১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি ঢাকা মুসলিম সাহিত্যসমাজের প্রথম বার্ষিকী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কাজী আব্দুল ওদুদ “বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সমস্যা” শিরোনামে একটি নিবন্ধ পড়েন। কাজী আনোয়ারুল কাদীর পড়েন “বাঙালি মুসলমানের সামাজিক গলদ” শীর্ষক একটি অত্যন্ত তীব্র সমালোচনামুলক যুক্তিরৃদ্ধ প্রবন্ধ। কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা থেকে এসে ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় অধিবেশনের শেষলগ্নে তিনি সম্মেলন সম্পর্কে চমৎকার বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন:

“আজ আমি এই মজলিসে আমার আনন্দবার্তা ঘোষণা করছি। বহুকাল পর কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখছি এখানে মুসলামানের নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটি কথা- এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্ত আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে মৌঃ আনোয়ারুল কাদীর প্রমুখ কতগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের, এর চেয়ে বড় শান্তনা আর আমি চাই না।” [মুক্তবুদ্ধির চর্চা, কবীর চৌধুরী, পৃঃ ১৪]

কবি নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লক্ষ করছি, যে যার বিশ্বাস-দর্শণ অনুযায়ী কবিকে তুলে ধরছেন, উপস্থাপন করছেন!

কেউ বলছেন, তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট, বলছেন সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী, কিন্তু তিনি মাকর্সবাদী ছিলেন না ইত্যাদি!

আবার কেউ বলছেন তিনি ছিলেন নাস্তিক, কেউ বলছেন তিনি ছিলেন আস্তিক,

কেউ বলছেন তিনি ছিলেন হিন্দু কেউ বলছেন তিনি ছিলেন মুসলমান!

কেউ বলছেন তিনি ছিলেন বাঙালি, কেউ বলছেন ভারতীয়!

যে যাই বলছেন, সবাই তার স্বপক্ষে কিছু না কিছু কাজ, প্রমান, বক্তব্য দেখাতে পারবেন, কোন সন্দেহ নেই,

কিন্তু তার বিরুদ্ধ ভাবনা, চিন্তা, কর্ম, দর্শণ, কাব্য, গীতি, সাহিত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না!

 

নজরুল নিজেও কখনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল-দর্শণের পক্ষে ধারাবাহিক ছিলেন না! এ বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলেনও নি এবং তার সেই বক্তব্যে তিনি কখনোই স্থিত/অটল থাকেন নি।

তিনি ইসলামের পূর্ণজাগরণের পক্ষেও লিখেছেন আবার ধর্মান্ধতা-মতান্ধতার বিপক্ষেও প্রচন্ড সরব ছিলেন! তিনি আজান নিয়ে লিখেছেন, উলুধ্বনি নিয়েও লিখেছেন! তিনি সুর-অসুর, প্রেম ও অপ্রেম সবই লিখেছেন! তিনি বাঁধনও নিয়ে লিখেছেন ছন্নছাড়াও নিয়েও লিখেছেন!

তিনি হা’মদ-না’দ লিখেছেন আবার শ্যামা সঙ্গীতও লিখেছেন! তিনি কালির চরণে লুটিয়েও পরিণু লিখেছেন আবার ভগবানের বুকে পদচিহ্নও এঁকে দিয়েছেন! তিনি বিদ্রোহের কবিতা লিখেছেন আবার প্রশান্তির কাব্য রচন করেছেন। যিনি নিজেকে আস্ত কাফের দাবী করেছেন, আবার মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই তাও বলছেন!

এ বিষয়ে বন্ধুবর চীর রঞ্জন সরকরের মন্তব্য আমার ভাল লেগেছে, তার মতে, “নজরুল মানুষটা ধর্মকর্ম খুব একটা মানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিয়ে করেছেন জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে। কবিতায় লিখেছেন, ‘বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি |।’ বলেছেন, ‘স্রষ্টারে আমি চুষে খাই !…. ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!’ বলেছেন, ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।’ তিনি ভজন লিখেছেন, কীর্তন লিখেছেন। লিখেছেন গজল।

আমরা নজরুলকে বুঝলাম আমাদের মত করে। আমরা ভুলে গেলাম নজরুলের সেই মহান বাণী, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাই কিছু মহীয়ান।’

আমরা ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’-এই কথাটিকেই নজরুলের একমাত্র ‘আদর্শ’ হিসেবে চালালাম।

নজরুল সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা ব্যক্তি যার চিন্তা-চেতনা-আদর্শকে অনেক বেশি ভুল বোঝা হয়েছে, ভুল ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে।”

 

২০২১ এর ডিসেম্বর মাস হবে কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার একশো বছর পূর্ণ হবে। কলকাতার একটি বাড়িতে বসে মাত্র ২২ বছর বয়সে কবি কাঠ পেন্সিলে লেখেন এই অমর কবিতা খানি। শুধু এই একটি লেখার কথাই বলি, গত একশো বছরেও আমরা বাঙালিকে তাঁকে ধারণের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠতে পারিনি। যে কারণে নজরুল হয়ে আছেন অন্ধের হাতি আর অন্ধের চশমায় দেখার দর্শণে।

বল বীর –

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

বল বীর –

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!

 

সে কারণে বলছি. প্রচলিত অর্থে কবি নজরুলের কোন নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ছিল না! তিনি ছিলেন মানবতার কবি এবং ব্যক্তি হিসেবে মানবতাবাদী! তাঁকে যারা কোন দল, দর্শন ও তরিকার মধ্যে ফেলে যে যার দলে টানতে চাইছেন, তারা ভুল করছেন! তিনি ছিলেন মুক্ত মানুষ, মুক্ত কবি। এটাই আসলে একজন কবির উত্তম গুণ যিনি নিজেকে ভেঙ্গে নিজেকে তৈরী করেন, নিজের বিপক্ষে নিজেকে দাড়া করান! এটাই ছিল নজরুল, তিনি ছিলেন যুগ সন্ধিক্ষনের কবি! তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ছিল না! তিনি ছিলেন মানবতার কবি, শৃংখল মুক্তির কবি, প্রতিবাদী কবি..!

কিন্তু ধর্মান্ধদের কথা শুনে মনে হয় বলি,

নজরুল তুমি করিয়াছ ভুল, রাখ নাই দাড়ি রখিয়াছ চুল!

শতত শ্রদ্ধাঞ্জলি কবি..

——————————————————————

ডঃ মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।