জিয়ার হাজারটা দোষ ধরা যাবে কিন্তু সে যে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে সেটা অস্বীকার করবেন কেমনে? এখন সরকারী আদেশে জিয়াকে যদি উপাধীপ্রাপ্ত বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা বলা না যায় তাহলে তো বঙ্গবন্ধুও সেই ফাঁদে পড়ে যাবেন। কারণ ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম সংহতি মিছিলে আওয়ামী সরকার গুলি চালালে ২ জন মারা যান আহত হয় ৭ জন। ফলে সারাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। সে সময় আওয়ামী কর্মীরা প্রেসক্লাবের পেছনে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি জ্বালিয়ে দেয়। ন্যাপের তৎকালীন নেত্রী মতিয়া চৌধুরী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিবাদ সভায় শেখ মুজিবের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি আর বঙ্গবন্ধু নও’। আর সেদিন পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সমাবেশে ডাকসুর পক্ষ থেকে তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব রহমানকে দেয়া (ডাকসু থেকে) জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নেন এবং ডাকসুর আজীবন সদস্য পদ বাতিল করেন। যদিও বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।

জেনে রাখা ভাল, অনেক মুক্তিযোদ্ধা আবার খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযোদ্ধা উপাধী পাননি। বিশেষ করে বামপন্থীরা যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের অনেককে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অনেকে ২০১০ সালের পরে এসে স্বীকৃতি পেয়েছেন। পদক সম্মান, খেতাব বেশির ভাগ সময় রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত।

“চার নং সেক্টরের সাব কমান্ডার মাহবুব রব সাদী ৭২-এ তাঁকে প্রদত্ত ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব বর্জন করেন। মাহবুব সাদীর খেদ ছিল- ‘আমি নিজে অন্তত তিন জনের কথা জানি যাদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া উচিত ছিল।’ কিন্তু দেওয়া হয়নি। ১৯৯৪ সালে পুনরায় তাঁকে পদক গ্রহণের আহ্বান জানালে তখনো তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেন- ‘মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা বিভিন্ন পদক পেয়েছেন তাঁদের বীরত্ব ও অবদানকে খাটো করি না। কিন্তু অন্য যাঁরা যথাযথ বীরত্ব প্রদর্শন করে এবং অবদান রেখেও যথাযথ মূল্যায়ন পাননি তাঁদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমি এ খেতাব ও পদক বর্জন করেছি।”

(অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি- অপূর্ব শর্মা, প্রকাশক- সাহিত্য প্রকাশ)।’

“পদক বিতরণের নামে এই প্রহসনে তৎকালীন সরকারের আস্থা ও বিশ্বাসের অমর্যাদা করে তৃতীয় বেঙ্গলের সদস্যদের আত্মত্যাগ, রক্তদান এবং সার্বিক অবদানকে ওসমানী বিদ্বেষমূলকভাবে অবমূল্যায়ন করেন। এই প্রহসনের ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করেও কেবল ওসমানী ও তার নিয়োজিত নির্বাচকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে বহুসংখ্যক অফিসার খয়রাতি ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। যুদ্ধের ময়দানে পালিত ভূমিকা বিবেচনা সেখানে অনুপস্থিত ও গৌণ, মুখ্য উপাদান ছিল গোষ্ঠী রাজনীতি ও তদবির।”

(একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, লেখক- কর্নেল শাফায়েত জামিল, প্রকাশক- সাহিত্য প্রকাশ)

মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আর এই কারণে তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনকেও ঝামেলায় পড়তে হয়। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের জন্যে পাকিস্তানী বাহিনী সব জায়গায় তল্লাসী শুরু করে। সেই ঘটনার একটা অংশ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়। এখানে পত্রিকার লেখাটি তুলে ধরা হল।

রোববার দৈনিক বাংলা, ২ জানুয়ারী ১৯৭২

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক মেজর (বর্তমানে কর্নেল) জিয়া যখন হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাদেরকে নাজেহাল করে তুলেছিলেন তখন তার প্রতি আক্রোশ মেটাবার ঘৃণা পন্থা হিসেবে খানসেনারা নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজনের ওপর।

তাদের প্রতিহিংসার লালসা থেকে রেহাই পাননি কর্নেল জিয়ার ভায়রা শিল্পোন্নয়ন সংস্থার সিনিয়র কো-অর্ডিনেশন অফিসার জনাব মোজাম্মেল হক। চট্টগ্রাম শহর শক্রকবলিত হবার পর বেগম জিয়া যখন বোরখার আবরণে আত্মগোপন করে চট্টগ্রাম থেকে স্টিমারে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছান তখন জনাব মোজাম্মেল হকই তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেদিন ছিল ১৬ই মে। ঢাকা শহরে ছিল কারফিউ। নারায়ণগঞ্জে সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারী করা হয়েছিল। এরই মধ্যে তিনি তার গাড়িতে রেডক্রস ছাপ এঁকে ছুটে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ টার্মিনালে।

বেগম জিয়াকে নিয়ে আসার দিন দশেক পর ২৬শে মে শিল্পোন্নয়ন সংস্থার সেক্রেটারি এই সংস্থার হক নাম সম্বলিত যত অফিসার আছেন সবাইকে ডেকে কর্নেল জিয়ার সঙ্গে কারোর কোন আত্মীয়তা আছে কিনা জানতে চান। জনাব মোজাম্মেল হক বুঝতে পারলেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তিনি সেখানে কর্নেল জিয়ার সাথে তার আত্মীয়তার কথা গোপন করে অসুস্থতার অজুহাতে বাসায় ফিরে আসেন এবং অবিলম্বে বেগম জিয়াকে তার বাসা থেকে সরাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন। কিন্তু উপযুক্ত কোন স্থান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ২৮শে মে তিনি তাঁকে ধানমন্ডিতে তার এক মামার বাসায় কয়েকদিনের জন্য রেখে আসেন এবং সেখান থেকে ৩রা জুন তাঁকে আবার জিওলজিকাল সার্ভের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর জনাব মুজিবর রহমানের বাসা এবং এরও কদিন পরে জিওলজিকাল সার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব এসকে আবদুল্লাহর বাসায় স্থানান্তর করা হয়।

এরই মধ্যে ১৩ই জুন তারিখে পাকিস্তানী বাহিনীর লোকেরা এসে হানা দেয় জনাব মোজাম্মেল হকের বাড়ীতে। জনৈক কর্নেল খান এই হানাদার দলের নেতৃত্ব করেছিল। কর্নেল খান বেগম জিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং জানায় যে, এই বাড়ীতে তারা বেগম জিয়াকে দেখেছে। জনাব হকের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে তার দশ বছরের ছেলে ডনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডন কর্নেল খানকে পরিস্কারভাবে জানায় যে, গত তিন বছরে সে তার খালাকে দেখেনি। সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলে খান সেনারা ব্যাপকভাবে তার বাড়ী তল্লাসি করে। কিন্তু বেগম জিয়াকে সেখানে না পেয়ে হতোদাম হয়ে ফিরে যায়। যাবার আগে জানিয়ে যায়, সত্যি কথা না বললে আপনাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। এর পরই জনাব হক বুঝতে পারেন সর্বক্ষণ তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। যেখানেই যান সেখানেই তার পেছনে লেগে থাকে কেউ। এই অবস্থায় তিনি মায়ের অসুস্থতার নাম করে ছুটি নিয়ে নেন অফিস থেকে এবং সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন।

ব্যবস্থা অনুযায়ী ১লা জুলাই গাড়ী গ্যারেজে রেখে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা দুটি অটোরিকশায় গিয়ে উঠেন। উদ্দেশ্য ছিল ধানমণ্ডিতে বেগম জিয়ার মামার বাসায় গিয়ে আপাতত ওঠা। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবরেটরী পর্যন্ত আসতেই একটি অটোরিকশা তাদের বিপল হয়ে যায়। এই অবস্থায় তারা কাছেই গ্রীন রোডে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ওঠেন। কিন্তু এখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করেছিল এক বিরাট বিস্ময়। জনাব হক এখানে গিয়ে উঠতেই তাঁর এই বিশিষ্ট বন্ধুর স্ত্রী তাকে জানান যে, কর্নেল জিয়ার লেখা একটি চিঠি তাদের হাতে এসেছে। চিঠিটা জনাব হককেই লেখা এবং এটি তার কাছে পাঠানোর জন্যে কয়েকদিন ধরেই তাকে খোঁজ করা হচ্ছে।

তার কাছে লেখা কর্নেল জিয়ার চিঠি এ বাড়ীতে কিভাবে এলো তা বুঝতে না পেরে তিনি যারপর নাই বিস্মিত হন এবং চিঠিটা দেখতে চান। তাঁর বন্ধুর ছেলে চিঠিটা বের করে দেখায়। এটি সত্যি কর্নেল জিয়ার লেখা কিনা বেগম জিয়াকে দিয়ে তা পরীক্ষা করিয়ে নেবার জন্যে তিনি তার বন্ধুর ছেলের হাতে দিয়েই এটি জিওলজিকাল সার্ভের জনাব মুজিবর রহমানের কাছে পাঠান।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় জনাব হক তার এই বন্ধুর বসায় রাতের মতন আশ্রয় চান। তাদেরকে আরো নিরাপদ স্থানে রাখার আশ্বাস দিয়ে রাতে তাদেরকে পাঠানো হয় সূত্রাপুরের একটি ছোট্ট বাড়ীতে। তার বন্ধুর ছেলেই তাদেরকে গাড়ীতে করে এই বাড়ীতে নিয়ে আসে। এখানে ছোট্ট একটি ঘরে তারা আশ্রয় করে নেন। কিন্তু পরেরদিনই তারা দেখতে পেলেন পাক-বাহিনীর লোকেরা বাড়ীটি ঘিরে ফেলেছে। জনা দশেক সশস্ত্র জওয়ান বাড়ীটার সামনে দাঁড়িয়ে। এই দলের প্রধান ছিল আরিফ। তারা ভেতরে ঢুকে কর্নেল জিয়া ও বেগম জিয়া সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জনাব হক ও তার স্ত্রী জিয়ার সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যান। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জনাব ও বেগম হকের সাথে তোলা বেগম জিয়ার একটি গ্রুপ ছবি বের করে দেখালে তারা জিয়ার সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তবে তাঁরা জানান কর্নেল ও বেগম জিয়া কোথায় আছেন তা তারা জানেন না।

এই পর্যায়ে বিকেল পাঁচটার দিকে জনাব হক ও তার স্ত্রীকে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়িতে তুলে মালিবাগের মোড়ে আনা হয় এবং এখানে মৌচাক মার্কেটের সামনে তাদেরকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। এখানেই তাদেরকে জানান হয় যে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে দ্বিতীয় রাজধানী এলাকা ঘুরিয়ে আবার সূত্রাপুরের বাসায় এসে ছেড়ে দেয়া হয়। এখান থেকে রাতে তারা গ্রীন রোডে জনাব হকের বন্ধুর বাসায় আসেন এবং সেখান থেকে ফিরে আসেন খিলগাঁয়ে তার নিজের বাসায়। উল্লেখযোগ্য যে এই দিনই জনাব এস এ আবদুল্লাহ সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকেও জিয়া ও জনাব আবদুল্লাহকে এবং এই একই সাথে জনাব মুজিবর রহমানকেও পাক বাহিনী গ্রেফতার করে। এবং ৫ই জুলাই তারিখে জনাব মোজাম্মেল হক অফিসে কাজে যোগ দিলে সেই অফিস থেকেই ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।

ক্যান্টনমেন্টে তাকে এফআইইউ (ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট) অফিসে রাত দশটা পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হয় এবং রাত দশটায় তাকে সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেলে প্রবেশের আগে তার ঘড়ি, আংটি খুলে নিয়ে নেয়া হয়। সারাদিন অভুক্ত রাখা হয়, সেলে তাকে কিছুই খেতে দেওয় হয়নি।

পরের দিন সকালে তাকে এক কাপ ঠাণ্ডা চা খাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের অফিসে। সাজ্জাদ তার কাছে তার পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। তিনি তার কোন পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেন। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করেন। এবং শাস্তি হিসেবে বৈদ্যুতিক শক দেবার হুমকি দেখায়। কিন্তু এর পর কোন কথা আদায় করতে না পেরে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাকে হাজার ভোল্টের উজ্জ্বল আলোর নীচে শুইয়ে রাখার হুমকি দেয়। হুকুম মত রাতে তাকে তার সেলে চিৎ করে শুইয়ে মাত্র হাত দেড়েক ওপরে ঝুলিয়ে দেয়। প্রায় চার ঘণ্টা এই অসহ্য যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়।

পরদিন তাকে আবার ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাজ্জাদ আবার তার পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। জানতে চায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার কি কি কথা হয়েছে, তিনি ভারতে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন কিনা। জনাব হক এসব কিছুই অস্বীকার করলে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তার ঘাড়ে প্রচণ্ড এক আঘাত হানেন। এর পর তার সেলে চল্লিশ ঘণ্টা হাজার ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে রাখার হুকুম দেয়।

বেলা একটায় তাকে সেলে এনেই বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ঘণ্টা কয়েক পরেই তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকার করে তিনি একটি কথাই বলতে থাকেন: আমার একবারেই মেরে ফেলে। এভাবে তিলে তিলে মেরো না। তিনি যখন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করেছিলেন তখন তার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল একজন পাঠান হাবিলদার। তার এই করুণ আর্তিবোধ হয় হাবিলদার সইতে পারেনি। তারও হৃদয় বোধ হয় বেদনায় ভারাক্লান্ত হয়ে উঠেছিল মানুষের ওপর মানুষের এই নিষ্ঠুর জুলুম দেখে। আর তাই বোধ হয় সে সেন্টিকে ডেকে হুকুম দিয়েছিল বাতি নিভিয়ে দিতে। বলেছিল কোন জীপ আসার শব্দ পেলেই যেন বাতি জ্বালিয়ে দেয় আবার জীপটি চলে যাবার সাথে সাথেই যেন বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাকে আরো কয়েক দিন জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নতুন ধরনের নির্যাতন চালায়। তার কাছ থেকে সারাদিন ধরে একটির পর একটি বিবৃতি লিখিয়ে নেয়া হয় এবং তার সামনেই সেগুলি ছিঁড়ে ফেলে আবার সেগুলি লিখতে বলা হয় এবং যথারীতি আবার তা ছিঁড়ে ফেলে আবার সেই একই বিবৃতি তাকে লিখতে বলা হয়। এই অবস্থায় শাস্তি ও অবসন্নতায় তিনি লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। এদিকে হাজার ওয়াটের উজ্জ্বল আলোর নিচে থাকার ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেন। দিন ও রাতের মধ্যে কোন পার্থক্যই বুঝতে পারতেন না।

২৬শে জুলাই বিকেলে তাকে ইন্টার স্টেটস স্কিনিং কমিটির (আইএসএসসি) ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে একটি ছোট্ট কামরায় তাকে মোট ১১০ জন আটক ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে তাকে বের করে রান্নাঘরের বড় বড় পানির ড্রাম ভরার কাজ দেয়া হয়। এই কাজে আরো একজনকে তার সাথে লাগানো হয় । তিনি হচ্ছেন জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব এসকে আবদুল্লাহ। তারা দুজনে প্রায় সোয়া মাইল দূরের ট্যাপ থেকে বড় বড় বালতিতে করে পানি টেনে তিনটি বড় ড্রাম ভরে দেন। রাতে লাইন করে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে একজন একজন করে খাবার দেয়া হয়। এতদিন পরে এই প্রথম তিনি খেতে পান গরম ভাত ও গরম ডাল। পরদিন সকালে তার এবং আরো অনেকের মাথার চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে দেওয়া হয়।

এখানে বিভিন্ন কামরায় তাকে কয়েকদিন আটকে রাখার পর ৬ই আগস্ট নিয়ে যাওয়া হয় ফিল্ড ইনভেস্টেগেশন সেন্টার (এফআইসি) মেজর ফারুকী ছিল এই কেন্দ্রের প্রধান এবং এখানে সকলের ওপর নির্যাতন করার দায়িত্বে নিযুক্তে ছিল সুবেদার মেজর নিয়াজী। ফারুকী এখানে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাকে বিবৃতি দিতে বলে। কিন্তু বিবৃতি লেখার নাম করে সেই পুরনো নির্যাতন আবার শুরু হয়। একটানা তিন দিন ধরে তিনি একই বিবৃতি একের পর এক লিখে গেছেন এবং তারই সামনে তা ছিঁড়ে ফেলে আবার একই বিবৃতি তাকে লিখতে বলা হয়েছে।

৯ই আগস্ট তাকে দ্বিতীয় রাজধানীতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এখানে বিভিন্ন কক্ষে তাকে প্রায় দেড়-মাস আটক রাখার পর ২১শে সেপ্টেম্বর তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ৩০শে অক্টোবর তিনি মুক্তি পান। ইতোমধ্যে রাজাকাররা তিন-দফা তার বাড়ীতে হামলা চালিয়ে সর্বস্ব লুটপাট করে নিয়ে যায়। সবশেষে গত ১৩ই ডিসেম্বর তারা তার গাড়ীটিও নিয়ে যায়।

জনাব মোজাম্মেল হক মুক্তি লাভের পর ২রা নভেম্বর চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু জেনারেল নিয়াজীর নির্দেশে সামরিক আইনের ১৮ নম্বর বিধিবলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এই চাকরি জনাব হক আজও ফিরে পাননি। এমনকি প্রেসিডেন্ট ফান্ড বা অন্য কোন সুযোগ সুবিধাও তাকে বরখাস্তের সময় দেয়া হয়নি। এবং এখনও তিনি এসব থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।