শুরুতেই বলে রাখি, আমার এ লেখায় হারুন ইয়াহিয়া ও আরিফ আজাদের বই দুটোর কেবল বিবর্তন তত্ত্ব সংক্রান্ত অংশ নিয়েই সমালোচনা। আর শেষে থাকবে ন্যাচারাল সায়েন্সের সঠিক সংজ্ঞা। বই দুটির বাকি অংশে কি আছে না আছে সেগুলি এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়।

আরিফ আজাদকে অনেক আগে জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবীদের কুম্ভিলকবৃত্তি(!) নিয়ে বেশ সোচ্চার হয়ে কথা বলতে দেখেছিলাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নিজেই সেরকম কাজে লেগে গেলেন। যাইহোক, সেটা অন্য আলোচনা। ভদ্রলোকের বই পড়ে যতোটুকু বুঝলাম, তার কাছে বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই সৃষ্টিতত্ত্ববিদদের(creationist) এতোগুলা পক্ষপাতদুষ্ট বক্তব্য কিংবা চেরি পিকিং

গত বছর আরিফ আজাদের “আরজ আলী সমীপে” বইটার “বিবিধ” অধ্যায়েটা পড়ার সময়ই কেন যেন মনে হলো আরও কোথাও পড়লাম।

তারপর হারুন ইয়াহিয়ার ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত Miracles of The Quran বইটা খুলে দেখি সেটার শেষ অধ্যায়ের সাথে “বিবিধ” অধ্যায়টার ৫০%-ই নকল করলেন আরিফ আজাদ।

যেসব উক্তি হারুন ব্যবহার করলো, হুবহু সেগুলোই আরিফ আজাদও ব্যবহার করলো।  মিসিং লিংক এর পর অস্ট্রালোপিথেকাস এর আলোচনা, তারপর রেন্ডম মিউটেশনের আলোচনা—আলোচনাটার এই পর্যায়ক্রমিক ধারাটা পর্যন্ত হারুন ইয়াহিয়ার বইয়ের নকল(ছবিগুলি দেখুন)। অথচ, আরিফ আজাদের এই বইয়ের কোথাও হারুন ইয়াহিয়াকে ক্রেডিট দিতে দেখি নি। যেটা খুবই বাজে ব্যাপার। সে যাই হোক, বিবর্তনের মতো একটা প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে নিয়ে বিষেদগার করার এই হাস্যকর প্রচেষ্টাটাকে এই চৌর্যবৃত্তিটা আরও বেশি হাস্যকর করে তুলেছে। আশা করি, ভদ্রলোক ভবিষ্যতে স্বীকার করবেন, কোথা থেকে তাঁর রচনার “সিংহভাগ” ঠুকে নিয়েছেন।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, আরিফ আজাদের “আরজ আলী সমীপে” বইয়ের “বিবিধ” অংশটির চমৎকার ডিবাংক করেছেন এই ফিল্ডেরই গবেষক মঞ্জুরুল ইসলাম রিফাত।  আমি এখানে কেবল আরিফ আজাদের নকল করা চোখে ও পড়ার মতো অংশগুলি তুলে ধরলাম। একই সাথে ডিবাংক লিখলাম।

এ লেখাটির উদ্দেশ্য

তাদের তুলে ধরা এই দাবিগুলি বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে তোলা জনপ্রিয় কিছু দাবি। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব দাবি খন্ডন করার মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণাটা পাঠকদের কাছে পরিষ্কার করা।

চলুন, ঢুকে পড়া যাক।

১. মিসিং লিংক কি নেই?

এখানে প্রায় ২০০ বছর আগে চার্লস ডারউইনের On the Origin of Species by Means of Natural Selection বইয়ে ডারউইন এর মিসিং লিংক খোঁজা সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে আরিফ আজাদ(হারুন ইয়াহিয়া) দেখাতে চেয়েছেন, মিসিং লিংক বা ট্রানজিশনাল ফসিল কিচ্ছুই পাওয়া যায় নি আজ পর্যন্ত।

বিবর্তন তত্ত্ব বিরোধী কোনো বই খুললে আপনি যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি পাবেন, সেটা হচ্ছে, “ট্রানজিশনাল ফসিল নেই“—এ নিয়ে যেন তারা এই প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলেছেন। সত্তুরের দশকে প্রকাশিত হওয়া মওলানা আব্দুর রহীম এর “বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব” বইয়ে লেখককে দেখলাম মিসিং লিংক না থাকার দাবি তুলেছেন। ২০০১ সালে হারুন ইয়াহিয়ার বইয়েও সে দবি, ২০১৮ তে আরিফ আজাদও পুরোনো প্রলাপ গাইলেন। লক্ষ করে দেখুন, এই ভদ্রলোকেরা একটা অন্য জগতে বাস করেন। যে জগতে ১৮ শতকের পর আর কোনো সময় এগোয় নি।  তারা বোধহয় জানেন না, পৃথিবী আর আমাদের বিজ্ঞান কতোটা এগিয়ে গেলো। জানেন না, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান কতোটা সমৃদ্ধ।

মজার ব্যাপার কি জানেন? বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণের একটা হচ্ছে আমাদের সংগ্রহে থাকা বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপের ফসিল বা জীবাশ্ম রেকর্ড। শুধু তাই না। একদম শুরু থেকেই জীবশ্ম রেকর্ডই ছিলো বিবর্তন তত্ত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণের একটা। এখন আমরা আণবিক পর্যায়েই বিবর্তনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ প্রমাণগুলি পেয়ে যাই। কিন্তু, আগে সে উপায়টা ছিলো না। মানুষের বিবর্তনেরও যে ধাপে ধাপে অনেক প্রজাতির নাম শোনা যায়। তাদের প্রত্যেকের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে বলেই নামগুলি পেয়েছি আমরা। কেউ হুটহাট করে এসব নাম বানায় না। আসলে, কোনো গণ কিংবা প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়ার আগে তার নামকরণ করা সম্ভব নয়। যেমন ধরুন, অস্ট্রালোপিথেকাসের জীবাশ্ম পাওয়া যায় আফ্রিকার দক্ষিণে। তাই এর নাম দেয়া হয়েছে Southern Ape যেটাকে ল্যাটিনে বলে অস্ট্রালোপিথেকাস ।

এমনি ভাবে নাম দেয়া হয়েছে সব জীবাশ্মের। হোমো ইরেক্টাসের নাম দেয়া হয়েছে, কেবল তারা “সোজা” হয়ে দাঁড়াতো পারতো বলে। নিয়ান্ডার উপত্যকায় পাওয়া হোমো গণের মানুষের প্রজাতিটির নাম দেয়া হয়েছে হোমো নিয়ান্ডারথ্যালসিস(নিয়ান্ডার উপত্যকার মানুষ)। ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে পাওয়া ৩ ফুটের বামন মানুষ প্রজাতিটিকে নাম দেয়া হয়েছে হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস বা ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ। ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসের আগে আমরা কেউ জানতাম না, এই প্রজাতির কোনো মানুষ থাকতে পারে।

যখন বিভিন্ন গবেষণা, হিসেব নিকেশের পর বলা হলো, টেট্রাপডরা মাছ থেকে এসেছে, তখন বিবর্তন বিরোধীদের আবদার হলো, সেই ‘মিসিং লিংক’ দেখাতে। টেট্রাপড আর মাছের এমন এক মধ্যবর্তী অবস্থা, যা দেখে সত্যিই বোঝা যাবে, টেট্রাপডদের পূর্বপুরুষেরা মাছ ছিলো। পাওয়াও গেলো সেরকম ট্রানজিশনাল ফসিল। ২০০৬ সালে ট্রানজিশনাল ফসিল আবিষ্কার এক যুগান্তকারী মোড় নেয়। অনেক সমস্যা ও দ্বিধার অবসান ঘটায় Tiktaalik এর আবিষ্কার। বিশ্ববিখ্যাত জীবাশ্মবিদ ও ফিলাডেলফিয়ার একাডেমি অব ন্যাচারাল সায়েন্সের এসোসিয়েট কিউরেটর টেড ড্যাসচলার, নীল শুবিন ও তাঁর সহকর্মীরা কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের কঠিন পাললিক শিলার আস্তরে খুঁজে পান মাছ এবং টেট্রাপডদের মধ্যেকার এই ট্রানজিশনাল ফসিলকে। এই জীবাশ্মটি ছিলো তিন ফিট লম্বা, রে-ফিন মাছের মতো পাখাযুক্ত ও এর মাথাটা দেখতে অনেকটা কুমিরের মতো। এই Tiktaalik এর শরীরে বিশেষ ধরণের শক্ত হাড় ছিলো যা দিয়ে সে অগভীর পানিতে পাখাকে(fin) লাঠির মতো অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করতো।

(তথ্যসূত্র: A Devonian tetrapod-like fish and the evolution of the tetrapod body plan. Edward B. Daeschler, Neil H. Shubin & Farish A. Jenkins Jr. | Nature. volume 440, pages757–763 (2006).)

শুধু তাই না, বিভিন্ন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জানা গেলো পাখিরা এসেছে ডানাওয়ালা মাংসাশী থেরোপড ডাইনোসর থেকে।

এখন, পাখি ও ডায়নোসরের মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এমন ফসিল পাওয়া গেছে কি?

জ্বী, পাওয়া গেছে। ডারউইন বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার আগেই জার্মানিতে পাওয়া গেছে আর্কিওপটেরিক্স। তারপর একে একে পাওয়া গেছে এমন আরও ট্রানজিশনাল ফসিল। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ফসিল হচ্ছে:

গত কয়েক দশকে ফসিল রেকর্ড এতোটাই সমৃদ্ধ হয়েছে যে, এটাকে কারোর অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই।  এ লিংকে যেয়ে ফসিল সংগ্রহের বিশাল ভান্ডারে চোখ বুলিয়ে আসতে পারেন। 

বিবর্তন নিয়ে ন্যূনতম পড়াশোনা করেছেন, এমন যেকেউ স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট এর নাম শুনেছেন। ১৭৪ বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিবর্তন গবেষণার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের একটা৷ তাদের সাইটে গিয়ে ফসিলের দুনিয়া থেকে ঘুরে আসুন। আজ অবধি পাওয়া অসংখ্য ফসিলের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের—কি বললাম? ছয় হাজার ট্রানজিশনাল ফসিলের নামকরণ করা হয়েছে। সেই স্পঞ্জের সময় থেকে, LECA, অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো ইরেক্টাস পেরিয়ে আজকের মানুষ অবধি আসার এই বিশাল যাত্রাপথের প্রায় সব পর্যায়ের ফসিল পাওয়া গেছে। পড়ে আসুন। চিন্তা খুলুক।

দ্বিধার ঘোর তাও না কাটলে, টক অরিজিনের এই লিংকটায় যেয়ে দেখে আসুন আমাদের ফসিল ভান্ডার  বিবর্তনের রূপরেখা কতো নিখুঁতভাবে স্পষ্ট করেছে

অতি সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত হওয়া একটা একটা সন্ধানের খবর জানানোর প্রয়োজনবোধ করছি। হোমো ইরেক্টাসের খুব কাছের আত্মীয় প্যারানথ্রোপাস রোবাস্টাসের এক পুরুষ সদস্যের ২০ লক্ষ বছর আগের খুলি পাওয়া গিয়েছে কয়েক মাস আগেই। সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের যে অঞ্চল থেকে এ ফসিলটি পাওয়া গিয়েছে, সেই একই অঞ্চল থেকে আজ থেকে ৫ বছর আগে আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ, হোমো ইরেক্টাসের এক শিশুর খুলির ফসিলও পাওয়া গিয়েছিলো

এ ব্যাপারে যাবতীয় কৌতূহল মেটাতে ঘুরে আসুন ন্যাচার জার্নালের এই পেইজ থেকে।

ফসিল রেকর্ড যে বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তি মজবুত করতে আজ অবধি কতোটা শক্তিশালী প্রভাব রেখে যাচ্ছে বা রাখবে, তা নীচের দেয়া লিংকগুলিতে ক্লিক করে আর্টিকেলগুলি পড়ে আসতে পারেন:

২. সলি জাকারম্যান আর অক্সনার্ড অস্ট্রালোপিথেকাসের ব্যাপারে কতোটা ঠিক ছিলেন?

এখানে আরিফ আজাদ(হারুন ইয়াহিয়া) সাহেব সলি জাকারম্যানের গবেষণা ও অক্সনার্ডের গবেষণা দেখিয়ে মোটাদাগে বলতে চাচ্ছেন, মানুষের পূর্বপুরুষ অস্ট্রালোপিথেকাস না। অস্ট্রালোপিথেকাস গণের প্রাণিরা একপ্রকার শিম্পাঞ্জিই।

এখানে গবেষণা হিসেবে দুটো রেফারেন্স টেনেছেন। সলি জাকারম্যান আর অক্সনার্ডের। লক্ষ করুন, ৭০ এর দশকের একটা গবেষণা দিয়ে আরিফ আজাদরা(হারুন ইয়াহিয়া) কিভাবে সিদ্ধান্তে চলে আসে জানি না। উনাদের জগতে কি সময় খুব ধীরে বয়ে চলে? দৈত্যাকার আর অতিভারী কোনো কৃষগহবরের পাশের কোনো গ্রহে থাকেন? যেখানে সময় ধীরে চলে?

সেই ৫০ বছর আগে আর আজকের পুরো ফসিল প্যারাডাইম পরিবর্তন হয়ে গেছে।

আপনি রাদারফোর্ডের ত্রুটিযুক্ত সোলার সিস্টেম এটম মডেল  দিয়ে পুরো কোয়ান্টাম মেকানিক্স কে “ভাঁওতা” বললে কেমন দেখাবে ব্যাপারটা?

প্রথমত, সলি জাকারম্যানের সময়ে ফসিল রেকর্ড, মলিকিউলার পর্যায়ে অগ্রগতি—সবই খুব কম ছিলো। সলি জাকারম্যানের কর্মপদ্ধতি ছিলো “ম্যাট্রিকাল এবং স্ট্যাটিস্টিকাল এপ্রোচ”… এভাবে বিবর্তনীয় গবেষণায় কখনোই নিখুঁত ফলাফলে আসা সম্ভব হয়নি। এর কিছু পরেই সলি জাকারম্যানের এ গবেষণা বাতিল হয়ে যায়

শুধু তাই না, পরবর্তীতে যখন রেমন্ড ডার্টের পাওয়া Taung Child ফসিলকে অস্ট্রালোপিথেকাসের ফসিল হিসেবে সর্বজনবিদিত ভাবে গৃহীত হয়, তখনও এক প্রকার গায়ের জোরে জেদ করেই এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক সলি জাকারম্যান তা মেনে নেন নি। তিনি জেদ বসত এ কথা বলেই কফিনে শুয়েছেন, “They are just bloody apes!”

(Lewin, Roger (1987), Bones of Contention: Controversies in the Search for Human Origins, Chicago: The University of Chicago Press, page-165)

এর পরের গল্প অস্ট্রালোপিথেকাস গবেষণার ইতিহাসে বর্ণাঢ্য। একে একে আসতে থাকে লুসি সহ শত শত ফসিল। এই পোস্ট লেখার কয়েক মাস আগেও পাওয়া গেছে সর্বশেষ একটা। উপরে বলা হয়েছে। না পড়লে, পড়ে আসুন।

কথা হচ্ছে, গুগলে খোঁজ চালিয়ে ইংরেজি নামওয়ালা কারোর কোনো গবেষণা নিজের মতের সাথে মিল পেলেই সেটাকে বইয়ে সেঁটে দেয়ার এই অভ্যাস বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধী ধূর্ত লেখকদের মধ্যে খুব সাধারণ। তারা একটুও ঘেঁটে দেখবে না, সেই গবেষণার ভূত–ভবিষ্যৎ কি ছিলো।

এখানে, অক্সনার্ডের গবেষণা ছিলো মাল্টিভ্যারিয়েট এনালাইসিস আর সিমুলেশন নির্ভর। অনেক কমপ্লেক্স ফ্যাক্টরই তিনি আমলে নেন নি। এমন গবেষণার ফলাফলও আমলে নেয়ার দরকার নেই তেমন। তাছাড়া, অক্সনার্ড সাহেবের পৃষ্ঠপোষক ছিলো সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরাই। তার পেপারগুলিও তাদেরই দ্বারাই সাইট করা হয়।

এসব গবেষণার ফলাফল আজকের এই প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে৷ যেগুলি আরিফ আজাদ কিংবা হারুন ইয়াহিয়ারা কিছুই জানেন না। বুঝেন না।

ফসিল রেকর্ড, জিনোম রেকর্ড থেকে আজকের প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা গুলি আপনাকে জানাই— অস্ট্রালোপিথেকাসের চোয়ালের হাড় আধুনিক শিম্পাঞ্জির বৈশিষ্ট্য বহন করে। অথচ, দাঁতের গঠন মানুষের মতো। হাঁটতো দুই পায়ে ভর করে। এরাই শিম্পাঞ্জি আর মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষ।

তথ্যসূত্র: 

আরও জানতে ন্যাচারের এই আর্টিকেলটাও পড়তে পারেন।

৩.  মিউটেশনের মাধ্যমে কি প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে না!?

এখানে আরিফ আজাদ বা হারুন ইয়াহিয়া বি.জি. র‍্যাঙ্গানাথান (B.G. Ranganathan) এর রেফারেন্স টেনে মিউটেশনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যাপারটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়েছেন। সত্যি বলতে, আপনি নিশ্চয়ই ১৯৭১ এর ইতিহাস জুলফিকার আলীর ভুট্টোর জবানীতে শুনে পুরোটা ব্যাপারটা বিচার করতে যাবেন না!

কথা হচ্ছে, উগ্রপন্থি খ্রিস্টান সংগঠনের স্থাপিত বব জনস ইউনিভার্সিটি থেকে বাইবেল স্টাডিজে  স্নাতক করা এই র‍্যাঙ্গানাথান এর বক্তব্য কিভাবে বিবর্তন তত্ত্বকে অস্বীকার করার হাতিয়ার হতে পারে?

ব্যাপারটা ফ্ল্যাট আর্থারদের দিয়ে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান ব্যখ্যার মতো।

লেখকদের এভাবে যার তার বক্তব্য গ্রন্থবদ্ধ করার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, এ ব্যাপারে তাদের পর্যাপ্ত পড়াশোনা না থাকা। তাই কেবল তাদের মতামতের সাথে মিলে যাওয়া এমন এক বিভ্রান্তিকর বক্তব্যকেই বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করি চলুন, দেখা যাক মিউটেশন কিভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাতে পারে।

মডার্ন সিন্থেসিসের ভিত্তি হচ্ছে মিউটেশন। এর শুরুটা মোটামুটি ১৮৯৬ সালেই। অগাস্ট ভাইজম্যান সে বছর তাঁর জার্মপ্লাজম-সোমাটোপ্লাজম(Germplasm-Somatoplasm) তত্ত্বে উল্লেখ করেন যে, জীবের জননাঙ্গে অবস্থিত জননকোষে থাকে জার্মপ্লাজম, আর দেহের অবশিষ্ট কোষে থাকে সোমাটোপ্লাজম। প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে মূলত জীবের জার্মপ্লাজম স্তরে। জীবনের প্রজননের সময় জনন কোষে ঘটা মিউটেশনের কারণেই প্রকরণের(variation) উদ্ভব ঘটে। এর ফলে সৃষ্টি হয় নতুন প্রজাতির।

ব্যাপারটাকে আরও সহজ করে উদাহরণ সহ দেখানো যাক।

জীব মাত্রই তার জননকোষে কোষ বিভাজন ঘটবে, ডিএনএ-র রেপ্লিকেশন ঘটবে। আর রেপ্লিকেশনের সময় প্রুফ রিডার এনজাইম সবসময় সঠিকভাবে প্রুফ রিড করতে পারে না। বেস পেয়ার কপিতে ছোটো একটা ওলটপালটের জন্য প্রাণির পুরো দেহেই কোনো না কোনো পরিবর্তন চলে আসে। জীব মাত্রই তার মধ্যে সদা বিরাজমান থাকবে এ প্রকৃয়া। ডিএনএ প্রুফ রিডিং-এ ভুল হবেই। এতে মিউটেশন ঘটবেই।

মেরু এলাকার ধবধবে সাদা ভাল্লুকদের কথাই ধরুন না।

অনেক অনেক কাল আগে। কিছু বাদামী বর্ণের ভাল্লুক উত্তর মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে দেখা গেলো কোনো এক ভাল্লুক শাবকের জন্মের সময় সে একটা ব্যতিক্রম রূপ নিয়ে জন্ম নিলো। তার জন্মের সময় ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় ছোট্ট কোনো ভুল অনুলিপির জন্য এ পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ মিউটেশন ঘটে। যার গায়ের রঙ তার বাবা মায়ের তুলনায় তুলনামূলক সাদা। এতে করে সে একটা বাড়তি সুবিধা পেলো। তার পশমের রঙ সাদা থাকায় সাদা বরফাচ্ছাদিত এলাকায় তাকে শিকার-রা দূর থেকে শনাক্ত করতে পারতো না। ফলে, শিকার পালাবার আগেই শিকারকে ধরে ফেলা যেতো। মিউটেশন থেকে পাওয়া এ সাদা লোম ঐ এলাকার জন্য সুবিধাজনক। এই বৈশিষ্ট্যই ওদের জেনারেশন থেকে জেনারেশন ছড়াতে থাকলো। এর ফলে দেখা গেলো, সাদা ভাল্লুকেরা সে অঞ্চলে বেশি শিকার করতে পারছে।

আর বাদামি ভাল্লুকরা সাদা বরফাচ্ছাদিত এলাকায় শিকারের চোখে ধরা পড়ে শিকার হারাচ্ছে। হাজার হাজার বছর যায়, সাথে বিলুপ্ত হতে থাকে বাদামিরা৷ সেই অঞ্চলে টিকে যায় সাদা ভাল্লুকেরা।

আজ থেকে ৭০,০০০ কি ১৫০,০০০ বছর আগে এই সাদা ভাল্লুকেরা ভিন্ন পরিবেশে ভিন্নভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। এর ফলাফল কি জানেন?

এই দুই রঙের পশমের ভাল্লুকেরা আর পুরোপুরি একই প্রজাতিতে নেই। আজকের দিনে সাদা ভাল্লুকেরা বাদামি ভাল্লুকের উপপ্রজাতি। এই পৃথিবীতে সাদা ভাল্লুকেরাও আছে, তাদের পূর্বপুরুষ, বাদামি ভাল্লুকেরাও টিকে আছে।

এব্যাপারে মজুদ আছে অসংখ্য গবেষণা, প্রমাণাদি:

এভাবেই মিউটেশনের মাধ্যমে প্রকরণ তৈরি হতে হতে একসময় উৎপত্তি ঘটে নতুন প্রজাতির। এই মিউটেশনের কারণেই পরিবেশ থেকে বাদ পড়ে, বিলুপ্ত হয়। কিংবা কখনও মিউটেশনের সুবিধাজনক ফলাফল সেই পরিবেশে আরও ভালো করে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, কোনো প্রাণিতে একটা মিউটেশানের ফলাফল সেই পরিবেশে টিকে থাকার মতো হলে ঐ পরিবেশের জন্য সেই মিউটেটেড প্রাণিটা টিকে থাকার যোগ্য। আর ফলাফল যদি সে পরিবেশে টিকে থাকার মতো না হয়, তাহলে সে টিকে থাকার মতো যোগ্য হতে পারবে না। বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

পোলার ভাল্লুকদের ব্যাপারটাই দেখা যাক না—এদের মধ্যেই হয়তোবা মিউটেটেড হয়ে কারোর জন্ম হয়েছে খুব কম পশম নিয়ে। ঠান্ডায় মারাও গেছে। কেউ জন্মেছে একটু সাদা রঙের বেশি পশম নিয়ে। তারা সুবিধা পেয়েছে। শেষ কথা হচ্ছে, কোনো প্রাণিতে মিউটেশনের ফলাফল সেই অঞ্চলের আবহাওয়া জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো হলেই সে প্রাকৃতিক ভাবে নির্বাচিত। মিউটেশন থেকে প্রাপ্ত এই সুবিধাজনক গুনাবলি স্থানান্তরিত হয় বংশপরম্পরায়।

মিউটেশন কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে,  এ সংক্রান্ত বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য সাইট থেকে কিছু গবেষণা আর আর্টিকেল পড়তে পারেন:

৪. Punctuated Equilibrium ও লেখকদ্বয়ের অজ্ঞতা

এখানে, এক প্রজাতির  হঠাৎ বিলুপ্তি, অন্য প্রজাতির দ্রুত বিস্ফোরণের ব্যাপারটাকে  হারুন ইয়াহিয়া এবং তার লেজ ধরে আরিফ আজাদ সাহেবও বিবর্তন তত্ত্বের সমস্যা হিসেবে মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছেন।

দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, তাদের পক্ষে Punctuated Equilibrium এর ব্যাপারে সম্ভবত পড়াশোনা করা সম্ভব হয় নি। তাই তাদের কাছে এটা বিবর্তনের সমস্যা।

সাধারণত, অনেক লম্বা সময় ধরে জীবে ঘটা মিউটেশনের কারণে পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সিলেকশানের মাধ্যমে খুব ধীর গতিতে প্রজাতির পরিবর্তন ঘটার এই ব্যাপারটাকে বলে Gradualism 

আবার, বিবর্তন আরেক ভাবেও হয়। সেখানে কিছু সময় ধরে প্রজাতির কোনো পরিবর্তন হয় না—স্থির থাকে। তারপর হুট করেই বড় রকমের পরিবর্তন চলে আসে। এরপর আবারও কিছু সময় ধরে স্থির থাকে। এভাবে করে চলতে থাকে বিবর্তন। একে বলে Punctuated Equilibrium । হঠাৎ করেই বড়সড় পরিবর্তন চলে আসায় Gradualism এর মতো এক্ষেত্রে অজস্র মধ্যবর্তী প্রজাতি পাওয়া যায় না।

গ্রেজুয়ালিজম এবং পাংচুয়াল ইকুইলিব্রিয়াম, এই দুইভাবেই বিবর্তন হয়। এই ব্যাপারটাকে কেন ইভোলিউশনের সমস্যা হিসেবে চালিয়ে দিলেন আরিফ আজাদরা, সেটা ভাবার বিষয়।

তথ্যসূত্র:

(এই সাইটে ঢুকতে ভিপিএন ব্যবহার করা লাগবে)

 ৫. বিজ্ঞান কেন অলৌকিকতা কে প্রশ্রয় দেয় না?

এ অংশটা বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে না যদিও। তাই শেষে রাখলাম। তবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লিওনটিনের এই বক্তব্যটার বিভ্রান্তিমূলক উপস্থাপনা করা হয়েছে।

উনার বক্তব্যের সার হচ্ছে, বিজ্ঞানে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সেখানে কোনো অলৌকিকতা, প্রাচীন আসমানী চিন্তাভাবনার স্থান নেই। সঠিক প্রমাণাদি ও যুক্তির মাধ্যমেই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটা আপনার চিরাচরিত চিন্তাভাবনার সাথে যায় কিনা, সেটার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হবে না।

যেমন ধরুন, হাইড্রোজেন সহ অন্যান্য পরমাণুর বর্ণালীর ব্যাখ্যা দিতে বোর ইলেকট্রন সমূহের কোয়ান্টাম জাম্পের কথা বলেন। পরবর্তীতে ব্যাপারগুলির যতো গভীরে ঢোকা হয়েছে, ততোই কমন সেন্স বিরোধী মনে হয়েছে। উদ্ভট মনে হয়েছে প্ল্যাংক স্কেলের নীচে থাকা এই কোয়ান্টাম জগতের নিয়মগুলিকে । এখানে কখনোই কোনো বিজ্ঞানী অলৌকিকতার হস্তক্ষেপ আছে বলে বিশ্বাস করে থেমে থাকেন নি। এতে করে বিজ্ঞান ও অগ্রগতি সবই থেমে যাবে। উইকিপিডিয়ায় উঁকি দিলে ন্যাচারাল সায়েন্সের সংজ্ঞা পাবেন—

Natural science is a branch of science concerned with the description, prediction, and understanding of natural phenomena, based on empirical evidence from observation and experimentation. Mechanisms such as peer review and repeatability of findings are used to try to ensure the validity of scientific advances.

সবশেষে লেখকের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চটকদার কথাবার্তা লিখে মানুষকে বিপথে নেয়ার আগে আপনাদের প্রচুর পড়াশোনা করা উচিত। জানা উচিত, আসলেই কোনটা প্রমাণসিদ্ধ, কোনটা বাস্তবতাকে ব্যখ্যা করে; জানা উচিত, কিভাবে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলি চূড়ান্ত হয়। আপনাদের বিস্তর পড়া উচিত রিসার্চ মেথোডলজির ওপর। আশা করি, ভবিষ্যতে বেশ ভেবে চিন্তে কুম্ভিলকবৃত্তি মুক্ত বই উপহার দিবেন আরিফ আজাদ।