লিখেছেনঃ আমীনুর রহমান
এ লেখা কোন অর্থেই ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। বরং ধর্ম আর ধর্মানুসারির মাঝখানে যে ‘মধ্যবর্তী মোল্লা’ ভয়ের-কৃপাণ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে, যাদেরকে কবি ইকবাল ‘হাঁকিয়ে’ দেবার কথা বলেছিলেন, তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে। বাংলাদেশে বহুকালের চর্চিত সহজিয়া ধর্মবিশ্বাসে ইসলাম যে সহনশীলতা ও বিভিন্ন ধর্মানুসারিদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল, সেখানে ওয়াজসংস্কৃতি কীভাবে অসহিষ্ণুতা ও অপধর্মের ভয়ঙ্কর চক্র তৈরি করছে, তার প্রকৃতি অনুসন্ধান করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।
আপনারা সবাই ইতোমধ্যেই জানেন ও মানেন যে গত তিন দশকে বাংলাদেশ ভেতরে ও বাইরে আমূল বদলে গেছে; বদলটা গুণে যেমন ঘটেছে মানেও তেমনি। কোন কোন ক্ষেত্রে বহুকাল ধরে যা বে-গুণ ছিল তার গায়ে পড়েছে গুণের প্রলেপ; আবার গুণের সমাহার ছিল এমন বিষয় নির্গুণে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলদেশের গুণে ও মানে বদলে যাওয়াটা, বা যে তরিকায় বদলটা ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটানো হচ্ছে, সেটা ভাল কিংবা মন্দ, তা নিয়ে বাহাস নিতান্তই কূটকচাল। সে তর্ক আবর্জনায় লাথি মারা মত হবে, তাতে দুর্গন্ধ বাড়বে; তার চে’ দরকারি অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক।
বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, কারো কারো কাছে ভাল; শুধু ভালই নয়, এ বদল তাদের কাছে বেহেশতি সমাজ গঠনের সূচনা। আবার কারো কাছে সামাজিক এই অদ্ভূতুরে পরিবর্তন ভূতের পায়ে হেঁটে অন্ধকার গুহামানব হয়ে যাবার ইঙ্গিত। যারা ভাবেন, বদলে যাওয়া বাংলাদেশে বেহশতি সমাজের সূচনা হয়েছে, তাদের নাম দেয়া যাক হিজাবি (দাড়ি, টুপি ও টাকনুর ওপর প্যান্ট ও কষে নারা বাঁধা কাবুলি ইজের পরিধানকারীসমেত); আর দ্বিতীয়দল, যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, তাদের নাম দেয়া যাক আজাবি (কারণ হিজাবিদের বিশ্বাস এ দলের লোকেরা দোজখের আজাবে অতিঅবশ্যই অনন্তকাল পুড়বে, আর তাদেরকে সত্ত্বর দোজখে পাঠানোর জন্য কুপিয়ে ও পুড়িয়ে মারা হিজাবিদের ইমানি দায়িত্ব)। মহা-পবিত্র হিজাবিবৃন্দ এই মহা-অপবিত্র আজাবিদেরকে দোজখের আগুনে কয়লা হতে দেখে আনন্দে নৃত্য করবে (থুরি, নৃত্য হিজাবিদের কাছে বেদাত, এবং তাদের মত অনুযায়ী শব্দটির বানান সহিহভাবে লিখতে হবে এভাবে: বিদ’আত); আর হাসতে হাসতে হিজাবিরা বেহেশতে প্রবেশ করে ৭০ বা ৭২জন অতীব সুন্দরি হুর ও অগণিত সমকামী গেলমান (তরুণ পুরুষ, যারা হবে সুরক্ষিত মণিমুক্তার মত সুদর্শন) নিয়ে অনন্তকাল আনন্দফূর্তি করবে আর মুঠি মুঠি খোরমা-খেজুর খাবে।
পৃথিবী যেমন উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বিভক্ত, বাংলাদেশও এখন সামাজিকভাবে হিজাবি ও আজাবিতে বিভাজিত। তবে দেশে হিজাবির সংখ্যা (আবারো মনে করিয়ে দেই, এই তকমায় দাড়ি, টুপি ও টাকনুর ওপর প্যান্ট-ইজেরধারীরাও অন্তর্ভুক্ত) সংখ্যা যতটা দ্রুত বর্ধনশীল, আজাবির সংখ্যা ততটাই ক্রমহ্রাসমান। সে কারণে দেশে জনসংখ্যার হার যত দ্রুত বাড়ছে, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে হিজাবির সংখ্যা বাড়ছে এবং অঙ্কের নিয়মে আজাবির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিজ্ঞান বলে, বৃক্ষের চেয়ে কচুরিপানার বংশবিস্তার বহুগুণ দ্রুতগতিতে ঘটে, এও তেমনি। আর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হতে থাকা আজাবিদের সংখ্যা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে কমতে কমতে একসময় বিলীন হওয়ার উপক্রম হবে। একথা নিঃসন্দেহে সত্যি যে, বাংলাদেশ থেকে আজাবিরা বিলুপ্ত হয়ে গেলে, বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস মুছে যাবে। মুছে যাবে সর্ষে ইলিশ-টাকি ভর্তা-ঝাল শুটকি, তাল-তমাল-আমের বৃক্ষ। আর এসব বাঙালিয়ানা আমিষঅভ্যাস ও ফলদায়ী লতা ও বৃক্ষের পরিবর্তে দুম্বা আর উটের মাংস এবং আজওয়া-আনবারা-সেগাই খেজুরের গাছে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে হিজাবিদের স্বপ্নস্তান, অর্থাৎ বাংলাস্তান। সে বাংলাস্তানের মরুভূমিতে চড়ে বেড়াবে উট, আর এই সব হিজাবিরা তাতে সওয়ার হয়ে ১২টা না হোক অন্তত চারচারটে বউকে উটের পেছনে হাঁটিয়ে নিয়ে এক মরু থেকে অন্য মরুর তাঁবুতে রাত কাটাবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের যে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছিল, সেই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ কীভাবে হিজাবিঅধ্যুষিত এক ভয়ঙ্কর ও খুনে জনপদে পরিণত হয়েছে তার বহুবিধ কারণ রয়েছ। মনে রাখা উচিত এই পরিবর্তন সচেতনভাবে ঘটিয়ে তোলার জন্য দীর্ঘদিন থেকেই সক্রিয় ছিল এবং এখনো আছে বহুমাত্রিক আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক-ধর্মীয় চলক ও চালিকাশক্তি। সে সব চলক ও চালিকার অনেকগুলোই দেশের অভ্যন্তরে ও কতিপয় দেশের বাইরে থেকেও সক্রিয়। যারা দূরের, তারা অদৃশ্য থেকে কলকাঠি নাড়ে। সে কলকাঠির অংশ হিসেবে মুফতে উট-দুম্বার মাংস পাঠায়, তেল ডুবানো অর্থ পাঠায়, গ্রামে গ্রামে স্কুলের চেয়ে শানদার মসজিদের সংখ্যা বেড়ে ওঠে; ‘শস্যের চেয়ে টুপির সংখ্যা’ বেড়ে যায়। আর সে সব ঝকঝকে মসজিদে সহিহ ইসলাম অর্থাৎ শুদ্ধতাবাদি ইসলামের বয়ান হয়; জোরেশোরে ইমানী জোশের সঙ্গে জিহাদি আলোচনা হয়। সে সব বয়ান থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের মানুষের মনে ও লোকসমাজে যে ইসলাম হাজার বছর ধরে বিরাজিত, সে ইসলাম আসলে ‘সাচ্চা’ ইসলাম নয়। শেখানো হয়, বাঙালির সংস্কৃতি কতটা হিন্দুয়ানি, কতটা ঘৃণ্য; সে সংস্কৃতিকে নিজের ভাবলে, প্রাণে ধারণ করলে, তার সঙ্গীতে-নৃত্যে-শিল্পকলায়, জীবনধারায় নিবেদিত হলে, সত্তুরেরও বেশি অপরূপা হুর মুহূর্তেই হাতছাড়া হয়ে যাবে; পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে, বা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করলে মণিমুক্তার মত সমকামী গেলমানও ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। হুরও যাবে, গেলমানও যাবে, সামনেও যাবে, পেছনেও যাবে। এমন নিরামিষ বেহেশতে গিয়ে কী লাভ? তার চে’ সহিহ ইসলামে উপগত হও, দাড়ি-টুপি-আবায়া-জিলবাব বোরকায় দিগন্ত কালো করে ফেল, ধর্মকে রাজনীতি ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির হাতিয়ার করে তোল, দরকার হলে আরও অনেকগুলো ‘হলি আর্টিজন’ ঘটাও, বেহেশতে তোমার স্থান অবধারিত, সিট নম্বরও রিজার্ভ।
ইসলামের এই নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা তৃণমূলে ও সমাজের একটা বিশেষ মহলে জানানো ও শেখানোর প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ওয়াজ। সেকালের মত, ওয়াজ যে আজকাল কেবল শীত মৌসুমে, ফসল কাটা হয়ে গেলে যখন কৃষকদের হাতে দুটো পয়সা ওঠে, তখন বিরাণ মাঠে বিরাট সামিয়ানা টাঙিয়ে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অল্পিশক্ষিত-অপশিক্ষিত ভোক্তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয় তাই নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইউটিউবের মাধ্যমেও পৌঁছে দেয়া হয় উপযুক্ত, আগ্রহী ও যথার্থ ভোক্তার কাছে; একেবারে হোম ডেলিভারি। ইসলামি বক্তাগণ (সহিহ করে বলতে হবে, ওয়ায়েজ; বহুবচন বাচক ওয়ায়েজিন) লাখলাখ টাকা নিয়ে জোশমাখানো ‘সহিহ’ ইসলাম বর্ণনা করেন; হেলিকপ্টারে করে কুয়াকাটা থেকে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় তাশরিফ রাখেন; আবার হেলিকপ্টারে গিয়েও পারিশ্রমিকের টাকাপয়সার (সহিহ করে বলতে হবে, হাদিয়া) বখরা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ‘মাহফিল’ না করে আবার ফিরে আসেন ‘হেলিকপ্টার হুজুর’।
কী বিষয় নিয়ে এসব ‘ওয়ায়েজিন’ কথা বলেন? বর্তুলাকার, ঘেমো-দুর্গন্ধে আমোদিত, ছাগল দাড়িশোভিত ‘হেলিকপ্টার হুজুর’দের বয়ানে অবশ্যম্ভাবীভাবে উঠে আসে বাঙালি সংস্কৃতির পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে নামাজ-রোজার পদ্ধতি কতটা ভুল সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো; কপালে টিপ পরা কেন বেদাত, কেন নামাজ না বলে সালাত বলতে হবে, কেন হিসু করে ঢিলাকুলুপ নিয়ে চেগিয়ে চেগিয়ে চল্লিশ কদম হাঁটতে হবে, কেন খোদা হাফেজের পরিবর্তে বলতে হবে আল্লাহ হাফিজ, রোজাকে রামাদান, সেহরি কে সুহর ইত্যাদি বিষয়। আবার সে সব শব্দকে নুরানি কায়দায় সহিহ করেও বলতে হবে, এতকাল ধরে রমজান মাস বললেও, নজরুল তা নিয়ে গান লিখলেও, নুরানী উচ্চারণে বলতে হবে মাহে রামাদান। শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়, পরিত্যাগ করতে হবে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে, বাঙালিয়ানাকে, সহজিয়া লোকধর্মের মর্মকথাকে, সম্প্রীতি ও সহনশীলতাকে; এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা ইসলামের আত্মিক সম্পর্কের কথাকে পরিহার করে যেতে হবে ‘শুদ্ধ’ ইসলামের দিকে। ভুলেও এসব ওয়ায়েজরা বলেন না, একজন মানুষ ধার্মিক হয়েও অসাম্প্রদায়িক হতে পারে; একজন মানুষ প্রকৃত মুসলমান হয়েও বাঙালি সংস্কৃতির অকৃত্রিম ধারক হতে পারে; সমাজকে হিজাবি ও আজাবিতে বিভক্ত না করেও ধর্ম ও সংস্কৃতির সৌষ্ঠবপূর্ণ সমমর্মিতা গড়ে তুলতে পারে। মানবিকতার চর্চার মধ্যে দিয়ে, পরিবার ও সমাজ-রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। তারা কোন দিক দিয়েই যোজনা করতে শেখান না, কেবল বিভাজনের উগ্রতায় ভাসিয়ে দিয়ে নিজের রিরংসা উদযাপন করতে শেখান।
তাদের বয়ানে আরো থাকে, কেন শাড়ি না পরে পাকিস্তানি ছাঁটের জামা পরতে হবে বাঙালি মহিলাদের, কেন লুঙ্গি ছেড়ে আফগানি পাজামা পরতে হবে; আর কেন মহিলাদের ঘুলঘুলিওয়ালা জিলবাব বা খিমার বোরকা এবং সঙ্গে হাতমোজা-পামোজাসমেত অতি অবশ্যই পরতে হবে। বাংলাদেশে তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেও নারীদেরকে এই নিষেধের ঘেরাটোপে আটকে থাকতে হবে। আর যে পুরুষ নারীদেরকে এভাবে তার মা বোনকে আটকে রাখতে পারবে না, তার কিন্তু হুরপ্রাপ্তির কোন সম্ভাবনাই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
এর বাইরে হেলিকপ্টার হুজুরদের বয়ানের একটা বিরাটা অংশ জুড়ে থাকে অসংখ্য মিথ্যা রটনার উল্লেখ, যেমন নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়ে আজান শুনতে পেয়েছিল, দেখেছিল ‘চাঁদের এক মাথা থেকে আরেকমাথার মাঝখানে ফাটা’, তারপর চন্দ্রাভিযান থেকে ফিরে সে কী করে মুসলমান হয়ে গেল (সবগুলো তথ্যই ডাহা মিথ্যা), সে সবের চমকপ্রদ বর্ণনা। জেনে বুঝে এমন মিথ্যার চাষ যারা করে, তারাই যদি ইসলামের প্রচারক হয়, তবে সে ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের জন্য আলো নয়, অন্ধকার বয়ে আনবে ও আনছে।
নারীশিক্ষা গুরুতর অপরাধ এটাও অনেকের ওয়াজে ঠারেঠোরে বিবৃত হয়। আফগানিস্তানের মত বাংলাদেশেও পঞ্চম শ্রেণির পর নারীশিক্ষা অপ্রয়োজনীয়; তাদের স্থান কেবল রান্নাঘর; তারা কেবল সন্তান জন্মদানের মেশিন। সেই ‘মেশিন’ কি করে সন্তান জন্ম দেয় তার বর্ণনা দেয়া হয় প্রায় সবগুলো ওয়াজেই। সে বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও টীকাসহ সবিস্তার বর্ণনা করা হয়। বয়ান শুরু হয় নারী পুরুষের সঙ্গমের ইসলাম সম্মত উপায় বর্ণনার মাধ্যমে। যেমন কোন দিকে মুখ করে সঙ্গম করতে হবে, মশারি খাটিয়ে নাকি মশারির বাইরে সে ক্রিয়ায় নিরত হতে হবে, সঙ্গম হয়ে গেলে কীভাবে গোসল করতে হবে এসব বিষয়ের সবিস্তার বর্ণনা। তারপর সন্তান ধারণ সম্পর্কে আলোচনা। সেখানে নারীর যৌনাঙ্গের ভুলভাল শারীরবিদ্যার বর্ণনা, এবং সে বর্ণনা যথেষ্টই রসালো। সব শেষে দেয়া হয় সন্তান প্রসবের গ্রাফিক বিবরণ। গর্ভবতী নারীর শারীরিক বর্ণনা, তার প্রসব বেদনা, এবং আতুর ঘরে তার মাতৃকালীন যন্ত্রণা। তবে সে বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু নারীর প্রতি আগত শ্রোতা-দর্শকের সম্মান উদ্রেক করা নয়, বরং নারীর শরীরকে হাজার হাজার হামলে পড়া জুলুজুলু চোখ কাম-বুভুক্ষু মানুষের সামনে ভোগ্য-লোভ্য বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা। প্রকৃতপক্ষে সে সব বর্ণনা ‘সফট পর্ন’ হিসেবে শতশত মানুষ শোনে এবং সুরসুরি মাখানো সুখ পায়। সে অর্থে ওয়াজ প্রকৃতপক্ষে যাদের হাতে স্মার্ট ফোন নেই, যারা ইচ্ছে করলেই পর্নহাব বা এক্সভিডিও দেখতে পারে না তাদের কাছে পর্নোগ্রাফি শোনার অভিজ্ঞতা।
ওয়াজ ধর্মের নামে অশিক্ষিত, আধাশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত ও অপশিক্ষিত লোকের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বাঁদর নাচ নাচায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারা একটা কথা এদেশের মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করে যে, বাঙালিত্ব ইসলামের মূল বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা শিখিয়ে দেয় বাঙালি সংস্কৃতির সবটাই পরিত্যাজ্য; পোশাক থেকে শুরু করে, বাংলা ভাষা। পাকিস্তান আমলে যারা বাংলাভাষাকে হিন্দুয়ানি ভাষা বলে পরিত্যাগের আন্দোলনে ছিল, এরা তাদেরই বংশধর, তাদেরই প্রেতাত্মা। তারা মনে করে বাংলাভাষার সংস্কৃত শব্দগুলো পরিত্যাগ করে সেখানে মরুভূমির শুকনো খেজুরকাঁটাসদৃশ শব্দ ঢুকিয়ে সবুজশ্যামল বাংলার জল-তরঙ্গিত ভাষাকে করে তুলতে হবে মুসলমানের উপযোগী। সে কারণে মরু-আগত শব্দের ‘আইন-গাইন’গুলো গলার ভেতর থেকে্ এমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে, যাতে বাংলা ভাষার উচ্চারণ রীতিতেও একটা সহিহ-সহিহ নূরানি ভাব লাগে।
ওয়াজ সংস্কৃতি অর্থাৎ মোল্লাতন্ত্র বাংলাদেশ ও বাঙালি সমাজকে ইতোমধ্যেই বিভাজিত করে দিয়েছে। সে বিভাজন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি, মানবিকতার প্রতি, অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি মানুষ হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব, তাকে ভুলিয়ে দিয়ে সংকীর্ণতার দিকে ধাবিত করছে। মানুষ হতে, রুচিবান, সংস্কৃতবান শুদ্ধ মানবিক হতে ভুলে যাচ্ছে, সে কেবল মোল্লা-মুসলমান হয়ে উঠছে। এ বড় ভয়ঙ্কর যাত্রা, ভয়ঙ্কর মানসিকতা। ধর্মের ব্যক্তিগত সীমানা হিংসা ও ঘৃণা দিয়ে সাজিয়ে তোলা ধর্মেরই অসম্মান, এ সত্য বাংলাদেশের মানুষ যত দ্রুত বুঝবে ততই তার মঙ্গল।
লেখক সম্পর্কে তথ্যঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া ও ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনে। বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণামূলক লেখার বাইরে স্বদেশশৈলী পাবলিকেশন্স থেকে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘শাহেরজাদার গল্প’ বেরিয়েছে এবছর (২০২৩) বাংলা একাডেমি বই মেলাতে।
অসাধারণ লিখেছেন। ধর্মই সবচেয়ে বড় বিষফোঁড়া বর্তমান বাংলাদেশে। এটাকে নির্মূল করা ছাড়া কিছুতেই শান্তিতে থাকা সম্ভব নয়!
আপনার অন্তরভেদী পর্যবেক্ষনকে প্রশংসা করতেই হয়। অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক এই ধরনের লেখা চালিয়ে যেতে হবে।
যারা অসীম ধৈর্য্য সহকারে, ধীর পদক্ষেপে তাদের লক্ষ্যে এগিয়ে তাদের সাফল্যের দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়েছে তাদের ক্ষমতাকে সমীহ করতেই হয়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ” এস আর্য এস অনার্য —— এক দেহে হল লীন।” এটা সম্ভব হয়েছিল তার কারন ইসলামের মূল ভূমির সাথে ( অন্যদের ও) দুরত্বের কারনে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্ত বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির কারনে সেটা না হয়ে লীন হবার প্রক্রিয়া এখন উল্টো পথে চলেছে।
ভারতেও এখন একই পথে চলতে চাইছে। অতীতে দুরত্বের কারনে যোগাযোগ হীনতার জন্যে একই সনাতনিদের মধ্যেও ধর্মীয় ও সমাজ আচারে ব্যাপক তফাত ছিল। কিন্ত এখন গোটা ভারতকে একই ছাঁচে গড়ে তোলার মৃদু প্রচেষ্টা চলছে। যদিও ভারতের মত বহুমাত্রিক দেশে সেটা মনে হয় সম্ভব হবে না।
যদি সুদুর অতীতে যাই তা হলে দেখা যায় যে এশিয়া মাইনর থেকে আর্যরা এসেছিল তারা সেখানকার ভাষা ধর্ম এদেশে আনলেও কালের নিয়মে এখানকার ভাষা ধর্মের সাথে লীন হয়ে গেছে। আর যেহেতু সেই আদি পিতৃ ভূমীর কোন অস্তিত্ব এখন নেই তাই সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন থাকছে না। কিন্ত ইসলামের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আলাদা।
ধর্মীয় আধিপত্যবাদ চাইবেই তার মতবাদ সারা পৃথিবীতে ছেয়ে যাক। এভাবেই বহু প্রাচীন জনপদ এবং সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরান (পারস্য), বামিয়ানের বুদ্ধ মুর্তি, নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয় একারনেই ধ্বংস করা হয়েছে। আর্যদের সাথে আদিবাসীদের সংগ্রাম ইতিহাসে সেভাবে জানা না গেলেও অনুমান করা যায় সেখানেও অনেক আচার বিশ্বাস বিলীন হয়ে গেছে।
দুঃখ জনক বিষয় এটাই যে ধর্মীয় আধিপত্যবাদের এই ধ্বংসাত্বক ক্ষমতা দেখা সত্বেও বেশিরভাগ দেশে ধর্ম একটি মৌলিক অধিকার। আবার অনুন্নত গনতন্ত্রের জন্য তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ধর্মের নামে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। আর মৌলবাদীরা এর সূযোগটাই নিচ্ছে।
উন্নত ধর্ম মুক্ত সমাজ গঠনের বিকল্প দর্শন ছিল না এমন নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে হোসেন মিঞা একটি ধর্ম মুক্ত সমাজ (দ্বীপ) গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটাও বোধহয় আমাদের নাড়া দেয় নি। আর কম্যুনিস্টদের ধর্ম হীনতা রাজনৈতিক কারনেই পরিত্যাগ করা হয়েছিল। এখন তো সব হাতের বাইরে চলে গেছে।
পৃথিবী ব্যাপি বড়সর ঘটনা না ঘটলে এর থেকে মুক্তি নেই। “দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন” না হোক দুনিয়া কাঁপানো কিছু ঘটলে তবেই আবার স্বপ্ন দেখা শুরু হতে পারে। তবে নিষ্ক্রিয় না থেকে আপনার মতো লোকেরা যেটুকু চেষ্টা করছে সেটাই বা কম কিসের!
ভালো লিখেছেন। সাংস্কৃতিক আবর্জনা পরিষ্কার করবার লক্ষ্যে এধরণের লেখা চালিয়ে যাওয়া উচিত। ধন্যবাদ।
ওয়াজ যেকালে প্রচলন শুরু হয়েছিল, সেকালের অধিকাংশ পপুলেশন গ্রন্থ বহির্ভূত জীবন যাপন ও নিরক্ষর এবং গ্রন্থস্বল্পতাও ছিল। একালে ওয়াজ নিষ্প্রয়োজন। মানুষ এখন পড়তে পারে৷ গ্রন্থেরও অভাব নেই। তদুপরি ইন্টারনেট সুবিধা।