লিখেছেন: অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
Like a fresh track across a field of snow,
Not reckoning that all could melt and go.
– Richard Wilbur
কথায় বলে, “লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে” । অর্থাৎ লেখা এবং পড়ার সঙ্গে আজও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার আদিম সম্পর্কটি যে রয়ে গেছে সেটা অস্বীকার করা অসম্ভব । আর সেজন্যেই বাপ-মায়ের মুখে সন্তানের লেখাপড়া না করার অভিযোগটি সর্বদা রণঝঙ্কারে গর্জে ওঠে । অন্যদিকে আরেক তরফেও এমনই অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় – লেখকগোষ্ঠী । লেখকের মন ও কন্ঠ যেন সর্বদাই বিচলিত এই ভেবে যে কেউ তার লেখা পড়ছে না । লেখক – তা সে উৎকৃষ্ট হোন বা অপকৃষ্ট – এই বিশ্বাসেই লিখে যান যে ‘মহাকাল’ নিশ্চয় তার পাঠক জোগাড় করে দেবেই । সেই পাঠকই বিচার করবে লেখকের সৃষ্টিমূল্যের যথার্থতা । লেখকরা যদিও সচরাচর এই খবর রাখেন না, কিন্তু একথা নিশ্চিন্তমনেই বলা যায় যে প্রত্যেকটি বইয়ের পাঠক আছেই আছে – তা সে একজন হলেও আছে কিংবা শত-শতবর্ষ পরে হলেও আছে । ব্লেকের কথা কি লেখকরা ভুলে গেছেন যাঁকে উদ্ধার করেছিলেন নর্থ্রপ ফ্রাইয়ি, তাও প্রায় দেড়শ বছর পরে । তাহলে লেখকের মনে এই অতৃপ্তি কেন থেকে যায় ? আসলে জীবিতকালেই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে কার না থাকে কিন্তু তাই-ই বলে লেখক যদি শুধু জনমনোরঞ্জনের জন্যই লিখতে থাকেন যেখানে কোনও নতুনত্ব নেই, থাকে না কোনও আশ্চর্যতম অভিজ্ঞান তাহলে লেখক সমসময়ে যতই খ্যাতি পান, মহাকালই তাকে ধ্বস্ত করে দেবে । আবার যে লেখক শিল্পের উচ্চতম পরাকাষ্ঠায় নিজের হৃদপিঞ্জর পেষণ করেন, আজকে তিনি যতই অনামা হোন একদিন তারিফের মালা তার গলায় শোভা পাবেই । জীবনানন্দের উপন্যাসগুলি ঠিক যেমন ভূমেন্দ্র গুহর দৌলতে একে একে বেরিয়ে এসেছে কিংবা কমলকুমারের গল্প-উপন্যাসগুলি গ্রন্থিত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ ‘বোষ্টমী’ গল্পে লিখেছিলেন, “আমি লিখিয়া থাকি অথচ লোকরঞ্জন আমার কলমের ধর্ম নয়” – লেখকের একথা বিস্মৃত হওয়া অনুচিত । কিন্তু লেখক যে গোত্রেরই হোক না কেন অর্থাৎ বাজারি কলমচি হোক বা নিভৃতলোকের অক্ষরসাধক, তার জীবনেও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাঠের অব্যয়টুকুই । সুতরাং, সাধারণ লেখা ও পড়া কিংবা লেখক ও পাঠক দুই-ই যে কোনও ভাবে সমাজের পাঠচেতনার ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিন্যাসে বিভক্ত হয়ে রয়েছে ।
এই ক্রমধারা ধরে নিলে, লেখাকে দুটি সরল ভাগে ভাগ করা যায় । এক, যে লেখা মানুষের হৃদয় ও মনকে উন্নতলোকে উত্তরণ করিয়ে জগতের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ককে পরিচালনা করে সৌন্দর্যমার্গে দীক্ষিত করে ও দুই, যে লেখা কেবলমাত্র দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষকে কর্মোপযোগী যন্ত্রে পরিণত করে যার সঙ্গে জীবিকার স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও অন্তরের সংযোগ থাকে না । এজন্যেই একাডেমিক বই ও নন-একাডেমিক বইয়ের পৃথকীকরণ মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই আবশ্যক পাঠের স্বীকৃতির । নইলে কি একাডেমিক কি নন-একাডেমিক দুই-ই অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই যেভাবেই হোক মানুষকে লেখাপড়া করতে হবে । সেটার চেয়ে জরুরি আর কিছু নেই । বিশেষ করে আজকের দিনে যেখানে অক্ষরজ্ঞানব্যতীত দক্ষ শ্রমিকেরও টিকে থাকা দুষ্কর । কিন্তু কীভাবে মানুষ পাবে, পেয়েছিল পাঠের খোঁজ ? আজ থেকে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে মানুষ পেয়েছিল পাঠচেতনার সন্ধান । সন্ধান বললাম এই কারণে যে পাঠচেতনা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনও আশীষ পুষ্পের ফসল নয় । মানুষকে অর্জন করতে হয়েছিল সেই চেতনা । একথা সত্য যে, কথনের অধিকার মানুষকে প্রকৃতিই দিয়েছিল । সে জন্যেই প্রায় আদিম মানুষের জন্মকাল থেকে আজও দেখা যায় একই উত্তরাধিকার। একটি শিশুর অনাবিল স্বরপ্রক্ষেপনই হল এর প্রমাণ । কিন্তু এরপরে তাকে শিখে নিতে হয় লেখা ও পড়ার প্রক্রিয়া । অ্যারিস্টটলের মতে, “Spoken words are the symbols of mental experience, and written words are the symbols of spoken words” । যদিও শুধুমাত্র শুনে-শুনেই কী করে একটি ভাষা আয়ত্ত করে ফেলে একটি সদ্যজন্মা তা সঠিকভাবে আন্দাজ করতে বিজ্ঞানীরা আজও অপারগ । কিছু হাইপোথেসিস আছে যদিও কিন্তু তার ভিত্তিতে অন্তিম দাবি করা যায় না । সে যাই হোক, খ্রীষ্টপূর্ব ৪ হাজার বছর আগের সুমেরীয় লিপি থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ২ হাজার বছরের ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যঞ্জনা আর মাত্র ১ হাজার বছর আগের স্বরবর্ণের সুরধুনী – এইভাবেই উচ্চারিত শব্দমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন লিপির ইতিহাসে অর্থাৎ লেখার আদি কাহিনীতে যুক্ত হয়েছিল পাঠচৈতন্য । তারপরে, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এসেছিল যতিচিহ্নমালা ও মাত্র নবম শতাব্দিতে এসেছিল শব্দের মধ্যিখানে ফাঁক দেওয়ার রীতি । ইত্যবসরে, পঞ্চদশ শতাব্দিতে গুটেনবার্গের বিপ্লব থেকে আজকের ই-বুক অব্দি বিস্তৃত হয়েছে মানুষের লেখা ও পড়ার ইতিবৃত্ত। লিপির এই বহুল বিবর্তনের আবহে পড়ুয়ার বিবর্তন কিন্তু হয়ছে মাত্র দুটি ধাপে – ধ্বনিময় উচ্চারিত পাঠ থেকে নিঃশব্দ পাঠের মননতন্ত্রে । তাহলে লেখাই কি মানুষের পাঠতন্ত্রকে উন্মোচিত করেছিল ? বোধহয় না ।
আদিম যুগে যখন লেখা ছিল না তখনও মানুষের কন্ঠ নিঃসৃত সংকেতধ্বনির মাধ্যমে সংযোগ রক্ষা হত । তখনও মানুষ বুঝে নিতে পারত উচ্চারণের অর্থ । কিংবা পশুপাখির পায়ের ছাপ দেখেই সে অনুধাবন করত খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক । সুতরাং পাঠের অধ্যায় লিখনের চেয়ে কিছু প্রাচীনতার দাবিদার । তাই মানুষের আগুন আবিষ্কার যেমন একটি বিপ্লব তেমনই এই ধ্বনি কিংবা প্রাকৃতিপ্রদত্ত চিহ্নের পাঠোদ্ধারও একটি বিপ্লব । আজও এ দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর কিন্তু তবুও সে জানে ট্রাফিক সিগন্যালের ভাষা কিংবা সরকারি দপ্তরের চোখের ভাষা যে কোথায় কীভাবে কী করলে কাজ উদ্ধার হবে। সুতরাং, পাঠ হল মস্তিষ্কের একটি শার্লকীয় বৃত্তি যা নানা বিষয়ের অন্তরাবহে থাকা সংকেতলিপির পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে খুঁজে নিতে চায় রহস্যদ্ঘাটনের আনন্দ । লেখার আগেই তাই এসেছিল পাঠচেতনা । কিন্তু সেই চেতনা পশু-পাখির মধ্যেও আছে । তাই এটাকে সভ্য মানুষের পাঠচৈতন্য বললে ভুল বলা হবে – এটা শুধুই জীবনে টিকে থাকার সংঘর্ষমাত্র । সভ্য মানুষের পাঠচৈতন্য লেখার ইতিবৃত্তের সঙ্গে সংশ্লেষিত হয় । ফলে এই প্রবন্ধের প্রতিটি শব্দ যখন পাঠ করা হচ্ছে, তখনও মস্তিষ্কের চৈতন্যস্তর এই সব লিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ বিমূর্ত প্রতীকগুলিকে অনবরত ডিকোড করছে এবং ফলাফল হিসেবে যা পাচ্ছে তাকেই জটিল ধারণায় সংশ্লেষিত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিচ্ছে মানুষকে। আদিযুগেও এভাবেই মানুষ যখন জীবনের বিবর্তনের পরম্পর্যে পশুপালন থেকে শস্যের উৎপাদন শুরু করেছিল, তখন তার প্রয়োজন হয়েছিল এইসব কন্ঠ-নিঃসৃত সংকেতগুলিকে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার মাধ্যমে পাকাপাকি করার। নইলে শুধুমাত্র স্মৃতির ভরসায় জীবন টিকিয়ে রাখা আর সম্ভবপর হচ্ছিল না । দরকার ছিল স্মৃতিগুলিকে সংরক্ষণ করারও । এভাবেই মানুষ পাঠচৈতন্যেরও পালাবদল ঘটাল – পশুপাখির স্তর থেকে সভ্যস্তরে । আর এর ফলেই ক্যানানাইটদের কিউনিয়েফর্ম এসেছিল প্রথমে । সেখান থেকে জন্ম নিয়েছিল আদিম অক্ষরমালা বা চিত্রাক্ষরমালা । এরপর নানান ধারার আবর্তনের পরে ধীরে ধীরে মানুষ পেয়েছিল গ্রিক, ল্যাটিন ও ভারতীয় ভাষাগুলিকে । তারপরে পেয়েছিল হিব্রু ভাষা যা আজও প্রায় অপরিবর্তিতই আছে । সর্বশেষে পেয়েছিল আরামাইক যা থেকে আজকের আরবী ভাষার উৎপত্তি । ব্যাবিলনিয়ানরা এই অক্ষর আবিষ্কারকে ভেবেছিল ঈশ্বরের আশীর্বাদ । তারা জ্ঞানের দেবতার নাম দিয়েছিল ঈয় । আসুরীয়রা কল্পনা করেছিল নাবুর যিনি মানুষকে শিল্পের অধিকার দিয়েছিলেন । আর হিন্দুদের ছিল গণেশ যিনি শুধুই জ্ঞানের ভাণ্ডার নন, নিজের দাঁত ভেঙে নিয়ে রচনা করেছিলেন শ্রুতির অক্ষরমালা । বাইবেলেও আমরা ইয়াওয়ের কথা জানতে পারি । সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসে তাই লেখাপড়ার সঙ্গে ঈশ্বরীয় যোগের কল্পনা আছে এবং লেখাপড়াই আদতে বিবর্তিত করেছিল মানুষের মস্তিষ্ককে । পাঠচেতনার এই উন্মেষই সভ্যতার প্রাকার বুনেছিল ধীরে ধীরে । কিউনিয়েফর্ম হোক কিংবা আজকের চৈনিক ভাষা সবই হল পাঠচেতনার আশ্চর্য প্রদীপ । এই পাঠচেতনাকে মূলত তিনটি অভিব্যক্তিতে ভাগ করা যায় – এক, চিত্রপরিচয় , দুই, ধ্বনিমার্গ ও তিন, বানানগত অভিধা । আজকের দিনেও এই ত্রিস্তরীয় পন্থাতেই কেউ কেউ গ্রন্থকীট হয়ে ওঠে, কেউ কেউ শুধুই নিজেদের কাজ চালানোর আবহে পাঠাভ্যাসকে আবদ্ধ রাখে । প্রকৃতপ্রস্তাবে পাঠ হল একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফসল যা একটি প্রগতিশীল সভ্যতার বোধ – দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টা ও ব্যর্থতার দ্বন্দ্বে – নির্দিষ্ট করেছে । একদিকে এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও অন্যদিকে মস্তিষ্কের টানাপোড়েন – দুই মিলিয়েই তৈরি হয়েছে মানুষের সভ্যতা ।
মস্তিষ্কের টানাপোড়েন বলেছি এই কারণে যে পশুপাখির পদচিহ্ন থেকে কিউনিয়েফর্ম ও আজকের দিনে নানা ভাষার চিহ্নলিপির মধ্যেই যে রয়ে গেছে মস্তিষ্ক বিকাশের আরেকটি নির্বিকল্প আখ্যান । পৃথিবীর যে মানুষ বা মানুষরা কিউনিয়েফর্মের জন্ম দিয়েছিল তারা একই সঙ্গে শুরু করেছিল শিক্ষাদানের অধ্যায়টিরও । কেননা কিউনিয়েফর্মের মধ্যে অন্তরিত বার্তাকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রত্যেকটি চিহ্নের অর্থ বোঝা । আজকের বাংলা অক্ষরমালা কিংবা ইংরেজি সবই বার্তাগঠনকারী একেকটি চিহ্নের বিবর্তিত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয় । তাই একে শিখে নিতে হবে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে । নইলে সব বার্তাই হবে অবোধ্য যা পরিপন্থী হয়ে উঠবে জীবনের । যুগে যুগে ভাষার পরিবর্তন হয়েই চলেছে । আগামি পৃথিবী যেমন কোডিং-এর ভাষ্যতেই মগ্নতা পাবে । তাই লিপির পাঠোদ্ধার শিখতেই হবে একেই বলে শিক্ষা । এটা একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া – কিউনিয়েফর্ম থেকে কোডিং-এর সন্ততিরেখা। কিন্তু তাতেও, আগে যা বলেছি সেই পদ্ধতির ব্যতিক্রম হবে না অর্থাৎ চিত্রপরিচয়, ধ্বনিমার্গ ও বানানগত অভিধার মাধ্যমেই মস্তিষ্ক পড়ে ফেলবে লিপির বার্তাগুলিকে । কিন্তু কীভাবে মস্তিষ্ক এটা করেছে – আদিমকাল থেকে আজ অব্দি – তা নিয়ে তিরিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার করে গবেষণা করে চলেছেন । বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের দৃষ্টি কোনও শব্দের ওপরে এসে নিবদ্ধ হলে রেটিনার মধ্যে দিয়ে অক্ষরমালার আলোকরেখাগুলি প্রবেশ করে আর সঙ্গে সঙ্গেই অসংখ্য টুকরোতে ভেঙে যায় । প্রত্যেকটি টুকরোকে আবার গ্রহণ করার জন্য আছে নির্দিষ্ট ফটোরিসেপ্টর । তারপরে এক অভিনব আয়োজনে পুনরায় সেই টুকরোগুলি সংযোজিত হয়ে গঠিত হয় সম্পূর্ন শব্দটি । তারপরে যদি ঐ শব্দের অর্থ অভিজ্ঞতা থেকে জেনে থাকি তাহলে অনুধাবন করে ফেলি লিপির তাৎপর্য । নইলে জেনে নেবার প্রয়াস করতে হয় শিক্ষকদের কাছ থেকে। এভাবেই চলে মস্তিষ্কের পাঠপ্রক্রিয়া । তাই জর্জেস ডি ব্রাবিউফ বলেছেন যে, “Writing—this ingenious art to paint words and speech for the eyes” । চোখের এই স্ক্যানের পরের পুরো কাজটা হয় মানব মস্তিষ্কে যা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত – সেরিব্রাম, সেরিবেলাম ও ব্রেন স্টেম । এর মধ্যে সেরিব্রাম পাঠ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে কাজ-কারবার করে থাকে । সেরিব্রাম আবার দুটি হেমিস্ফিয়ারে বিভক্ত । প্রত্যেকটি হেমিস্ফিয়ারের আছে চারটি করে ভাগ – ফ্রন্টাল, প্যারিইটাল, টেম্পোরাল এবং অক্সিপিটাল । এদের প্রত্যেকটির কাজ নির্দিষ্ট । যেমন, ফ্রন্টাল লোব ব্যক্তিত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং যুক্তিবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্যারিইটাল লোব ভাষা, শব্দ, স্পর্শ, ব্যথা, সংবেদনশীলতা, দৃষ্টি, শ্রবণশক্তির উদ্দীপনায় কাজ করে, টেম্পোরাল লোব নিয়ন্ত্রণ করে স্মৃতিশক্তি, বক্তৃতা এবং গন্ধ অনুভূতি ও অক্সিপিটাল লোব রঙ, আলো ও গতিবিধির ব্যাখ্যান নির্মাণ করে থাকে । যদি খুব নির্দিষ্টভাবে বলতে হয় তাহলে বলা যায় যে, বাঁ-পাশের অক্সিও-টেম্পোরাল অংশের দ্বারাই মূলত পাঠ নিয়ন্ত্রিত হয় । যেমন, শব্দ শোনা, শব্দ পড়া, শব্দের গঠন এবং শব্দের সম্মিলত বোধের উদ্দীপনা সমস্তই নিয়ন্ত্রিত হয় এই অংশের দ্বারাই । আসলে যেকোন শব্দের অভ্যন্তরে নিহিত থাকে একটি ধ্বনি এবং ধ্বনির অভ্যন্তরে থাকে অর্থ ও সর্বশেষে থাকে চিত্র – এই পন্থাতেই মানুষের মগজাস্ত্র উপলব্ধি করেছে পাঠের অভিধা । ডারউইনই বোধহয় প্রথম চিন্তক যিনি এই ইঙ্গিতটিকে ধরতে পেরেছিলেন । সুতরাং পাঠচেতনার এই প্রস্তুতিপর্বের মধ্যে দিয়েই আজকের মানুষ শিক্ষা বিষয়ে সচেতন হয়েছেন । লেখাপড়ার মাধ্যমেই সকলে প্রতিষ্ঠিত হতে চান । কিন্তু এই বিশাল প্রস্তুতিপর্বের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আদিম প্রবৃত্তি থেকে উন্নত মানসিক জীবনবোধে মানুষের অভিবাসন কমই দেখা যায় বলে অভিযোগ আছে । আর তাই দক্ষতা অর্জনের লেখাপড়ার বাইরে এসে প্রয়োজন লেখকের ভাববিশ্বে আশ্রয় নেওয়ার । দরকার পড়ুয়া থেকে পাঠক সত্তায় বিলীন হয়ে যাওয়ার – উচ্চারিত ধ্বনিতন্ত্র থেকে নিস্তব্ধ মনীষায় ।
এমন অনেক পড়ুয়া আছে যারা বাংলা ভাষা দিব্যু গড়গড়িয়ে পড়তে পারে, বুঝতেও পারে কিন্তু বাংলাতেই লেখা কমলকুমার মজুমদার কিংবা সন্তোষ ঘোষ পড়তে দিলে ব্যর্থমনোরথ হবে । কেন এমন হয় ? বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় আছে, জানা আছে ব্যবহৃত শব্দগুলির অর্থও, অথচ কেন উপন্যাসের বাক্যগুলিকে অবোধ্য লাগে । এখানেই পার্থক্য পড়ুয়ার সঙ্গে পাঠকের । এই বিভেদের কারণ কমলকুমারের উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখা থেকে বোঝা যায় । সেখানে বলা হয়েছে যে, “বস্তু দর্শনে নাম, নাম শ্রবণে বস্তু মনেতে আসে না” আর এটাই প্রকৃতপক্ষে কমলকুমারের লেখার বৈশিষ্ঠ্য । এই বিশিষ্টতাই পাঠপ্রক্রিয়ার স্বাভাবিক আবর্ত থেকে পাঠরত চক্ষুদ্বয়কে দেয় মুক্তি – পাঠকস্তরে জানায় নিমন্ত্রণ । সেজন্যই কমলকুমারের পাঠক হতে গেলে তাকে উন্নততর পাঠের দীক্ষায় দীক্ষিত হতে হবে। স্রেফ পড়ুয়া হলে হবে না । তবেই পাওয়া যাবে লেখকের ব্যবহৃত চিহ্নের আলোকিত উদ্ধারকল্প । আর এভাবে পড়ুয়ার জীবনে অর্জিত হবে রুচিশীল আভিজাত্য মানবিকতর বীক্ষা । যা পয়সা না করতে পারলেও সমাদৃত ও সমাহিত করবে চৈতন্যকে । এই পাঠচেতনার ভাবলোকের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ পেতে গেলে সাধনার প্রয়োজন । সাবলীল শিক্ষার দ্বারা গণ্ডিবদ্ধ সংকেতলিপির পাঠোদ্ধারের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে ও সম্ভোগ করতে শিখতে হবে লেখকের মননপ্রদেশ । আর এটা একমাত্র নিজ-গরজের স্বশিক্ষার দ্বারাই সম্ভব ।
আসলে লেখক তার অন্তর থেকে যে বার্তাটি দিতে চান, তিনি সেটিকে আবৃত করেন একটি প্রহেলিকাময় অক্ষরঝিল্লির দ্বারা । তিনি চান যে যোগ্য মানুষই যেন পায় সেই বার্তার অন্দরে থাকা অন্যলোকের সন্ধান । আর তাই সেই বার্তা গ্রহণের জন্য প্রয়োজন একটি সাধক পাঠকের । তবেই লেখকেরও তৃপ্তি । প্রকৃতপ্রস্তাবে এই লেখক ও পাঠকের সম্পর্কটি খানিক জটিল এবং পরিপূরক । ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে, লেখার অন্তিম যতিচিহ্নটি আরোপের সঙ্গে সঙ্গেই লেখকের শবদেহে সাদা চাদর আবৃত হয় । লেখক তখন হয়ে ওঠেন তার লেখার প্রথম পাঠক । অন্যদিকে এই বৃত্তের বাইরে যারা অপেক্ষমান সেখানে শুরু হয় লেখকের অমরত্ব অথবা বিনাসের দ্বন্দ্বময় ভ্রমণকাল । সপ্তম শতাব্দিতে ঈসিডোর বলেছেন যে, “letters have the power to convey to us silently the sayings of those who are absent” । যদি লেখক এই পরিসমাপ্তিতে রচনা করেন কোনও প্রতিক্রিয়াশীলতার যাপনচিত্র তাহলে পাঠকের অভিধা তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর পক্ষ-বিপক্ষ নির্বাচনের যুদ্ধে আলোড়িত হয় । পক্ষান্তরে যদি হয় শৈল্পিক কিন্তু ক্ষমতার প্রাচীরকে ভেঙেচুরে দেবার স্পৃহাহীন ব্যখ্যান তাহলে জোটে পুরষ্কারের সাফল্য । অন্যদিকে যদি তা শুধুই আদিরসাত্মক বিনোদনের ফক্কিকা হয় তবে জোটে ক্ষমতার পদতলে দাসত্বময় খ্যাতি ও বিজ্ঞাপিত প্রতিষ্ঠা । তবে একথাও ঠিক যে একমাত্র প্রতিক্রিয়াশীলতার মাধ্যমেই কিন্তু রচিত হয় সমাজপ্রগতির ভাষ্য, সেটাই প্রতিক্রিয়াশীল লেখকের মহাকাল প্রদত্ত পুরষ্কার । নইলে সভ্যতা তো বিলীন হয়ে যেত স্থবিরতার অলাতচক্রে । সুতরাং, পাঠকের চরিত্র ও দায় অবিসম্বাদিভাবে এখানে সবচেয়ে বেশি, কেননা সেই-ই যে এখানে মূল আধার ।
পড়ুয়া ও পাঠকের বাইরে সমাজের পাঠ-বলয়ে আরেকটি লক্ষন প্রায় দেখা গেছে – মেকি পাঠকবৃত্তির । আভিজাত্য রক্ষার জন্য ঘরে অনেকে বইয়ের সংগ্রহশালা বানান । কিংবা অনেক ক্ষেত্রে বইয়ের দেখদারির মাধ্যমে নিজেকে সুশীল পাঠক-সমাজের অন্তর্গত করার প্রয়াস করেন । এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় অসোনিয়াসের কয়েকটি পঙক্তি, যেখানে তিনি লিখেছেন যে,
You’ve bought books and filled shelves, O Lover of the Muses.
Does that mean you’re a scholar now?
If you buy string instruments, plectrum and lyre today:
Do you think that by tomorrow the realm of music will be yours?
অর্থাৎ, পাঠের সংগ্রহশালা হাতের মুঠোয় থাকলেই যে কেউ পাঠক হয়ে উঠবে এমনটা নয় । যে কোনও ধনী মানুষই ঘরের মধ্যে বৃহৎ পুস্তকাগার বানাতে পারেন কিন্তু খাঁটি পাঠক হওয়ার জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা হল চর্চা । আর এই চর্চা দারিদ্রের মধ্যেও বজায় থাকবে যদি থাকে অন্তর্চেতনার অভিলাষ । আমার দেখা বিমল দেব এরকমই একজন সাধক পাঠক । গবেষণাতে দেখা গেছে যে, পাঠাভ্যাস আবেগগতভাবেও মানবমনকে সংবেদিরূপে গড়ে তোলে, একে ‘ফ্লুইড ইন্টেলিজেন্স’ বলা হয় । এটি ধৈর্য, মনোপ্রবৃত্তি এবং সন্ধানে প্রবৃত্ত করে পাঠককে, মানুষকে । সুতরাং, প্রকৃত পাঠচেতনা হল বহুমাত্রিকতার ব্যাপ্তিতে বিস্তৃত ‘অন্য কোনও সাধনার ফল’ । ভণ্ডামির দ্বারা শুধু নিজেকে অপমানই করা হয় ।
বাদবাকি যারা সাধক তাদের সাধনফলেই পাওয়া যায় অমূল্য রতন । যেমন এরকমই কয়েকজন সাধকের সাধনায় ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’ও পেয়েছে লিখন-পঠনের ইতিহাসের উত্তরাধিকার । আদি অক্ষরমালা আবিষ্কারের জন্য রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাই বাঙালি বিশেষভাবে ঋণী । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায়দের কাছেও কিছু কম নয় । আসলে মানবসভ্যতার সময়বর্তনীতে রয়ে যাওয়া নানা চিহ্নের নামই তো ইতিহাস – যা থেকে তৎকালের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তদুপরি পাওয়া যায় সভ্যতার কাহিনীটি । বাঙালির ক্ষেত্রে সেই কাহিনীই উদ্ধার হয়েছিল এঁদের দৌলতে । চিহ্নের সমন্বয়ে তর্জমাকৃত এইসব বোধগুলিকে ঐতিহাসিকরা বলেন লিপি কিংবা ভাষা, আর তর্জমাকৃত বোধটিকে ধারণ করে রেখেছে যে আধার তাকেই বলে পাঠের উত্তরাধিকার। রাখালদাস কিংবা হরপ্রসাদ উন্মুক্ত করেছেন সেই উত্তরাধিকারকে সাধারণ্যের মধ্যিখানে, এখন সাধারণ সেটাকে গ্রহণ করবে না বর্জন সেটাই সভ্যতার টিকে থাকার মূল আখর। রিচার্ড উইলবুর, ইট্রুস্কান সভ্যতার লিপি প্রসঙ্গে যে কবিতাটি রচনা করেছিলেন, তাতে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এই প্রাচীন সভ্যতার ভাষার জটিল চলন যাকে আজও মানুষ সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার করতে পারেনি, ফলস্বরূপ এই সভ্যতাটির রূপ মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে । তাই চিহ্নের লেখনী ও পাঠের উত্তরাধিকারেই যে লুক্কায়িত আছে আজকের বাঙালির সভ্যতারও পরিণতি । বাঙালির কি সেই উত্তরাধিকার রক্ষার দায় নেই ? গিটহাব প্রকল্প যদিও আর্কটিক অঞ্চলের মাটির তলায় ২১ টিবির ফিল্মে সঞ্চিত করে রাখছে তাবৎ সভ্যতার যাবতীয় লক্ষন – বিভিন্ন ভাষায় । কেননা আশঙ্কা এই যে, আচমকা যদি আজকের সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয় তবে আগামি ১০০০ বছরের জন্য অন্তত রক্ষা করা যাবে এই উত্তরাধিকারকে ভাবিকালের পাঠকের ভরসায় ।
সুতরাং, প্রবন্ধের অন্তিমে এসে বোঝা যাচ্ছে যে পাঠচেতনার প্রস্তুতিপর্ব ও উত্তরাধিকারই আসলে সভ্যতা । প্রাচীনযুগের টেরাকোটার একটি অভূতপূর্ব নিদর্শন হল ২১২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের গুডীয় সিলিণ্ডার, যার গাত্রে খোদিত আছে কিউনিয়েফর্মের আদিরূপ । সেখানে দেখা যাচ্ছে যে সুমেরীয় সভ্যতার লেখনীর দেবী নিশাবার হাতে আছে একটি স্বর্ণ স্টাইলাস ও একটি মাটির ট্যাবলেট যাতে স্বর্গের ছবি ফুটে উঠেছে । সভ্যতার এই পাঠ যদি পাঠক বুকে খোদাই করে না রাখে তাহলে আজকের রবি ভর্মার “জয় জয় দেবী চরাচরসারে / কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে / বীনা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে /ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তুতে” আসবে কোত্থেকে ! এমনই একজন পাঠক হলেন রেমব্রান্ট্র যাঁর বিখ্যাত চিত্রখানির কথা মনে করা যেতে পারে যেখানে রাজা বেলশাজার, যিনি বিখ্যাত নেবুচাদনেজারের উত্তরসূরি, ঈশ্বরের লেখনী দেওয়ালের গায়ে ফুটে উঠতে দেখে বিমূঢ় হয়ে গেছিলেন । পাঠোদ্ধারেই জানা যায় প্রাচীনতম কবি হিসেবে একজন মহিলার নাম – এনহিজুয়ানা । হোমার কিংবা ব্যসদেব যাঁর উত্তরাধিকারী । ব্রাহ্মীলিপি থেকে চর্যাপদ অব্দি না থাকলে কিংবা মঙ্গলকাব্য থেকে আলালের ঘরের দুলাল অব্দি না থাকলে যেমন আমরা আজকে চন্দ্রিলের ভিডিও পেতাম না, তেমনই পেতাম না কমলকুমারের গদ্যশৈলীও । তাই সবই পেয়েছি পাঠচৈতন্যের উত্তরাধিকারেই । আর এই ‘সব পেয়েছির দেশে’ আছে একটি অন্য অস্তিত্বের সাকাররূপ, যাকে বলা হয় স্মৃতি । আগেকার দিনে শিক্ষকের কিউনিয়েফর্ম মাথায় রেখে ছাত্রকে ট্যাবলেটের অন্যদিকে লিখতে হত, আর আজকেও বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পুজোর দিনে দেখা যায় কৃষ্ণ-অশ্মরে প্রস্ফুটিত নব্যবর্ণমালার আখরে কচি হাতের মকশো। । জানতে ইচ্ছে করে মানব মস্তিষ্ক উত্তরাধিকারের কতটা পাঠ তার স্মৃতিতে ধরে রাখতে সক্ষম ? বিজ্ঞান বলছে, বড়জোর মিনিট পিছু একশো শব্দ মানুষের আয়ত্তাধীন । শেখার জন্য ২০০ শব্দ প্রতি মিনিট, বোঝার জন্য ৪০০ শব্দ প্রতি মিনিট ও আত্মস্থ করে ফেলতে পারলে প্রায় ৭০০ শব্দ প্রতি মিনিটে ধরে রাখা সম্ভব । যদিও এই দাবির ভিত ভীষণ মজবুত নয় । কিন্তু সে যাই হোক, চিত্রকল্পনা থেকে চিন্তাব্যপ্তী কিংবা শুধু বেঁচে থাকাটুকু কিংবা হাসি-কান্না সব কিছুর মধ্যেই আছে পাঠের স্পর্শ, ইঙ্গিতের পাঠোদ্ধার । এই উত্তরাধিকারকে হারিয়ে ফেললে যে আমরা নিজেদেরকেই হারিয়ে ফেলব একদিন । ফিরে যেতে হবে পশুপাখিরস্তরে । ভুললে চলবে না, দিগ্বিজয় করা রাজা অ্যালেকজান্ডারও কিন্তু মারা গেছিলেন ইলিয়াড বুকে নিয়েই । আসলে লেখাপড়ার অভ্যন্তরেই আছে দিগ্বিজয়ের হিগস-বোসন পার্টিকেল । একে ঈশ্বর-কণা বলে দায় না এড়িয়ে, এর ভূমিকা উপলব্ধির দায় শুধুমাত্র আমাদেরই ।
গ্রন্থপঞ্জী ও তথ্যসূত্রঃ
1. Alberto Manguel – A History of Reading
2. Stanislas Dehaene – Reading in the Brain
3. বাঙ্গালার ইতিহাস – রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
4. Alberto Manguel – A Reader on Reading
5. https://en.wikipedia.org/wiki/Reading
Leave A Comment