সূর্য ওঠে নাকি ডোবে।।
প্রশস্ত এক রাস্তা ধরে রিক্সা দিয়ে এগিয়ে গেলেও মিনিট বিশেক লাগে পৌঁছতে। জায়গাটা পতেংগা সমুদ্র সৈকতের নিকটবর্তী জেলে পাড়ার কাছে; খাড়ির মতো একটা জায়গা; মাঝে মাঝে হাওয়া এসে কেমন এলোমেলো করে দেয়। যেখানে অজস্র জেলে নৌকা ভাটায় দাড়িয়ে থাকে আর জোয়ারে চলে যায় সমুদ্রের গভীরে, মাছ ধরতে। রাস্তার কিছুটা প্রারম্ভে চট্টগ্রামে কাট্টলী সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। বিজ্ঞান বক্তৃতা (কসমিক ক্যালেন্ডার বিষয়ে) করতে হয়েছিলো ৬ষ্ঠ শ্রেনী থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাঝে। সময়টা ছিল সকাল ১১টায়, ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল। খোলা মাঠে রোদের মধ্যে অনুষ্ঠানটি হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া তেমন কাজে আসেনি। তবে অনুষ্ঠানটি ভীষণ প্রাণবন্ত হয়েছিল। অনেক ধরনের প্রশ্ন আমার দিকে ছুড়ে মেরেছিল তারা। বক্তৃতা পর বিকেলে আমি যখন জেলে পাড়ায় নৌকাগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের শেষ আলোর চলে যাওয়া দেখছিলাম, তখনই শিক্ষার্থীদের করা অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন আমাকে ঘিরে ধরেছিল; যেন পিথাগোরীয় সময়ের আবেগ আর ঈজিয়ান সাগরের ঢেউ, লাল আভায় মোড়ানো এক পৃথিবী।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়া এক শিক্ষাথী প্রশ্ন করেছিল: তুমি বলছো সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘোরে আর এই কথাটি বলার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের ওপর নির্যাতন চলেছে, জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছে, অথচ আজও আমরা যখন বলি সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে; তাতো এই কথাই বলে সূর্যের চারিদিকে নয়, পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘোরে। আমি চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি; অনুভব করি বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনকে সাধারণের কাছে পৌছে দেওয়ার ব্যাপারে পৃথিবীর সংস্কৃতিগুলোর ব্যর্থতা। কেননা এখনও সেরকম বাক্যবিন্যাস আমাদের অভ্যাসে আনতে পারেনি যার অর্থ হবে, ‘সূর্যের চারিদিকেই পৃথিবী ঘোরে; বুঝতে পারবে প্রতিদিন সূর্যের মুখোমুখি হই, ১২ ঘন্টা কাটিয়ে সূর্য থেকে সরে গিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করি, ১২ ঘন্টা পরে সূর্যের মুখোমুখি হয়ে দিনের আলোর মুখোমুখি হই’। অথচ এটাই ছিল কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যাওয়ার অভিযাত্রা। শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা থেকে সরে গিয়ে সবার একজন হয়ে ওঠার যাত্রা।
সবার একজন হয়ে ওঠার যাত্রা মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুও তার স্মৃতিকথায় বলেছেন
সমুদ্রের পাড়ে দাড়িয়ে আমি যেন ঢেউ গুনছিলাম, নতুন করে বেড়িয়ে পড়ার জন্য। সাংস্কৃতিক দর্শনের অগ্রপথিক ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এই কথাগুলোর এক ধরনের প্রারম্ভিক সূচনা ঘটায়। ২০০৭ সালে নালন্দার সঙ্গে সংযুক্তি আমাকে শিশুশিক্ষা নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শুনেছিলাম নালন্দা এক ধরনের প্রকৃত ঘনিষ্ট করে শিশুদের বড়ো করে তুলতে চায়, বুঝেছিলাম মাঠহীন, গাছহীন কংক্রিটে মধ্যে কাঠানো শৈশবকে মুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা। ভালো লেগেছিল। কিন্তু কালচারালি ইন্টগ্রেটেড কথাটার কোনো মানে খুজে পাচ্ছিলাম না, যদিও জীবন বিকাশের নতুন কোনো প্রচেষ্টার একটা ইঙ্গিত ওয়াহিদুল হকের কন্ঠেও আমি শুনেছিলাম। দূর্ভাগ্য বলতে হবে এগুলো স্পষ্ট হওয়ার আগেই উনি প্রয়াত হন।
একটা স্কুল আসলে কী। কিভাবে এরমধ্যে দিয়ে একটি শিশু তার জার্নিটা শুরু করবে? অর্থনৈতিক লাভক্ষতির গুটি হিসেবে বড়ো না হয়ে যাতে সে মানব সাগরের তীরে পৌছতে পারে? একটা বিষয় আমার কাছে সব সময় পরিস্কার ছিল, শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা জাহির করার জায়গাগুলো থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে না-শিক্ষা, না-সমাজ মানবিক হয়ে উঠবে। শ্রেষ্ঠত্ব হলো কেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টা আর সবার একজন হয়ে ওঠা হলো বিকেন্দ্রীকরণের পথ, মানবিকতার পথ। মস্তিষ্কের গভীরে এই কেন্দ্রীকরণের বিষয়টি প্রোথিত। বিবর্তনে উদ্ভুত এই অংশের অসংগতিগুলোকে দূর করতে না পারলে – যেই ক্ষমতার শীর্ষে যাক, যেই রাজা বা রাস্ট্র প্রধান হোক তাতে কিছু আসে যাবে না। প্রচলিত একটা প্রবাদতো আছেই, যে যায় ‘লঙ্কায় সেই হয় রাবন’। তখনই লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাকে যুক্ত করার তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হতে থাকে।
এর অর্থ হচ্ছে অতীতে মানুষের যে জীবনযাপন যার কারণে আমরা এতদূর এসেছি তা সংগঠিতভাবে শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা। তাই হচ্ছে কালচারালি ইন্টেগ্রেশন বা সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্তকরণ বা জোড়াহীন এক পথ। মস্তিষ্কের অসংগতিগুলোকে দূর করার একটা উপায়ও। তাই আইনস্টাইনও ১০০ বছর আগে বলে গেছেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে সর্বাধিক জ্ঞান পৌছে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে ব্যবহার করার চেয়ে বরং স্কুলের তরুণদের মধ্যে সেসব গুণ ও দক্ষতা গড়ে তোলার প্রতি জোড় দিয়েছেন। কেননা সহনশীলতা, নমনীয়তা নিয়ে মানবিকবোধ জাগ্রত করতে না পারলে নানা অঘটন ঘটিয়ে আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি। যেমন জঙ্গীবাদ, জীবাণুঅস্ত্র, সাংষ্কৃতিক সংঘর্ষ এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই মানবীকরণের পদক্ষেপগুলোকে এভাবে চিন্তা করা যেতে পারে:
১. স্কুল সবার সঙ্গে মিলেমিশে জীবযাপনে উদ্বুদ্ধ করবে। যখন একটা শিশু অঙ্কুর বা প্রাক প্রাথমিকে ভর্তি হয় তখন সে অনেকের সঙ্গে জীবনের যাত্রায় সামিল হয়। হৈচৈ করে, খেলাধুলা চিৎকার চেচামেচি করে, ভাবের আদানপ্রদান করে। এর মধ্যে দিয়ে শিশুরা এক ধরনের বিনিময় ঘটায়। বুঝতে শুরু করে একা ও অনেকের সঙ্গে মিলে চলার পার্থক্যটা। শিক্ষাকর্মী বা শিক্ষকরা শুধু নজর রাখবেন, কোনো অঘটন থেকে বিরত রাখায় সচেষ্ট হবেন।
এগুলোর পাশাপাশি শিক্ষাকর্মীরা ধীরে ধীরে ক্লাস বা পাঠ কক্ষের মতো পরিবেশ তৈরি করতে থাকবেন, যাতে শিক্ষার্থীরা সবার সঙ্গে বসে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর কথা শুনতে উদ্বুদ্ধ হয় অথবা কোনো শিক্ষার্থী সবার সামনে ফর্মাল কথা বলার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে যেন এই প্রস্তুতি গড়ে ওঠে: ক্লাসে সবাই সু-শৃঙ্খলভাবে বসবে, নিজের ক্লাসটা ভালো না লাগলেও অন্যের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে নজর রাখবে, প্রশ্নউত্তরের ব্যাপারে শিক্ষার্থী একটা বোঝাপড়ায় পৌছতে চেষ্টা করবে।
এভাবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণির মধ্যেদিয়ে শিক্ষার্থীদের এই সিদ্ধান্তে আনতে হবে, আমাদের চিৎকার চেচামেচী খেলাধুলা, গল্পগুজবের অভিজ্ঞতা, পাঠচর্চা, প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্ন বিনিময় করার সুশৃঙ্খল জায়গা হচ্ছে এই শ্রেণিকক্ষ, নিজেদের উম্মোচন বা এক্সপ্লোরেশনের জায়গা এটা। এগুলো মধ্যেদিয়ে বোঝাপড়া, সহনশীলতা অর্থাৎ মিলেমিশে থাকার শক্তি ও উপলব্ধিটা বাড়বে।
বিবর্তনীয় জীববিদ্যা বলছে, যে পরিবর্তন ও অভিজ্ঞতা ও অন্যকে ধ্বংসের মধ্যেদিয়ে আমরা হমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি এখানে এসেছি। তাতে এই মিলেমিশে থাকার গুণগুলোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। স্কুলিং এর এই চর্চার মধ্য দিয়ে উল্লেখিত গুণগুলো ধীরে ধীরে অর্জন করতে হবে।
২. মেমোরাইজেশন:
মানুষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে ভুলে যাওয়া। মানবজাতির অর্জনই হচ্ছে এই ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতিধারণের সংগ্রাম। সে যত বেশি পিছনের ঘটনাবলীকে মনে রাখতে পারবে। তার চলার পথ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ততবেশি সহনশীল ও প্রশস্ত হবে, ভবিষ্যতকে সে নির্মাণ করতে পারবে তত বেশি আপন আলয়ে। মানবিক জীবনের বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করবে সেই সব স্মৃতিধারণ। তাছাড়া প্রত্যেকটি শিশু ভবিষ্যতের মানুষ। আজকের যে বাস্তবতা তা ভবিষ্যতে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেটা আমাদের শিক্ষায় গুরুত্বসহকারে নিতে হবে।
নালন্দা, অরণী, সহজপাঠ এবং ফুলকীর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুরা তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১২ বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় অতিবাহিত করে। অংকুর বা প্রাক প্রাথমিক থেকে একটা শিশুর যাত্রা এখানে শুরু হয়। ১২ বছরের জীবন করে স্কুল থেকে বের হয়ে যাবে। ১২ বছরের প্রত্যেক পর্বে স্কুলে তার কর্মকান্ডের কম করে একটিসহ মোট ১২চিহ্ন (লেখা বা ছবি ইত্যাদি) তাকে অ্যালবামের আকারে বিদায় প্রাক্কালে দেওয়া গেলে সে নিজের বেড়ে ওঠাটা দেখতে পাবে। এতে স্কুলের স্কুলের প্রতি, সমাজের প্রতি যে বোধ তৈরি হবে তা সমাজ ও নিজের প্রতি অপরিসিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করবে।
৩.প্রত্যেক শিশুর চারপাশের পরিবেশ ও ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া
২০০৯ সাল। নিঝুম দ্বীপের গামছা খাল। এই খাল দিয়ে প্রতিদিন আমরা দুজন পার হতাম। আর ৮ বছরের এক শিশু নৌকার হাল ধরতো। সে গাণ গাইতো ‘আমি নিঝুম ™ দ্বীপের মাঝি’। তার উদাত্য কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতো। যেন নিঝুম দ্বীপ কাপতো। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি বড়ো হয়ে কি হবে। সে স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল আমি মাঝি হব। যেন মাঝি হওয়ার মধ্যদিয়েই নিজেকে উম্মোচন করতে চায়, জগৎকে জানতে চায়। আমাদের শিক্ষিত সমাজেও কেউ নাবিক হতে চায়, কেউ ডাক্তার হতে চায়, প্রকৌশলী হতে চায়; কেউ বিজ্ঞানী হতে চায়। নিঝুম দ্বীপের সেই শিশুকে, কেন সে মাঝি হবে জিজ্ঞেস করলে সে হেসেছিল। আমি বুঝেছিলাম প্রত্যেকটি শিশুর একটা পারিবারিক পরম্পরা থাকে, পরম্পরা থাকে ঐতিহ্যের। তার চারপাশটা ঘিরে সে চিন্তা নানা পরিবর্তন ও বিকাশ সাধন হয়। তার ভিত্তিতে এই চাওয়া। অতএব একটা শিশুকে ভর্তি করার সময় কেস হিস্ট্রিটা ঠিক মতো নিতে পারলে পরিবার ও স্কুলের মধ্যে ইন্টিগ্রিটি বা অবিচ্ছেদ্যতা তৈরি করবে। এটা স্কুলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর সঙ্গে আমাদের সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি নাবিক হওয়ার ব্যাপারে যে লাভক্ষতির হিসাব কাজ করে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ওরকম মিথস্ক্রিয়া থেকে যদি এরকম হওয়ার ইচ্ছা জাগে তা মানবিক এবং মহৎ। তাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
৪.সঙ্গীত ও শিল্পকলা আবাশ্যকীয় বিষয়
সঙ্গীত ও শিল্পকলাকে বিশেষ বিষয় হিসেবে না দেখে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একই তালে মিলিয়ে দিতে হবে। এগুলো একীভূতভাবে সংযুক্ত করতে পারলেই শিক্ষা মানবিক হয়ে উঠবে। কেননা সভ্যতার বিকাশে শ্রমের উদ্দীপনায় ছন্দ ও শব্দের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, অস্তিত্বের সংকটে চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। পারফরমিং বা বিনোদনের জায়গা থেকে নয় বরং অস্তিত্বের প্রয়োজন ও বিকাশের জায়গা থেকে সঙ্গীত ও শিল্পকলাকে অন্তর্ভূক্ত থাকতে হবে। এক্সট্রা কারিকুলাম বা বিশেষ বিষয় হিসেবে নয়। আরও ১০টি বিষয়ের মতো এর অন্তর্ভূক্তি থাকতে হবে। কেননা এ বিষয়গুলো মানবজাতির আদি বিকাশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, সভ্যতার বিকাশেই তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গুহাচিত্র তার সবচেয়ে বড়ো নিদর্শন। ধরুন ৩০ থেকে ৩২ হাজার বছর আগে মানুষেরা ছবি আকা শুরু করলো। কেন? শিকার করার অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করার জন্য, বা কিভাবে ভবিষ্যতে শিকার করবে; এমন্ও হতে পারে অবসর সময়ে গভীর ভাবনার বিমূর্তকে রূপায়নের প্রচেষ্টা থেকে। তিনটার কোনটা আগে এসেছিল বলা মুস্কিল। তবে আমরা বলতে পারি অস্তিত্বের প্রয়োজন থেকেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। তদ্রুপ সঙ্গীতও শারীরিক ছন্দ ঐক্যতানের প্রণোদনা যোগাতে আরম্ভ হয়েছিল ৩৬ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে। সভ্যতার অস্থিরতার ক্ষেত্রে একটা বড়ো কারণ হচ্ছে মানুষের জীবনযাপন থেকে সঙ্গীত ও শিল্পকলার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
মানুষ যদি শৈশব থেকে এই প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়গুলো বুঝতে এবং শুনতে শুরু করে তাহলে এটা অন্যরকম উপলব্ধি নিয়ে আমাদের সামনে দাড়াবে। আবেগ অনুভূতিগুলো গভীর তাৎপর্যময় ছন্দে স্পন্দিত হবে।
৫. প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল
প্রত্যেক শিশুকে যন্ত্র থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তারপরও বাস্তবতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না। অতএব যন্ত্র সম্পর্কে তার ভালো মন্দ দিকগুলো অবগত করাতে হবে। মাথায় রাখতে হবে সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের চেয়ে প্রাযুক্তিক উলম্ফন অনেকবশি হয়ে যায়। তখন বিজ্ঞানকে বোঝার চেয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়ে যায়। সেটাই সৃষ্টি করে প্রাযুক্তি বয়সন্ধিকাল। তার মধ্যে সেই পরিপক্কতা অর্জিত হয় না যা দিয়ে পরিমিতভাবে একটা আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। আমরা তার নানারকম উদাহরণ দেখতে পাই। অনেকটা কৈশোরের বয়সন্ধিকালের মতো, কৈশরে শিশুরা শারীরিকভাবে নতুন এমন কিছু অনুভব করে যার সঠিক নির্দেশনা বা পরিপকক্কতা ছাড়া মারাত্মক ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
অ্যান্ড্রয়েড বা স্মার্ট ফোন এবং কম্পিউটারগুলো আমাদের সুস্থ ও অসুস্থ ব্যবহার খাড়া গিরিচূড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে পরিমাণ কাজ করেছি, আমরা নিজেদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও উম্মোচন প্রক্রিয়া নিয়ে সেই পরিমাণ কি ভেবেছি? প্রথম দিকে স্টিফেন হকিং এর সমর্থক হলেও পরে তিনি বলেছেন, এই উন্নতির তিনি বিরোধি নন, তবে দ্বিধান্বিত; হয়তো এটা মানুষের সেরা উদ্ভাবন, নয় তো সব চেয়ে খারাপ।
অনেকে বলে থাকেন এটাতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞানের যুগ হলে কি মানুষ্য নির্মিত জলবায়ু বিপর্যয় হতো। বিজ্ঞানের যুগ হলে কি মাঠহীন ভবিষ্যতের প্রজন্ম বড়ো হতো, বিজ্ঞানের যুগ হলে কি ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস এর প্রনোদনা জোগানো খাবারগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হতো বা এর উপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে উঠতাম। এটা হলো বিজ্ঞানের সুবিধা লাভের যুগ। কীভাবে বিজ্ঞানকে না বুঝে ভোগের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তার যুগ। আরও প্রবলভাবে আত্মধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার যুগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থিদের লাভের মেশিন বানানোর পরিকল্পনার যুগ।
৬. ৪০ হাজার প্রজন্মের উত্তরাধিকার সে
মনে রাখতে হবে একটা শিশু শুধু পরিবার থেকে আসেনি, মা-বাবা থেকেও শুধু আসেনি। সে আসলে ৪০ হাজার প্রজন্মের সুদুর উত্তরাধিকার। এটা বোঝার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর উদ্ভব, গ্যালাক্সির উদ্ভব এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এটা বোঝার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর উদ্ভব, গ্যালাক্সির উদ্ভব এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এটার মধ্যে দিয়ে সে বুঝতে পারবে অপরাধ প্রবণতা কেন তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে সবকিছু কুক্ষিগত করার প্রবণতার কারণ কি? মানুষ কেন ছলে বলে কৌশলে সবকিছু নষ্ট করে ফেলতে চায়। আসলে সমাজ বিকাশে যে গভীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা আসলে বিবর্তনের দীর্ঘ যাত্রায় সৃষ্ঠ। মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা। এগুলো শুধরানো স্কুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দয়িত্ব। সেটাই শিক্ষা, প্রশিক্ষণ নয়। স্কুলিং এর কাজ হলো মানবজাতির যা অর্জন তাকে যতটা পদ্ধতিগতভাবে শেখানো আর তার আলোয় ভবিষ্যতের পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করা। তা পারলেই পেশাগত কাজের জন্য বুনিয়াদি স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণই তাকে সমাজের কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে গ্রহনযোগ্য তুলতে পারবে। সমাজে মানবিক মানুষ হিসেবে তার পেশা সম্পাদন করতে পারবে।
অথচ আমরা শিক্ষন প্রশিক্ষনকে এক করে ফেলেছি, শিখাচ্ছি শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। এ জন্য আমি মনে করি, কসমিক ক্যালেন্ডার বা মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জির ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কেননা কসমিক ক্যালেন্ডার এমন একটি শেখার হাতিয়ার যেখানে মহাবিশ্ব, জীবনের উদ্ভব, লিঙ্গের উদ্ভব এবং মানুষের উদ্ভব ও এর বিকাশের এমন আনুপাতিক চিত্র দেওয়া আছে যা মনে রাখার জন্য সুবিধাজনক।
শিশু বয়সে এই ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে যেতে পারলে মানবিক সমাজ তৈরির পথ প্রশস্ত হবে। মানুষ অনিশ্চয়তা থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পারবে। শিক্ষায় প্রথম থেকেই একটা শিশুকে শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যদের থেকে বেশি মেধাবি ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার বীজ বপন করা হয় তার থেকে রক্ষা করতে পারবে। পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া, সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সুষম মানবিক সমাজ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করবে।
এসব কাজ রাস্ট্রীয়ভাবে হতে পারলে অনেক সমস্যাই হয়তো কমে যেতো। কিন্তু সেরকম আশা এ সময়ের বাস্তবতায় খুবই কম। তবে যেসব স্কুলগুলো শিশুদের বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে গড়ে তুলতে চায় তাদের সবসময় একটা সেল থাকতে হবে যাদের কাজ হবে স্থানীয় অঞ্চলগুলোর (প্রত্যেক দেশে পরীক্ষা নামের) সনাতন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে শিক্ষার্থীদের শেখাবে। তাহলে যাত্রাপথ সুগম রাখবে। নাহলে অকালে ঝরে গিয়ে আরো জটিলতার সৃষ্টি হবে।
জ্যাকব ব্রনোওস্কি (দ্য অ্যাসসেন্ট অফ ম্যান ১৯৭৩) উইলিয়াম ব্লেক এর একটি কথাকে এভাবে ব্যাক্ত করেছেন : ”জ্ঞান সত্যের আলগা পাতাওয়ালা নোট বুক নয়। জ্ঞান হচ্ছে প্রাথমিকভাবে নৈতিক জীবদের এমন এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র যেখানে পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ ও দক্ষতা নিয়ে একজন মানুষ তার ব্যাক্তিগত দায়বদ্ধতা, বৌদ্ধিক প্রতিশ্রুতি ও সংবেদনশীল মনকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করে, যা মানুষটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উৎসাহিত করে।” আসুন আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করি।
১৬ মার্চ ওয়াহিদুল হকের জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখাটি পোস্ট করা হলো
Leave A Comment