি প্রমাণের জন্যে প্রথমে বিপরীত একটি সিদ্ধান্ত সঠিক বলে ধরে নেয়া যাক। মানে, ধরি – বিষমবাহু ত্রিভুজের যেকোন দুটি কোণ সমান, অথবা তিনটি কোণই সমান। বিষমবাহু ত্রিভুজের দুটি কোণ সমান হলে দেখা যাবে, ঐ দুই সমান কোণের বিপরীত দুই বাহু সমান হবে, আবার তিনটি কোণ সমান হলে দেখা যাবে (দুটি দুটি কোণ ধরে প্রমাণ করা সম্ভব) ত্রিভুজটির তিনটি বাহু সমান। যেহেতু বিষমবাহু ত্রিভুজ, অর্থাৎ তার তিনটা বাহুই অসমান। ফলে, বিপরীত সিদ্ধান্তটা ভুল প্রমাণ হলো, তার অর্থই হচ্ছে, বিষমবাহু ত্রিভুজের তিনটি কোণ সমান হওয়া সম্ভব না (কেননা, সমান হলে সেটি আর বিষমবাহু থাকে না)। এভাবে, বিপরীত সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণের মাধ্যমে মূল উপপাদ্যটি প্রমানিত হলো! একইভাবে, আজ পর্যন্ত ঈশ্বরের প্রমাণে যত যুক্তি প্রদান করা হয়েছে, বা ঈশ্বর সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে, সবই আসলে ভুল বা অযৌক্তিক হিসেবে প্রমানিত হয়েছে। সেখান থেকেও বলা যায়, ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা, তথা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষের যুক্তি ও ব্যাখ্যাগুলোর বেঠিকতা ও অসারতা প্রমাণই ঈশ্বরের অনস্তিত্বের প্রমাণ। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

ক) “ঈশ্বর সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা”: এই “সমস্ত কিছু”র অন্তর্গত যদি ঈশ্বর হন, তবে তিনি কি নিজেকেও সৃষ্টি করেছেন? আর, ঈশ্বরের যদি কোন আদি বা সৃষ্টি না হয়ে থাকে, বা তিনি যদি অনাদি ও অনন্তকাল ধরেই বিরাজমান হতে পারেন, তাহলে ঐ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও এমন সৃষ্টি বাদেই অনাদি ও অনন্তকাল ধরে বিরাজমান হতে অসুবিধা কোথায়? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মোট বস্তু ও শক্তি অনাদি ও অনন্তকাল ধরে একই থেকে কেবল রূপান্তরিত হচ্ছে, কোন ইউনিভার্সে কোথাও বিগ ক্রাঞ্চ হচ্ছে, কোনটিতে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে কোন ইউনিভার্সের যাত্রা শুরু হচ্ছে, আবার কোনটিতে বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং হওয়ার পর থেকে প্রসারিত হচ্ছে – এ সবই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে, প্রাকৃতিকভাবেই কোন সৃষ্টিকর্তা বাদেই তো হতে পারে। আর, সবকিছুর সৃষ্টির জন্যে সৃষ্টকর্তা আবশ্যক যদি হবেই – তাহলে সেই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের পক্ষেও অনাদি-অনন্তকাল বিরাজ করা সম্ভব নয়, তারও সৃষ্টিকর্তা কেউ না কেউ আছেন, সেই সৃষ্টিকর্তার আবার আরেকজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, সেই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকর্তা, তারও সৃষ্টিকর্তা আছেন। এভাবে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকর্তা বা পিতা, তার পিতা বা পিতামহ – প্রপিতামহ … এভাবে যেতে যেতে চেইনের শেষটা কোথায় পাওয়া যাবে? ফলে, সব কিছুরই একটা শুরু আছে বা সৃষ্টিকর্তা আছে, এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

খ) “জীবের মৃত্যু ঘটান ঈশ্বর, সমস্ত কিছু ধ্বংসও করবেন ঈশ্বর” : তবে কি তিনি নিজেকেও ধ্বংস করবেন? আর, বস্তু ও শক্তি অনিত্য, মানে তার ধ্বংস বা বিনাশ নেই, কেবল রূপান্তর আছে। মানুষসহ সকল জীবের মৃত্যুও আসলে ধ্বংস বা বিনাশ নয়। মৃত শরীর পঁচে ডিকম্পোস্ট হয়ে কিছু অংশ বাতাসের অক্সিজেনের সাথে মিলে কার্বন ডাই অক্সাইড হয়, আর বাঁকি অংশ মাটির সার হয়ে উর্বরতা বাড়ায়, স্তরে স্তরে মাটির গভীরে জমা হতে হতে অনেক বছর পরে জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা) হয়। আর, জীবের কোষগত মৃত্যুর জন্যেও কোন ঈশ্বরের দরকার আসলে নেই, জৈবিক কারণে ও জৈবিক উপায়েই সেগুলোর মৃত্যু ঘটে। চিন্তা করেন, দুনিয়ার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন জীবের প্রতিটা কোষের মৃত্যুর জন্যেই যদি ঈশ্বরকে নির্দেশ দিতে হয়, আর তার জন্যে যমদূত বা আজরাইলকে আসতে হয়, তাহলে প্রতি মুহুর্তে গোটা দুনিয়ায় কতগুলো যমদূতকে এই কাজে লিপ্ত থাকতে হবে! আমাদের এক মানব শরীরেই এক জীবনে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের মৃত্য ঘটে, তার মানে প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তেই কি যমদূত আমাদের শরীরে কোষ-হত্যার কাজে ব্যস্ত থাকেন (একা একসাথে এতগুলো কোষকে মারতে পারেন যদি)? তাহলে তো বেচারি যমদূতকে আসলে প্রতিটা মানুষের (এবং অন্যান্য জীবের) শরীরেই স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে নিতে হবে! এমন ধারণাই হচ্ছে আসলে উদ্ভট ও অবাস্তব। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

গ) “ঈশ্বর সর্বশক্তিমান”: ঈশ্বরের কি সেই পরিমাণ শক্তি আছে, যা দিয়ে তিনি নিজেকে পরাজিত করতে পারবেন? এই যুক্তিটিকে ফ্যালাসি মনে হতে পারে, কিন্তু “সর্বশক্তিমান” বা সুপ্রিম পাওয়ার বলে আসলে যে কোন কিছুই থাকতে পারে না, সেটা বুঝার জন্যে এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালীর ধারণামাত্রই আপেক্ষিক, কাউকে অন্যের চাইতে শক্তিশালী বলা যেতে পারে, এমনকি অন্য সকলের চাইতে শক্তিশালী বলা যেতে পারে, কিন্তু “সর্বশক্তিমান” বলা যায় না। আরেকটা প্রশ্নও করা যেতে পারে, ঈশ্বর কি এমন কোন পাথর তৈরি করার মত শক্তি বা সামর্থ্য রাখেন, যেই পাথর তিনি নিজে তুলতে পারবেন না? এই প্রশ্নও দেখিয়ে দেয় যে, আসলে “সর্বশক্তিমান”, “সব কিছুই পারেন” – এই দাবিগুলো প্রচণ্ডরকম ভুল। বস্তুত “সর্ব” বাদ দিয়ে ঈশ্বরকে বিপুল – বিশাল শক্তিমান হিসেবে দাবি করলেও, আসলে সেটাকে নিমিষেই অপ্রমাণ করে দেয়া যায়! ঈশ্বরকে যেকোন জায়গা থেকেই যেকেউ যেকোন চ্যালেঞ্জ জানালেই দেখা যাবে, কোন কিছুই বস্তুত করতে তিনি সক্ষম নন। ঈশ্বর কি এখন আমার হাত থেকে ল্যাপটপ নিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়ে- এসব ঈশ্বরবিরোধী লেখা থেকে আমাকে বিরত রাখতে পারবেন? কিংবা আমার হাতকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে বা আমার তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটিয়ে এই পোস্ট দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারবেন? সেই শক্তি, সামর্থ্য তাঁর আছে? এরকম প্রতিটা মানুষই ইচ্ছেমত চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেখতে পারে! প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে কোন কাজ করার সামর্থ্যই এই তথাকথিত “বিপুল শক্তিমান” ঈশ্বরের নেই। কেউ কেউ বলতে পারেন, ঈশ্বরের সামর্থ্য আছে, কিন্তু তিনি “তুচ্ছ” মানুষের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন, বা যার তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার দরকার মনে করেন না! তাহলেও বলা যাবে, চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সামর্থ্যহীনতা ঢাকতে ইচ্ছার অভাবকে অযুহাত হিসেবে তিনি ব্যবহার করছেন, নতুবা তার এই ইচ্ছাশক্তির অভাবটা আছে। দুই ক্ষেত্রই তাঁর শক্তিহীনতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

ঘ) “ঈশ্বর আছেন বলেই, এই বিশ্বজগৎ এত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে”: আমাদের দুনিয়াতেই এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড় – বন্যা – ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, সুনামিতে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয় যখন, তখন কি ঈশ্বর ছুটিতে থাকেন? বিশ্বজগৎটা মোটেও সুশৃঙ্খল নয়, বরং প্রচণ্ড রকম বিশৃঙ্খল (chaotic)। আজকে আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে এবং উপগ্রহগুলো গ্রহের চারদিকে বিচরণ করছে, কোথাও কোন সংঘর্ষ হচ্ছে না, পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতির কারণে দিন রাত হচ্ছে, ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে, যার কারণে পৃথিবীটা মানুষ ও জীবজন্তুর জন্যে আবাসযোগ্য হয়েছে – এত সব সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা দেখিয়ে অনেকেই দাবি করে, এর পেছনে নিশ্চিতভাবেই একজন ঈশ্বর আছেন, নচেৎ এত এত সুষ্ঠুভাবে সব কিছু চলতে পারতো না। বাস্তবে, আমরা পৃথিবীর চারদিকে যে শৃঙ্খলাটা দেখছি, সেটা মূলত দুটো বিশৃংখলার মাঝে পাওয়া একটু ফুসরৎ। এই বিশ্বজগতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নক্ষত্র, গ্যালাক্সি একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে, গ্রহে আছড়ে পড়ছে কোন গ্রহাণু বা ধুমকেতু, কখনো বা বাইরে থেকে ধেয়ে আসা কোন জ্যোতিস্ক কোন নক্ষত্রের মহাকর্ষে বাঁধা পড়ে গ্রহ হয়, বা বড় কোন গ্রহের মহাকর্ষে আটকে পড়ে হয় উপগ্রহ, কখনো বা, মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, কোন সময়ে ছোট একটা গ্যালাক্সি বড় গ্যালাক্সির পেটের মধ্যে ঢুকে যায়! পুরা বিশ্বজগৎ জুড়েই চলছে এমন তুমুল বিশৃঙ্খলা। আমাদের সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ – উপগ্রহের সৃষ্টি তথা এই সৌরজগতে আটকে পড়ার মাঝেও আছে এই বিশৃঙ্খলা! এই মুহুর্তেও আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে’ও ধেয়ে চলেছে পার্শবর্তী গ্যালাক্সি এণ্ড্রোমিডার দিকে (একে অপরের দিকে আকর্ষিত হয়ে ছুটে চলছে), এই দুই গ্যালাক্সির মাঝে সংঘর্ষ অনিবার্য (ততদিনে অবশ্য মানুষের কোটি প্রজন্ম পার হয়ে যাবে, যদি তার আগেই পৃথিবী ধ্বংস না হয়ে যায়, বা ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীটা মানুষের জন্যে বাসযোগ্য থাকে)। এই বিশ্বজগৎ কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে চলছে ঠিকই, কিন্তু এখানকার সমস্ত কিছুই লাগাম ছাড়া, উদ্দেশ্যহীন, স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে, এই বিশৃংখল মহাবিশ্বে সমস্ত ঘটনাই আকস্মিক ও অকস্মাৎ, কোন ঈশ্বরের পক্ষে যেমন প্রাকৃতিক সেই নিয়মগুলোর ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব নয়, তেমনি ঈশ্বরের বাবারও সাধ্য নেই যে, এই বিশ্বজগতে শৃঙ্খলা আনবে। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

ঙ) “ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান”: অস্তিত্বশীল কোন কিছুর পক্ষেই আসলে সর্বত্র বিরাজমান হওয়া সম্ভবই না! কোন একটা কিছু সর্বত্র বিরাজমান বলে মেনে নিলে বলতে হবে, হয় অন্য আর কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়, অথবা অন্য যা কিছু আছে, সেগুলোকেও সর্বত্র বিরাজমান সেই সত্ত্বার অংশ। অর্থাৎ, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান – এটা ধরে নেয়ার আরেক অর্থ হচ্ছে জগতের যা যা কিছু আছে, তার সবই ঈশ্বর। মানে, মহানাস্তিক আমি আর পরম ধার্মিক আপনি থেকে শুরু করে, জীব – জড় সবাই ও সবকিছুই ঈশ্বর। মানুষের মল বা পশুপাখির বিষ্ঠা, থেকে শুরু করে গ্রহ – তারা – নক্ষত্র সবই আসলে ঈশ্বর। এভাবে সবকিছুকে ঈশ্বর নাম দিয়ে ডাকলে আমি এমনিতে অবশ্য আপত্তির কিছু দেখি না, কিন্তু বুঝতে হবে – সেক্ষেত্রে ঈশ্বরকে স্রষ্টা বলার উপায় থাকবে না। কেননা, ঈশ্বর যে নতুন কোন কিছু একটা সৃষ্টি করবেন, সেটা কোথায় বা কিভাবে সৃষ্টি করবেন? সেই ফাঁকা জায়গাটিই তো নেই, যেহেতু সর্বত্রই অলরেডি তিনি রয়েছেন! থার্মোডাইনামিক্সের সূত্র অনুযায়ীও আসলে এগুলো অসম্ভব। তবে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান – এর আরো দুটো অর্থ করা যেতে পারে। স্থান বা স্পেস এর ধারণা অনুযায়ী একমাত্র এই স্পেসই সর্বত্র বিরাজমান, মানে বিশ্বজগতের সর্বত্রই স্পেস বিদ্যমান। সেই হিসেবে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান ধরলে ঈশ্বরকেই স্পেস বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে – এই স্পেস নামক ঈশ্বর হবেন কেবলমাত্র একটা ডাইমেনশন মাত্র, যার ফিজিকাল কোন অস্তিত্ব বা সত্ত্বা নেই। মানে স্পেস কোন কিছুই করতে সক্ষম নয়, সৃষ্টিকর্ম তো দূর অন্ত! স্পেস বাদে আরেকটা জিনিস আছে, যা সর্বত্র বিরাজমান। তা হচ্ছে শূণ্য। গাণিতিকভাবে এই শূণ্যই সবকিছুর মাঝে বিদ্যমান। আপনি যেকোন কিছুর সাথে একটা শূণ্য যোগ করে নিতে পারবেন, তাতে সেটা সেই থেকে যাবে, কোন কিছুর হেরফের হবে না। ফলে, একমাত্র এই শুণ্যই সর্বত্র বিরাজমান। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ঈশ্বরই হচ্ছে আস্ত একটা শুণ্য, বা অস্তিত্বহীন! অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

চ) “ঈশ্বর পরম দয়ালু”: দয়ার ব্যাপারটা কেবলমাত্র প্রাণধারণকারী সত্ত্বা তথা জীবের জন্যে প্রযোজ্য, এবং সবুজ গাছ ব্যতীত কারোর পক্ষেই অপর জীবে দয়া দেখানো সম্ভবই নয়। এই জীবজগতটাই টিকে আছে যে খাদ্য শৃংখলের উপরে, সেখানে একমাত্র সবুজ গাছ বাদে সকলের জন্যেই একে অপরকে ভক্ষণ করাই হচ্ছে বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র। খাদ্য শৃংখলে নীচে অবস্থান যারা করে, তারা উপরের খাদকদের নির্দয় ক্ষুন্নিবৃত্তির শিকার। এমন ব্যবস্থা যদি ঈশ্বরের হাতে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সেই ঈশ্বরকে আর যাই হোক, পরম দয়ালু বা নিদেন দয়ালুও বলা সাধে না! ঈশ্বর যখন এক জীবের সামনে অন্য জীবকে খাবার হিসেবে তুলে দিচ্ছেন, তখন তিনি খাদক জীবের প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু খাদ্য হওয়া জীবের প্রতি ঠিক ততখানিই নির্দয়, পাষাণ হয়ে যাচ্ছেন! জীবজগতের সবচেয়ে দয়ালু জীব সবুজ গাছপালা, যারা কখনও অন্য জীবকে হত্যা করে না, জীবন্ত খেয়ে ফেলেনা (মারা যাওয়ার পরে খায়), বরং সকল প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার জন্যে অতীব প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে, সেই সবচেয়ে দয়ালু জীব গাছাপালাই সবচেয়ে বেশি নির্দয়তা – নির্মমতার শিকার! এছাড়াও, ঈশ্বর রোগ – বালাই, ঝড় – বন্যা – সুনাম – ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির মাধ্যমে কত শত জীবকে হত্যা করেন, জীবনে ভয়ানক দুর্ভোগ দেন – তখন তার সেই দয়া কোন শিকেয় তোলা থাকে? মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে যে অনেক সময় দুর্বল, রোগা, পঙ্গু শিশু সন্তানের জন্ম দেন, অনেককে যে জন্মের পরপরই বা অল্প বয়সে মৃত্যু দেন, সেখানেই বা কোন দয়া কাজ করছে? অনেকেই বলতে পারে, ঈশ্বর নাকি এভাবে পরীক্ষা করছেন! মানুষকে (এবং অন্য জীবকেও কি?) এভাবে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য কি, এতে ঈশ্বরের কোন লাভটা হচ্ছে? তাঁর মনের আনন্দ, কিংবা খেয়াল-খুশি বা অলস সময় কাটানোর খেলা বাদে এসবের তো কার্যকারিতা নেই, স্রেফ মনের আনন্দের নিমিত্তে পরীক্ষার নামে মানুষের জীবনে এত দুর্ভোগ প্রদানের চাইতে নির্দয় ও নির্মম কাজ আর কিছু থাকতে পারে কি? অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

ছ) “ঈশ্বর সব শুনেন, সব দেখেন, ঈশ্বর রাগেন, খুশী হন, সাজা দেন, পুরস্কার দেন, ঈশ্বর ভালোবাসেন”: শুনা, দেখা, রাগারাগি করা, খুশী হওয়া, সাজা দেওয়া, পুরস্কৃত করা, ভালোবাসা – এসব কিছুই মনুষ্য প্রজাতির কার্য, আচার আচরণ, আবেগ অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। সেখান থেকেই বুঝা যায়, মানুষ আসলে নিজের আদলে ঈশ্বরকে কল্পনা করে নিয়েছে। ঈশ্বর যদি শুনেন, প্রশ্ন আসবে তার কি তবে কান আছে? যদি তিনি দেখেন, কি দিয়ে দেখেন? তাঁর কি চোখ আছে? রাগ করেন, খুশী হন, তাহলে কি ঈশ্বরের একটা মন আছে, আবেগ-অনুভূতি আছে? ভালো কাজের পুরস্কার দেয়া ও মন্দ কাজের সাজা দেয়ার কাজটা মানব সমাজে নিয়ম-শৃংখলা বজায় রাখা, সমাজকে সঠিক পথে রাখা – এসবের জন্যে দরকার হতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর পরে এরকম পুরস্কার আর সাজা দিয়ে ঈশ্বরের বা অন্যদের কি লাভ হচ্ছে? এতে দুনিয়ার মানুষের সামনে একরকম মূলা ঝুলিয়ে সুপথে রাখা আর কুপথ থেকে দূরে রাখার কাজ হতে পারে যেমন, তেমনি দুনিয়াতেই দুষ্টের দমন – শিষ্টের পালন করতে না পারার ব্যর্থতা শিকার করে নিতেও এটা আগ্রহী করতে পারে। অর্থাৎ নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত হতাশ মানুষ পরকালের ন্যায়বিচারের আশায় এভাবেই সান্ত্বনা খুঁজে নিয়ে মুখ বুজে সহ্য করে যেতে পারে। তাতে আদৌ সমাজের মঙ্গল সাধিত হয় না, পারলৌকিক সাজার ভয় আর পুরস্কারের লোভ, মানুষের উপরে ইহলোকে বিপরীত প্রভাবই রাখে, মানে ভালো কাজের জন্যে মানুষ সাজা ভোগ করতে থাকে, আর খারাপ কাজের জন্যে পুরস্কৃত হতে থাকে! সবমিলেই ঈশ্বরের ভালোবাসা দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ ও জীবকূল পায় না! অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

জ) “ঈশ্বর সর্বজান্তা এবং ত্রিকালদর্শী (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানেন বা দেখতে পারেন)”: কোন কিছু জানা ও বুঝার বিষয়টাও আসলে মানবীয় বিষয়, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়। ঈশ্বর যে কিছু জানবেন ও বুঝবেন – স্মৃতিতে সমস্ত কিছু জমা রাখবেন – প্রসেস করবেন, তার জন্যে তো তাঁর মগজ-বুদ্ধি থাকতে হবে, চিন্তা শক্তি থাকতে হবে। আর সবকিছু জানাও তো একটা অলীক ও অবাস্তব ব্যাপার। এই মহাবিস্তৃত মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু একসাথে জেনেবুঝে বসে থাকা কারোর বা কোন কিছুর পক্ষেই আসলে সম্ভব নয়। আর, ত্রিকালদর্শী বলে কিছু নেই। হ্যাঁ, অতীতটা জানা সম্ভব, মানে স্মরণশক্তি খুব ভালো হলে, কিংবা খুব ভালো বই থাকলে, আধুনিক কালের ভালো কম্পিউটারে অনেক তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে অতীতকে জানা সম্ভব। বর্তমানকে জানার কিছু নেই, বর্তমানকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্মৃতিকোটায় ধরে রাখা যেতে পারে। আর, ভবিষ্যৎ মানেই হচ্ছে – এখনো যা কিছু ঘটেনি। সেটা আগে থেকে জানার উপায় নেই। হ্যাঁ, পূর্ব ধারণা বা প্রেডিকশন করা যেতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রেডিকশন ঠিকঠাক হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। ফলে, ঈশ্বরের সর্বজান্তা হওয়া ও ত্রিকালদর্শী হওয়ার দাবির মাঝে কোন রকম সারবস্তু নেই। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কোন কিছু নেই।

ঝ) “ঈশ্বরের নির্দেশেই বিশ্বজগৎ চলছে, ঈশ্বরের নির্দেশ ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়তে পারে না”: কোন কিছুর নির্দেশেই বিশ্বজগৎ চলছে না, সবই চলছে আসলে নিজ নিজ প্রয়োজন মাফিক, বস্তুজগতের প্রাকৃতিক কিছু নিয়মের অনুসারে। একটা গাছের পাতা দূরের কথা, একজন চরমতম ঈশ্বর-বিশ্বাসী হিসেবে দাবি করা ব্যক্তিও আসলে ঈশ্বরের নির্দেশে চলছে না! কত ধার্মিক ব্যক্তিই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ধর্মের কত বিধি-নিষেধ অমান্য করে, তার ইয়ত্বা নাই। ঈশ্বর বলেছেন, মিথ্যা বলো না, তবু লোকে মিথ্যা বলে; ঈশ্বর বলেছেন, সুদ-ঘুষ খেয়ো না, মানুষ সুদ-ঘুষ খায়, অপরকে ঠকিয়ো না, তবু ঠকায়। নামাজ-রোজা, পূজা – আর্চনা – এসবেও কতজন কত ফাঁকিঝুকি মারে! খোদ সবচেয়ে বড় ফেরেশতা ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করে শয়তান হয়ে গেলো! ধার্মিক ব্যক্তিরই এই অবস্থা, আর আমার মত নাস্তিক হলে তো কথাই নেই! ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই – তার নির্দেশ অমান্য করি! ঈশ্বরের নির্দেশ ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা কৌতুককর ব্যাপার! আর, যদি বলা হয় – ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করাটাও আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছায় বা নির্দেশেই ঘটছে; তার চাইতে হাস্যকর আর কি হতে পারে? মানে, আমি এই যে ঈশ্বরকে ভুল ও ভুয়া প্রমাণ করে এই লেখাটি লিখছি, কিংবা আরেকজন ঈশ্বরকে গালাগালিই করছে, সেসবও যদি ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে, তাহলে ঈশ্বরের এমন নির্দেশের মূল্যই থাকলো কি, আর এসব নিয়ে কথা বলারই কি আছে? যা কিছু ঘটে বা হয়, সব ঘটার ও হওয়ার পরেই যদি বলে দেয়া, এমন এমনটাও ঈশ্বরের ইচ্ছায় বা নির্দেশেই ঘটেছে, তাহল ঈশ্বরের এমন নির্দেশ ও ইচ্ছার চাইতে অগুরুত্বপূর্ণ ও ফালতু বিষয় জগতে আর কি থাকতে পারে? অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

ঞ) “ঈশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক”: ঈশ্বরের ধারণাটিই হচ্ছে জাঁদরেল, প্রতাপশালী একনায়কতন্ত্রের ধারণা, এর সাথে ন্যায়বিচারের তো কোন সম্পর্কই থাকা সম্ভব না! ঈশ্বরকে তখনই ন্যায়বিচারক বলা সম্ভব হতো, যদি তিনি তার অপার-অসীম ও একচ্ছত্র ক্ষমতা মানুষ, জীবকূল এবং অন্যসব মহাজাগতিক সত্ত্বা, যেমন ছোটখাট দেব-দেবী, এঞ্জেল বা ফেরেশতা, জ্বিন, অসুর, দানব, – সবার মাঝে সমান ভাগ করে দিতেন, এবং কোন কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ না করে- সকলকেই অপার স্বাধীনতা দিতেন। কোনকালেই কোন একনায়ক, ক্ষমতা কুক্ষীগত করা কাউকে ন্যায়বিচারক বলা যায় না। আর, তিনি তার সৃষ্ট সকলের মাঝেও ন্যায় বিচার করেন কি না (যেমনঃ মহা পরাক্রমশালী – অত্যাচারী রাজাও – তার সমস্ত প্রজাকে সমান ভাবে শোষণ করেন কি না, নাকি প্রজায় প্রজায় ভেদ করেন) – সেই অর্থে ন্যায়বিচারকে ধরলেও বলা যাবে, তিনি মোটেও ন্যায়বিচারক নন। ঈশ্বরের ফুট-ফরমাশ খাঁটার জন্যে যেসব চাকর-বাকরকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, সেই সব এঞ্জেল বা ফেরেশতাদের জীবন কত করুণ, কত পরাধীন, কত নিরানন্দ! সেই চাকর-বাকরদের মাঝেও ঈশ্বর কোন রকম সমস্তা, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। যেমনঃ এক চাকরকে তিনি নিয়োজিত করেছেন তার কথা নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, সেটাও প্রায় দেড় হাজার বছর হলো বন্ধ করে দিয়েছেন, তার মানে তারপর থেকে সেই চাকরের আর কোন কাজ নেই। আরেক চাকরকে একটা বাঁশি দিয়ে রেখেছেন, কোন এক ভবিষ্যতে ঈশ্বর সব কিছু ধ্বংস করবেন, তখন এই বাঁশিতে ফুঁ দিতে হবে। তার আর কোন কাজ নাই! অন্যদিকে আরেক চাকরকে তিনি জীবের মৃত্যুর জন্যে নিয়োগ দিয়েছেন, বেচারার তো দম ফেলারই ফুসরৎ নেই। নরকে নিয়োজিত করেছেন যেসব চাকরকে, নরকের সেই প্রচণ্ড যন্ত্রণাময় পরিবেশে তাকে অনন্তকাল কাটাতে হচ্ছে কোন রকম পাপ না করেই! এই যে চাকর বাকরের মধ্যেও যে এত এত ভেদাভেদ করে রেখেছে্ন যেই ঈশ্বর, তাকে কোনভাবেই কি ন্যায়বিচারক বলা সম্ভব? এই প্রকৃতি জগৎটা যদি তিনি সৃষ্টি করে থাকেন, তবে তিনি এটাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, সেখানে ন্যায় বিচারের কোন নামগন্ধই নেই। সারভাইবল অফ দ্য ফিটেস্ট এখানে একমাত্র মন্ত্র। সবল ও যোগ্যই এখানে দুর্বল ও অযোগ্যের উপরে ছড়ি ঘুরায়। বাঘ যখন হরিণকে খায়, বিড়াল যখন ইদুর খায়, বড় মাছ যখন ছোট মাছকে খায়, এখানে ঈশ্বর দয়া করছেন বাঘকে, বিড়ালকে, বড় মাছকে! এমন একতরফা দয়াই আসলে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী! কেননা, বাঘের খাবার হওয়া হরিণ, বিড়ালের হাতে মারা পড়া ইঁদুর বা বড় মাছের পেটে ঢুকে যাওয়া ছোট মাছ সর্বতভাবেই ঈশ্বরের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত! মানুষের সমাজেও যদি দেখি, ক্ষমতাবান – লোভী – বিত্তবানরাই সমস্ত ভোগ বিলাস করে, সারাজীবন অন্যায় করেও পার পেয়ে যায়, অন্যদিকে ক্ষমতাহীন – গরীব – দিনরাত পরিশ্রম করা মানুষ তিলে তিলে শোষিত, নিপীড়িত হতে হতেই শেষ হয়ে যায়! ঈশ্বর কোথায় – কিভাবে তাহলে ন্যায়বিচার করলেন? মৃত্যুর পরের জগতে ঈশ্বর ন্যায় বিচার করবেন বলে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বলা আছে। মানে, ভালো কাজের পুরস্কার দিবেন স্বর্গে পাঠিয়ে, আর মন্দ কাজের সাজা দিবেন নরকে পাঠিয়ে। মৃত্যুর পরের জীবন, আত্মা, স্বর্গ, নরক – এসব কিছুই কাল্পনিক রূপকথা বাদে কিছু না। তারপরেও, এই পুরস্কার ও সাজার গল্পের মাঝেও আসলে কোন রকম ন্যায়বিচার নেই। সেখানে, ঈশ্বর নিজের প্রতি আনুগাত্য, চাটুকারিতা বা দিনরাত তাকে ডাকা- পূজা আর্চনা- নামাজ রোজা পড়া – প্রার্থণা করা, এসবের গুরুত্ব বেশি দিয়েছেন। পুরস্কারের ক্ষেত্রে ভালো কাজের চাইতেও চাটুকারিতার গুরুত্ব যেখানে বেশি, আর সাজার ক্ষেত্রে মন্দ কাজের চাইতেও চাটুকারিতা না করার গুরুত্ব যেখানে বেশি (বিভিন্ন ধর্মে আছে, ভিন্ন ধর্মী বা অবিশ্বাসী বা ইশ্বরকে অন্য ঈশ্বরের সাথে অংশীদার করলে জাগতিক যত ভালো কাজই করুক, স্বর্গে যেতে পারবে না), – সেখানে আর যাই থাকুক, ন্যায়বিচার থাকতে পারে না! অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

৭। বিভিন্ন ধর্মের ঈশ্বর সম্পর্কিত দাবি, বিশ্বজগৎ ও মানুষের সৃষ্টির ব্যাখ্যা বা কাহিনীর ভুল দেখানোর মাধ্যমেও ঐ ধর্মের ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। যেমনঃ

ক) প্রাচীণ মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী, আদিতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব ছিল না; কেবল ছিল নু (আদিম পানি বা বিশৃঙ্খলা, যা সৃষ্টির সম্ভাব্যতাকে ধারণ করে)। ওই নু থেকে দেবতাদের সৃষ্টিকর্তা আটুম নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেন। তার মাধ্যমে রূপায়িত হয় দিনের সম্পূর্ণতা, সূর্যের সাথে এই সম্পৃক্ততার দরুন তাকে আটুম-রা বলেও উদ্ধৃত করা হয়েছে। আটুমের নিক্ষেপ করা থুতু থেকে জন্ম নিলো পুত্র বাতাসের দেবতা ‘শু’ এবং বমি থেকে আর্দ্রতার দেবী ‘তেফনুত’। পিতার ব্যস্ততার সুযোগে তারা সেই আদিম জলে নেমে হারিয়ে যায়। সন্তানদের খোঁজে আটুম নিজের চোখ তুলে ছেড়ে দিলেন নিঃসীম শূন্যতায়, আর সেখানে স্থাপন করলেন আরো বড় নতুন একটা চোখ। প্রথম চোখটা ঠিক ধরে আনলো পুত্র-কন্যাকে, আটুম এবার প্রথম চোখটাকে স্থাপন করলেন নিজের কপালে মাঝে, যা দিয়ে তিনি দেখতে পেলেন সৃষ্টির সমস্ত কিছুর অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। অন্যদিকে সন্তানদের ফিরে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন আটুম। তার প্রতি ফোঁটা চোখের জল থেকে জন্ম নিল মানুষ। পাহাড় আর পাথর ছাড়া তখনো তেমন কিছুই নেই। আটুম-রা, শু আর তেফনুত মিলে মানুষের জন্য যথোপযুক্ত বাসভূমি তৈরি করেন। শু এবং তেফনুতের মিলনে জন্ম নিলো পুত্র ‘গেব’ বা ভূ-পৃষ্ঠ এবং কন্যা ‘ন্যুত’ বা আকাশ। মিশরীয় বিখ্যাত দেবতা হোরাস হচ্ছে এই আটুম-রা এর নাতির নাতি। হোরাসের বাবা ওসিরিস ও মা আইসিস, এবং চাচা সেট – এই তিনজনের প্র-পিতামহ হচ্ছে আটুম-রা। অন্য একটি মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী, আদিতে কিছুই ছিল না; কেবল ছিল খনুম (আদি দেবতা বা ঈশ্বর)। খনুম সৃষ্টি করার জন্য মনস্থির করলেন; ফলে জন্ম নিলো দেবতারা। তাকে ভাবা হতো স্বর্গীয় কুমোর; যিনি কাদা দিয়ে শিশু তৈরি করে মায়ের গর্ভে স্থাপন করে দেন। বস্তুত খনুম সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন কাদা থেকে। দেবতা, মানুষ, পশু-পাখি, মাছ এবং গাছকেও। তবে মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে ছিলেন সবচেয়ে সতর্ক। শরীরের আকৃতি ও রক্তপ্রবাহের জন্য নালী সৃষ্টির পর ঢেকে দিলেন চামড়া দিয়ে। বিভিন্ন রকম মানুষ সৃষ্টির জন্য তার কাছে রয়েছে কুমোরের চাকা। খনুম মাটি থেকে সৃষ্টি করার পরে সেখানে জীবন ফুঁকে দিতেন। প্রাচীণকালে মিশরীয়দের এসব ধর্ম বিশ্বাস এখন আর কেউ ধারণ করে না, ফলে যে কারোর কাছে এসব কেবলই কাল্পনিক কাহিনী, মিথ বাদে কিছুই নয়। যদিও, এখনকার প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসে পানি থেকে বা মাটি থেকে মানুষ (ও জীবজন্তু) তৈরি, ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের শরীর তৈরি করে সেখানে আত্মা ফুঁকে দেয়া – এমন কাহিনীগুলোও ঠিকই পাওয়া যাবে। সেগুলোতে বিশ্বাস আনা মানুষই নিশ্চিন্তে বলে দিবে- অতএব, প্রমানিত হলো যে, আটুম-রা ঈশ্বর বা খনুম ঈশ্বর বলে বাস্তবে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।

খ) ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, ঈশ্বর তথা পরব্রহ্ম বা পুরুষের বিরাট নামক বিশ্বরূপ হল সৃষ্টির উৎস। পুরুষ নিজেকে আহুতি দিয়ে পক্ষী, বন্য ও গবাদি পশু, চার বেদ, মন্ত্রের ছন্দ সৃষ্টি করেন। তার মুখ, বাহু, জঙ্ঘা ও পা থেকে চার বর্ণের, মন থেকে চন্দ্র ও চোখ থেকে সূর্যের জন্ম হয়। তার মুখ ও নিঃশ্বাস থেকে ইন্দ্র ও অগ্নির জন্ম হয়। তার নাভি থেকে আকাশ, মাথা থেকে স্বর্গ, পা থেকে পৃথিবী ও কান থেকে অন্তরীক্ষের জন্ম হয়। এই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ, জাগতিক ও মহাজাগতিক সকল সত্ত্বার মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়। সহজেই বুঝা যাচ্ছে, পুরুষ বা পরব্রহ্ম ঈশ্বরের মুখ, বাহু, জঙ্ঘা, পা, মন, চোখ, মুখ, নিঃশ্বাস, নাভী, মাথা, কান প্রভৃতি থেকে বন্য ও গবাদি পশু, চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, পৃথিবী, অন্তঃরীক্ষ, অগ্নি, মানুষ, জাগতিক সকল সত্ত্বার এরকম সৃষ্টির কাহিনীগুলো সম্পূর্ণভাবেই কাল্পনিক রূপকথা বা মিথ। বেদ আর মন্ত্রের ছন্দ বস্তুত মানুষেরই তৈরি, চার বর্ণ বা বর্ণভেদ প্রথা মানব সমাজে ক্ষমতাধর মানুষের তথা শাসক গোষ্ঠীর হাতে পুরোহিততন্ত্রের সহযোগে উদ্ভূত। আর, ইন্দ্র দেবতা, মহাজাগতিক সত্ত্বা বলেও কোন কিছু নেই। পরব্রহ্ম বা পুরুষ ঈশ্বর কর্তৃক এমনতর সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে বাস্তবতার কোন রকম সংযোগই নেই। অতএব, প্রমানিত হলো যে, পরমব্রহ্ম, পরমেশ্বর বা পুরুষ ঈশ্বর বলে বাস্তবে কোন কিছুই নেই।

গ) জরাথুষ্ট্রীয় ধর্ম বা জরথুস্ত্রবাদ অনুযায়ী, ভালো বা শুভশক্তির ঈশ্বর হচ্ছেন আহুরা মাজদা (“সর্বজ্ঞানস্বামী”) বা ওরমুজদ, আর মন্দের ঈশ্বর হচ্ছেন আংরা মাইনু বা আহরিমান। সৃষ্টির একদম আদিতে কিছুই ছিল না, কেবল ছিলো আহুরা মাজদা যিনি ছিলেন অনন্ত আলোয় আর ছিলো আহরিমান, যিনি ছিলেন নিঃসীম অন্ধকারে, এর মাঝখানে ছিল কেবলই শূণ্যতা। একদিন আহুর মাজদা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে ধাতুর তৈরি উজ্জ্বল আকাশ তৈরি করলেন, তারপরে তৈরি করলেন বিশুদ্ধ পানি, তারপরে তৈরি করলেন সমতল ও গোল পৃথিবী, চতুর্থ ধাপে তৈরি করলেন বৃক্ষরাজি, পঞ্চম ধাপে প্রাণী এবং ষষ্ঠধাপে তৈরি করলেন প্রথম মানুষ। আহরিয়ান এসব সৃষ্টি দেখে তাদেরকে ধ্বংস করতে চাইলেন, ফলে আহুরা মাজদা তার সৃষ্টিকে রক্ষার জন্যে পাঁচটি পবিত্র স্পিরিট তৈরি করলেন, আর নিজে দায়িত্ব নিলেন মানুষকে রক্ষার। ফলে, আহরিমানের চেস্টার পরেও কোন কিছু ধ্বংস হলো না, তবে পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বত হলো, গাছে কাঁটা হলো, প্রাণিতে – মানুষে রোগ – শোক – দুঃখ – দুর্দশা এলো। বুঝাই যাচ্ছে, এসব কাল্পনিক সৃষ্টিকাহিনীগুলোর মাঝে সত্যতার লেশমাত্রও নেই। এই মিথগুলো থেকেই কিছুটা বিবর্তিত হয়ে পরবর্তীতে অন্যান্য ধর্মের ঈশ্বর ও শয়তান বা ডেভিলের ধারণা, পবিত্র আত্মা তথা ফেরেশতা বা এঞ্জেল এর ধারণা, ছয় ধাপে সৃষ্টির ধারণাগুলো এসেছে। জরাথুষ্ট্রীয় বিশ্বাসগুলোকে কিছুটা উল্টেপাল্টে নিয়ে গ্রহণ করা ধর্মের অনুসারীরাই নিশ্চিন্তে বলে দিবে- অতএব, প্রমানিত হলো যে, ভালো ঈশ্বর (আহুরা মাজদা) কিংবা খারাপ ঈশ্বর বা শয়তান (আহরিমান) বলে বাস্তবে কোন কিছুই নেই।

ঘ) ইহুদী, খৃস্টান ও ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ও কোরআন অনুযায়ী, জিহোভা বা গড বা আল্লাহ ছয়দিনে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। “সৃষ্টির শুরুতেই ঈশ্বর মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন” (আদিপুস্তক ১-১)। আদিপুস্তক বা জেনেসিস-১ অনুযায়ী, ঈশ্বর ১ম দিনে আলো তৈরি করেন ও আলোকে অন্ধকার থেকে আলাদা করে আলোর নাম দিলেন দিন ও অন্ধকারে নাম দিলেন রাত। ২য় দিনে জলকে দুভাগ করে উপরের জল ও নীচের জলের মাঝখানের ফাঁকা জায়গার নাম দিলেন আকাশ। ৩য় দিনে আকাশের নীচের সব জল একসাথে করে তৈরি করলেন সমুদ্র, এতে যে শুষ্ক জায়গা পাওয়া গেলো তার নাম দিলেন ভূমি, সেই ভূমিতে তৈরি করলেন গাছপালা। ৪র্থ দিনে আকাশে তৈরি করলেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র। ৫ম দিনে সমুদ্রে বসবাসকারী এবং উড়ন্ত প্রাণী তৈরি করলেন। আর ৬ষ্ঠ দিনে ঈশ্বর তৈরি করেন ভূমিতে বসবাসকারী প্রাণী এবং অবশেষে নিজের প্রতিমূর্তিতে মানুষ তৈরি করেন। অন্যদিকে কোরআন অনুযায়ী, আল্লাহ আকাশ (আসমান) ও ভূপৃষ্ঠ (যমীন) ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপরে তিনি আকাশে (আরশে) আসন গ্রহণ করেছেন (উঠেছেন/ সমুন্নত হয়েছেন/ সমাসীন হয়েছেন)। তারপরে তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দিয়েছেন, যাতে রাত ও দিন একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী (সুরা আল আরাফ : ৫৪)। আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এর অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন (সুরা সাজদা : ৪)। আল্লাহ দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তারপরে ৪ দিন ধরে সেখানে অটল পর্বত স্থাপন করেছেন, বরকতমণ্ডিত করেছেন এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এরপরে তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, ২ দিন ধরে আকাশকে সাত স্তরে ভাগ করলেন এবং নিকটবর্তী আকাশের শোভাবর্ধনের জন্যে প্রদীপমালার (তারকারজি) ব্যবস্থা করলেন (সুরা ফুসসিলাত : ৯-১২ )। সহজেই বুঝা যাচ্ছে, জরথুস্ত্রবাদের সৃষ্টিকাহিনীকেই এদিক ওদিক করে প্রথমে রচিত হয়েছে বাইবেল এর সৃষ্টিকাহিনী, সেখান থেকে এসেছে কোরআনের সৃষ্টিকাহিনী (জরথুস্ত্রবাদের ৬ ধাপ, বাইবেল ও কোরআনে কিভাবে যে ৬ দিন হয়ে গেলো, সেই সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টির আগে বা আলো-অন্ধকারকে আলাদা করে দিন-রাত সৃষ্টির আগে এই দিনের হিসাব কেমন হবে, তা বুঝা মুশকিল)। এদিকে কোরআনে আবার আল্লাহ ৬ দিনের কবে কি সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা নাই। একটি সুরায় কেবল বলা হয়েছে আল্লাহ ২ দিনে পৃথিবী (যমিন), ৪ দিনে পৃথিবীতে পর্বত ও খাদ্য আর ২ দিনে আকাশ ও তারকারাজি সৃষ্টি করেছেন, সে অনুযায়ী সবগুলো দিনের হিসাব ধরলে ৮ দিন হয়ে যায়, কোরআনের অনেকগুলো সুরার অনেক আয়াত আল্লাহ ৬ দিনে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন বলে জানানো হয়েছে (অনেক তাফসিরে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে – আকাশ তৈরির এই ২ দিন আসলে পৃথিবীর সৃষ্টির ২ দিনের প্যারালাল ছিল, মানে কোরআনে থাকা “অতঃপর” বা “তারপর” কথাটাকে অগ্রাহ্য করতে হবে)। যাই হোক, বাইবেল ও কোরআনে বর্ণিত এহেন আকাশ তৈরি করা, সেখানে সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্র স্থাপন করা, আলো ও অন্ধকারকে আলাদা করা, আগে রাত-দিন তৈরি করা ও পরে সূর্য তৈরি করা, সূর্য – নক্ষত্রের আগে পৃথিবী বা ভূমি (যমিন) তৈরি করা- এসব কিছুই বস্তুত কাল্পনিক কিচ্ছাকাহিনী, যার মাঝে সত্যতার ছিটেফোটাও নেই। একইভাবে, বাইবেল ও কোরআন অনুযায়ী জিহোভা, গড বা আল্লাহ নিজের প্রতিমূর্তিতে প্রথম মানব আদমকে তৈরি করেন মাটি দিয়ে, তারপরে সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। আদমের বুকের পাজরের হাড় থেকে তৈরি করেন প্রথম মানবী ইভ বা হাওয়াকে। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ায় শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে গড বা আল্লাহ ইডেন গার্ডেন বা বেহেশত থেকে বিতাড়িত করেন, তারা পৃথিবীতে আসেন, তাদের সন্তান-সন্ততি থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মনুষ্য প্রজাতি। প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়ার এমন কাহিনীও আসলে কাল্পনিক, এতে সত্যতার লেশমাত্রও নেই। অতএব, প্রমানিত হলো যে, জিহোভা, গড বা আল্লাহ বলে বাস্তবে কোন কিছুই নেই।

ঙ) বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, ঈশ্বর আছেন। অর্থাৎ, বিভিন্ন ধর্মের ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয় সেই সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থকে! সেই ধর্মগ্রন্থগুলোতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা জানানো হয়েছে, কখনো কখনো ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে যুক্তিও করা হয়েছে, এবং ধর্মগ্রন্থগুলো যে ঈশ্বরের প্রেরিত বা ঈশ্বর কর্তৃক লিখিত, সেই দাবিও আছে ধর্মগ্রন্থগুলোতে। অর্থাৎ, ঈশ্বর আছে তার প্রমাণ এই ধর্মগ্রন্থ, এই ধর্মগ্রন্থ যে সত্য বলছে তার যুক্তি হচ্ছে ধর্মগ্রন্থ মানুষের লেখা নয়, সেগুলো ঐশ্বরিক। এগুলো যে ঐশ্বরিক, বা মানুষের লেখা নয়- সেটার প্রমাণও আছে ধর্মগ্রন্থে। এগুলোকে বলা হয় সার্কুলার যুক্তি, ফলে এমন যুক্তির মাঝে কোন সারবেত্তা নেই। তারচেয়েও বড় কথা, যেকোন গ্রন্থ কেবল ও কেবলমাত্র মানুষই লেখতে পারে, মানুষ ভিন্ন কোন গ্রন্থ কোনকালে অন্য কেউ লিখেছে, তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার উপরে, প্রতিটা ধর্মগ্রন্থ এত অসংখ্য অযৌক্তিক, ভুলে ভরা ও পরষ্পরবিরোধী কথাবার্তায় ভরপুর যে, সেখান থেকেও বুঝা যায়, এগুলো কোন নির্দিষ্ট কালের, নির্দিষ্ট জায়গার বা সমাজের মানুষেরই লেখা। যেমনঃ কোরআনে সৃষ্টিকাহিনী, বিভিন্ন রকম অলৌকিক ঘটনা, পিতা ছাড়াই ঈসা নবীর জন্ম, যাদুবিদ্যায় বিশ্বাস, জ্বিন ও ফেরেশতার গল্পকথা, ভূমিকম্পের ভুল ব্যাখ্যা, পর্বতকে পেরেক, আকাশকে খুটিবিহীন ছাদ বলা, দুনিয়া-চাঁদ-সূর্য-নক্ষত্রের নানা ভুলভাল আলাপ, উত্তরাধিকার সম্পত্তির বন্টনের হিসাবে গাণিতিক ভুল, এক মানুষের সৃষ্টি কি থেকে- সেই ব্যাপারে একেক জায়গায় একেক কথা বলা, এমন অসংখ্য ভুলভ্রান্তিতে ভরপুর কোরআন, কিংবা আরো অনেক অনেক বেশি (যত প্রাচীণ গ্রন্থ, স্বাভাবিকভাবেই ভুলের পরিমাণ তত বেশিই হবে) ভুলভালে ভরা নিউ টেস্টামেন্ট, ওল্ড টেস্টামেন্ট, কিংবা বেদ-পুরাণ, মহাভারত, রামায়ন – এসব গ্রন্থগুলোর সবকটিই প্রকৃতপক্ষে মানুষের লেখা (কেননা, মানুষ ভুল করে, বা এক যুগে মানুষ যা সঠিক হিসেবে জানে, পরবর্তীতে জ্ঞানের উৎকর্ষতায় আগের জ্ঞানকে ভুল হিসেবে বুঝতে পারে)। অতএব, প্রমানিত হলো যে, ঈশ্বর বলে বাস্তবে কিছু নেই।

সংযুক্তিঃ
১। ঈশ্বর আছে কি নেই, তা নিয়ে অনেক আগে আরেকটি লেখা লিখেছিলাম। আগ্রহী পাঠকরা পড়তে পারেনঃ ঈশ্বর ও বিজ্ঞান – “আছে” ও “নাই” প্রমাণের কথিত দ্বন্দ্ব!

২। অভিজিৎ রায়ের “অক্কামের ক্ষুর (occam’s razor) এবং বাহুল্যময় ঈশ্বর” এবং “মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর -একটি দার্শনিক আলোচনা” – শীর্ষক প্রবন্ধদুটিও পাঠ করা যেতে পারে।