শেষ বিকেলের অনুভূতি

১৯৯৯’র সেপ্টেম্বর মাসে ২৭ তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে আমি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র আন্দোলন থেকে বিদায় নেই। আনুষ্ঠানিক বিদায়ের সময়ে আমার মনে হয়েছিল, যখন সংগঠন ও সংগ্রাম কিভাবে গড়ে তুলতে হয়, তার কিছুটা বুঝলাম-শিখলাম, তখন সংগঠন থেকে নিজের বিদায়ের আয়োজন সম্পন্ন করছি! বাংলাদেশের শিক্ষা-সংগঠন ও সংগ্রামের নানা প্রসঙ্গ যখন আসে তখন আমার সেই সময়ের এই ভাবনা ও অনুভূতির কথা খুব মনে হয়। কেন আমার সেদিন এমন মনে হয়েছিল, সংগঠনের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তার কিছুটা এখানে শেয়ার করছি। হয়তো এই আলোচনা ছাত্র ইউনিয়নের বর্তমান নেতৃত্বের জন্য, সংগঠন গড়ে তোলায় ক্ষেত্রে, গতানুগতিকতার বাইরে ভিন্নচিন্তা ও কর্মপদ্ধতির পূর্ণবিন্যাসে ভূমিকা রাখবে।

চেক উপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা লিখেছিলেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ স্মৃতি যেন এক মোমের প্রদীপ, আলো নিভে গেলেও তলায় জমাট মোম পড়ে থাকে। দেড় দশকের মাথায় সেই বিবেচনার কতটা আবেদন ও বাস্তবতা আছে, আর জমাট বাধা স্মৃতিইবা কতটা পারবে, সময়ের উপযোগী করে এই ক্ষরণ মেটাতে-, সেই দ্বিধা নিয়েই কথাগুলো বলছি। সংগঠন-সংগ্রামের অনেক ছোটখাট প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও অর্জন হয়তো পর্যবেক্ষনে বোঝা সম্ভব। কিন্তু দুর থেকে তার সবটা দেখা সম্ভব নাও হতে পারে। দীর্ঘ পরবাসের কারণে এই সময়ে সংগঠনের অনেক পরিবর্তন হয়তো আমার অজানা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এই লেখার কোন অংশ যদি বর্তমান নেতৃত্বের আশাহতের কারণ হয়, এজন্য আগেই আমার অস্বস্তির বিষয়টি জানিয়ে রাখছি।

ইতিহাস অর্পিত দায়িত্বঃ বৈরী সময়ের নায়ক

আমরা সবমসয় বলি ছাত্র ইউনিয়ন হচ্ছে এমন একটি সংগঠন যার জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনের পরিণতি হিসেবে। সময়টা ছিল ১৯৫২ সালে ২৬শে এপ্রিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই। সংগঠনটির জন্মের ২দশকের মধ্যেই আবার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়। ধর্মভিত্তিক স্বাধীনতার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক স্বাধীনতার প্রাপ্তি। ছাত্র ইউনিয়ন মহান মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মতাদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তত ও চর্চার একটি প্রধান সংগঠন হিসেবে কাজ করে। সার্বজনীন শিক্ষা ও বৈষম্যহীন সমাজের সংগ্রামকে অগ্রসর করতে সংগঠনকে নানা অভিঙ্গতার মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে, বর্তমান পরিস্থিতি হচ্চে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক প্রতিকূল ও জটিল!

স্বাধীনতার পর গত সারে ৪ দশকে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতি-সাংস্কৃতিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে সমাজের ইতিবাচক ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধের বিপরীতে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে স্বার্থপরতা, আত্বকেন্দ্রীকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতার সংস্কৃতি। অপ্রিয় বাস্তবতা আজ নতুন প্রজন্ম এই পরিবেশে বেড়ে উঠছে। এই নৈরাজ্যকে মনে করছে এমনটাই সবকিছু। অস্বাভাবিক ও বিকৃতিকেই মনে করছে স্মার্টনেস ও আধুনিকতা। সমাজ, রাজনীতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমন ভাবনার ইস্যুগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। সেগুলোকে সূত্রবদ্ধ করার মাধ্যমে ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াকে গুরুত্বপূর্ন মনে করি। যার মাধ্যমে সংগঠন পাবে গুনগতমান, পরিবেশ উপযোগিতা, গ্রহনযোগ্যতা ও গতিশীলতা। এই প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও যে তারুণ্য শিক্ষা, গণতন্ত্র ও সমাজপ্রগতির সংগ্রামে অবিচল তাঁদের নেতৃত্বেই হোক সেই অচালায়তন ভাঙ্গার কাজ।

এসো ভাঙনকে ভাঙি, সৃষ্টিকে গড়ি

সহজ কাজগুলোর একটি হচ্ছে উপদেশ দেয়া। বিশেষ করে গ্যালারিতে বসে মাঠের খেলোয়ারদের ক্ষেত্রে হলে তা আরও সহজ হয়! তবে অবস্থার পরিবর্তনে সেই অভিঙ্গতার আলোচনা কখনো গুরুত্বপূর্ণ কখনো অস্বস্তিকর। তবু দায় ও যন্ত্রনা থাকে সে কথা বলার, সংগঠনকে তার কাঙ্খিত জায়গায় দেখার।

প্রথমে উল্লেখ করছি সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াঃ একটি দৃশ্যমান ও শক্তিশালী সংগঠন নির্ভরশীল সদস্যের পরিমানে উপর। ছাত্রত্ব যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের চক্রে বাঁধা সেহেতু প্রতিবছর ছাত্র ইউনিয়ন সদস্যদের একটি অংশের বিদায় ও বরণ খুব নিয়মিত বিষয়। সুতরাং সংগঠনের ‘সদস্যসংগ্রহ অভিযান’ রুটিন কাজগুলোর অন্যতম। সেই বাস্তবতায় বর্তমান সদস্য সংখ্যা ও ইউনিটের অবস্থা অনুযায়ী তা সংগ্রহের একটি সৃজনশীল ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা সমীচীন মনে করি। যেমন দেশব্যাপী কতগুলো ইউনিট ও কতজন কর্মী-সদস্য সক্রীয় আছে, তার ভিত্তিতে একটি সুনিদ্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করে অগ্রসর হওয়া। সেটার একটি পদ্ধতি হতে পারে জ্যামিতিক হারে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা। প্রতিবছর এই সংখ্যা দ্বিগুন বা তার কাছাকাছি করার পরিকল্পনা করা। বর্তমান সদস্য সংখ্যা যদি ২০ হাজার হয় তাহলে একজন সদস্যের ভাগে পরবে বছরে একজন করে সদস্য করা। ৩ থেকে ৫ বছর মেয়াদী এরকম একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেয়া ও তা কার্যকর করা। এই পদ্ধতি অনুযায়ী ৩ বছরে সদস্য সংখ্যা হবার কথা ১ লক্ষ ৬০ হাজার। আর পরিকল্পনার অর্ধেক বাস্তবায়িত হলে তা হবে ৮০ হাজার। এই পরিসংখ্যান কেবল একটি ধারণার অংশ। এই অনিবার্য কাজের (৩০%‍~৭০%) কত শতাংশ অর্জিত হলো তার যথার্থ মূল্যায়ন করা। যে কোন বিষয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গুরূত্বপূর্ণ। তাহলে নিজেদের কাজ ও প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা নজরে আসবে যা ভবিষ্যত করনীয় নির্ধারনে অধিক সহায়ক হবে।

যোগাযোগ ও সম্পর্ককে বলা হয় রাজনীতির শিল্প। সংগঠনের বর্তমান, প্রাক্তন ও শুভাকাঙ্খীদের সাথে ধারাবাহিক যোগাযোগ রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাংগঠনিক বন্ধন ও একাত্মতা জোরদার হয়। যে দূর্বলতার অনেক অভিযোগ/অভিমানের বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাদের অনেক হতে হয়েছে। সুতরাং সামাজিকতা ও যোগাযোগের এই বিষয়টির চর্চা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে এই সুযোগ এখন অনেক সহজ ও সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রাক্তনদের সাথে একটি পুর্ণাঙ্গ ও শোভন যোগাযোগের বিষয়টি উল্লেখ করছি। পেশা, অবস্থান ও বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রাক্তন ও শুভাকাঙ্খীদের একটি ডাটাবেজ তৈরী করার মাধ্যমে এই কাজ করা যেতে পারে। নিজেদের মধ্যে থেকে নানামাত্রিক যোগাযোগের গ্রুপভিত্তিক দায়িত্ব বন্টন কাজটিকে সহজ করবে।

প্রচার-প্রচারণায় ভারচ্যুয়াল জগতে প্রভাব বিস্তার আজ অনিবার্য ও গুরুত্বপূর্ন। তথ্য ও মনস্তত্ত্বের এই সংগ্রাম অভিন্ন, সমন্বিত ও পরিকল্পিত হতে হবে। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা নয়, লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। তারজন্য প্রয়োজন তথ্যভান্ডারের নিয়মতান্ত্রিক সংরক্ষন ও বিকাশ। সেই টিমকে হতে হবে অতি চৌকষ ও তৎপর। এই জগতেও নানা সিন্ডিকেট সক্রীয় আছে তাঁদের তথ্য সন্ত্রাস সমন্বিত মোকাবেলা করার জন্য দরকার শক্তিশালী পাল্টা ক্যাম্প। বর্তমান পেশি ও সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্র রাজনীতির বিপরীতে ভার্চ্যুয়াল জগতে (ফেসবুক-ব্লগ-মেইল-ম্যসেজিংসহ সকল সামাজিক মাধ্যমে) প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগটিকে সবটুকু কাজে লাগাতে হবে প্রতিপক্ষকে দূর্বল করতে।

একইভাবে আর্থিকসহ অন্যান্য বিষয়েও পরিকল্পিত নীতিমালার একটি প্রায়োগিক ধারা কার্যকর করা। প্রশ্ন আসা খুব সঙ্গত আমি বা আমরা কি এই কাজ করতে পেরেছিলাম? এই প্রশ্নে আমি আমার গ্লানি ও আত্মসমালোচনা কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। তবে একথা আমি বলতে পারি আমার ভাবনার ধরন ছিল অনেকটা এমন। এইসব কাজের জন্য ‘টিমওয়ার্ক’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি লক্ষ্য করেছি, ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের অব্যবস্থাপনা ও অগোছালো ভাব। সেই পরিবেশ উন্নত করতে অফিস ডিসটেমপার করা, কার্পেট, পাপোষ, নতুন চেয়ার, গ্লাসটেবিল, ফুলদানি, টেলিফোন, কম্পিউটার, চায়ের ব্যবস্থা করা, ধূমপান বন্ধ করা, পুরান ফার্নিচার সংস্কার, ল্যান্ড ও মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটব ব্যবহারের কারণে সেই সময় কিছু বন্ধুর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সৌখিন বিপ্লবী ও পেটিবুর্জোয়া বলে। তবে সময় ও প্রয়োজনে পাল্টে যায়। এখন সবার হাতে স্মার্টফোন, নোটপ্যাড আরও অত্যাধুনিক টেকনলোজি। পরিবেশ ও বাস্তবতায় নিয়ত পরিবর্তন হয় মানুষের মনোজগত! ঘুরে দাড়ায় তারুণ্য, ভাঙ্গনকে ভাঙ্গতে নিপুণ দক্ষতায়।

কঠিনেরে বাসিলাম ভাল

ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রদের সংগঠন মোটামুটি ১০০ভাগ সদস্যই পূর্ণকালীন ছাত্র। সুতরাং এই সংগঠনের সদস্যরা হবে আদর্শছাত্র ও দায়িত্বশীল কর্মী। তাদের জীবন-যাপন, বোধ-বিবেচনা হওয়া উচিত অন্যদের জন্য অনুকরনীয় ও আলোচনার বিষয়। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-আদর্শ ধারণ ও লালনকারী সংগঠনের শৃংখলার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তার প্রধান একটি বিষয় সময় ও জীবন বোধের সচেতনতা। আমি লক্ষ্য করেছি, ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ধরণের সভা, সমাবেশ, আয়োজন, অনুষ্ঠান ও যোগাযোগের নির্ধারিত সময়কে অনুসরণ করতে না পারার দূর্বলতা। জীবন-যাপনের ক্ষেত্রেও দেখেছি কর্মী-সদস্য-নেতাদের শৃংখলাবোধের অভাব।

ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়া অবধি কাজ ও সময়ের পরিকল্পনাহীনতা। ব্যক্তিগত জীবনের অনেক ছোটখাট বিষয়কে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। একজন অগ্রসর, আধুনিক, উন্নত, রুচীশীল, পরিশীলিত ও মার্জিত নাগরিকের যে গুণাবলী অর্জন করা দরকার তার আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার অভাব বোধ করেছি। আমরা সমাজের ক্ষতিকর ও নেতিবাচক বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে বলি এবং দূর করতে চাই, কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে অসঙ্গতি ও অনিয়মগুলো আছে তাকে কি আমরা কখনো কমিয়ে ফেলতে বা দূর করতে পেরেছি? যেমন খেয়াল করেছি, ধূমপান, পরিষ্কার-পরিচ্চন্নতা, শরীর-স্বাস্থ্য, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির অসঙ্গতি, অযত্ন, উদাসীনতা, অভ্যাস। ব্যক্তিজীবনে যদি সুশৃংখল ও দায়িত্বশীল না হওয়া যায় তাহলে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কি তার চর্চা সম্ভব হবে? সুস্থ কর্মী, সুশৃংখল সংগঠনের উপরই নির্ভরশীল কাঙ্খিত আন্দোলন-সংগ্রামের গতিশীলতা। আত্মউন্নয়ন, শিক্ষন, প্রশিক্ষন, কর্মশালা নানা পদ্ধতিতে এই অবস্থার গুণগত পরিবর্তন হতে পারে, যা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বিষয়। এই কঠিন সত্যের উপলব্ধি ও অনুশীলন গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

যে অপবাদ আমাদের অহংকার

বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বরুপের প্রকাশ্য ও নেপথ্যের নায়ক ছাত্র ইউনিয়ন। বর্ষবরণ, প্রভাতফেরী, বইমেলা, আল্পনা, মঙ্গলযাত্রা যার সবকিছুই আজ আমাদের আত্মপরিচয়ের গর্ব ও অহঙ্কার। ছাত্র আন্দোলনে মেয়েদের ব্যাপক অংশগ্রহন সম্মেলন, নবীনবরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লিটল ম্যগাজিন, দেয়ালিকা যার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্বোধক এই সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধ, দেশ গড়ার সংগ্রাম, মানবতার সেবায় অংশগ্রহন ছাত্ররাজনীতিকে যে গৌরব ও অহংকর দিয়েছে তার মূল কৃতিত্ব এই প্রতিষ্ঠানের। একটি সুস্থ ধারার ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে দলটিকে নিতে হয় হারমোনিয়ম ও লিপস্টিক পাটির অপবাদ! এদেশের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার এক সফল ইনস্টিটি‌উট। আর সেই সংগঠনের কেন্দ্র থেকে নিচ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক মানের নিম্নমুখী ও বিভিন্নতা কাম্য নয়। কাজে ও প্রকাশে স্বকীয়তা ও বৈচিত্রতা থাকতে পারে কিন্তু তা মৌলিকত্বকে অস্বীকার করে না। যেমন, দলটির প্রধান শ্লোগান সমুহ, বক্তৃতার বিষয় ও তথ্য-উপাত্ত, পোষ্টারের ভাষা, প্রকাশনা ও পত্রিকার নাম, দেয়াল লেখা যতটা সম্ভব অভিন্ন ধরণের (ইউনিফরম) হওয়া বাঞ্চনীয়। দেশব্যাপী একটি অভিন্ন ধারা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলা গেলে একটি বিশেষ ধারার প্রতিনিধিত্ব হিসেবে পরিচিত লাভ করবে। জয়ধ্বনি কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয় একই সাথে বিভিন্ন নামে অন্যান্য ইউনিটেও একই উপলক্ষে বের হয় কিন্তু নাম ভিন্নভিন্ন। একই নামে তা প্রকাশিত হলে জাতীয়ভিত্তিক পরিচিত পেতে অনেক সহজ হবে ছাত্র ইউনিয়নের প্রকাশনা হিসেবে। সব ইউনিটের প্রকাশনার মান এক হবেনা, কিন্তু একটি ইতিবাচক ধারা তৈরী হবে। আর না হয় কেন্দ্র থেকে একটাই প্রকাশনা নিয়মিত করা হোক জেলা ও ইউনিটের চাহিদা অনুযায়ী।

ফেসবুকে লক্ষ্য করেছি, ছাত্র ইউনিয়নের ছেলে-মেয়েরা (প্রাক্তনসহ) যে যার মত করে বাংলাভাষার ব্যবহার করছে এবং একটি স্বীকৃত প্রমিত ধারাকে অবজ্ঞা করছে। ভাষার সৃজনশীল বিকাশের পরিবর্তে নানা ধরনের বিকৃতির প্রকাশ দেখছি। তার মাধ্যমে নিজেদের আধুনিক ও স্মার্ট প্রমানের চেষ্টা করছেন। তা কতটা শোভন? শিক্ষা ও সংস্কৃতির একমুখীর কথা বলবো আর ভাষার বিভিন্নমুখী ব্যবহার করবো, তাকি স্ববিরোধিতা নয়? কেউ বলতে পারেন বৈচিত্রতার কথা কিন্তু বৈচিত্রতা আর বিকৃতি এক বিষয় নয়।

বিভিন্ন জেলা-ইউনিটে আমি দেখেছি ছাত্র ইউনিয়নের পতাকার রং তারকার আকৃতি অবস্থান ও অনুপাত ভিন্ন। এমনকি দলীয় সঙ্গীতের সুর ও প্রকাশ ঢংও আলাদা। বিভিন্ন ইউনিটের সন্মেলনের উদ্বোধক, প্রধান অতিথির কর্তব্য ও বক্তব্যে সমন্বয়হীনতা ও ধারাবাহিকতার অভাব ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বক্তব্য ও বিষয় ভাগ করে নিয়ে, একই তথ্য বারবার না দিয়ে, প্রয়োজনীয় আলোচনা ও করণীয় স্পষ্ট করে তুলে ধরা।

এক সময় ব্যান্ডসংগীত ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারকে অপসংস্কৃতি মনে করা হতো। আমার মনে হয় সেই সময় পার হয়েছে। এখন সময়ের এই চাওয়া ও পরিবর্তনে সাংস্কৃতিক ইউনিয়নকে দেখাতে হবে ইতিবাচক সৃজনশীলতা। সংগঠনের ওয়েবপেজকে আরও ও স্মার্ট, বর্ণিল ও সমৃদ্ধ করা। যাতে করে দেশের শিক্ষা সম্পর্কিত, ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলন সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত এখানে পাওয়া যায়। ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভিত্তিক আর্কাইভ তৈরীতে প্রাক্তন ও শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতা আহ্বান করা।

অশুভের সাথে আপোষহীন দ্বন্দ্ব চাই

আদর্শহীন, সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্র রাজনীতির বিপরীতে একটি সুস্থধারার সংগ্রাম গড়ে তোলার দুইটি দিক আছে, একটি রাজনৈতিক অন্যটি সাংস্কৃতিক। সুতরাং যে কোন রাজনৈতিক সংগ্রামের সাংস্কৃতিক দিকটি গুরুত্বপূর্ন। সেখানে উন্নত রুচী ও সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। যার মধ্যদিয়ে অধিক স্পষ্ট হবে শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্ব। অনেক কড়া কথা মার্জিত ভাষায় বলা যায়। বাংলা ভাষা এখনও এতটা দৈন হয়ে যায়নি। কিছু উত্তেজক শ্লোগান বর্জন করা যেমন, জ্বালো জ্বালো- আগুন জ্বালো, শিবির ধর- জবাই কর, রক্তের বদলা- রক্তেই নেব, খুনের বদলা- খুনেই নেব, অমুকের চামড়া- কুকুর দিয়ে কামড়া, জুতা মারো- তালে তালে ইত্যাদি। এই শ্লোগানগুলোর মধ্যেদিয়ে এক ধরণের ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রকাশ ঘটলেও উন্নত রুচী, সংস্কৃতি ও মানসিকার প্রকাশ ঘটে না।

ছাত্রদের স্বার্থেই ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র মানেই ক্লাস-পরীক্ষা-লাইব্রেরী-সেমিনার ইত্যাদি থাকে। আর এগুলো চলাকালে মিছিল-সমাবেশ ও মাইক ব্যবহার করা কতটা শোভন? মিছিল-সমাবেশ অংশ নেয়া হয়তো অনেকের ক্লাস-পরীক্ষা থাকে না, কিন্তু যাদের থাকে তাদেরতো সমস্যা হয়। যারা এর ভুক্তভোগি তারা কি এই কর্মকান্ডকে সমর্থন করবে? সহানুভূতি দেখাবে? ক্লাস-পরীক্ষা যখন শেষ তথন অথবা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একটি নির্ধারিত সময় বের করে নেয়া উচিত মনে করি। অবশ্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময় ও পরিস্থিতিই বলে দেবে এই নিয়মের ব্যতিক্রম। এই ধরণের চিন্তা ছাত্র আন্দোলনে একটি গুণগতমান যুক্ত ও সংগঠন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সহানুভূতিশীল করবে।

 

আমাদের দেশে শিক্ষাসহ অন্তহীন সমস্যা এবং এর কোন আশু সমাধান নেই। তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের উপর। কিন্তু ছাত্রসমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরী করতে আপাত আদায়যোগ্য ও জনপ্রিয় কিছু দাবীকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়া। এটি জাতীয়ভিত্তিক শক্তিশালী সংগঠন ও কার্যকর ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা/কৌশল হিসেবে কাজে লাগতে পারে১. সেই দাবীগুলোকে চিহ্নিত করা ২. একে ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশে পরিণত করা ৩. বিষয়গুলোকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত, গ্রহনযোগ্য ও সমর্থিত করা ৪. তা অর্জিত না হওয়া অবধি লেগে থাকা এবং কতটুকু অগ্রসব হলো তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ৫. সমসাময়িক শিক্ষা-আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ইস্যু সামনে আসলে সেখানে একাত্ম ও সংহতির পাশাপাশি মূল এজেন্ডাকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে যে কোন বিশেষ পরিস্থিতির বিবেচনা ভিন্ন। ৬. এই সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সংগঠন ও নেতৃত্বের দক্ষতা, যোগ্যতা সামর্থ ও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি নজরে আসবে এবং সংগঠনের জাতীয় সন্মেলন হবে সেই পরিস্থিতি মূল্যয়নের একটি উপযুক্ত রাজনৈতিক অনুষ্ঠান। ৭. সন্মেলন মানেই নতুন শ্লোগান, কর্মসূচী, কমিটি’র চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হবে বিগত সন্মেলনের শ্লোগান ও কর্মসূচীর কতটুকু অর্জিত হলো, তার আবেদন, প্রয়োজন, বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতার বিশ্লেষণ। কাঙ্খিত অবস্থার যদি গুণগত কোন পরিবর্তন না ঘটে তা অর্জনের উপযুক্ত কৌশল ও নীতি গ্রহনই হবে আরেকটি সম্মেলনের প্রধান এজেন্ডা। এই প্রশ্নের আপোষহীন ধারাবাহিকতা হতে পারে লক্ষ্য অর্জনের আরেকটি পথের অনুসন্ধান।

তত্ত্ব ধূসর, জীবন চীর সবুজ

গ্যটের ভাষায়, তত্ত্ব ধূসর জীবন চীর হরিৎ। জীবন মানে প্রাণ, উৎসব, উচ্ছাস ও আনন্দ। মানে গতিশীলতা। জীবন যেখানে ছন্দের প্রতিশব্দ বয়ে চলাই সেখানে শেষ কথা। মানুষের জীবনের কঠিন কাজগুলোর একটি হচ্ছে নিজের জীবন সম্পর্কে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে পারা। সেই বিবেচনায় পেশা নির্বাচন তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে আছেন তাদের জন্য। ছাত্রত্ব ও ছাত্র আন্দোলন শেষে (আত্মসমালোচনাসহ) অনেককে দেখেছি এক ধরণের অস্থিরতা, আবেগ ও স্বপ্নে আচ্ছন্ন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সম্পর্কে যথেষ্ট বাস্তবজ্ঞান ও যুক্তিবোধের অভাবে, বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে অপরিকল্পিত সময় পার করে! যাতে করে নিজের মেধা, সামর্থ, সক্ষমতা ও সম্ভবনার যথার্থ বিকাশ ও প্রয়োগ হয় না, অন্যদিকে প্রয়োজন ও বাস্তবতার মধ্যে সংযোগ ঘটাতে না পেরে বিভ্রান্ত হন। মনস্তত্ত্বের ভাষায় মানুষ যখন কোন বিষয়ে তার তুমুল আকাঙ্খাকে ধারণ ও রুপায়নে অক্ষম হয় তখন সে ক্রমশ সেই বিষয়ে নেতিবাচক হয়ে পড়ে। যা ঘটতে দেখি আমাদের এই পরিবার ও বলয়ের সাবেকদের একটি বড় অংশের মধ্যে। এটাই একমাত্র কারণ না, এরসাথে আছে দল, রাজনীতি, দেশের আর্থ-সামাজিকসহ নানা বিষয় ও বাস্তবতা। তত্ত্ব ও জীবনের প্রয়োগ-উপলব্ধির সঠিক জ্ঞান এবং এই দুয়ের সংযোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ। যাতে জীবনের কোন সময় কোন গ্লানি নীতি, আদর্শ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী না করে।

সুন্দরের কানে কানে বলি, এ দ্রোহ আমার

বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে তার উত্তাপ দেশেও পড়ছে। আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে একবারে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান-তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ উদ্ভাবন, উন্নয়ন, প্রসার, সংক্রমন মানুষের জীবনকে করছে গতিময়, বৈচিত্রময় ও বেপরোয়া। সময়ের সেই গতি, চাহিদা, মনস্তত্ত্ব বোঝার অতি অগ্রসর বোধ-বিবেচনা কেবল গুরুত্বপূর্ণই না, স্বীকার করতে হবে তা অনিবার্য। সময়, সংস্কৃতি, চাহিদা পূরণে সক্ষম উপযুক্ত সংগঠক ও নেতৃত্ব ছাড়া এই নৈরাজ্য ও শৃংখল মুক্তির স্বপ্ন হবে অলীক। সাদা-কালো যুগের সমাজ, রাজনীতি মৌলচরিত্র প্রায় অভিন্ন থাকলেও এখন মানুষকে আস্থায় নেয়া ও বিভ্রান্ত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক বেশী। তাই সতর্কতার মাত্রায় হতে হবে অভাবনীয় সংবেদনশীল। ছাত্র রাজনীতি আজ অনেকের কাছেই গৌরবের কোন বিষয় নয়। সমাজের ভাবাদর্শ আজ পাল্টাচ্ছে।

এখানে দুটি বিষয় প্রথমত: সমাজে এই নেতিবাচক প্রবণতার বিপরীতে আস্থার ক্ষেত্র তৈরী করার বিশাল চ্যালেঞ্জ, দ্বিতীয়ত: শিক্ষা সমস্যাভিত্তিক ছাত্র আন্দোলন ও সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে অগ্রসর করা। এই বৈরী সময়ে টিকে থাকাটা যেমন কঠিন ততোধিক কঠিন এই সংগ্রামকে অগ্রসর করার কাজটি। একটি হচ্ছে সংগঠনের টেকনিক্যাল অন্যটি আন্দোলন-সংগ্রামের দিক। এই দুইয়ের ধারাবাহিক ও ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরী। কখনো কখনো শক্তির আকৃতির চেয়ে সময় ও প্রয়োজনের যথার্থ উপলব্ধি যে কোন বড় অর্জনের পথকে প্রশস্ত করে। গতানুগতিক ধারাবাহিকতা টিকে থাকার কারণ হবে, কিন্তু আকাঙ্খা অর্জনে হতে হবে অনেক সুচতুর, স্মার্ট, সৃজনশীল ও বেপরোয়া। যে সাহসী তারুণ সংগ্রাম সুন্দরের কানে তুলে দেয় সেই মন্ত্র, এ দ্রোহ আমার।

অভিলাষি মন চন্দ্রে না হোক জোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই

মানুষের কাছে তার মূল্যই সর্বাধিক যা মানুষ কখনো আর ফিরে পায় না। ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যা প্রত্যেক মানুষের অস্তিত্বের অনিবার্য অংশ। আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগের একটি সময় কেবল কল্পনাতেই ফিরে যাওয়া সম্ভব- বাস্তবে নয় কখনো, যেমন সম্ভব্ নয় আকাশ আর সমুদ্রের, দিগন্ত এবং স্বপ্নের। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় জীবনের সমীকরণ, পাল্টে যায় পরিবেশ, পরিস্থিতি ও বাস্তবতা। বোধে ও জীবনে আসে সময় নির্ধারিত গুণগত পরিবর্তণ। পাল্টে যায় বাস্তবতার ও সম্পর্কের মানচিত্র। সেই সময়ের সহযোদ্ধাদের সাথে আবার একসাথে হেসে ওঠা, আড্ডায় মেতে ওঠা কম আনন্দের নয়। কিন্তু যে গল্প প্রথমেই বলছিলাম জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা যা আমাকে তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে যদি আমাকে কর তোমাদের গল্পের ও স্মৃতির অংশ, তাহলে হয়তো আমিও থাকব তোমাদের পাশে। বঞ্চিত আনন্দের সুখে, দুঃখ বিলাসী আমি’ অভিমানে বলি- ভালবাসা মিলনে মলিন হয় বিরহে উজ্জল।

————————————————————————-

ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক-গবেষক, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।