আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে যতটা না পড়েছি, তার অধিক শুনেছি। মানুষকে মুগ্ধ করবার মত অসাধারণ ক্ষমতা উনার আছে। যে কারণে তাঁর আছে অসংখ্য ভক্ত ও গুনগ্রাহী। আমি তাদের একজন। তাঁর অনেক কথা/বক্তব্য চমৎকৃত হয়েছি, তেমনি কিছু কিছু কথায় ও আচরণে ভিষন হতাশ হয়েছি, বিরক্ত হয়েছি। পৃথিবীতে কোন মহামানবই নিজেকে সমালোচনার উর্ধে-বাইরে রাখতে পারনেনি। তিনি তাঁদের স্বপ্ন ফেরী করলেও নিজেকেও তার বাইরে রাখতে পারেননি।

কেন এই প্রসঙ্গ? সম্প্রতি আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বিভিন্ন স্থানে প্রবাসীদের আয়-উপার্জন, জীবনযাপন, স্বার্থপরতা ও ক্ষুদ্রতা ইত্যাদি নিয়ে তির্যক বক্তব্য রাখছেন। তার সে ভিডিও বক্তব্য (https://www.youtube.com/watch?v=Z_RtyYmcrdc) কতটা শোভন, সঠিক ও যৌক্তিক, সে আলোচনা-বিতর্ক বুঝতেই এই লেখার সূত্রপাত। তাঁর মতে,

যে সব বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিদেশে থাকে তারা আমাদের দেশে রেমিটেন্স করে, টাকা পাঠায়, তাদের কষ্টেশ্রমেঘামেরক্তে উপার্জন করা টাকা দেশে পাঠায়, সেই টাকা দিয়ে আমাদের বাইশ বিলিয়ন ডলার জমেছে। . . .কিন্তু আমাদের যারা প্রফেশনালরা বাইরে আছে তারা কী পাঠায়? কয়জন পাঠায়? . . গরিব মানুষের রক্তযে গরিব মানুষের ছেলেটা কোনোদিন কলেজে আসতে পারবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবে নাতার . . উপার্জিত অর্থ দিয়ে সে এদেশে পড়াশুনা করে চলে গেছে।

ঋণ থাকলে তো তার ঋণ পরিশোধের একটা হৃদয় থাকা উচিৎ। . . আমি গভার্মেন্টের সঙ্গে ইতিমধ্যে কথাবার্তা শুরু করেছি যে, যারা দেশের বাইরে আছে তাদের আর্নিংএর থ্রি পার্সেন্ট বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। . . আর তা না হলে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট যদি থাকে সেটা ক্যানসেল করে দেওয়া উচিৎ এবং কোনোদিন যেন সে ভিসা না পায় বাংলাদেশের আসার সে ব্যবস্থা করতে হবে।” “মানুষ যে, সে তার ঋণ পরিশোধ করে। অমানুষ ঋণ পরিশোধ করে না।

[১] প্রথমে একটু রেমিটেন্স নিয়ে কথা বলা যাক। এখানে মাস বা বাৎসরিক হিসেব না গিয়ে একটু মোটা আলোচনা করা যাক। গত ১১ বছরে প্রবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশে রেসিটেন্স পাঠিয়েছে ১.৩ বিলিয়ন ডলার (মানে ১ লাখ ৩৭ হাজার ডলার)! তারমানে ১.৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিপরীতে, বিদেশে পাচার হয়েছে ৬৫ বিলিয়ন ডলার! তারমানে যে টাকা বাংলাদেশ আয়ে করেছে তার প্রায় ১৪ গুন (১৩.৭) পাচার হয়েছে! লক্ষ লক্ষ শ্রমিক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যা আয় করে আর, বাংলাদেশের কতিপয় দূর্ণীতিবাজ তা বিদেশে পাচার করে! গত ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঁচার হয়েছে!

স্যার বাংলাদেশের এই সব গণদুষমনদের বিরুদ্ধে তো কিছু বলেন না, কিছু লেখেন না? তাহলে তাদের কেন বিচারের কথা বলেন না? তাদের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট কেন বাতিল করতে বলেন না..?

আপনি যেহেতু সরকারের এতটা ঘনিষ্ট প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর সন্তান জয়সহ তাঁর আত্মীয়স্বজনেদর সুবিধা পাসপোর্ট বাতিল করতে বলেন? মার্কিন অভিভাসী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডঃ গওহর রেজভি কে নিয়ে কিছু বলুন! আপনি কি জানেন বাংলাদেশের কতজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক বিদেশী পাসপোর্টধারী? সরকারের কতজন মন্ত্রীএমপি পরিবার স্থায়ীভাবে বিদেশ বাস করেন? দেশের আয়-বাণিজ্য-পাচারকৃত অর্থে বিদেশে রাজকীয় জীবনযাপন করেন! সেটা নিয়ে কিছু বলছেন না কেন? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিয়ে তাদের গণতন্ত্রে নাগরিকদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করছে, আর আপনি আছেন কিভাবে প্রবাসীদের পাসপোর্ট ও নাগরিত্ব বাতিল করা নিয়ে!

[২] ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। যার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা, যা দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৯ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ। ঠিক তার পরের বছর ২০১৪ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা (১ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার)। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে পাঁচার হয় ৫৫ হাজার ৩৮২ কোটি! তারমানে বছরের অর্থের পাচার বন্ধ করা গেলে সেটা দিয়ে প্রায় ২৫ বছরের বৈদেশিক রৃণের সূদ পরিশোধ করা সম্ভব। হিসেবেটা কি বুঝতে পারছেন স্যার?

[৩] যে সমস্ত দেশে দক্ষ পেশাজীবীরা বসবাস করেন তাদের সংখ্যা এবং পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাটা একটু হিসেব করে দেখবেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ৫ থেকে ২০ লক্ষ শ্রমিক থাকে তাদের পাঠানো আয় আর জাপান, ইউরোপ, আমেরিকার পাঠানো শ্রমিকের সংখ্যার সাথে আথাপিছু পাঠানো ডলার একটু হিসেব করে দেখে নিন, কাদের পাঠানো অংক অধিক।

“মধ্যপ্রাচ্যে আমরা যেভাবে শ্রম বিক্রি করছি গত পয়তাল্লিশ বছর ধরে, তার চাইতে লজ্জাজনক দাসত্ব আর কিছু হতে পারেনা। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজারে আমাদের পরে যোগ দেয়া নেপাল, শ্রিলংকা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের শ্রমিকেরা কি করে, কোথায় থাকে, কি খায় আর কত টাকা দেশে পাঠায় সেটা একটু খোঁজ করে দেখলে আমাদের সবারই মাথাই হেঁট হয়ে যাবে। নেপালের লোকসংখ্যা কোটি তাদের রেমিটেন্স ৮০৬৪ মিলিয়ন ডলার (জিডিপি ২৮ শতাংশ), শ্রীলংকা কোটি মানুষ তাদের ৭৪৬৪ মিলিয়ন, আর বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৭ কোটি ১৫৪৯৬ মিলিয়ন ডলার (জিডিপি . শতাংশ) একটু হিসেবে করে দেখুন তাদের প্রবাসী শ্রমশক্তি জনসংখ্যার তুলনায় তাদের আয় কতগুন! James Montague নামের এক সাংবাদিক ২০১৭ সালে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন “How Bangladesh sold its future to Gulf” এই শিরোনামে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন কি ভয়ংকর সস্তা দামে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম বিক্রি করি। দুনিয়ার সবচাইতে সস্তা শ্রমিক হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিক, দুনিয়ার সবচাইতে অদক্ষ শ্রমিক হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিক। এসব কে ছাপিয়ে যখন আপনারা “রেমিট্যান্স” এর গর্ব করেন, তখন আমি সবসময়ই লজ্জিত হই। তাই একজন অধ্যাপক সায়ীদকে বিদ্রুপ করা হয়ে ওঠে না!”

[৪] গরিব মানুষের রক্তযে গরিব মানুষের ছেলেটা কোনোদিন কলেজে আসতে পারবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবে নাতার . . ! কেন এমন কথা বলছেন? কেন তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতে পারবে না? আপনি ধরেই নিয়েছেন এদের প্রজন্মান্তর মুটে-মজুর-কামলাই থাকতে হবে। এটা নিয়তি নির্ধারিত আপনিও সেটাই বিশ্বাস করেন! কিন্তু যে সমাজ ও ব্যবস্থা এই ব্যবস্থা করে রাখলো, রাখছে তাকে প্রশ্ন করছেন না? কারণ আপনার আলোকিত জ্ঞানের মিশন-প্রকল্প সেই প্রশ্ন করতে শেখায় না!! সেই জন্য এমন যুক্তিহীন হিংসার বাণী প্রচার করতে পারছেন।

[৫] আপনার দেশপ্রেম, দরদ-মমতা ও উন্নয়ন ভাবনা আমাকে মুদ্ধ করে। একই সাথে কিছু প্রশ্ন-ভাবনা সবসময় মাথায় ঘুরপাক খায়। বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়-সমস্যায় আপনাকে কখনো কথা বলতে শুনিনা? তার কারণটি কি স্যার..?

[ক] গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কয়েক গজের দূরত্বে থেকেও কখনো আপনি কখনো ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে ও ঋণ স্বীকার করতে যাননি? টাকাই কি সব এবং দেশাত্ববোধ বুঝানোর একমাত্র মাপকাঠি?

[খ] কোন সামরিক স্বৈরাচারের অন্যায়, অত্যাচার অগণতান্ত্রিক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন? আপনি দেশপ্রেমিক- দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিয়ে কোন কথা বলেছেন? আদীবাসী, উপজাতী, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন? তাদের সম্পত্তি দখল, লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন কখনো? সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ এমন কোন ইস্যুতে?

[গ] রাষ্ট্রের সম্পদ, ব্যাংকের টাকা লুটপাট, খেলাপী ঋণের টাকা, ডেসটিনি, হলমার্কের ব্যাংক থেকে ৪ হাজার আর গ্রাহকের প্রায় সারে ৫ হাজার কোটি টাকা লুটের প্রতিবাদ করেছিলেন? খেলাপী ঋণের পরিমান ৬৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে কোন কথা? শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা লুটপাট তার কোন প্রতিবাদ করেছেন? ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন?

[ঘ] বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর-জাতীয় স্বার্থের নিয়ে আপনাকে কোন কথা বলতে শুনিনি? জাতীয়সম্পদ সুন্দরবন নিয়ে এতবড় একটি আন্দোলন চলছে আপনাকে তো কখনো দেখলাম না?

[ঙ] বাংলাদেশে যে সব দেশপ্রেমিক পেশাজীবীরা আছেন তাদের বৈধ আয়ের সাথে, তাদের সম্পদ ও জীবনযাপনের হিসেব করেছেন? তারা তাদের আয়কর দিচ্ছেন কিন্তু তারা যে অবৈধ আয় করছে তা মূল বেতনের কয়গুন- চিত্রটা কি জানেন? প্রতিবছর টিআইবি’র রিপোর্টে কি আপনার চোখ যায়? প্রবাসী পেশাজীবীদের অমানুষ প্রমানের প্রকল্প নিয়ে নেমেছেন? কে দেশপ্রেমিক যে পেশাজীবী দেশে অবস্থান করে দেশে দূর্ণীতি করে, দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করে, দেশে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ করে তারা দেশপ্রেমিক না’কি, যে সব প্রবাসী যেটুকু কাজ করে তার ঘন্টা হিসেবে বা মাস-বছরের গোনা টাকায় জীবনযাপন করে তার সৎ? একটু বলবেন কি?

[চ] আপনার সহকর্মী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হলো প্রকাশ্যে কোন প্রতিবাদ করেছেন? অভিজিৎকে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হলো তখনও তো আপনাকে প্রতিবাদ করতে দেখলাম না? আমাদের প্রজন্মের অভিজিতের চেয়ে আলোকিত আর একজনের নাম বলুন..?

[ছ] আলোকিত মানুষ জাফর ইকবার আড়াই দশক হয় বিদেশ থেকে যেয়ে দেশে আছেন, পুলিশ পাহাড়ায় কেন তাকে চলাফেরা করতে হয়? আওয়ামী সরকার না হয় তাঁকে নিরাপত্তাটা দিয়েছে, অন্যরা এলে? কেন বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ব্লগ লেখার কারণে, মুক্তিবুদ্ধির চর্চার কারণে দেশ ছাড়তে হচ্ছে? কেন টগবগে তরুণ লেখকদের রাস্তাঘাটে খুন করছে তখন কোথায় থাকে আপনার দেশপ্রেম। তারা তো টাকাপয়সা বা সরকারের প্রতিবাদের কারণ খুন হয়নি। কেবল বই পড়ে আলোকিত হবার কারণে খুন হয়েছে!!

[জ] বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবী জেলে গেলেও, প্রতিহিংসার স্বীকার হলেও আপনাকে তো কখনো তা স্পর্শ করে না? আনিসুজ্জামান, কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অজয় রায়, জাফর ইকবাল, এম এম আকাশ, আনু মোহাম্মাদ, হত্যার হুমকি দেয় কিন্তু আপনাকে নিয়ে তো কখনো কিছু শুনিনি! বিষ্মিত হই আলোকিত মানুষের দেশবোধ শুনে?

[ঝ] সর্বশেষ বাংলাদেশের কৃষক ধানের দাম পেল না, যে পরিশ্রমী কৃষকের প্রতি আমাদের দায়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন কিন্তু আপনি কি আপনার দায় ভুলে গেলেন স্যার? কি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হলো এই কৃষকের সেটা নিয়ে আপনার কোন কথা নেই? যে প্রবাসী শ্রমজীবী মানুষের জন্য আপনার এত মায়া, কিন্তু দেশে খেটে খাওয়া ভূমিহীন ক্ষেতমজুর, প্রান্তিক কৃষক, দিনমজুর, মিল-ফ্যাকন্টরি গার্মেন্টেস শ্রমিক, হকার, বস্তিবাসী, রিক্সা উচ্ছেদ তাদের নিয়ে তো আপনি কিছু বলছেন না?

[৬] আপনার আলোকিত মানুষ তৈরীর মহৎ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু বিনয়ের সাথে জানতে চাই বাংলাদেশে এই আলোকিত মানুষের প্রভাব কোথায়, কিভাবে ছড়াচ্ছে, বলবেন কি? সমাজের কোথায় কিভাবে সে আলো ছড়িয়ে সমাজের গুণগত পরিবর্তন সাধনে ভূমিকা রাখছে? আমি তো দেখছি বাংলাদেশের সমাজের ভাবাদর্শমূল্যবোধনীতিবোধ দিনদিন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে! সেটা বুঝতে কি গবেষণার দরকার আছে? আপনার আলোকিত মানুষেরা কোথায় কিভাবে অন্যায়অবিচারঅনৈতিকতার প্রতিবাদ করছে, বলবেন..?

আপনি কেমন আলোকিত মানুষ তৈরী করেন? যারা কেবল ফুল-পাখী, নদী-নারী, লতা-পাতা, ধান-পান নিয়ে কাব্য করে, গল্প করে তারাই আলোকিত? যে আলো অন্ধকারে প্রবেশ করে না, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে না, যে আলো বাধাগ্রস্থ হয় না সে নিরাপদ আলো হাজার বছরের কোন কোন্কে আলোকিত করতে পাররে না। পৃথিবীতে আলো নিয়ে কিছু মানুষ আসে যায়, কিন্তু তারা মানুষের বিষদাগার করেন নি।

[৭] বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ লক্ষ! তাদের সবার কি কাজ আছে? বাংলাদেশের সকল পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা কি সবাই চাকুরী পাচ্ছে? কেন বিভিন্ন পেশায় লেখাপড়া করা মানুষজন দেশ ছাড়ছেন? সবার কি সেই পয়সা ছিল সন্তানদের স্কুলে পড়ানোর? বিদেশে কর্মরত সমগ্র শ্রমশক্তির মাত্র ২ শতাংশ হচ্ছে পেশাজীবী। পেশাজীবী মানেই অতি উচ্চআয়ের মানুষ তাদের ৩ শতাংশ দেশে পাঠালে না’কি বাকী ৯৮ শতাংশের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার বেশী হবে। হিসেবটা কি আবার কষে দেখবেন? পেশাজীবীরা দেশে টাকা পাঠায় না তারা দেশপ্রেমিক নয়। তা যারা নিজের খাওয়ার টাকা ছাড়া সব টাকা পাঠায় দেশে তাদের কি সম্মান আছে? সে সব দেশপ্রেমিকদের সাথে এয়ারপোর্টে তাদের সাথে কি নিষ্ঠুর আচরন করা হয় দেখেছেন? বিভিন্ন দূতাবাসে কি ব্যবহার করা হয় খোঁজ নিয়েছেন? আগের এই সব সরকারী কর্মচারীদের মানুষ মানুষ বানান আলোকিত করেন? তারপর অন্যদের কথা বলুন।

[৮] বিদেশে মানুষের খ্যাপ (কাজ) করতেই দিন যায়! তাতের আপনার সমস্যা কোথায়? বাংলাদেশে তো মানুষে তাবলিগ করতে মাসজিদেই দিন, মাস, বছর কাটায়? তাদের তো সেটা বলতে যান না? এখানে সাহিত্যসংস্কৃতির চর্চা হয় না। এখান থেকে আলী রিয়াজ, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আমর্ত সেনরা কাজ করছেন না? বিদেশে বাংলাদেশী অভিভাসিরা এমপি, মন্ত্রী, মেয়র হচ্ছেন না? তারা মানুষের কাজ করছে না? আপনার প্রতিষ্ঠানেরবিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কট্টোর জাতীয়তাবাদী!?

[৯] বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে আপনার অনেক মাথা ব্যাথা, বাংলাদেশের সরকারের কোন একটি গণবিরোধী নীতির সমালোচনা করেছেন? কিছু কি বলবেন? না বলবেন, কারন হয়তো বলবেন, আমার তো কাজ জ্ঞানঅর্জন করা মানুষকে আলোকিত করা? সেটাই যদি হয় তাহরে প্রবাসী কি করল, কি খেলো, সেটা নিয়ে আপনার মাথা ব্যাথা হয় কেন? আগে নিজের ঘরে দিকে নজর দিন, তারপর বাইরে আসেন! বিচারপতি সিনসা সরকারের সমালোচনা করার জন্য, অপবাদ দিয়ে দেশ থেকে বিতারিত করা হয়েছে। প্রতিবাদ করলেন না? আসলে আপনি কোন দলের বিরাগভাজন হতে চান না! এরশাদ, জিয়া, হাসিনা, খালেদা সবার সময়ই আপনার কোন সমস্যা হয় না!

[১০] সরকারের নীতি বিদেশে লোক পাঠাও। অধিক জনসংখ্যার দেশ। দেশে তাদের সম্পত্তি বিক্রী করতে যায়। কারো সম্পত্তি কি করবে সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়, সরকারী আইন মেনে বিক্রী করলে তো কোন সমস্যা নেই। মুক্তবাজারের সমর্থক, সেবক হবেন, সুবিধা নেবেন, বিশ্বায়নকে সমর্থন করবেন আর ব্যক্তির পছন্দকে শেকল পরাবেন- এতো দ্বিমূখী নীতি।

[১১] বিদেশে বসবাসকারী একটি অংশ প্রফেশনাল ওয়ার্কারস বিদেশে আসে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তারা তাদের পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করে। নিজেদের যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ী বিদেশে কাজ-ব্যবস্যা করে আয় করে। বিদেশে আয়ের ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য আছে। তারপরও সেখানে আয়ের স্তর অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত তাদের আয়কর দিতে হয়। ১৫ শতাংশ ভোক্তাকর, পরিবেশ কর, জায়গা জমির কর দিতে হয়। বাড়ী-গাড়ী কেনা এখানে কোন বড় বিয়য় না। মূলদামের ৫ শতাংশ দিয়েও কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম দিয়ে বাড়ী-গাড়ী ক্রয় করা যায়। এবং আয়ের একটি বড় অংশ দিয়ে একজনকে ২০-২৫ ধরে শোধ ধরে তা শোধ করতে হয়।

আপনি প্রবাসীদের বিনিয়োগের কথা বলছেন? অতি উত্তম প্রস্তাব! প্রবাসে যাদের সামর্থ আছে, তাদের অবশ্যই দেশে কিছু করার সুযোগ থাকলে করা উচিত। এই ভাবনার সাথে আমার কোন দ্বিমত নেই। প্রবাসীরা কিছু করতে পারছে না বা করছে না তার সব দ্বায় কি কেবল প্রবাসীদের? এখানে কি সরকারের কোন দ্বায় নেই? দেশে তেমন আকর্ষনীয় নিরাপদ, নিজ্ঝান্ট পরিবেশ সৃষ্টি করা গেছে? ইচ্ছে ছিল ঢাকায় একটা এপার্টমেন্ট কিনব। প্রতিবছরই দেশে যাই ভাইবোনের বাসায় থাকতে হয়! স্যার, ঢাকায় একটি এপার্টমের্ন্টের দাম কত জানেন? আমার তো সেই সামর্থ নেই! একটা ছোট জায়গা কিনতে চেয়েছিলাম নিজ এলাকায়, কিন্তু যখন শুনলাম আমার এক প্রবাসী বন্ধুর জায়গা দখল কেউ দখল করেছে তখন আর সাহস পায়নি! আমার এক জাপানপ্রবাসী বন্ধু তার দুলাভাইয়ের সাথে খামার করতে বিনিয়োগ করেছিল তার ভগ্নিপতি সব নিজের নামে লিখে নিয়েছে! লতাপাতা ছাড়া এমন গল্প কি আপনার সাহিত্যের পুস্তকে নেই?

[১২] বাংলাদেশে যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, যাদের সন্তানেরা শুরু থেকেই বিদেশে লেখাপড়া করে বিদেশেই অবস্থান করে। তারা বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত এবং সরকার ও ক্ষমতার নানা ভাবে সুবিধাভোগী। দেশে আয় করে বিদেশে ব্যায় করছে! জানেন তো- যে কোন বিদেশী শিক্ষার্থীকে স্থানীয় ছাত্রদের চেয়ে ৩ থেকে ৪ গুন অর্থ বেশী দিতে হয়! কতটাকা প্রতিবছর দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কোন কথা?

যারা বিদেশে ভ্রমন করেন, চিকিৎসা, কেনাকাটায়, সন্তানের লেখাপড়ায় বাংলাদেশ থেকে আনা অর্থ খরচ করেন, তার জন্য কি সরকার ট্যাক্স প্রদান করেন? যে বাইরে আয় করে বাইরে খরচ করল তারজন্য এত ক্ষোভ এত বিষদগার, কিন্তু মূল্যবান দেশীমুদ্রা বিদেশে ব্যায় করল তার বেলায় কোন কথা নেই কেন?

[১৩] বাংলাদেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক বৈষম্য নিয়ে কিছু বলছেন না যে! বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশও ভারতের ৫ম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি উৎস। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাৎসরিক রেমিটেন্স আয় বিলিয়ন ডলারের উপরে। ভারতের মোট বৈদেশিক রপ্তানি বাণিজ্য আয়ের ১০% আসে বাংলাদেশ থেকে ভারত বাংলাদেশ থেকে ১৫.৭৮ বিলিয়ন ডলারের অধিক রফতানি আয় করে, সেখানে ভারত থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় এক বিলিয়ন ডলারের ভাগের এক ভাগ (৩৫০.৬৬ মিলিয়ন ডলার) ।

[১৪] হজ্বের অর্থনীতি কিছু বলছেন না যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১ লাখ থেকে দেড়লাখ লোক হজ্বে যায়। এটা হচ্ছে হজ্জ মৌসুমে অন্য সময়ের হিসেব এখানে আনছি না। সে সংখ্যাও হবে প্রায় তার সমপরিমান! সেখানে বাংলাদেশ থেকে কি পরিমান দেশীয় মুদ্রা সৌদিআরবে চলে যাচ্ছে? একবার ভেবে দেখেছেন? সৌদিআরব থেকে আমাদের প্রবাসীরা যে পরিমান অর্থ প্রতিবছর দেশে পাঠায় তার কয়েক গুন, এই গরীব দেশের কর্ষ্টার্জিত মুদ্রা বা বৈদেশিক মুদ্রা তারা বিদেশে নিয়ে যায়! ধর্মের নামে সেই টাকা তারা খরচ করে আসে। যে টাকা ঐ দেশের শাসকরা ফূর্তি করে, অস্ত্র কেনে আর জঙ্গীবাদের বিষ ছড়াতে খরচ করে! সেখানে আপনার জ্ঞান বন্ধা!

[১৫] প্রবাসীরা বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া করেছে, সে জন্য তারা দেশের মানুষের কাছে ঋণী। এ কথা কেউ অস্বীকার করে না। এবং এজন্য প্রবাসীরা দেশের কাছে ঋণী। ঋণ শোধের বিষয়টি পারষ্পারিক। প্রথম প্রশ্ন দেশে যারা চাকুরী করছে তারা কিভাবে জনগণের অর্থে লেখাপড়া করে তাদের ঋণ শোধ করছে? তারা সরকারকে ট্যাক্স দেয়ার মাধ্যমে তাদের ঋণ শোধ করছে তাই তো? কিন্তু যে সব নাগরিকরা সরকারকে কর প্রদান করছে, তারা কেউ নিঃশর্ত কর প্রধান করছে না? কর প্রদানের বিনিময়ে তারা সরকারের নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। তারা রাস্তা-ঘাট-নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ড্রেনেজ তাদের সন্তান ও পরিবারের জন্য ভোগ করছেন! কর কোন দান নয়, এটা একটি আইনী বাধ্যবাধকতা। যারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া করেছে তারা চাকুরী-ব্যবস্যা-কাজ থেকে উপর্জন করে সরকারকে কর দেয়া ছাড়া বাড়তি দান করেন না! বরং অধিকাংশ মানুষ কর দেন না, বা কর ফাঁকি দেন! বাংলাদেশের মোট জনগোষ্টীর ১ শতাংশও কর প্রদান করেন না।

দ্বিতীয়ত, একইভাবে প্রবাসীরা যে সব দেশে থাকেন, সেখানে তারা কর দেন এবং একই ধরণের সুবিধা ভোগ করেন। তাহলে প্রবাসী ও তার পরিবার দেশে না থেকে সে সব সুবিধা ভোগ না করে কেন সরকারকে কর দেবে? তাহলে আপনি যে বলছেন দেশকে আয়ের ৩ শতাংশ দেয়ার জন্য সেটা কোন বিবেচনায়? কেবল দেশের নাগরিকত্ব রাখার কারণে সরকারকে কর দিতে হবে? বিশ্বের কোথায়, কোন দেশে কি এমন আইন-নিয়ম আছে?

আপনি বলছেন প্রবাসীদের নাগরিকত্ব রাখতে শতাংশ কর বাধ্যতামুলক করা নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করছেন। কিন্তু সরকার বাজেটে দেখছি তার উল্টা প্রস্তাব দিয়েছেন! প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠালে তাদেরকে শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করবেন! তারমানে আপনার কথা সরকারই ভুল উদ্ভট মনে করে! স্যার আবেগ আর টাকাপয়সার রাজনীতিঅর্থনীতির গতিপ্রকৃতি অনেক আলাদা।

[১৬] যারা এখনে থাকেন তারা বাংলাদেশে থাকলে রাস্তাঘাট, গাড়ী, বাড়ী, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ, পানী ব্যবহার করত, কিন্তু তারা সেটা করছে না, এ মানুষগুলো সেখানে না থাকাতে দেশের উপর থেকে কতটা চাপ কমছে। সরকারকে তারজন্য বাড়তি খরচ করতে হতো। কিন্তু আমাদের অধিক জনসংখ্যার, সরকারের নীতিও তাই দেশ থেকে মানুষ বাইরে যাবে, দেশের উপর চাপ কমবে এবং দেশের জন্য মঙ্গল হবে।

[১৭] উনি বলছেন, এ সব পেশাজীবীরা অমানুষ! অকৃতজ্ঞ। একজন পেশাজীবী কেবল একা বিদেশে আসেন না। তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরও বিদেশে নিয়ে আসেন। তারমানে একেকজন পেশাজীবী ২ থেকে ৪-৫ জন সদস্যকে বিদেশে নিয়ে আসেন। আর সেই মানুষগুলোকে বিবেচনা করা হচ্ছে অমানুষ হিসেবে?! বিদেশে সবাই টাকা উপার্জনের জন্য আসে না। বিদেশে আসে যারা আসে একটা শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের আশায়। উনি যেভাবে বলছেন, সবাই বিদেশে এসে দুইহাতে টাকা উপর্জন করছেন।

প্রতিবছর সরকারী উদ্যোগে যে পরিমান শ্রমশক্তি বিদেশে রপ্তানী করা হয়, তারচেয়ে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি উদ্যোগে তার অধিক মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়। এবং পেশাজীবীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রচেষ্টা আর সরকারী উদ্যেগ মিলেই ৭০-৮০ লক্ষের বিশাল শ্রমশক্তি বিদেশে কাজকর্ম করছে। এবং যে আয়ের একটি বিশাল অংশ দেশে যাচ্ছে! আপনাকে একটু অর্থনীতি Spillover Effect বুঝতে হবে! একজন শিক্ষিত/পেশাজীবী মানুষ সমাজে টাকা দিয়ে ভূমিকা রাখে না, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক নানা তৎপরতা পরিবার-পরিবেশ-সমাজ ও রাষ্ট্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। আপনি কেবল একজন পেশাজীবীর সেটুকই দেখছেন যে তিনি বিদেশে গেছেন উপার্জন করছেন, কিন্তু দেশকে নগদ অর্থ দিচ্ছেন না, অতএব তিনি অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর, ক্ষুদ্র, এই হচ্ছে আপনার ভাবনার পরিধি! কিন্তু এই পরিস্থিতির দায় কেবল প্রবাসী পেশাজীবীদের একার নয় সরকার, রাজনীতি, সামাজিক কাঠামো, বর্তমান পরিস্থিতি কতটা দায়ী সেই ভাবনা-আলোচনাই এই অভিযোগের পারষ্পারিক দ্বায় বলে দেবে!

ডঃ মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। লেখাটি অনেক আগের মুক্তমনা’য় আবার প্র্রকাশ করছি।