লিখেছেন: সুজন বড়ুয়া
আদিকাল থেকে মানুষের একটি সহজাত চিন্তাধারা হচ্ছে বেঁচে থাকার তাগিদ, কিন্তু প্রক্রিয়ার এমন ব্যবহার যে, সকল সত্তা বা জীব বস্তু অবশ্যই মরণের ফাঁদ। এটি একটি প্রকৃতপ্রক্রিয়া প্রভাব। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কিভাবে বেঁচে থাকা যায় সেটাই বের করার পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- মন যদি বস্তুগত, তবে জীবের মৃত্যু ঘটলে শরীর-জীবেন্দ্রীয় পতন হয়, সেই পতনে মন (মস্তিষ্কজাত প্রতিক্রয়া) নিষ্ক্রিয় হয়। এটাই প্রগতিশীল ধারণা। তাই প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা, তাহলে কি মন শরীর বা পদার্থ ছাড়া ক্রিয়াশীল হতে পারে? এর যৌক্তিক কোন ব্যাক্ষ্যা আছে কি? তাছাড়া মন কি এক দেহ ছেড়ে অন্য দেহে যেতে পারে? পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বুদ্ধের দর্শনে পুনর্জন্ম বিষয়টি উহ্য, এটি অভাবনীয় বা অপ্রয়োজনীয় বলে অনুমোদিত। কেউ কেউ বৌদ্ধ জনশ্রুতি বুদ্ধ’কে ডিঙ্গিয়ে অভাবনীয় বিষয়টিকে জোর করে সামনে এনে, ভাবিয়ে পুনর্জন্মের অবতারণা করেন, এটি উচিৎ কি?
বিজ্ঞান ভিত্তিক ভাবে ধরতে গেলে জীববস্তু বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়ে ভিন্নমাত্রায় প্রকৃতি টিকে থাকে।
বিভিন্ন দার্শনিক তাদের মতামত দিয়েছেন- মানুষ বেঁচে থাকার কিছু প্রক্রিয়া বা দার্শনিক চিন্তাধারা, আজকের প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক যে ধর্ম গুলো আমরা দেখতে পাই, সেখানেও রয়েছে মানুষ বেঁচে থাকার বা চিন্তাধারার বিষয় বস্তু। এটাকে সাধারণত পরকাল বা পুনঃ জন্ম অথবা জন্মান্তরবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। তদ্রূপ বৌদ্ধ মতাদর্শ নিয়ম বা মতবাদে প্রজন্মের যে কথাবার্তা গুলো রয়েছে, সেখানেও পুনঃ জন্ম বা জন্মান্তরবাদ এর বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু বৌদ্ধ দর্শন নানাভাবে বিভক্ত হওয়ায় বৌদ্ধ মতাদর্শন এর মাঝে বিভিন্ন মতবিরোধ রয়েছে। সাধারনত বৌদ্ধমতে সুখ এবং দুঃখের পথে শুভ অশুভ কর্মের প্রেরণা নিশ্চয়ই স্বীকার্য। প্রশ্ন হল এই কর্মের প্রেরণা যোগায় কে? জীব বা জীব আত্মা? কিন্তু বৌদ্ধদর্শনে জীবের জীবাত্মা নামক কোন অদৃশ্য বস্তু রয়েছে, সেটা অস্বীকার করা হয়েছে পুরোপুরি। তাহলে জীবের এই কর্মকার কে’তা আমরা ধারণা করতে পারি? সে ক্ষেত্রে বৌদ্ধ দর্শন কিছুটা নীরব থাকলেও এর জবাব কিন্তু দিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধের মতে জীব বস্তু কিংবা জড় বস্তুর অদৃশ্য-অলৌকিক বিষয় নেই বলে ধারণা। এটা স্ব স্ব বিবর্তন বা কার্যকারণ প্রক্রিয়া মাত্র।
প্রিয় পাঠক এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করে দেখুন গৌতম বুদ্ধ কিন্তু জন্মান্তরবাদ বিষয়টিকে উহ্য রেখেই দিয়েছেন। সরাসরি গৌতম বুদ্ধ যখন জিজ্ঞাসিত হয়, পুনর্জন্মের ব্যাপারে আপনার ধারণা বা মন্তব্য কি? তখন গৌতম বুদ্ধ পুনর্জন্ম সংশ্লিষ্ট ১৬ টি বিষয় নিয়ে ভাবিত না হতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন।
১. আমি কি অতীতে ছিলাম?
২. আমি কি অতীতের ছিলাম না?
৩. কি আমি ছিলাম?
৪. কি রুপ ছিলাম?
৫.কিরূপ অবস্থা হতে কি রূপ অবস্থায় আমার প্রত্যাবর্তন হয়েছিল?
৬. আমি কি ভবিষ্যতে থাকবো?
৭.আমি কি ভবিষ্যতে থাকবো না?
৮. কি হবো?
৯. কি রূপ হব?
১০. কিরূপ অবস্থা হতে কি রূপ অবস্থায় আমার প্রত্যাবর্তন হবে?
১১. আমি কি বর্তমানে আছি?
১২. আমি কি নাই?
১৩. আমি কি হয়ে আছি?
১৪. কি রুপ আছি?
১৫. আমি কোথা হতে এসেছি?
১৬. আমি কোথায় যাব?
উক্ত ষোড়শ বিষয় নিয়ে বুদ্ধ না ভাবতে নির্দেশ দিয়েছেন, কেন না এগুলি মানব কল্যাণের জন্য একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, এই বিষয়গুলি মানব কল্যাণে সত্য দর্শন বা সত্য লাভের অন্তরায়। অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে বর্তমানকে নিয়েই বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের দর্শন। প্রিয় পাঠক এতে আমরা ধারণা করতে পারি গৌতম বুদ্ধ জন্মান্তরবাদ বিষয়টিকে মানব জীবনের কল্যাণে অভাবনীয় বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে মতামত দিয়েছেন? তাছাড়া বৌদ্ধ দর্শনের একটি জনপ্রিয় গ্রন্থ “মিলিন্দ প্রশ্ন” এ পুনর্জন্ম বিষয়ক ব্যাপারে কিছুটা জবাব দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
মিলিন্দ প্রশ্ন বইটির চরিত্রে নাগসেন নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং মিলিন্দ নামে রাজার কথোপকথন হচ্ছে:
মিলিন্দ রাজ নাগসেনকে প্রশ্ন করলেন, সত্ত্বা বা লোক কি সংক্রমণ(সংক্রমিত, জন্ম গ্রহণের জন্য গমন) না করেই পুনঃ জন্ম গ্রহণ করে?
নাগসেন জবাব দিলেন হ্যাঁ মহারাজ, অবশ্যই সংক্রমণ না করেই, অথচ লোক জন্মগ্রহণ করে।
মিলিন্দ রাজ ইতস্ত হয়ে আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, সংক্রমণ করে না, অথচ কিভাবে, কি প্রকারে পুনঃ জন্ম গ্রহন করে? কোন উপমা প্রদান করুন।
নাগসেন বললেন, যদি কোন এক ব্যক্তি দীপ্ত প্রদীপ হতে অন্য প্রদীপ দীপ্ত করে, তবে কি’ সেই দ্বিতীয় প্রদীপ প্রথম প্রদীপ হতে সংক্রান্ত হয়?
মিলিন্দ রাজ জবাব দিল- না।
নাগসেন আবারো বললেন, আপনার কি মনে আছে, যখন আপনি বালক ছিলেন, তখন কোন শ্লোক আচার্য হতে কোন শ্লোক শিক্ষা করেছিলেন?
মিলিন্দ রাজ জবাব দিলেন, হ্যাঁ শিক্ষা করেছিলাম।
এদিকে নাগসেন জবাব দিলেন, মহারাজ! সেই শ্লোক কি শ্লোক আচার্যের নিকট হতে সংক্রান্ত হয়েছিল?
বরাবরের মতো মিলিন্দ রাজ আবারো একই জবাব দিয়েছেন- না। আমার আচার্য পূর্বাপর অনেক শিষ্যকে শ্লোক শিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু শ্লোক কাহারো সংক্রান্ত হয়নি!
নাগসেন জবাবে বললেন, মহারাজ এ রূপ সংক্রমণ না করেই, অথচ পুনঃ জন্ম গ্রহণ করে।
প্রিয় পাঠক, মিলিন্দ প্রশ্ন বইটি যদিও বা জনশ্রুতিতে বুদ্ধ ভাষিত নয়, কিন্তু বৌদ্ধদের মাঝে একটি জনপ্রিয় বই হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই আমরা উপরোক্ত কথোপকথন হতে দুইটি ধারণা-অনুমান করতে পারি:
১. বংশবিস্তার প্রক্রিয়া।
২. চরিত্রের বিকাশ।
এখানে পুনর্জন্ম বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত মেলে না, বরং পুনর্জন্ম বিষযটি মাধ্যমিক বা উহ্য হিসেবে ধারণা করা যেতে পারে। কেননা গৌতম বুদ্ধ এও বলেছেন যে, নাম-রুপ বা দেহ মন(আত্মা, বৌদ্ধ মতে- বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান) আলাদা কোনো বিষয় নয় বরং একে অপরের পরিপূরক, মন কোন বস্তু বা পদার্থ নয়, মন বস্তুগত বা পদার্থ জাতক কার্যকারণ।
প্রিয় পাঠক বুদ্ধের ইঙ্গিত থেকে আমরা এই অনুমান পাই যে, পদার্থ ছাড়া মন বা মনের ক্রিয়া অনুপস্থিত, কিন্তু মন ছাড়া পদার্থের ক্রিয়া বিদ্যমান-চলমান। তবে বৌদ্ধ জনশ্রুতি এও বলে যে, লোকের মৃত্যুর পর তাহার আবার পুনঃজন্ম ঘটতে পারে বা ঘটে।
ঐতিহাসিক ভাবে বিভিন্ন ধর্ম-দর্শনের পুনর্জন্ম মূলক বিষয়টি বুদ্ধের দর্শনে অনুপ্রবেশ করা হয়েছে এমন ধারণা ঐতিহাসিকদের। তাই বৌদ্ধ পিটকে পুনর্জন্ম-মূলক বিষয়টি নিয়ে স্ববিরোধ প্রতীয়মান হয় ঘন ঘন। বৌদ্ধ গ্রন্থ ছাড়া আমরা বিভিন্ন দার্শনিকের মতামত ও গ্রন্থগুলোতে দেখতে পাই, বুদ্ধের দর্শনকে সংশয়বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। আপাতত যৌক্তিকভাবে বিচার করতে গেলে বুদ্ধের দর্শন একটি সংশয়বাদ দর্শন হিসেবে মেলে। এরপরেও যদি কোন ব্যক্তি, জনশ্রুতি ও গ্রন্থ গোঁড়ামির কারণবশত বুদ্ধের সংশয়বাদ দর্শনকে জন্মান্তরবাদ দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন, সে ক্ষেত্রে মন্তব্যে আমার কিছুই বলার থাকেনা, কেননা গায়ের জোরে সত্য দর্শন চর্চা করা অসম্ভব, তবে বিশ্বাস -এর চর্চা করা যেতে পারে। গৌতম বুদ্ধ যেমন জন্মান্তরবাদ বা পুনঃ জন্ম বিষয়টিকে অপ্রয়োজনীয় কিংবা অভাবনীয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তদ্রুপ আত্মা(মন) ও ঈশ্বর ধারণাটিও অপ্রয়োজনীয় বা অভাবনীয় হিসেবে মতামত প্রদান করেছেন। সুতরাং বুদ্ধের শিক্ষা থেকে আমরা যৌক্তিক সূত্র হিসেবে ধারণা করে নিতে পারি- ঈশ্বরবাদের সহিত আত্মাবাদ, আত্মাবাদের সহিত জন্মান্তরবাদের সম্পর্ক। তদ্রুপ অনীশ্বরবাদের সহিত আনাত্মাবাদ, অনাত্মাবাদের সহিত জন্মান্তরবাদ এর সম্পর্ক থাকতে পারে না, একেবারেই চলে না।
জন্মান্তরবাদ বিষয়ে আপনাদের মন্তব্য/মতামত পেলে বাধিত হব।
আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল সকলের প্রতি…. ধন্যবাদ।
সহায় গ্রন্থ- বিশুদ্ধি মার্গ, সুত্ত পিটক, মিলিন্দ প্রশ্ন ও সত্যদর্শন।
এটাই বুজালেন পুনঃজন্ম নেই?
বেশ বিতার্কিক পোস্ট, পুরোটা পড়লাম, ভালই লেগেছে.
বুদ্ধ কে.. ১কজন বৈজ্ঞানিক আখ্যাও দেওয়া যেতে পারে।
১জন বিজ্ঞানী তার মনের মধ্যে জাগ্রত প্রশ্নের সমাধানে নিজের ইচ্ছা _শক্তি _অভিজ্ঞতা _জ্ঞান প্রভৃতি যথাযথ ব্যাবহারের মাধ্যমে সমাধান বের করেন।
বুদ্ধ ও ঠিক ৪টা বিষয়বস্তু বা মনের মধ্যে জাগ্রত প্রশ্ন কে .
অবলম্বন করে বুদ্ধত্বলাভ এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন।
* ১। কেন মানুষ জরাগ্রস্থ হয়?
*২। কেন মানুষ ব্যাধি বা রোগে আক্রান্ত হয়?
*৩। কেন মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়?
*৪। জরা_ব্যাধি_মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ বা এগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় কি???
সুতরাং, বুদ্ধ ধর্ম এই ৪ বিষয় বস্তুুকে অবলম্বন করে, জন্মান্তর বাদকে নিয়ে নয়.. এজন্য বুদ্ধ সরাসরি জন্মান্তর বাদকে উহ্য রেখেছেন, কারণ সেটা অনেকটা কূল কিনারাহীন সাগরে দিনরাত সাঁতরানো সমান। তবে, কেউ যদি বুদ্ধের ভাবিত ৪ বিষয় বস্তুকে নিজের মধ্যে স্থান দিয়ে তা, বুদ্ধের দেখানো পথ অনুসরণ করে.. ৪ প্রশ্নের সমাধান করতে সক্ষম হয়.. তাহলে, সেই শুধুমাত্র জন্মান্তর সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে.. কেননা ১ গ্লাস স্বচ্ছ পানি টেবিলের উপর রাখলে, তার উপারেও পানির স্বচ্ছতা র জন্য দেখা যায়, কিন্তু ১ক গ্লাস ময়লা পানিতে সেটা দেখা সম্ভব নয়।
অাপনি যা বলেছেন সেটা নিজের অান্দাজে। বুদ্ধ যে চার সত্য ভাবিস্কার করেছেন সেটা হচ্ছে চারি অার্যসত্য।
দুঃখ, দুঃখ সমুদয়, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধ মার্গ।
আচ্ছা ধরে নিলাম বুদ্ধ ঈশ্বর, আত্মা,পুনর্জন্ম এসব কিছুই অস্বিকার করেছেন । জগতের সব কিছুই পরিবর্তনশীল, সংসয়বাদী আবার উনি নাস্তিকও না। তাহলে উনি কি বলতে চান ? মানুষ কেন উনার মতবাদকে অনুসরণ করবে? কেনই বা বলবে বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি।
তাছাড়া গীতার মত একটা সুন্দর জীবন বিধান থাকতে উনি কেনই বা আরেকটা মতবাদ দিলেন কেননা গীতায়ও অহিংসা কথা আছে । আমি খুবই কনফিউজড। বুদ্ধ নতুন কি দিলেন?
(সকল ধর্মই মনুষ্য সৃষ্ট)
গীতা যে অহিংসা মূলক, সেটা আপনাকে কে বলল গীতা তো একটা যুদ্ধক্ষেত্র, লক্ষ লক্ষ হোমো স্যাপিয়েন্স হত্যা করা হয়েছে, আর আপনি বলছেন গীতার অহিংসা বাণী, গ্রন্থ গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসুন, সত্যের সন্ধান করুন, হাসির কথা বললেন ভাই!