হিটলার যখন সামরিক পোশাক পরা বাচ্চাদের সাথে সাক্ষাৎ করছিলেন তখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে তার বাম হাত কাঁপছিল। কেউ যেন তা বুঝতে না পারে তার জন্যে পিঠের পেছনে নিয়ে হাতটিকে আড়াল করলেন। খুব শীঘ্রই হিটলার ৫৬ বছরে পা দেবেন এবং তার গোঁফ ইতোমধ্যে ধূসর হতে শুরু করেছে।
হিটলারের জীবনের শেষ দিকে যে কয়েকটি ছবি তোলা হয়েছিল এগুলো তার একটি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ১২ বছরের এক বাচ্চা ছেলের সাথে হিটলার বেশ আন্তরিকতার সাথে সাক্ষাৎ করছেন। আজকের লেখা এই ১২ বছর বয়সী হিটলারের শিশু যোদ্ধাকে নিয়ে।
এই শিশু যোদ্ধার নাম আলফ্রেড চেক (Alfred Czech)। তবে এই শিশু অন্যরকম এক উদ্দেশ্য নিয়ে তার আইডল/নেতা’র সামনে হাজির হয়েছে। আলফ্রেড বলতো, শিশুদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো আমি পাগলামো হিসেবে মনে করি না। কারণ এটি ছিল একটি যুদ্ধ।
Artur Axmann ছিল হিটলারের ইয়ুথ দল তৈরির মূল কারিগর। যে কিনা সোভিয়েতের রেড আর্মির বিপরীতে হাজার হাজার তরুণকে যুদ্ধকে পাঠিয়েছে। এই Arthur Axmann হলেন তাদের একজন যে হিটলারের শেষ সময় পর্যন্ত তার সাথে ছিলেন। হিটলারের বিয়ের সাক্ষীরও একজন।
জার্মান প্রোপাগান্ডা ছবিতে দেখানো হচ্ছে কীভাবে ১২ বছর বয়সী আলফ্রেডের সামনে হিটলার থামলেন এবং তাকে দ্বিতীয় গ্রেডের আয়রন ক্রস দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আয়রন ক্রস কিংবা লৌহ ক্রুশ ছিল প্রাক্তন প্রুশিয়া রাজ্যের সামরিক বাহিনীর বীরত্বের প্রতীকী তকমা, পরবর্তীতে জার্মান সামরিক বাহিনীতে (১৮৭১-১৯১৮) পরবর্তী সময়ে নাৎসি জার্মানি পার্টিতে (১৯৩৩-১৯৪৫) পর্যন্ত এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে রাজা ফ্রেডরিক উইলহেম (তৃতীয় প্রাশীয়ান রাজা) তার মৃত স্ত্রী রাণী লুইসের জন্মদিনে ১৮১৩ সালের ১০ মার্চ নেপোলিয়ন সময়কাল যুদ্ধের সময় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আইরন ক্রস উপাধিটি সর্বপ্রথম ভূষিত করা হয় রাণী লুইসকে।ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে এই উপাধিটি দেয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এই উপাধিটি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তকমাটিতে সামান্য পরিবর্তনও করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে, তকমাটির মধ্যখানে একটি সওয়াস্তিকা ব্যবহৃত হয়েছিল যা নাৎসি জার্মানি পার্টিকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই তকমাটি সাধারণত সামরিক বাহিনীদের দেয়া হয়েছিলো তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক ভাবে পাইলট হিসেবে বীরত্বের পরিচয় দেওয়াতে হ্যানা রেইচকে আইরন ক্র্স ফার্স্ট ক্লাস এবং সেকেন্ড ক্লাস এবং মেলিটা শেনক পান আইরন ক্রস সেকেন্ড ক্লাস উপাধি। আইরন ক্রস এর নকশা কালো এবং সাদা বা ধূসর রঙের বর্ডার রয়েছে।এই নকশাটি টিউটনিক বা আদি-জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমানে আইরন ক্রস এর ব্যবহার জার্মান আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী বুন্ডেসওয়ের এ কিছুসংখ্যক পদবি তকমাতে ব্যবহৃত হয়। (সূত্র: উইকি)
২০০৫ সালে জার্মান পত্রিকা Stern এর সাথে এক আলাপে আলফ্রেড সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করছে এভাবে; আমি তখন ১২ বছরের ছিলাম। নেতা আমার সাথে করমর্দন করলেন এবং আমার বা গালে চিমটি কেটে দিলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমিই কী এখানে সবচেয়ে কম বয়সী? তুমি যখন সৈন্যদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলে তখন কী একটুও ভয় পাওনি? জবাবে বললাম, না, আমার নেতা (Führer)। তিনি বললেন, চালিয়ে যাও।
ছবিগুলো তোলা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ২০শে মার্চ। এর ৪০ দিন পর ৩০ এপ্রিল হিটলার নিজের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেন।
অপূরণীয় ক্ষতি
আলফ্রেড চেক ছিলেন হাজার হাজার জার্মান যুবকদের একজন যাদের হিটলারের তৃতীয় রাজত্বের (Third Reich) জন্য যুদ্ধ করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৩ সালের জুলাইতে প্রথমবারের মতন যুব-বাহিনী থেকে “শিশু আর্মি” সৃষ্টি করা হয়। যাদের বয়স ছিল মাত্র ১৬ থেকে ১৮। পরবর্তীতে এটিকে SS-আর্মির ১২তম ডিভিশন হিসেবে “যুব হিটলার” কিংবা “বেবি ডিভিশন” হিসেবে নামকরণ করা হয়। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে এই শিশু ডিভিশনকে ফ্রান্সের উত্তরে নর্ম্যান্ডির কেনে (Caen in Normandie) মোতায়েন করা হয় এবং স্বাভাবিকভাবে এই ডিভিশন খারাপ-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৪৪ সালে হিটলারে যুব ডিভিশন ফ্রান্সের উত্তরে নর্ম্যান্ডিতে বন্দি হয়। তারা নিজেদের ১৮ বছর দাবী করলেও মূলত তারা এর থেকে অনেক কম বয়সী ছিল। মূলত রাজনৈতিক কারণে “বেবি ডিভিশন” প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু যুদ্ধের অবস্থা যতোই খারাপ হচ্ছিল জার্মান প্রতিরক্ষা বাহিনী ও SS ততোই বেশির করে যুদ্ধের জন্যে এসব কমবয়সী তরুণদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করল।
“হিটলারের ভুলে যাওয়া শিশু সেনা (Hitlers bortglömda barnarmé)” বইয়ের লেখক Harald Stutte এবং Günter Luck বলছেন- যুদ্ধের শেষ সপ্তাহে প্রায় ৬০ হাজার জার্মান শিশু নিহত হয়েছে, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের চেয়ে কম। আলফ্রেড চেক বলছেন, একজন কম বয়সী শিশু হিসেবে আমি বেশি কিছু ভাবিনি। আমি কেবল আমার দেশের মানুষগুলোর জন্যে কিছু করতে চেয়েছি। বাচ্চাদের যুদ্ধ যাওয়াটাকে আমি মোটেই পাগলামি হিসেবে ভাবিনি। এটি ছিল একটি যুদ্ধ।
১২ জন সৈন্যকে রক্ষা
রেড আর্মি আগ্রাসন যখন আলফ্রেডের শহর গোল্ডেনাউ (Goldenau, যা বর্তমান পোল্যান্ডে অবস্থিত) পর্যন্ত পৌঁছল , তখন আলফ্রেড জার্মান সৈন্যের একটা ছোট দলকে আহত অবস্থায় দেখতে পায়, যারা রেড আর্মির গুলি ও গ্রেনেডে আহত হয়ে পড়েছিল। আলফ্রেড আর দেরি না করে পিতার ট্রাক্টর নিয়ে সৈন্যদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দুই বারে তিনি মোট ১২ জন সৈন্যকে উদ্ধার করলেন। আলফ্রেড বলছেন, ১২ বছর বয়সেই আমি ছিলাম হিটলারের একজন উৎসাহী সমর্থক। তবে এটা ঠিক যে-হিটলারের জন্যে আমি জার্মান সৈন্যদের রক্ষার করিনি। এমন পরিস্থিতিতে যেন কোন আহত রাশিয়ান সৈন্য কিংবা পোলিশ সৈন্যদেরও বিষয়েও আমি একই কাজ করতাম। আর এই অবদানের জন্যে ১২ দিন পর এমন বীরত্বের জন্যে হিটলারের হাত থেকে আলফ্রেড আয়রন ক্রস বা লৌহ ক্রুশ লাভ করেন।
বীরত্বপূর্ণ কর্মের কয়েক দিন পর আলফ্রেডকে বার্লিনে পাঠানো হয়। সেখানে সে তার মতন আরও অসংখ্য তরুণের দেখা পায়, যারা জার্মান প্রতিরক্ষায় সাহসী ভূমিকা পালন করছে। তবে আলফ্রেডের মা এর বিপক্ষে ছিলেন। কারণ ছেলের সাথে বাজে কিছু ঘটে যেতে পারে এমনটা তিনি মনে করতেন। এমনকি তার বাবাও এর বিপক্ষে ছিলেন কিন্তু আলফ্রেড সামগ্রিকভাবে গর্বিত ছিল।
১৪ বছর বয়সী তিন জার্মান সৈন্যরা যারা ১৯৪৫ সালে জার্মানির বারস্টড (Berstadt) আমেরিকার সৈন্যদের হাতে আটক হয়।
হিটলারের সাথে দেখা করার পূর্বে ভাল করে গোসল এবং ভাল প্রাতরাশের পর ছেলেরা নিজেদের ইউনিফর্ম পরে বাগানে নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের শেষে হিটলারের সাথে নৈশভোজের জন্যে তারা বাঙ্কারে প্রবেশের অনুমতি পেল। সেখানে তাদের সাহসী কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলা হল। হিটলার তাদের জিজ্ঞেস করলেন- তারা বাড়িতে নাকি রণক্ষেত্রে যেতে চায়। আলফ্রেড জবাব দিল; রণক্ষেত্র যেতে চাই, my Führer। পরবর্তীতে আলফ্রেড আর বাড়িতে ফিরতে পারেনি কারণ গোল্ডেনাউতে জার্মান সৈন্যরা রেড আর্মির কাছে পরাজিত হয়েছে।
আমার বয়স ছিল কম এবং ছিলাম বোকাও। পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের পর আমাকে এন্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্রের (Panzerfaust) দ্রুত প্রশিক্ষণ দিয়ে রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেও হয়। পরবর্তীতে ভাবলাম, আমি সম্ভবত একটা ফাঁদে পড়ে গেছি।
আলফ্রেডকে সুদেতলানডেতে (Sudetlandet) পাঠানো হয় যা বর্তমানে চেক রিপাবলিকের অন্তর্গত। তবে সেখানে যুদ্ধ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এপ্রিলের মাঝে আলফ্রেড গুলিবিদ্ধ হয় (ফুসফুসে) এবং যুদ্ধবন্দি হিসেবে গ্রেফতার হয়। ১৯৪৭ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, তার বয়স হয় মাত্র ১৪ বছর। এই ১৪ বছরের অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চা ছেলে যখন প্রাগ থেকে তার জন্মস্থান গোন্ডেনাউতে পৌঁছায় তখন জানতে পারল সেটি আর জার্মান রাষ্ট্র নয় বরং পোল্যান্ড রাষ্ট্রের অধীনে একটি শহর।
আলফ্রেড যখন ফিরে আসলো তখন জানতে পারল যে তার পিতা নিখোঁজ ছিল। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে যুদ্ধ করার জন্যে জার্মানরা হাজারো মানুষকে নিয়ে যে স্বেচ্ছাসেবক সৈন্য দল গঠন করে, সে দলে তার বাবাও ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার পিতার লাশ পাওযা যায়।
পরবর্তীতে আলফ্রেড খনিতে কাজ করা শুরু করেন, বিয়ে করেন এবং গোন্ডেনাউ থেকে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্যে বিদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লেখেন। ১৯৬৪ সালে তার আবেদন মঞ্জুর হয় এবং আলফ্রেড পশ্চিম জার্মানির রেহলান্ডেত (Rhenlandet) শহরে নতুন জীবন শুরু করেন। আলফ্রেড ১০ সন্তানের লাভ করেন এবং ২০০০ সালের দিকে তার নাতি-নাতনির সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ টিরও বেশি!
রেড আর্মির হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে আলফ্রেড তার বীরত্বের সেই আয়রন ক্রস, পোশাক সবই ফেলে দিয়েছিল। যদিও ২০০৫ সালেও তার বাসার দেওয়ালে হিটলারের সাথে তার সেই ছবি ৮০*৮০ সে.মি ছবি যত্ন করে বাঁধাই করা ছিল। এবং প্রতিদিন একবার হলেও এই ছবিটির দিকে আলফ্রেড তাকাত। আলফ্রেড বলতো, কেন আমি এই ছবি রাখবো না কিংবা দেখবো না। এটি আমার জীবনের অংশ এবং আমার সাথে তা মিশে আছে। কিন্তু আমার সাথে সেই তরুণদের কোন যোগাযোগ নেই। তারাও হয়তো আমার মতন একা থাকতে চান। আলফ্রেড চে ২০১১ সালের জুলাইতে মারা যান। আর তাকে সমাহিত করা হয় তার স্ত্রী পাশে Kleingladbach-তে।
পত্রিকায় প্রকাশিত মূল প্রবন্ধের নাম- Så gick det för Hitlers yngsta “krigshjälte”
হলোকাস্ট নিয়ে আগ্রহীদের জন্যে:
যে ট্রেন বৈঠক বদলে দিতে পারতো নাৎসিদের ইতিহাস
নাৎসি ক্যাম্পঃ মৃত্যু হেঁটে গেছে জীবনের পথ ধরে, পর্ব ১
দারুণ লিখেছেন । বিদেশী ভাষা রপ্ত করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ইতিহাস মিথ্যা বলেনা।
আপনার মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ 🙂
ইতিহাস অনুবাদ না হলে চলবে কেন? সব বিষয়েই আরো হোক অনুবাদ। তথ্য ছড়িয়ে পড়ুক দেশ দেশান্তরে, উস্কে দেওয়া যাক জ্ঞানের স্পৃহা। কঠিন কঠিন কাজগুলো করে চলবার জন্য ধন্যবাদ সুব্রত শুভ। শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ কাজী দা। সুইডিশ ভাষা এখনো অনেক শেখার বাকি, তার উপর অনুবাদ করা যে কী কঠিন তা এখন টের পাচ্ছি।। তারপরও ব্যক্তিগত ইচ্ছায় অনুবাদ করছি।।