১। বেগমপাড়া তথা লুটেরা বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
২০২০ এর জানুয়ারীর শুরুতে বাংলাদেশে মূলধারার পত্র-পত্রিকায় দেশের দূর্ণীতিবাজ ঋণখেলাপী, অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক সংবাদ-প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছিল। পত্রিকার সংবাদ-প্রতিবেদনে বলা হচ্ছিল, দেশ থেকে অর্থপাচারকারীরা- আমানতকারীদের টাকা মেরে ব্যাংকগুলোকে পথে বসিয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন, সেখানে আত্মগোপন করেছেন। দূর্ণীতিবাজ ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা কানাডার বেগমপাড়ায় দামী বাড়ী-গাড়ী কিনে সেখানে আরাম-আয়েশে নিরাপদ জীবন-যাপন করছেন। চোরাই অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবস্যা-বাণিজ্য করে বহাল তবিয়তে আছেন।
প্রতিবেদনগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কানাডাই যেন একমাত্র দেশ যেখানে লুটেরারা নিরাপদে আশ্রয় গ্রহন করেন, আর কোথাও এমনটা ঘটছে না। এমন সংবাদে প্রবাসীদের প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে। তাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সেখান থেকেই এই অন্যায়ের প্রতিবাদের পরিকল্পনা আসে। ‘লুটেরা রুখো স্বদেশ বাঁচাও’ নামে- বেগমপাড়া তথা লুটেরা বিরোধী আন্দোলনে এখানকার সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী ও অন্যান্যরা এগিয়ে এলেন।
২। বেগমপাড়া ও লুটেরা বিরোধী আন্দোলন
আন্দোলনের ১ম পর্ব
২০২০ এর মধ্য জানুয়ারীতে টরন্টোতে বসবাসরত বাংলাদেশী প্রবাসীরা বেগমপাড়া ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে ফুসে উঠে থাকে।
- ১৮ জানুয়ারী তাৎক্ষনিক কর্মসূচীর ঘোষণা আসে যদিও সে কর্মসূচী পালিত হয়নি।
- জানুয়ারী’র ১৯ তারিখে প্রচন্ড শীতের মধ্যে বরফের উপর দাড়িয়ে প্রবাসীদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ প্রদর্শন করে
- ২৪ জানুয়ারী প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়। সেখানে প্রতিবাদী গান-কবিতা ও এই আন্দোলনের সংগঠক ও বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য রাখেন
- ২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়
- ২১শে ফেব্রুয়ারী ২০২০, শহীদ মিনারে মানববন্ধন হয়
- ৬ মার্চ মনট্রিলে মানববন্ধন হয়
- ৭ মার্চে একটি ঘরোয়া সমাবেশ হয়
- ২৬ মার্চ ঘিরে ২৮ মার্চ হোপ চার্চে লুটেরা বিরোধী মঞ্চ, কানাডার সভার আহ্বান করা হয় কিন্তু করোনার কারণে তা স্থগিত করা হয়।
- ২০২০-এ ভয়াবহ করেনার বিপর্যয়ের কারণে এ আন্দোলনকে অগ্রসর করা যায়নি। কিন্তু
- আমাদের কর্মী-সংগঠক-সমর্থকদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল ও আছে।
আন্দোলনের ২য় পর্ব
২০২১’র জানুয়ারীতে বেগমপাড়া ও লুটেরা বিরোধী সামাজিক আন্দোলন আবার তীব্র আকার ধারণ করে। এবং কমিউনিটিতে তা ব্যাপক সাড়া ফেলে ও সমর্থন পায়। কেন সে আন্দোলন ছিল?
২০২০ সালে আমরা যখন লুটেরা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলি তখন ঘোষণা করেছিলাম লুটেরাদের সামাজিক ভাবে বর্জন করা হবে। এবং তাদের সাথে কমিউনিটির কোন সংযোগ সমর্থন করা হবে না। বাংলাদেশের অভিযুক্ত দূর্নীতিবাজ ও অর্থপাচারকারীদের কমিউনিটির কোন কাঠামোতে রাখা যাবে না। দূর্ভাগ্যজনকভাবে দু’জন অভিযুক্ত অর্থপাচারকারী টরন্টো শহীদ মিনার নির্মান কমিটিতে ঢুকে পরে। আমরা তাদেরকে এই কমিটি থেকে বহিষ্কারের দাবী জানাই। সে দাবী বাস্তবায়নের জন্যই আন্দোলন করতে হয়। সে আন্দোলনটি মূলত ভার্চ্যুয়ালি হয়েছে। অনেক দেন-দরকার ও চাপের মাধ্যমে অভিযুক্তদের এই কাঠামো থেকে বাদ দেয়া হয়।
এ জন্য আইএমএলডি ও কমিউনিটির সাথে অনেকগুলো সভা হয়। মটর মার্চ হয়। সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি ও প্রতিবাদ হয়। কমিটি থেকে উল্লেখযোগ্য সংখক সদস্য পদত্যাগ করলে কমিটি বাতিল করে নতুন করে ৭ সদস্যের কমিটি করা হয়।
আন্দোলনের ৩য় পর্ব
গতবছর ডিসেম্বরে প্রতিমন্ত্রী ডা: মুরাদ হাসানের নারীর প্রতি অত্যন্ত আপত্তিকর ও অবমানকর বক্তব্য ও ফোনালাপ ফাঁসসহ আরো নানা ঘটনায় সামাজিক মাধ্যম ফুসে ওঠে । এ অবস্থায় তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাকে অপসারিত হন।
এ ঘটনার পর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ডা. মুরাদ কানাডায় আসার ঘোষণা দেন। পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশের পর ‘লুটেরা বিরোধী মঞ্চ, কানাডা’ ও কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীরা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ও তাকে অবাঞ্চিতের ঘোষণা দেন। বিএনপি ও সরকার সমর্থকও অনেকে সামাজিক মাধ্যমে কানাডায় তাকে- বর্জন ও অবাঞ্চিতের ঘোষণা দেন। এবং কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সিকে তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমানসহ শতশত ইমেইলে অভিযোগ প্রেরণ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে সিবিএস তাকে কানাডায় প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন।
কানাডাকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারে বলা হয়, কানাডা হচ্ছে বাংলাদেশের বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী অভিযুক্ত অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেই অপবাদ ঘুচাতেই প্রবাসীদের এই প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
৩। আন্দোলনের অর্জন ও প্রভাব
(ক) তার ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন কমিটি করা হয়, সেখানে অভিযুক্ত লুটেরা ও তাদের সহযোগীদের কোন স্থান দেয়া হয়নি।
(খ) এই আন্দোলনের মাধ্যমে বেগমপাড়া ও অভিযুক্ত লুটেরাদের একটি কঠিন বার্তা দেয়া গেছে। এ সকল ব্যক্তিদের জীবন কানাডায় সুখের ও স্বস্তির হবে না
(গ) এর মাধ্যমে প্রবাসীদের মধ্যে এদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক ঘৃণাবোধ তৈরী করা গেছে। অতীতে তাদের সাথে কারো কোন পরিচয় সংযোগ-সম্পর্ক থাকলেও এ আন্দোলনের পর আর সেটা দেখা যাচ্ছে না।
(ঘ) এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে লুটেরা যে দেশ ও জাতির শত্রু, দুষমন তা জানিয়ে দেয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ঘৃণা জাগানো গেছে।
(ঙ) অভিযুক্ত-বিতর্কিতদের ব্যবস্যা-বাণিজ্য-দোকান ছিল তার কোন কোনটি বন্ধ হয়েছে। এবং তাদের সাথে অন্যরা সবাই সামাজিক সম্পর্ক-যোগাযোগ পরিত্যাগ করেন।
(চ) এই আন্দোলনকে নিয়ে নানা ধরণের বিভ্রান্তি দূর করতে- আমরা এই বেগমপাড়া ও লুটেরা বিরোধী আন্দোলনের একটা সংজ্ঞাও তৈরী করেছি।
৪। অর্থপাচারের গন্তব্য শুধু কানাডা নয়, অন্যান্য দেশও
অর্থ শুধু কানাডায় নয়, অন্য দেশেও যায়, সে তথ্য সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণাতেও আছে। বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ১০টি দেশে এ অর্থ যায়। ১. যুক্তরাষ্ট্র ২. যুক্তরাজ্য ৩. কানাডা ৪. অস্ট্রেলিয়া ৫. সিঙ্গাপুর ৬. হংকং ৭. সংযুক্ত আরব আমিরাত ৮. মালয়েশিয়া ৯. কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ১০. ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
বিভিন্ন দেশের অবৈধ অর্থের লেনদেন ও পাচার নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) কাজ করছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ২০০৮ থেকে এ অর্থ পাচার হচ্ছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বলছে, ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
তারা বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ অর্থবছরে দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ ও এনবিআরকে ৩ হাজার ২২৮টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন দিয়েছেন। পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৪টি বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছেন। এর বাইরে পাঁচ অর্থবছরে ২ হাজার ২৯০টি অর্থ পাচারের ঘটনার তথ্য সরবরাহ করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
বিএফআইইউ সূত্র জানায়, অর্থ পাচারের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে পাচারকারীদের দেশের বাইরে কোথায় কী পরিমাণ সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও বিনিয়োগ আছে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
গতবছর কানাডার ফেডারেল সংস্থা ফিনট্র্যাক (The Financial Transactions and Reports Analysis Centre of Canada (FINTRAC) গত এক বছরে অর্থ পাচারের ১ হাজার ৫৮২টি তথ্য কানাডার সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ও আরসিএমপির কাছে হস্তান্তর করেছে।
সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশিদের বিষয়ে গোপনে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারির বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চার জন। এ ছাড়া কিছু আছেন তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। তবে পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। কানাডা সরকারের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনো সংযোগ আছে কিনা’ তা অজানা।
এর পরিপেক্ষিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর উচ্চ আদালত রুল জারি করেছিল। কানাডার বেগমপাড়ায় বসবাস করা অর্থ পাচারকারীদের তালিকা ও তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানান, আমি বারবার চাওয়ার পরও কোন তথ্য পাচ্ছি না। আমরা কীভাবে এগোব? তিনি বলেন, মানিলন্ডারিংয়ের তথ্য কোনো দেশ দিতে চায় না। কারণ টাকা সেই দেশে যাচ্ছে আর টাকাগুলো রাখার জন্যই তারা তথ্য দিচ্ছে না। বলছে, মামলা হলে তথ্য দেবে, কিন্তু মামলা করার জন্যই তথ্য দরকার। কোনো দেশই দিচ্ছে না।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ২০ বার অবৈধ অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, জরিমানাসহ ১৮ হাজার কোটি টাকার অধিক বৈধ হয়নি। যা বিদ্যমান অবৈধ অর্থের তুলনায় খুব সামান্য। তাহলে সেই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ কোথায় যায়? সেই অর্থও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়ে চলে যায়।
২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৩৬৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের হিসেবে অনুযায়ী এখন সেখানে আছে ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়েছে ১ হাজার ৩৭০ গুণ! বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই অবৈধ অর্থের চালান শুধু কানাডায় নয় পাচারকারীর সুবিধা অনুযায়ী তা বিভিন্ন দেশে চলে যায়। লুটেরাদের দ্বিতীয় আবাসভূমির ‘বেগমপাড়া’ শুধু কানাডাতেই নয় এসব দেশেও আছে!
৫। লুটেরা বিরোধী আন্দোলনের সংজ্ঞা
লুটেরা বিরোধী আন্দোলন কোন ব্যক্তি-পরিবারের বিরুদ্ধে নয়, কোন প্রতিহিংসা থেকে নয়। আমরা ব্যক্তির অনৈতিক কর্মকান্ড, চরিত্র ও বিশ্বাস ভঙ্গের পক্ষে নয়, সেটা নিয়ে কথা বলছি না।
আমাদের এ আন্দোলন-সংগ্রাম তাদের বিরুদ্ধে, “যারা বা যে সব ব্যক্তির চরিত্র-কর্মকান্ড সমষ্টি স্বার্থের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি করে, যারা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও সম্পদের ক্ষতি করে তাদের বিরুদ্ধে। এখানে পরিষ্কার- যে সব ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ পরিকল্পিত ভাবে, সূদুরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে সমষ্টির স্বার্থের ক্ষতি করে, সাধারণ মানুষের ব্যাংকের নামানত আত্মসাৎ করে, নামে-বেনামে অবৈধ সম্পত্তির মালিক হয়, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে বিলাশবহুল জীবনযাপন করে তাদের বিরুদ্ধে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, “যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমুহের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, মামলা আছে, যাদের সাজা হয়েছে, আত্মগোপনকারী পলাতক আসামী তাদের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন। আমাদের এই সংগ্রামে কোন অস্পটতা নেই। প্রচলিত কোন রাজনৈতিক সমীকরণ ও পক্ষবিপক্ষ নেই।
৬। এই আন্দোলনের সংকট ও সীমাবদ্ধতা
(ক) এ আন্দোলনের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তথ্য ও প্রমানাদির সংকট। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এ সব দুর্নীতিবাজ ও অর্থপাচারকারীদের তথ্য সরবরাহ করা হতো তাহলে এ আন্দোলনকে অর্থপূর্ন উপায়ে অগ্রসর করা যেতো। বাংলাদেশ থেকে কোন তথ্য না পেলে কানাডাতেও কিছু করা সম্ভব হয় না। কানাডা সরকারকে বিষয়গুলো লিখিত জানাতে- অটোয়া পার্লামেন্ট হিলে যাবার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু তথ্যের সংকটে সেটা হয়নি।
(খ) এদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিপদও আছে। দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতাসীনদের সাথে সংশ্লিষ্ট ও অর্থবিত্ত থাকায় তারা ভয়ংকর ও বিপদজনক।
(গ) তবে যথাস্থানে যথা সময়ে তথ্য দিলে অনেক সময় তা তাৎক্ষনিক কাজে লাগে- প্রমান সাবেক মন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান।
(ঘ) কানাডায় কোথাও কোন কিছু লিখলে, যোগাযোগ করলে অন্তত তার সারা পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা আশা করা যায় না।
(ঙ) লুটেরারা অনেক অর্থ-বিত্ত্ব ও ক্ষমতাবান তাকে ব্যবহার করে প্রতিবাদকে বাধাগ্রস্থ, দ্বিধাবিভক্ত করতে চায়। গতবছর আন্দোলনের সময় তারা আন্দোলনকারী বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছিল।
৭। সরকার, প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের কথায় অসঙ্গতি ও সমন্বয়হীনতা
(ক) অর্থমন্ত্রী সংসদের দাড়িয়ে বলেছেন তার কাছে অর্থ পাচারের কোন তথ্য নেই! তিনি জানেন না কারা অর্থ পাচার করেন?
(খ) অন্যদিকে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বলছে, তারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রদানের দিয়েছেন।
(গ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন তাঁর কাছে কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি কেস আছে।
(ঘ) হাইকোর্ট রুল দেয়ার পর, দূদক আবেদন-নিবেদন করেও সে নাম তথ্য তারা যোগার করতে পারলেন না।
(ঙ) দূদক চেয়ারম্যান বলছেন, তার সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে অনেক যোগাযোগ করেও কোন তালিকা সংগ্রহ করতে পারেননি।
(চ) পি কে হালদারসহ কারো কারো বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড এলার্ট ঘোষণা পত্রিকায় আসলেও তার কোন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না!
(ছ) অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজরা আদালতের নিষেধজ্ঞা থাকা সত্বেও বিদেশে চলে যায়। এমন অনেক অসঙ্গতি আমরা সরকার ও প্রশাসনে দেখতে পাই।
৮। এ আন্দোলনের গুরুত্ব
আমরা কানাডায় অনেক কিছু করে ফেলিনি, কিন্তু লুটেরাদেরকে একটা বার্তা দিতে পেরেছি। তবে কাজ এখানেই শেষ নয়, আরো অনেক দূর যেতে হবে। লুটেরাদের বিরুদ্ধে দেশে দেশে এমন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে দূর্ণীতিবাজদের বিদেশে অর্থপাচার করে প্রজন্মান্তর সুখে-নিরাপদে থাকার স্বপ্ন অগ্রসর হতে পারবে না।
দেশে দেশে লুটেরা বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠুক। যে দেশই হোক ক্ষতিকর ব্যক্তিদের আশ্রয় দেয়াও অন্যায়-অনৈতিক। উন্নত দেশগুলোতে অপরাধীদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে কোন আইনী দূর্বলতা থাকলে তা দূর করার উদ্যোগ রাখতে হবে।
কানাডার আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমরা একে দলমতের উর্ধে রাখতে পেরেছি। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন ও বিপরীতমূখী হলেও সকলকেই আমরা আন্দোলনে যুক্ত রাখতে পেরেছি। প্রচলিত ধারার মত আমাদের কোন সাংগঠনিক কাঠামো নেই। লুটেরা বিরোধী আন্দোলনে সবাই নেতা, সবাই কর্মী, সবাই সংগঠক। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়া ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমাদের বড় কোন সমস্যা হয়নি।
৯। শেষ কথা
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর মোট জিডিপি’র ২ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জিডিপির আরও ১ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। দুর্নীতির কারনে জিডিপির ৩/৪ শতাংশ ক্ষতি ধরলে- দুর্নীতির কারণে বছরে ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫/৪৫ হাজার কোটি টাকা। ভাবতে পারেন? অথচ এই বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি বেকার। কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত, গৃহ, শিক্ষা ও চিকিৎসাহীন। কিছু সংখ্যক দূবৃত্তের কারণে কোটি মানুষের এই দূর্দসা।
দেশে যাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা, এ সব অনাচার-অনিয়ম-দুর্নীতি-পাচার বন্ধ করার কথা তারা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতায় এ অপকর্মগুলো হচ্ছে। যারা অর্থপাচার বন্ধ ও উদ্ধারের জন্য কাজ করবেন তারা নিজেরাই যদি এর সহযোগী হন তাহলে কিভাবে- সে কাজ হবে? শাসক যদি জবাবদিহিতার উর্ধে থাকেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সহসাই এ সংকট সহসাই কাটবে না। তবু আমরা আমাদের বিবেকের দায় থেকে, দেশের প্রতি ভালবাসা থেকে এ সব অন্যায়ের, দুর্নীতি, অর্থপাচার ও লুটপাটের প্রতিবাদ করে যাব।
আজকের এই দিনে আন্দোলনে অংশগ্রহন, সমর্থন, সহযোগিতাকারী সকল ভাইবোনদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
——————————————————-
ড. মঞ্জরে খোদা (টরিক), সংগঠক, লুটেরা বিরোধী মঞ্চ, কানাডা।
৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২
Leave A Comment