১৯৭২ সালের ২৪ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা দুটো সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে পাকিস্তানের সাবেক শাসক ইয়াহিয়াকে ভাষানী ক্ষমতা নিতে বলেছিলেন এমনটা ছাপা হয়। পত্রিকাগুলোতে কী লেখা হয়েছিল তা এখানে আমরা দেখতে পাব।
দৈনিক ইত্তেফাক:
‘তাহরিক-ই-ইশতিকলাল’ এর সেক্রেটারি জেনারেল মালিক গোলাম জিলানী বলিয়াছেন, বাংলাদেশের এর অন্যতম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ক্ষমতা দখলের জন্যে ইয়াহিয়া খানকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন।
এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মালিক জিলানী বলেন, ১৯৬৮ সালে মওলানা ভাসানীর অন্যতম সহচর জনাব মসিহুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট একখানি চিঠি দেন। চিঠিখানি লিখিয়াছিলেন মওলানা ভাসানী। চিঠিতে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়াকে বলেন, “প্রসিডেন্ট আইয়ুব খান ব্যর্থ হইয়াছেন। আপনি অগ্রসর হউন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি।”
মালিক জিলানী আরও বলেন, গত বৎসরই প্রথম আইয়ুব খান তাঁহার (জিলানীর) নিকট প্রথম জানান যে, যে লোকটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ কাগজপত্র তাহার হাতে দেন (যে কাগজপত্রে শেখ মুজিবর রহমানকে বিচার করিতে বলা হইয়াছিল) সে লোকটি হইল ইয়াহিয়া খান স্বয়ং। মালিক গোলাম জিলানী বলেন, সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর হইতেই ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে উঠিয়ে পড়িয়া লাগেন। ১৯৬৮ সালে তাঁহার (জিলানী) সহিত এক বৈঠকের সময় ইয়াহিয়া খান বলিয়াছিলেন আয়ুব দেশকে ধ্বংসের মুখে লইয়া আসিয়াছে। আইয়ুবকে সরানোর জন্যে ইয়াহিয়া জনাব জিলানীর সহযোগিতা চাহেন। পরে খোঁজ লইয়া দেখে যায় যে, ইয়াহিয়া খান অনুরূপভাবে মমতাজ দৌলতানা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মওলানা মওদুদী, নসরুল্লাহ খান প্রমুখের ও সহযোগিতা করিয়াছেন-উদ্দেশ্য আইয়ুব খানকে গদি হইতে সরানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা।
এই সময় আইয়ুব খুব অসুস্থ হইয়া পড়েন। ইয়াহিয়া তখন আরেকটু হইলে ক্ষমতা দখল করিয়া ফেলিতেন। কিন্তু সাহাবুদ্দিন ও আলতাফ গওহর একাজে তাহাকে বাধা দেন। মালিক জিলানী আরেকটি চমকপ্রদ খবরের অবতারণা করিয়াছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পতাকাটি তৈরি হয় করাচীর একটি বাংলোয় সেখান হইতে গত বৎসরের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের ভাই আগা মোহাম্মদ আলীর তত্ত্বাবধানে ইহা ঢাকায় লইয়া যাওয় হয়।
ইয়াহিয়ার অজ্ঞাত যাত্রা: অপর এক খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটা হইতে জিয়ারত পাহাড় গমন করেন এবং জিয়ারত পাহাড় হইতে আবার এক অজ্ঞাতস্থানে গমন করিয়াছেন।
দৈনিক বাংলা: ভাসানী ইয়াহিয়াকে ক্ষমতা নিতে বলেছিলেন?
মাওলানা ভাসানী জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা গ্রহণে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। পাকিস্তানের তারিথে ইশতেকলাল পার্টির সাধারণ সম্পাদক মালিক গোলাম জিলানী পিপি আইর সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক ‘যাযাবর’ বলে খ্যাত গোলাম জিলানী বলেন, ১৯৬৮ সালে মওলানা ভাসানীর অন্যতম সহচর মসিহুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট একখানি চিঠি দেন। চিঠিখানি লিখিয়াছিলেন মওলানা ভাসানী। চিঠিতে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়াকে বলেন, “প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ব্যর্থ হইয়াছেন। আপনি অগ্রসর হউন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি।” আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ইয়াহিয়ার সৃষ্টি।
গোলাম জিলানী মালিক বলেন, গত বছর আইয়ুব খান তাকে বলেছেন, ইয়াহিয়া খানই আগরতলা মামলার নথিপত্র তার (আইয়ুবের) কাছে এনেছেন যার ভিত্তিতে বিচারের চেষ্টা করা হয়।
১৯৬৮ -তে ইয়াহিয়ার চক্রান্ত: গোলাম জিলানী বলেন, সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করেছেন। ১৯৬৮ সালে ইয়াহিয়া আইয়ুবকে উৎখাত করার জন্যে জিলানীর, মমতাজ দৌলতানা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মওলানা মওদুদী, নসরুল্লাহ খানের সাহায্য চেয়েছিল। আইয়ুব খুব অসুস্থ হইলে ইয়াহিয়া তখন ক্ষমতা দখলের উদ্ধত হোন কিন্তু সাহাবুদ্দিন ও আলতাফ গওহর তা হতে দেননি।
বাংলাদেশের পতাকা করাচীতে তৈরি হয়েছে: জিলানী জানান, করাচীর একটি বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয় এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাই আগা মোহাম্মদ আলীর তত্ত্বাবধানে গত বছরের মার্চ মাসে ঢাকায় পাঠানো হয়।
ভাষানীকে নিয়ে এমন সংবাদ ছাপার পর ভাষানী থেকে কিংবা তার দলকে কোন প্রতিবাদ বা বিবৃতি দিয়েছে কিনা জানা নেই। কারণ পত্রিকায় এমন কোন কিছু ছাপা হয়নি কিংবা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। তবে একই সপ্তাহে যখন ভুট্টো ভাসানীকে পাকিস্তানে সফরের আমন্ত্রণ জানান তখন ভাষানী ভুট্টোকে কয়েকটি শর্ত দেন। ভাসানী বলেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি ও আটক বাংলাদেশীদের স্বদেশে শর্তহীনভাবে ফেরত পাঠানোর পরই শুধুমাত্র তার পাকিস্তান সফরের প্রশ্ন উঠতে পারে। এই শর্তগুলো পূরণ হলেই তবে তিনি অনুরোধ বিবেচনা করে দেখবেন।
“মালিক জিলানী আরেকটি চমকপ্রদ খবরের অবতারণা করিয়াছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পতাকাটি তৈরি হয় করাচীর একটি বাংলোয় সেখান হইতে গত বৎসরের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের ভাই আগা মোহাম্মদ আলীর তত্ত্বাবধানে ইহা ঢাকায় লইয়া যাওয় হয়।”
ইত্তেফাকের খবরের এই অংশটি যেমন মিথ্যাচার, তেমনি ভাষানীকে নিয়ে এটিও জঘন্য মিথ্যাচার, নিছকই তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর প্রচারণা। নকশাল, সর্বহারা, জাসদ সহ বিবিধ চরমপন্থী দলগুলোকে ঠেকাতে গেলে লাল-মওলানার চরিত্র হনন দরকার বটেই। পুরাই ছুপা রুস্তমী রাজকূট।
আর একই ভূয়া সাক্ষাৎকার দৈনিক সংবাদ ও অন্যান্য কাগজ প্রকাশ করেছে। তবে ভুয়া খবরের আকারটি বলে দেয়, কোন কাগজ একে কি মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রসংগত, ১৯৭২-৭৩ সালে “সর্বহারা পার্টি প্রধান সিরাজ সিকদার দলীয় কোন্দলে নিহত” এরকম একটি গুজব ইত্তেফাকে প্রকাশিত হওয়ার পর সে সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেনামে দেওয়াল লিখন হয়েছিল :
“”এক খবরের মধ্যে ঢোকায় হাজার রকম মিথ্যে-ফাঁক, সিআইএ গুজব রটায়, খবর ছড়ায় ইত্তেফাক!”…
সুব্রতর উচিত হবে শুধু পেপার ক্লিপিং তুলে না দিয়ে ঘটনা পরাম্পরায় ইতিহাস বিশ্লেষণ। নইলে নতুন করে বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে।