অভিজিৎ হত্যার ৬ বছর। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে অভিজিৎ ও বন্যার ওপর হামলায় অভিজিৎ নিহত হন, বন্যা আহত হন। পত্রিকায় দেখলাম অভিজিত হত্যা মামলার রায় হয়েছে। এতে ৫জনের ফাঁসি ও একজনের যাবজ্জীবন হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে চোখ আটকে গেল। তাঁর বক্তব্য, “কেবল গুটিকয়েক চুনোপুঁটির বিচার করে এবং উগ্রবাদের উত্থান ও এর শিকড় উপেক্ষা করার মাধ্যমে অভিজিতের হত্যা এবং এর আগে ও পরে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক এবং সমকামীদের হত্যার ন্যায়বিচার হয় না।অভিজিৎকে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের পাঁচ সদস্যকে ঢাকা ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড ও অপর একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। প্রধান দুই অপরাধী, শীর্ষ কমান্ডার সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আমাদের ওপর হামলাকারী জঙ্গি গোষ্ঠীর শীর্ষ কর্মী আকরাম হোসেন এখনও ধরা পড়েনি।
বন্যা বলেন, গত ছয় বছরে বাংলাদেশের এই মামলার তদন্তকারীদের একজনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। যদিও আমি এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং হামলার শিকার। তিনি খুনীদের একজনকে বিনাবিচারে হত্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
তিনি মন্তব্য করেন, তাদের ওপর হামলার পর থেকে বাংলাদেশের সরকার আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। বাকস্বাধীনতা আরও সীমিত হয়ে গেছে। মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, অ্যাকটিভিস্টদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১৫ সালে ও তার পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর, লেখার জন্য ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদের নিয়মিতভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ক্রমেই মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ইসলামী দল হেফাজতে ইসলামের বন্ধু হয়ে উঠছেন। তারা ২০১৪ সালে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের ‘হত্যার‘ দাবি করেছিল। আমি জানতে চাই, এই অর্থের প্রবাহের বিষয়ে কে তদন্ত করেছে? আমরা যদি হত্যার মূল খুঁজে না পাই কিংবা অর্থের উৎস না পাই, তাহলে এই রায় দিয়ে কী হবে?”
এখানে তিনি ব্যক্তি অভিজিতের বিচারের সাথে সামগ্রিক অবস্থা-বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর অনেক প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার উত্তর সহসাই পাওয়া যাবে না, কিন্তু তাকে এড়িয়ে যাওয়া, অবজ্ঞা করা হবে খুনীদের প্রজনন ক্ষেত্রকে অক্ষত-অধরা রাখা।
খুনের রায় যদি খুনীদের ভীতু না করে, ঐদ্ধত্য বাড়িয়ে দেয়- তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যবস্থায় ঝামেলা আছে, গোলমাল আছে। হত্যা বিচারের কারণ ও উপসর্গগুলোকে পরিবর্তনহীন রেখে, তার পুষ্টির ব্যবস্থা করে রায় দিলে’ তা প্রহসন বৈই অন্য কিছু হয় নয়। অভিজিত হত্যার বিচার যদি অজস্র অভিজিতের জন্ম ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা না দেয় তাহলে সে রাষ্ট্র তার খুনীদেরই, তাদের চিন্তারই পৃষ্ঠাপোষক হয়ে যায়। কখনো কখনো ব্যক্তির খুন ও তার খুনীর বিচার হওয়ার চেয়ে খুনের কারণ-সমীকরণের বিচার-বিশ্লেষণ জরুরী হয়। সেটা না হলে আরো অজস্র খুনের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা হয়। অভিজিত হত্যার চেয়ে তাঁর হত্যাকান্ডের কারণ অনুসন্ধান সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে সে আলাপ এক অর্থে পাপ ও অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ।
সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি, অভিজিতের হত্যা মামলার রায়ে অনেকেই আনন্দ ও হয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। ৫জনের ফাঁসি ও একজনের যাবজ্জীবন হয়েছে, কম কি? আবেগে বলেই ফেলেছেন, অভিজিৎরা হারে না, অভিজিৎ জিতে গেছেন ইত্যাদি। কিন্তু আমি দুঃখিত, অতটা উচ্ছাসিত হতে পারিনি। কারণ তাঁর বইয়ের, ভাবনার, চিন্তার, দর্শনের, চিন্তার কালো অক্ষরগুলো আজ আরো অরক্ষিত, আরো অনিরাপদ। যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধির সমাজ ও প্রজন্মের কথা ভেবে ব্রুনো-অভিজিৎরা নিজের দেহকে হায়নাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাদের খোড়াক হয়েছেন, সে অবস্থার কতটা পরিবর্তন হয়েছে? বরং দেখছি সে পরিস্থিতির আরো অবনতি ও সংকুচিত হচ্ছে।
হত্যাকারী, খুনী, জঙ্গীদের ক্রোধ কি কোন ব্যক্তি অভিজিতের বিরুদ্ধে ছিল? তারা তো কখনো তাঁকে দেখেওনি, তাকে পড়েওনি, হয়তো নামও শুনেছে তাদের শিক্ষাগুরু-ধর্ম ও রাজনৈতিক গুরুদের কাছ থেকে। কিন্তু কি সেই বোধ, কি সেই বিশ্বাস তাদের এতটা বেপরোয়, এতটা হিংস্র করেছে? হলি অর্টিজানের নিরীহ মানুষগুলোকে এক এক করে জবাই করে, এমনকি অন্তসত্বা মাকেও জবাই করে জরায়ু থেকে সন্তান টেনে বের করে উল্লাস করে? সে প্রশ্ন-বিজ্ঞানের আলাপই তুলেছিলেন অভিজিত। তার কালজয়ী রচনা বিশ্বাসের ভাইরাস ও অবিশ্বাসের দর্শণে। যে আলাপ তারা নিতে পারেনি, মানতে পারেনি।
ব্যক্তি অভিজিতের হত্যার বিচার হয়েছে হয়তো (?)। হয়তো বলছি, এর তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদ নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন। বন্যা শুধু তার জীবনসঙ্গীই ছিলেন না, ছিলেন তার চিন্তা, দর্শন, লেখা ও কাজেরও সার্বক্ষনিক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। তারচেয়েও বড় বিষয় অভিকে যখন হত্যা করা হয় তিনি গায়ের সাথেই লেপ্টে ছিলেন। তারও জীবন সমান বিপন্ন ছিল। জীবনসঙ্গীকে রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টায়ও করেছেন তিনি, পারেননি, সে হামলায় তাঁরও রক্ত ঝরেছে, অঙ্গহানি হয়েছে।
হাজার হাজার মানুষ ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে তার স্বামীকে তার দেহের উপর দিয়ে, বুকের উপর দিয়ে, কুপিয়ে মাংশের কিমা বানানো হলো- কেউ এগিয়ে এলো না। তার জীবনের সবচেয়ে কাছের, পছন্দের মানুষের শরীরকে মাছের মত দাপাদাপি করে নিস্তেজ হতে দেখলেন- কেউ তার পাশে দাড়ালো না! তিনি হাত উচিয়ে চিৎকার করে সবার সাহায্য চাচ্ছিলেন কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। হয়তো মনে মনে নিজের অসহায় অক্ষমতার জন্য নিজেকেই অভিশাপ দিয়েছেন। ভাবতে পারছেন বিষয়টি? চোখ বুজে একটু সেখানে নিজেকে কল্পনা করুণ, দেখুন কতটা নিতে পারেন, কতটা গ্রহন করতে পারেন। তার জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তি এই বিশাল মনোস্তাত্বিক আঘাতের ক্ষতি। যে ক্ষরণ তাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে।
গতবছর ফ্রান্সে গলা কেটে এক স্কুল শিক্ষককে হত্যা করা হয়। স্যামুয়েল প্যাটি ইতিহাসের শিক্ষক কিন্তু পড়াতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ ক্লাসে তিনি শিক্ষার্থীদের মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন দেখিয়েছিলেন। কার্টুন দেখানোর আগে শিক্ষক ক্লাসে বলেছিলেন, ক্লাসে থাকা মুসলিম শিক্ষার্থীদের যদি খারাপ বোধ করে, তবে তারা বেরিয়ে যেতে পারে। সেটাই হলো তার কাল!
সেই স্কুল শিক্ষককে গলা কেটে হত্যার পর দল-মত-নির্বিশেষে পুরো দেশ গর্জে উঠেছিল। সকল দল এক কাতারে দাড়িয়েছিল, সবাই প্যাটি হত্যার প্রতিবাদ করেছে। সে সংবাদ সারা দুনিয়া জেনেছে।
প্যাটি হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ফরাসী সরকার কট্টর ইসলামের বিরুদ্ধে ‘দ্রুত এবং কঠোর‘ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। সন্দেহভাজন মসজিদ-সংগঠন বন্ধ করা হয়েছে, বাড়িতে তল্লাশি, অনেক অনুসন্ধান-তদন্ত চলছে। কট্টর ইসলামি মতবাদ প্রচারের অভিযোগে বেশ কিছু সংগঠন এবং সমিতি বাতিল করা হয়েছে। সন্ত্রাসে অর্থ জোগানোর রাস্তা বন্ধের কৌশল নিয়েছেন। শিক্ষকদের জন্য বাড়তি সাহায্য-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সাথে সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর নজরদারি ও চাপ বাড়িয়েছেন।
ফরাসী জনমত জরিপ সংস্থা আইএফওপি‘র পরিচালক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেরোম ফোরকোয়া বিবিসিকে বলেন, “আমরা এখন আর শুধু সংগঠিত জিহাদি নেটওয়ার্কের মোকাবেলা করছি না, “আমরা এখন এমন এক সন্ত্রাসীকে দেখলাম যার কট্টরপন্থায় দীক্ষা এদেশে বসেই হয়েছে।“ তিনি বলেন, “সরকার এখন মনে করছে যে শুধু আইন-শৃঙ্খলার বেড়ি দিয়ে এই সন্ত্রাসের মোকাবেলা সম্ভব নয়। তাদেরকে এখন সামাজিক নেটওয়ার্ক সামলাতে হবে, কারণ ট্র্যাজিক এই হত্যাকাণ্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে কীভাবে এসব নেটওয়ার্ক জনগণের মধ্যে ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুরো এই ব্যবস্থাটি বদলাতে হবে।“
মি ফোরকোয়া বলেন, দু বছর আগে তাদের প্রতিষ্ঠানের এক জনমত জরিপে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষক বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যুতে সংঘাত এড়াতে তারা ক্লাসরুমে ‘সেলফ-সেন্সরশিপের‘ পথ বেছে নিয়েছেন। এই বিশ্লেষক মনে করেন, ফ্রান্সের আইনের বিরুদ্ধে এই যে ‘আদর্শিক হুমকি‘ তা মোকাবেলায় এই সরকার যে পথ নিচ্ছে তা সঠিক।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এই হামলার ঘটনাকে ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তারা জিততে পারবে না…আমরা পদক্ষেপ নেব।‘
এ আলাপ এখানে নিয়ে আসার কারণ জঙ্গীহামলায় নিহত দুই দেশের সরকারের বিপরীতমূখী চিত্রটি তুলে ধরা। অভিজিৎ বাংলা সাহিত্যের একজন মূলধারার আলোচিত বিজ্ঞান লেখক ও আর প্যাটি ফ্রান্সের শহরতলীর একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষক। সেক্ষেত্রে এ তুলনা কিছুটা অসামঞ্জস্য তবু প্রসঙ্গক্রমে নিয়ে আসা। জঙ্গীহামলায় নিহত ফ্রান্সের একজন নাগরিকের জন্য সে দেশের সরকার, সকলদল, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সবাই অভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন, কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র তার বিপরীত। ফ্রান্স তাদের ঐতিহাসিক ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ঐতিহ্যের প্রশ্নে কোন ছাড় দেননি, আপোষ করেননি বরং তা রক্ষায় আরো ব্যবস্থা নিয়েছেন, আইন করেছেন। আর আমাদের দেশে তা সংকোচন ও রোধের আইন হয়েছে। এখানেই উন্নত ও সভ্য দুনিয়ার গণতন্ত্রের সাথে আমাদের পার্থক্য।
যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল অভিজিতদের বাঁচতে দেয় না, তার শিক্ষা, চর্চা, প্রচার, প্রসার, বিস্তারকে পৃষ্ঠোপষোকতা দেয় সেখানে তার এ বিচারের রায় কিছু শান্তনার হলেও অনেক উচ্ছাস বা স্বস্তির নয়। অভিজিৎ হত্যার রায়ের পর বন্যা যে ক্ষোভ-আক্ষেপ-অভিযোগের কথা বলেছেন, সে অবস্থার পরিবর্তন না হলে অভিজিৎদের জন্ম ও জীবন রবে নিষিদ্ধ, আলোর স্বপ্ন হবে পরাহত!
আজ ২৬ ফেব্রুয়ারী, প্রিয় মানুষ অভিজিতের ৫ম মৃত্যুবাষিকীতে আনত সালাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি..
——————————————————
/ ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক, গবেষক।
Leave A Comment