লিখেছেনঃ এন এন তরুণ
আচার্য শব্দের অর্থ প্রধান পুরোহিত আর পুরোহিত শব্দের ভাবার্থ হল, যিনি গৃহস্তের মঙ্গলের কথা তাঁদের পুরোভাগেই অর্থাৎ আগেই চিন্তা করেন। যাঁর কথা বলছি, তিনি আমাদের ড. আহমদ শরীফ, হুমায়ূন আজাদের ভাষায় ‘বয়স্ক বিদ্রোহী’ বা ‘বামুনের দেশে একমাত্র মহাকায়’ আর নতুন প্রজন্মের কাছে ‘বাংলার ভলতেয়ার’। জনগণের কিসে মঙ্গল হবে, তা যিনি জনগণের আগেই চিন্তা করতেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জনগণের মঙ্গলের নিমিত্তে এমন সাহসী উচ্চারণ আর কেউ করেন নি।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ ওয়াল্ট হুয়িটম্যান রষ্টোর মতে, একটি সমাজের বা রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে মূলত সেখানকার অধিবাসীরা কোন দর্শনে বিশ্বাস করেন তার ওপর। তিনি ব্যাখ্যা করেন, আদৃষ্টবাদী জনগোষ্ঠীর পক্ষে উন্নতির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানো কঠিন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত দর্শনে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পৃথিবীর মানুষ প্রধানত দুই শিবিরে বিভক্ত — আস্তিক ও নাস্তিক। আজ্ঞেয়বাদে ও সংশয়বাদে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা অতি অল্প। আস্তিক্যবাদে ও নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী মানুষেরাই সমাজ নির্মাণে ও জাতিগঠনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। অতএব, আস্তিক্যবাদ-নাস্তিক্যবাদ প্রসঙ্গটি রাষ্ট্রীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানব প্রজাতির সৃষ্টি ও তার ক্রমবিকাশ পূর্বসংস্কারমুক্ত হয়ে, যুক্তিবাদী দৃষ্টি নিয়ে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, মানুষের দুর্বল অসহায় মনই ঈশ্বর নামক কনসেপ্টের উৎসভূমি। অর্থাৎ ঈশ্বর মানবমনের অসংখ্য বিচিত্র কল্পনার একটি কল্পনা মাত্র। অর্থাৎ ‘ঈশ্বর’-এর ধারণা থেকে জন্ম হয়েছে অসংখ্য ধর্মের। আর প্রতিটি ধর্ম আত্মার অস্তিত্বে ও অমরত্বে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ পরকালে বা পরলোকে তথা স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস ধর্মের বা ঈশ্বরবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অতএব, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তারা সবাই পরকালে বিশ্বাস করেন| ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ পরলোকের কল্পিত অনন্তকালীন সুখের তুলনায় ইহজাগতিক জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। ইহজাগতিক উন্নতি তার কাছে অপ্রধান। আর পরলোকের স্বর্গের লোভে ও নরকের ভয়ে লক্ষ্য স্থির রেখে ধর্মগ্রন্থসমূহে যেসব বিধি-বিধান রচিত হয়েছে, তা মানুষের চিন্তাধারাকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে, জীবনাচরণকে অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও স্ববিরোধী করে। কারণ ধর্মগ্রন্থে ধর্মবিরোধী কাজের জন্য যেমন শাস্তির উল্লেখ আছে, তেমনি “একবার রাম নামে যত পাপ হরে, জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে”-এর মতো সমস্ত পাপ থেকে ক্ষমা পাওয়ার উপায়ও আছে। ফলে মানুষ ধর্মকর্ম ও পাপকর্ম একই সঙ্গে করে যাচ্ছে।
ধর্মগ্রন্থের বিধান অনুসারে তথা বাইরের নির্দেশে জীবনচালনার প্রবণতা সৃষ্টি হওয়ায় যৌক্তিক মানবিকবোধ ও বিবেক জাগ্রত হয়না। মানুষ হয়ে ওঠে অদৃষ্টবাদী; পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, এমনকি সে নিজে যা কিছু করে তা-ও ঈশ্বর দ্বারা কৃত ও পূর্বনির্ধারিত বলে সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। স্বশাসিত, সম্পূর্ণ সার্বভৌম প্রাণীর পরিবর্তে সে হয়ে ওঠে একটি যন্ত্র। যন্ত্রের মতো তাঁর মধ্যেও নিজস্ব শ্রেয়োবোধ, কল্যাণচেতনা, সমন্বিত জীবনচেতনা, তাঁর নিজের ও সমষ্টির যুগপৎ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অনুপস্থিত। এজাতীয় মানুষ অধ্যুষিত সমাজে আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটতে পারে না। পক্ষান্তরে, যারা পরকালে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা এই জীবনকেই বড় করে দেখেন। এই জগতেই তারা তাঁদের সুখ সর্বাধিক করার চেষ্টা করেন । কারণ তাঁরা অদৃষ্টবাদী হওয়ার পরিবর্তে ‘Men is the architect of his or her own fate’ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। একজন নাস্তিক মানুষকে অবশ্যই ইহাজাগতিক, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিমান হতে হবে। বস্তুত, সংস্কৃতিমান হওয়া অর্থ সমন্বিত জীবনচেতনাসহ সর্বপ্রকার মানবীয় গুনাবলীসম্পন্ন হওয়া। ইহজাগতিক, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থে সংস্কৃতিমান মানুষ অধ্যুষিত সমাজের পক্ষেই উন্নতির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানো সম্ভব।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে পারলৌকিকতার বিপরীতে ইহজাগতিকতার, যাজকতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রের, ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানের পক্ষে যে সকল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, সেই আন্দোলনই ইউরোপের অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। ফ্রান্সের দার্শনিক, লেখক ও ইতিহাসবিদ Jean Francois Arouet Valtaire (১৬৯৯-১৭৭৮) অষ্টাদশ শতকে চিন্তার জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি, যিনি ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি রচনা কারীদের একজন এবং ইউরোপসহ পৃথিবীর দেশে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের নীরব বিপ্লবে ইন্ধন যোগান। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে এবং বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের পক্ষে ভলতেয়ারের পরিষ্কার ও অকাট্য বক্তব্য পৃথিবীর মানুষকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে।
ভলতেয়ার নিজেকে কখনও নাস্তিক বলে ঘোষনা করেননি কিন্তুতাঁর বিশ্বাস ও বক্তব্য সম্পুর্ণরূপে প্রচলিত ধর্মবিরোধী ছিল: God does not intervene in the course of events. There is no providence, no miracle, no divine revelation. তাঁর চিন্তাধারা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তধর্মী ও প্রয়োগধর্মী। তিনি ধর্ম শব্দটিকে নৈতিকতার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করতেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মীয় শিক্ষার ইতিবাচক প্রভাব অর্থাৎ ধর্মের শুধু বাস্তবমুখী শিক্ষার অংশটুকু তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। সত্য, ন্যায়বিচার, সততা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি শব্দগুলোর সমণ্বিত স্বয়ংসিদ্ধ শব্দ হিসেবেই ধর্ম শব্দটিকে ব্যবহার করতে রাজী ছিলেন, এর বেশি কিছু নয়।
ভলতেয়ারের মতো আরো অনেক মহাপুরুষ যেমন, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, ভি. আই. লেনিন, মাও সে তুং ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পৃথিবীতে অনেক এগিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে শিক্ষার হার নিম্ন, অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া, সেখানে একক ব্যক্তির পক্ষে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ও প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখা একটি দুরূহ ব্যাপার। প্রয়াত ড. আহমদ শরীফ এই কাজটি সম্পাদন করেছিলেন।
আমার তারুণ্যের শুরুতেই তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল আমার জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা। দীর্ঘ কাল তাঁর গভীর সান্নিধ্যে থেকে কত কিছু যে শিখেছি তাঁর কাছ থেকে, বলে শেষ করা যাবে না। শুধু বিষয়-ভিত্তিক জ্ঞান নয়— বাংলা বাক্য গঠন, বাংলা বানান পর্যন্ত তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। আমার কোন কোন লেখা নিজ হাতে কলম দিয়ে সংশোধন করে দিয়েছেন। একজন গুরু যেমন শিষ্যকে পুত্রবৎ জ্ঞান করে অসীম স্নেহে তাঁর উন্নতির জন্য জ্ঞান দান করেন, ড. আহমদ শরীফ আমার জন্য তা-ই করেছেন। নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে আমি আবিষ্কার করেছি, তাঁর মননে ছিল সারাক্ষণ শ্রমজীবি মানুষের মুক্তি চিন্তা। সে জন্যই তাঁদের মুক্তির পথে যে সব বাধা তিনি অনুভব করতেন, নিঃশঙ্কোচে নির্দ্বিধায় তা-ই বলে ফেলতেন, সেটা হতে পারে প্রাচীন গ্রন্থ, পুঁজিতন্ত্র, রাষ্ট্র বা সরকার। রষ্টোর উন্নয়ন সম্পর্কিত দর্শনে তাঁর বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাস ছিল মার্ক্সবাদে। ভলতেয়ারের মতো একজন কর্মবীরও ছিলেন তিনি। বুদ্ধজীবীর ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বুদ্ধিজীবীকে শুধু বুদ্ধি বিক্রি করে জিবিকা নির্বাহ ও লেখালিখির মধ্যে তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। তাঁকে সংগঠন করতে হবে, আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হতে হবে, সমাজ নির্মাণে ও রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে— কার্ল মার্ক্সের এই তত্ত্ব তিনি সারা জীবন অনুসরণ করেছেন। বস্তুত, তাঁর জীবন ছিল ভীষণ রকম কর্মমূখর। শিক্ষাদান ও গবেষণার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, শিক্ষকদের নেতৃত্ব দান, পাঠচক্রসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন সারা জীবন।
ধর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়াকে মার্ক্সিস্ট হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত এমন অনেকেই অসমীচীন বলে মন্তব্য করেছেন। ব্যাপারটিকে তাঁরা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা বলে মন্তব্য করেছেন। আহমদ শরীফের মতো একজন মহান ব্যক্তি সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা এ ধরণের মন্তব্য করেন, তাঁদের অনেকেই মার্ক্সবাদের প্রবক্তা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে ঘরোয়া পরিবেশেও তারা কখনো কথা বলেন না, বরং তাঁরা কোরবানির ঈদে গরু জবাই করার মতো পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক ধর্মীয় প্রথাও মেনে চলেন। কেউবা প্রয়াত স্ত্রীর মৃত্যু বার্ষিকীতে মিলাদ দেয়ার মতো পারলৌকিক অনুষ্ঠানও করে থাকেন। তাঁরা দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার পালনের ক্ষেত্রে ও স্বাগত সম্ভাষণে বা বিদায় সম্ভাষণে ধর্ম নির্দেশিত শব্দবলি উচ্চারণ করেন, যা শুধু ইহজাগতিক সংস্কৃতিবিরোধীই নয়, বাঙালি সংস্কৃতিরও পরিপন্থী। অর্থাৎ জীবনাচরণে তাঁরা এদেশের ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের মতোই। গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস এঁদের নেই। আমার এই লেখা দ্বারা এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া কোনো যুক্তি নেই। কারণ এখানে আমি এদেশে যারা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, তাঁদের জীবনের স্ববিরোধিতার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি মাত্র।
যারা আন্তরিকভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন এবং ধর্মগ্রন্থের বাণীকে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ বলে বিশ্বাস করেন, তাঁদের পক্ষে ধর্মেনির্দেশিতভাবে জীবন যাপন করাই আমি যৌক্তিক বলে মনে করি। ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না বলে আমার নাস্তিক্যবাদী দর্শন অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার জবরদস্তি নীতির ঘোর বিরোধী আমি। তবে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচারের যেমন সুযোগ আছে, তেমনি নাস্তিক্যবাদী দর্শনের পক্ষে মত প্রকাশ করার, এমনকি প্রচার চালানোর অবাধ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা থাকা একান্ত জরুরী, অন্যথায় জাতি একটি বদ্ধ ডোবায় পরিণত হবে এবং প্রগতির পথ রুদ্ধ হবে।
এ দেশে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই স্ববিরোধী। বিশ্বাসে সাথে কর্মের অমিল। পদ, পদবী ও পুরষ্কারের জন্য সরকারের আনুকুল্য লাভের চেষ্টা। বিনাশ্রমে অর্থ, যশ ও খ্যাতি লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা। এ দেশে স্ববিরোধিতমুক্ত একজন মাত্র মানুষের হাদিস আমরা জানি, তিনি হচ্ছেন, ড. আহমদ শরীফ যিনি যা বিশ্বাস করতেন ঠিক তাই লিখতেন আর বলতেন। এই ভূখণ্ডে আহমদ শরীফ একমাত্র ব্যক্তি যিনি ব্যাক্তিগত দর্শনকে জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজের অন্য দশজনের সঙ্গে কৃত্রিমভাবে একাত্ম হওয়ার ধার ধারেননি। যিনি একঘরে হওয়ার ভয়কে উপেক্ষা করে তাঁর পরিবারের সবাইকে ধর্মীয় আচার পালন না করায় উদ্ভুদ্ধ করতেন। নাস্তিকবাদী দর্শনে নিজের বিশ্বাসের কথা ও ধর্মের অসারতার কথা প্রকাশ্যে যে কোনো লোকের সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা করতেন না। তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব ছিল, কারণ রাষ্ট্রের বা সমাজের, সরকারে, সংগঠনের, প্রচার মাধ্যমের বা প্রেসের, এমনকি কোনো ব্যাক্তির কাছ থেকে কোনোরূপ সুযোগ গ্রহণ করার আকাঙ্খা তার মধ্যে ছিল না। রেডিও টেলিভিশনে কোনো সাক্ষাৎকার বক্তব্য দিতে তাকে কখনো দেখা যায়নি।
একবার ৮৭ বা ৮৮ সালের দিকে বিজয় দিবস উপলক্ষে খ্রিস্টীয় যুব সংগঠনের উদ্যোগে তেজগাঁও কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ এটি ছিল ধর্মীয় সংগঠনের একটি উদ্যোগ। যারা প্রকাশ্যে তার ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রদানকে অসমীচীন মনে করতেন তাঁরা এর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেননি। আমি তার সাথে বেশ কয়েকবার একান্তে কথা বলেছি, গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছি এবং আবিষ্কার করেছি যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে নির্মম অমানবিকতা বিদ্যমান, তা অনুধাবন করে তিনি গভীর বেদনা অনুভব করতেন। যেহেতু ধর্মের আশ্রয়ে পুঁজিবাদ বেড়ে ওঠে, তাই ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার এক তীব্র প্রেরণা তাঁর মধ্যে নিরন্তর কাজ করতো।
তিনি পুঁজিবাদী সমাজকে সুক্ষ্মভাবে বোঝার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিশতেন এবং কথা বলতেন। তিনি একবার রমনা পার্ক থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক রিক্সাচালকের কাছ থেকে তাঁর অবস্থা জানতে চেয়ে এক করুন কাহিনী আবিষ্কার করেছিলেন। সেই রিক্সাচালক রিক্সা চালিয়ে টাকা রোজগার করে তাঁর ছোট ভাইকে ম্যাজিস্ট্রেট বানিয়েছেন, যে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে ঢাকা শহরে বাড়ি করেছে এবং ‘সম্মানহানি হবে’ এই জন্য রিক্সাচালক ভাইকে তাঁর বাড়ির আশেপাশে না আসতে অনুরোধ করেছে। বৃদ্ধ রিক্সাচালক তাঁর ছোট ভাইয়ের সম্মানহানি ঘটাতে চান না। তাই নিজেকে তাঁর ভাই বলে পরিচয় দেন না।
ড. আহমদ শরীফ একদিন আমাকে এই সমাজের আরেকটি মারাত্মক বৈশিষ্টের কথা বলেছিলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে যে প্রযোগিতামুখী স্বর্বগ্রাসী চারিত্র্য প্রোথিত করে তা, তাঁর দেখা কিছু ঘটনা উল্লেখ করে আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের বিয়ে বাড়িতে বা পিকনিকে অংশগ্রহণ করেছি এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, খাবার সময় হলে মাংসভর্তি পাত্র খাবার টেবিলে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে মাংসের ভালো টুকরাটি অন্যের আগে নিজের প্লেটে নিয়ে নেওয়া যায় সবার মধ্যে এরকম একটি নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়’। তারপর তিনি বললেন, ‘যাঁরা এই শহরে বাস করে, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যা-ই হোক সবাই তো প্রায়শই মাংস পোলাও খেয়ে থাকে, তারপরও তাদের মধ্যে এই যে প্রতিযোগিতা ও লোভ এটি ধনতান্ত্রিক সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ধর্ম এখানে মানুষকে ত্যাগের শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে’।
আমি আরেকদিন স্যারের সঙ্গে সংস্কৃতি প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলাম, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভূতি উন্নতির ফলে, অবাধ তথ্যপ্রবাহের ফলে, যুক্তিবাদের বিকাশের ফলে এখন আর কোন জাতির বা ভূখণ্ডের বা জনগোষ্ঠীর স্বকীয় সংস্কৃতি বলে কিছু থাকবে না। আর থাকার দরকারও নেই; বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে একটি অখন্ড বিশ্বসংস্কৃতি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাসের সাথে আমার কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই কথাটিই তো আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি। কে কার কথা শোনে! আমি বহুবার বলেছি যে, আধুনিক ইংরেজ সংস্কৃতিই বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হবে। আমাদেরকেও আমাদের সংস্কৃতির অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও ধর্মীয় উপাদানগুলি পরিহার করতে হবে’।
তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে আবিষ্কার করেছি যে, সর্বক্ষণ তাঁর মননে থাকতো স্বদেশ ও পৃথিবীর সব শোষিত মানুষের মুক্তির চিন্তা। আন্তরিকভাবে ও জোরালোভাবে ধর্মকে মানুষের মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে বিশ্বাস করতেন বলেই সব সময় ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। রাজনীতির কৌশলগত দিকের বিবেচনায় ধর্মভীরু মানুষের এই দেশে তাঁর এই প্রকাশ্য ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রদান ভুল হতে পারে; কিন্তু তিনি যেহেতু রাজনীতি করতেন না এবং তাঁর যেহেতু ভোটের দরকার ছিল না, তার পক্ষে এই দুঃসাহসিক কাজ অবশ্যই জনকল্যাণমূলক। অতএব, প্রশংসার যোগ্য। জনকল্যাণমূলক এই কারণে যে, যাঁরা জন্ম থেকে অন্ধভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে, পৃথিবীতে এমন লোক আছে যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না এবং তাদের যেমন একটি ধর্ম আছে, এই অবিশ্বাসীদেরও তেমন একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে— এই তথ্যটি পৌঁছানো একটি বড় কাছ। কারণ এই তথ্যটি তাঁদের মনের একটি জানালা খুলে দিতে পারে, যে পথ দিয়ে হয়তো কোনদিন ধর্মের অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতার কারণে ধর্মবিশ্বাস উবে যেতেও পারে। কিন্তু মনের অন্তত একটি জানালা খোলা না থাকলে ধর্মীয় গাঢ় অন্ধকার পরিবেশে মানুষের মুক্তি ঘটবে কোন পথে? আর জনগণের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসকে অটুট রেখে একটি উন্নত প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রকৃত গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো সংঘাত নেই। অতএব, ড. আহমদ শরীফ তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে এদেশের ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভূত উপকার সাধন করে গেছেন। ভলতেয়ার স্কুল জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ধর্মের বিরুদ্ধে, ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুখে ও কলমে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন এবং একটি আধুনিক পৃথিবীর নির্মাণের ভিত্তি গড়ে গিয়েছিলেন, তেমনি ড. আহমদ শরীফও একটি উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন। ভলতেয়ার বা আহমদ শরীফের মতো মানুষের জন্ম যে কোনো জাতির জন্য চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এরকম মানুষের সংখ্যা পৃথিবী যত বেশি হয় ততই মঙ্গল।
(প্রবন্ধটি আহমদ শরীফ স্মারক গ্রন্থ ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’তে “অধ্যাপক আহমদ শরীফ: আমাদের ভলতেয়ার” শিরোনামে প্রকাশিত। প্রবন্ধটি লেখক কর্তৃক ইষৎ পরিবর্তিত)
———————————————————————————————————————————————
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]
Leave A Comment