লেখকঃ ফয়সাল আশিক
বাঙালি জাতি কি তার আত্মপরিচয় ভুলে যেতে শুরু করেছে? এখন কি বাঙালিরা তাদের বাঙালিত্ব কম, মুসলমানিত্বকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সেই জন্যে সমাজে ডানপন্থী মোল্লাদের দৌরাত্ম্য দেখা যাচ্ছে? হ্যাঁ, বাঙালি জাতি তার আত্মপরিচয় ভুলে যাচ্ছে, বা ভুলে যেতে শুরু করেছে।
ঢাকা শহরের বাসায় আমরা প্রতি শুক্রবারেই এলাকার মসজিদ থেকে আসা মাইকের আওয়াজে মসজিদের ইমামের ওয়াজ শুনি; ইমাম সমাজ নিয়ে মন্তব্য করেন, তিনি সমাজটাকে ঘুণে ধরে দাবি করেন এবং সমাজটাকে ঠিক করার জন্য মানুষকে ইসলামের পথে আসার জন্য বলেন। রক্ষণশীলতাবাদী ইমাম বাংলাদেশের সমাজটাকে কথিত সুস্থ বানানোর জন্য ইসলামের আইন চালু করার কথা বলেন; নারীদেরকে হিজাব-বোরকা বা পর্দা করতে বলেন, ছেলে-পুরুষ এদের মুখে নবীজীর সুন্নত রাখতে বলেন – দাড়ি রাখতে বলেন, নামাজ পড়তে বলেন; এছাড়াও সমাজে আছে তাবলীগী লোকদের কার্যক্রম, এটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সংগঠন যেটা সমাজের বহু মানুষকে দাড়িওয়ালা এবং বোরকা পরিহিত বানাতে সক্ষম হয়েছে।
এই রকম একটা সমাজে আমরা যারা প্রগতিমনা বা মুক্তমনা তারা কিভাবে চলাফেরা করি বা করতে পারি; আমরা ছেলেরা ছেলেরা আড্ডা দিলে হঠাৎ তাবলীগের লোক এসে বিরক্ত করে, মসজিদের নেবার জন্য এক প্রকারের জোরাজুরি করে, আবার ছেলেদের কেউ তাদের প্রেমিকা নিয়েও কোথাও বসতে পারেনা, এখানেও এরা সমাজের কথিত শিক্ষিত লোকদের বদ নজরে পড়ে যায়; এমনি বিপদে পড়লে মোল্লারা কোনো সাহায্য সাধারণত করেনা কিন্তু একটু অন্যরকম দেখলে মোল্লাদের মন জ্বালা করে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে এগুলো এলো কি করে? আগেকার যুগে কি ছিলো এসব? নাকি এই যুগেই শুধু এরকম দেখা যাচ্ছে। কোনটা? বাংলাদেশের সমাজে আগেও রক্ষণশীলতা ছিলো, শুধু ছিলোনা বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব; বাংলাদেশের সমাজে একবিংশ শতাব্দী শুরু হবার পর থেকে আরবীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটা শুরু হয়, পশ্চিমি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশও বলা যায় তখন থেকেই পাল্লা দিয়ে এক সঙ্গে এসেছে সমাজে। সমাজে হতাশা আছে, আছে দুশ্চিন্তা, এগুলো দূর করার জন্য মোল্লারা সুযোগসন্ধানীদের মতো কাজ করে; মোহাম্মদীয় আইন-কানুন, জীবন পদ্ধতি তারা ভেতো বাঙালিদের উপর চাপিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়; উদ্দেশ্য একটাই, কল্পিত পরকালে শান্তি পাওয়া এবং ইহকালে গণহারে মোহাম্মদের অনুসারী বানানো। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকাতেও পশ্চিমি সংস্কৃতি পালনকারী তরুণী-তরুণদের ওপর ডানপন্থী মুসলিম সাংগঠনিকদের পদচারণা আছে নইলে সেখানেও হিজাব পরিহিতা তরুণী দেখা যায় কিভাবে? আর পশ্চিমি সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমাজে কখনোই ভালো করে আসেনি; এটা এসেছে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে, ঋণাত্মক ভাবে এসেছে। আরবপন্থী বাঙালি মুসলমানের মন ঘনঘন বদলিয়েছে, যুগে যুগে বদলিয়েছে, মানুষের স্বভাবের উপর নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব বাঙালি সমাজে আগেও ছিলো তবে নিয়ন্ত্রণটা ডানপন্থী শৈলীর হয়েছে এই একবিংশ শতাব্দীতেই বেশি পরিমাণে।
ষাটের দশকে হুমায়ুন আজাদ দেখেছিলেন মুসলিম বাঙালি রেনেসাঁ যেটা তিনি তার ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ বইতে লিখেছেন, তিনি আক্ষেপ করেছেন এবং বলেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের যতোগুলো দশক দেখেছেন তার মধ্যে ষাটের দশকই নাকি সবচেয়ে ভালো ছিলো; তিনি ঐ দশকে ধর্মপন্থীদের উত্থান দেখেননি। বাংলাদেশ এখন অনেক ধর্মপ্রধান। বাংলাদেশের সমাজে মাঝখান দিয়ে নব্বইয়ের দশক এবং তার পরের দশক অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে অনেক সামাজিক প্রগতি দেখা গিয়েছিলো কিন্তু ২০১০-এর দশক থেকে তা ধীরে ধীরে উবে যেতে শুরু করে এবং এখন পুরো বাংলাদেশই প্রায় একটি ময়লা পুকুরের মতো যে পুকুরে অনেক বদমাশ মোল্লামাছ সাঁতার কাটছে।
বাংলাদেশের সমাজে এখন প্রায় প্রত্যেক জায়গায় জায়গায় মসজিদ, মাদ্রাসা আর মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র, আর বোরকা পরিহিত মেয়ে – এইগুলোই দেখা যাচ্ছে। এতো হুজুর আর হুজুরনি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে যেটা আগে কল্পনাও করা যেতোনা; এইসব ইসলামপন্থী মানুষ সমাজের মানুষের পুরোনো ছোটোখাটো স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে, আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও রবীন্দ্র সঙ্গীতের চর্চা হতো, কোরআন শরীফ পড়লেও তারা তাদের পোশাক বা চেহারায় ধর্মের চিহ্ন আনতোনা; আর এখন তো দেখেনই যে ছেলেদের মুখ ভর্তি দাড়ি আর মেয়েদের মাথায় হিজাব এবং শরীরে বোরকা। কপটতাবাদী নারীরা সমাজকে দেখানোর জন্য হিজাব পরছেন আবার অনেক কপটতাবাদী ছেলে মাদক সেবন করছে ঠিকই কিন্তু তার মুখভর্তি দাড়ি এবং সে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ছে।
পশ্চিমি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমি অপছন্দ করিনা কিন্তু তাও বাংলাদেশের সমাজে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যেভাবে পশ্চিমি সংস্কৃতি এসেছে সেটা আমি মেনে নিতে পারিনি – এটা মানুষের মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে; পশ্চিমি চলচ্চিত্র বা গান বাঙালি জাতিকে সত্যিকারের শান্তি দিতে পারেনি, জিহাদি হুজুররা এটার সুযোগই নিয়েছে যে বিদেশী জীবন-যাপনে যেহেতু শান্তি নেই তাই আজকালকার তরুণ-তরুণীদেরকে ইসলামের পথে আনতে হবে। আগে মেয়েরা শাড়ি বা সালোয়ার কামিজের মধ্যেই তাদের পোশাক সীমাবদ্ধ রাখতো আর এখন বোরকা, হিজাব কতো কিছুর সমাহার, পশ্চিমি সংস্কৃতি যেমন বাঙালিদের মনে অশান্তি এনেছিলো, ঠিক তার উল্টো পিঠে আরবীয় সংস্কৃতিও বাংলাদেশের সমাজে বিষফোঁড়া তৈরি করছে, এটাও এক ধরণের জগাখিচুড়ির মতোই; আত্মপরিচয়হীন বাংলাদেশীরা প্রথমে পশ্চিমি সংস্কৃতিকে ভালো মনে করে এখন ইসলামকে ভালো মনে করছে; মাঝখান দিয়ে বাঙালিরা ছিলো ভারতীয় চলচ্চিত্রপ্রেমী, হিন্দি চলচ্চিত্রের গান বাজতো বাংলাদেশের বিভিন্ন সমাজে; এখনো অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানে এসব দেখতে পাওয়া যায়; ষাটের দশক বা সত্তরের দশকে কি এরকম ছিলো? না, ছিলোনা; বাঙালিদের তখন একটা আত্মপরিচিতি ছিলো যে আমরা বাঙালি আর এখন বাঙালিরা মূলত মুসলিম পরিচায়ক।
হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ উপন্যাস কারা কারা পড়েছেন? দেখেছেন না হুমায়ুন আজাদ উপন্যাসটিতে রাশেদ নামের একটি চরিত্র দ্বারা বাংলাদেশের সমাজের উপরে কি রকম বিরক্ত প্রকাশ করেছিলেন। ঠিকই তো বাংলাদেশের সমাজ হচ্ছে নষ্টভ্রষ্ট, ঘুণে ধরা এবং অশিক্ষিত (কথিত শিক্ষিত)।
আপনাদের শক্তিশালি লিখনি সমাজকে পরিবর্তন করুক ধর্মান্ধতার বেড়াজাল থেকে। ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ
পশ্চিমী সংস্কৃতির সব যেমন খারাপ না তেমনি সব ভালোও না। এই সংস্কৃতি প্রধানত ভোগবাদী। অতএব এই সংস্কৃতি প্রোমোট করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। সেখানে দেশীয় “সুস্থ” সংস্কৃতির পিছনে কোন অর্থ নেই। ফলে অসম প্রতিযোগিতায় পশ্চিমী সংস্কৃতি বিজয়ী হয়। আর এখানেই মানুষের মনের ক্ষোভ পুরণ করতে ধর্মীয় অনুশাসন জনপ্রিয়তা লাভ করে। আবার এই ধর্মীয় সংস্কৃতিকে প্রোমোট করার জন্যও বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে।
ঠিক বলেছেন; শুধু ছেলেরা না মেয়েরাও অনেক ঝামেলায় পড়ছে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার কারণে।
ব্যাপার টা হচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতির মাধ্যমে চলাফেরা করে দিনশেষে কেউ ই শান্তি পায়না। নারীরা হয় ভোগপণ্য আর ছেলেরা হয় ভোগবাদী। তাই দিনশেষে অধিকাংশ ই ধর্মের পথে ফিরে আসে। এটাই বাস্তবতা।
সত্য কথা টি সুন্দর ভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আপনার শক্তিশালী লেখনীর মধ্যে দিয়ে ।
ধন্যবাদ 🙂