বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টগুলো ফ্যাক্টরগুলো বিশ্লেষণ করলে এটি সুস্পষ্ট যে, এই নৃশংস ঘটনাটি ছিল পাকিস্তান-আমেরিকা-সৌদিআরব-চীন এবং দেশীয় দালাল ও স্বার্থান্বেষীদের একটি কূটপরিকল্পনার পরিণতি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চীনের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের বিরোধী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আলো নিভিয়ে দিতে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্রের একটি ছিল চীন। পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ, জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন, বাংলাদেশের চীনাপন্থীদের একটি বড় অংশকে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা, অপর অংশকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় নিযুক্ত করা তথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল চীন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশ ভারত ও রাশিয়ার সাথে পরম মিত্রতার সর্ম্পক বজায় রাখে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চীনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের নীতি পরিবর্তিত হয়নি বরং তা আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করে চীন নিজের জন্য সুবিধাজনক শাসকগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সরকারে দেখতে চেয়েছিল। খন্দকার মোশতাক ও জিয়ার শাসনামল ছিল তাবেদারির; সেই সময়ে আমেরিকা-চীন-সৌদিআরবের বলয়ে থাকা বাংলাদেশ প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পিছনে আন্তর্জাতিক ক্রিড়নক কারা।
বাংলাদেশে চীনের সবচেয়ে বড় এজেন্ট ছিলেন মওলানা ভাসানী। চীনের ষড়যন্ত্রের প্রতিফলন স্বাধীন বাংলাদেশে তার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে। চীনের সাথে সেসময় ভারতের উষ্ম-দ্বন্দ্ব ও পাকিস্তানের পরম-মিত্রতা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সহযোগীতা করায় বঙ্গবন্ধু সরকারের সাথে চীনের সম্পর্ক ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র এবং ভারতের মিত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় চীন আর এই কাজে চীনের প্রতিনিধিত্ব করে ভাসানী।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর রাজনীতির ধারা ছিল চীনের আদেশ পালন করা- এই কাজ করতে যেয়ে ভাসানী বঙ্গবন্ধু, তাঁর সরকারের ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করতে চেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির বিরোধিতা করেছেন, ভারত বিরোধিতা করেছেন, হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়েছেন, পাকিস্তানের সাথে উষ্ণ যোগাযোগ রেখেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছেন, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে চীনের ভূমিকা ও ভাসানীর দায় তাই এক সূঁতোয় গাঁথা।
ষড়যন্ত্র, চীনের ভেটো-
১৯৭২ সালের ০৪ এপ্রিল লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায়’ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘সিআইএ এবং চীনের সহায়তায় মওলানা ভাসানী বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন’। এর প্রমান পাওয়া যায়, কয়েকদিন পরেই। ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য পদ দানের প্রস্তাবে চীন ভেটো দেয়। চীনের অনুগত দালাল ভাসানী শুধুমাত্র একটি বিবৃতি দিয়েই তখন দায়িত্ব শেষ করেন। আন্দোলন সংগ্রামে মুখর ভাসানী তার চীনা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থেকেছেন কিন্তু সেসময় ঠিকই তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মুখর ছিলেন, সভা-সমাবেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের একহাত নিতে তিনি ছাড়তেন না।
চীনের দালাল-
চীনের সাথে ভাসানীর সম্পর্কের গভীরতা পাওয়া বুঝতে ১৯৭৩ সালের একটি ঘটনার দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। ১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধীতা করে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা করে।সেই সভায় ভাসানী বলেছিলেন, ‘মুজিব, তুমি আমার সঙ্গে পিকিং বলো, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গণচীনের স্বীকৃতি আদায় করবো (দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ জানুয়ারি, ১৯৭৩)।
ভুট্টোর সাথে বন্ধুত্ব-
জুলফিকার আলী ভুট্টোর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাই, স্বাধীন বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর ভয়ানক শত্রু ছিল ভূট্টো। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে ভুট্টো প্রকাশ্যে উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করেছিল এবং খুনিদের দ্বারা গঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই ভূট্টোর সঙ্গে ভাসানীর উষ্ণ ও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ভুট্টো-ভাসানী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একযোগে কাজও করেছিল, ভাসানীর ‘মুসলিম বাংলা’কে ভূট্টো সহযোগীতা করেছিল (হিস্টোরি অব ফ্রিডম-মুভমেন্ট ইন বাংলাদেশ : জ্যোতি সেন গুপ্ত)।
ভাসানী পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য দালালীও করেছিল। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে এক গণসমাবেশে ভাসানী বলেছিল, “মি. ভুট্টো, আপনি কেন আমাদের স্বীকৃতি দিচ্ছেন না? আপনি যদি স্বীকৃতি দেন, তা হলে আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন। এই সে দিন পর্যন্ত এদেশ পাকিস্তানি মালপত্রের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল এবং আবারও তাই হবে” (দি স্টেটসম্যান, কলকাতা; ১৫ মে, ১৯৭৩)।
একাত্তরের দালালদের আশ্রয়দান-
মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানপন্থী দালালদের ভাসানী তার ‘মুসলিম বাংলা’র’ মাধ্যমে পুনর্বাসিত করার সুযোগ করে দেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক-দালাল জামাতে ইসলামির মুখপাত্র ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা ‘মুসলিম বাংলা আন্দোলনের’ পক্ষে নিয়মিত প্রচার অভিযান চালানো হয়েছিল। ভাসানী এসবের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে বলেন, ‘মুসলিম বাংলার জন্য যারা কাজ করছে, তাদের আমি দোয়া করি, আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে (গণকণ্ঠ; ১৫ জুন, ১৯৭১)। ভাসানী ‘খোদাই খিদমতগার’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, এই সংগঠনে রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তান আমলের ইসলামি ছাত্র সংঘের মাঠপর্যায়ের সদস্যরা যোগদান করে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময় ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’, এর ছায়াতলে আশ্রয় পায় একাত্তরের দালাল, পাকিস্তান-পন্থী বাঙালি, ডানপন্থী ও চৈনিক বামপন্থী রাজনীতিকরা।
একাত্তরের দালালদের বিচারে বাঁধা–
ভাসানী পাকিস্তানের সহযোগী দেশীয় বর্বর দালালদের বিচারকার্যে বিঘ্ন করার চেষ্টা করেছিল। ভাসানীর দল ন্যাপের একটি বড় সংখ্যক নেতা-কর্মী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের দালাল হিসেবে কাজ করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা দেন এবং এই বিষয়ে তাঁর আন্তরিকতার নজির হচ্ছে- ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি অর্থাৎ, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দুই সপ্তাহের মাথায় বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ কোলাবোরেটর্স ট্রাইব্যুনাল অর্ডার ১৯৭২’ জারি করে।
দালাল আইনে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ভাসানীর ন্যাপের অনেক নেতাকর্মী ছিল। এদের মধ্যে ছিল ভাসানীর ন্যাপের র্শীষনেতা মশিউর রহমান (যাদু মিয়া)। যাদু মিয়া জিয়াউর রহমানের সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার সিনিয়র মন্ত্রী ছিল এবং ভাসানির মৃত্যুর পর ন্যাপের সভাপতি হয়। ভাসানী দালাল আইন ও দালালদের বিচারের বিরোধী ছিল; এমনকি দালাল আইন বাতিলের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারকে চাপ পর্যন্ত দেয়। ১৯৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে দালাল আইন বাতিল করার জন্য ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন।
ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা-
সাধারণ ও ইসলামী বেশভূষাধারী হবার কারনে আমজনতার কাতারে মিশে যেতে পারা ভাসানীর গ্রহণযোগ্যতা ছিল আম-বাঙালির কাছে। ভাসানী তার এই গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের আমজনতার মাঝে তার পরম পূজণীয় চীনের শত্রু ভারত ও রাশিয়ার প্রতি বিদ্বেষ এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৫ আগস্ট ভাসানী মুক্তিযুদ্ধের পরমমিত্র ভারতকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর শত্রু’ বলে আখ্যা দেন। ১৯৭২ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর ভাসানী বঙ্গবন্ধু সরকারকে ‘ভারতের পুতুল’ বলে অভিহিত করেন (গণকণ্ঠ; ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২)। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভাসানীর ন্যাপের মূল এজেন্ডাগুলোতে ভারতবিদ্বেষীতা স্পষ্ট ছিল। ‘ভারতের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙে বাংলাকে আজাদ করা’ এসব অর্ন্তভুক্ত ছিল ভাসানীর নির্বাচনী ওয়াদায়।
বঙ্গবন্ধু সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্টতার বিষয়ে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হন ভাসানী। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে গণসমাবেশে বলেন-
“আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের ভুলনীতি অনুসরণ করার ফলে উক্ত পরিণতি অবশ্যম্ভাবী। …এই দু’টি দেশ এ দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। …বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অত্যধিক মূল্যের জন্য ভারত দায়ী। …বাংলাদেশ ভারতের গোলাম পরিণত হোক তা আমরা চাই না। …আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যদি ভারতের ক্রীড়নক থাকার নীতি অব্যাহত রাখে, তা হলে আজ যারা পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে বিচারাধীন রয়েছে, তারাই ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে তাদের বিচার করবে।” (দি স্টেটসম্যান, কলকাতা; ১৫ মে, ১৯৭৩)
হিন্দুবিদ্বেষ–
ভারতবিদ্বেষীতার সাথে সাথে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি ভাসানীর ন্যাপের সাম্প্রদায়িক মানসিকতা স্পষ্ট হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে ভাসানী ন্যাপের মিছিল হতে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম, মুজিববাদের অপর নাম’, ‘হিন্দুরা যদি বাঁচতে চাও, বাংলা ছেড়ে চলে যাও’ –এজাতীয় স্লোগান দেয়া হয়েছিল। (সাপ্তাহিক একতা; ০৬ এপ্রিল, ১৯৭৩)
ভাসানীর নিজমুখেও সাম্প্রদায়িক বিষবাণী উচ্চারিত হয়; হিন্দুদের উদ্দেশ্যে ভাসানী বলেন-
“তারা যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে তাদের নিরাপত্তা এবং স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তা পাবে বলে ভেবে থাকে, তাহলে তাদের ভাগ্য বিহারীদের মতো হবে। …জয় বাংলা অথবা আওয়ামী লীগ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না, তোমাদের ভাগ্য বিহারীদের মতোই হবে।” (দি স্টেটসম্যান, কলকাতা; ১৫ মে, ১৯৭৩)
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ষড়যন্ত্র-
ভারত ও হিন্দুবিদ্বেষীতা শুধু নয়, ক্রমেই ভাসানীর কর্মকান্ড উগ্র মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের সাথে মিলে যেতে থাকে। ভাসানী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগণ তথা মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলতে ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে গণসমাবেশে ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে কম ধর্মপরায়ণ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু আল্লাহর রহমত চান না বলে উল্লেখ করেন। (দি স্টেটসম্যান, কলকাতা; ১৫ মে, ১৯৭৩)। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ বিরোধিতা করতে থাকেন ভাসানী।তিনি সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সরিয়ে কুরআন, সুন্নাহ ও হাদিস তথা ধর্মকে ভিত্তি করে সংবিধান ও আইন রচনার দাবি করেন। (মর্নিং নিউজ; ৮ অক্টোবর, ১৯৭২)
বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে ধর্মভিত্তিক তথা ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল ভাসানী। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে’র গণসমাবেশে তিনি বলেছিলেন, “…অতি শিগগিরই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে এবং ঢাকার বাড়িঘরের উপর মুসলিম বাংলার পতাকা উড়বে।” (দি স্টেটসম্যান, কলকাতা; ১৫ মে, ১৯৭৩)
৭৩-এর নির্বাচনে ভাসানীর দল একটি আসনও না পেয়ে ভাসানী মুসলিম সেন্টিমেন্টের দুয়ো তুলে বঙ্গবন্ধু ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। এসময় ভাসানী সাম্প্রদায়িক বিষবাণী প্রচার করে চুড়ান্ত উসকানি দেয়া শুরু করে। ১৯৭৩ সালের ২৪ মার্চ ভাসানী কর্তৃক প্রকাশিত ‘জ্বেহাদ’ নামক বুলেটিনে ভাসানীর একটি চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক আহবান প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা হয়-
“যে মুসলমান সমাজ এককালে বিশ্বের সেরা জাতি ছিল, দিল্লিতে সাতশ বছর জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ন্যায়পরায়ণ বাদশা ছিল, আজ তাহারাই পথের কাঙাল হইয়া পড়িয়াছে। বিধর্মীরা কতিপয় হিন্দুস্থান সরকারের দালাল মুসলমানদের সহায়তায় রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে নিরপরাধ মুসলমানদিগকে অপমান, অপদস্ত ও মারপিট করিতেছে। …আমাদের ধর্মের বিধান ও আল্লাহর আদেশ- বিধর্মীরা যদি মুসলমানদের প্রতি অন্যায়ভাবে প্রথমে আক্রমণ না করে তাহা হইলে তাহাদের কখনও আক্রমণ করা যাইবে না। তাহাদের ধর্মের কোন প্রকার বিঘ্ন ঘটানোও যাইবে না। কিন্তু যদি তাহারা অন্যায়ভাবে মুসলমানদিগকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে উহা কিছুতেই বরদাস্ত করিবে না, পাল্টা আক্রমণ করিয়া সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করিতেই হইবে।… …আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া অনেকদিন ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। বর্তমানে সন্তোষে ফিরিয়া আসিয়া জানিতে পারিলাম,টাঙ্গাইল জেলার এক শ্রেণীর ‘হিন্দুস্তানের দালালরা’ মুসলমানদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাইতেছে। কিছু সংখ্যক উগ্রপন্থী হিন্দু আওয়ামী লীগ ইলেকশানে জয়লাভ করিবার পর হইতে মুসলমানদের উপর প্রকাশ্যভাবে নির্যাতনের স্টিম রোলার নির্বিবাদে চালাইয়া যাইতেছে। জানিতে পারিলাম, তাহারা একজন প্রবীণ মুসলমানের দাড়ি পর্যন্ত টানিয়া তুলিয়াছে।’’
‘হক কথা’ ও ‘হক বাণী’ পত্রিকা দুটো ছিল ভাসানীর তথা চৈনিকদের প্রোপাগান্ডা মেশিন। এই দুটো পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়। বাংলাদেশ ভারত-রাশিয়ার গোলাম, মুজিব ভারতের আজ্ঞাবহ, দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, হিন্দুরাজ কায়েম হচ্ছে বাংলাদেশে, মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে বাংলাদেশে, হিন্দুরা বাংলাদেশের সব ক্ষমতা-অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছে, মুজিব ও তার সরকার ইসলাম বিরোধী – এজাতীয় প্রোপাগান্ডা প্রতিনিয়ত চালিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়কে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছিল ভাসানী।
ষড়যন্ত্রের চৈনিক রাজনীতি–
চীনের অনুসারীরা স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্থির করতে এবং বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি করতে হেন কোন কাজ নেই, যা করেনি। চীনাপন্থীরা বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতীয় দুশমন’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে ‘খতম’ করার ঘোষণা দেয়। চীনাপন্থী সিরাজ সিকদার, হক, তোয়াহা, মতিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেনদের চীনাপন্থী গ্রুপগুলো ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করে। চীনাপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে শীর্ষে থাকা চীনের অনুগত ভৃত্য মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করে ‘নতুন পতাকা ওড়াবার’ ঘোষণা দেয়।
বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের ঘোষণা-
বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের ইঙ্গিত ভাসানী ১৯৭২ সাল থেকেই দিয়ে আসছিল। ১৯৭২ সালের ২৪ আগস্ট দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব আসন্ন।’ ১৯৭৩ সালের ১৪ মে এক গণসমাবেশে ভাসানী বলে, “অতি শিগগিরই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে’। (দি স্টেটসম্যান, কলকাতা; ১৫ মে, ১৯৭৩)
বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত-চেষ্টায় ভাসানীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় জাসদের আ.স.ম. আবদুর রবের কথায়; ১৯৮৮ সালের ১০ নভেম্বর সংসদে জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ.স.ম. আবদুর রব বলেন, ১৯৭৩ সালে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে গোপনে দেখা করে তিনি মুজিবসরকার বিরোধী আন্দোলনে তাকে নেতৃত্বদানের অনুরোধ করেছিলেন। উত্তরে ভাসানী বলেছিল, ‘মুজিব বেঈমান, মীরজাফর, তাঁকে উৎখাত করতে হবে’।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে ভাসানী-
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। এর সপ্তাহখানেক পরেই ২৪ আগস্ট ভাসানী বঙ্গবন্ধুর খুনি ও ষড়যন্ত্রীদের গঠিত সরকারকে সমর্থন করে তিনি এই সরকারের প্রতি ‘মেহনতি মানুষ, বুদ্ধিজীবী, সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারী,সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী, বেসামরিক নাগরিক এবং মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই নয়, সবার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরোপুরি অর্জনের জন্য নিরলসভাবে কঠোর পরিশ্রম করার’ আহবান জানান (দৈনিক বাংলা; ২৫ আগস্ট, ১৯৭৫)।
১৯৭৫ সালের ০৭ নভেম্বর ক্ষমতায় আসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আরেক ষড়যন্ত্রী জিয়াউর রহমান। সামরিক শাসক জিয়াকে সমর্থন করেছিলেন ভাসানী। জিয়াকে লেখা একটি চিঠিতে ভাসানী লিখেন-
‘আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা, তুমি বিরাট দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছ, তাহা পালন করিতে সক্ষম হও।’
এবিষয়ে ভাসানীর দল ন্যাপের মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া একটি কলামে লিখেছেন-
“৭৫–এর ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, মওলানা ভাসানী যদি সেদিন জিয়াউর রহমানকে সমর্থন না জানাতেন; তবে এ সংগ্রাম হয়তো তখন নিঃশেষ হয়ে যেত। আধিপত্যবাদ–সাম্রাজ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ–আগ্রাসনবাদের কালো থাবা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এ দেশের দেশপ্রেমিক সিপাহি–জনতার সংগ্রামের পাশে মওলানা ভাসানীর সমর্থন সংগ্রামকে করেছিল বেগবান। ৭ নভেম্বর পরবর্তী শুধু জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং জিয়ার সরকার এবং দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মওলানা ভাসানী বৃদ্ধ বয়সে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে। জনসভায় বক্তব্যের মাধ্যমে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার করেছেন। পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে করেছেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ। ৭ নভেম্বরের চেতনার সাথে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও শহীদ জিয়াউর রহমান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।”
সাংবাদিক এল.কে. খতিবের বই অনুসন্ধানী বই ‘হু কিল্ড মুজিব’-এও আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনের ষড়যন্ত্রী জিয়াউর রহমানের প্রতি ভাসানীর সমর্থন ও সহযোগিতার উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সবচেয়ে বড় বেনেফেসিয়ারি জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করাটা স্বাধীন বাংলাদেশে চীনের প্রধানতম ভৃত্য ভাসানীর জন্য খুবই স্বাভাবিক ছিল।
দ্য চায়না ফ্যাক্টর-
বঙ্গবন্ধুর দুই খুনী ফারুক ও রশীদ ১৯৭৫ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকাস্থ মার্কিন রাজনৈতিক কাউন্সিলরের সাথে দেখা করে অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করে। পরদিন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি তারবার্তায় জানান যে, ফারুক-রশীদ চীন বা পাকিস্তান হতে ‘পর্যাপ্ত সহায়তা’ পাবার ভরসা করছে না।
মাসখানেক পর ১৯৭৫ সালের ২০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আমেরিকার ভিসার জন্য ব্যাংককে অপেক্ষমান থাকাকালীন সময়ে ফারুক মার্কিন রাজনৈতিক অফিসারকে বলেছিল, ভারত বাংলাদেশে যেন কোন পদক্ষেপ না নেয়, সেজন্য চীন সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করছে। (Indira called KGB to verify ‘Chinese’ hands in Bangabandhu killing – Mizanur Rahman Khan)
প্রসঙ্গতঃ চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের দুই সপ্তাহ পরে।
চীনের প্রতি ভাসানীর আকন্ঠ আনুগত্য ভাসানীকে মানসিকভাবে অন্ধ করে তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা চীনের প্রতি দালালি করতে যেয়ে ও ব্যাক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধু সরকারের নামে অপপ্রচার, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচী-ষড়যন্ত্র, চরম ভারত-বিদ্বেষীতা, ক্রমেই দক্ষিনপন্থী সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ, দালালদের বিচারের বিরোধিতা, জিয়া সরকারের সাথে একসাথে কাজ করা –এসব কর্মকান্ড ভাসানীকে ইতিহাসে কলঙ্কিত করে রেখেছে। তাই, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মত গর্হিত পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় ভাসানী এড়াতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রায় দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে পাকিস্তানপন্থী, বঙ্গবন্ধুর খুনি, তাদের পৃষ্টপোষক ও এই ঘটনার বেনেফিসিয়ারিরা তাদের ক্ষমতাকালে ভাসানীর একটি ক্লিন ইমেজ গড়ে তুলেছিল। তাই, ভাসানী সম্পর্কে আম-বাঙালির মাঝে এত ভক্তি। কিন্তু বাস্তবের নিরিখে ভাসানীকে বাংলা, বাঙালির বন্ধু বলা চলে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর পর বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতি প্রদান, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ভাসানীর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও পরবর্তীতে জিয়া সরকারের সাথে তার ঘনিষ্টতা থেকে বুঝে নেয়া যায়, বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতে তথা হত্যাকান্ডে চীনের ভূমিকা ও ভাসানীর দায় কতটা বিস্তৃত।
সহায়ক সূত্রঃ
১. মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ – দৈনিক জনকন্ঠ।
২. Indira called KGB to verify ‘Chinese’ hands in Bangabandhu killing – Mizanur Rahman Khan – Prothom Alo English.
৩. Who Killed Mujib? – A L Khatib.
৪. ৭ নভেম্বর : মওলানা ভাসানী ও শহীদ জিয়া
শনিবার এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া – দৈনিক সংগ্রাম।
৫. History of Freedom Movement in Bangladesh (1947 – 1973) – Jyoti Sen Gupta
### প্রবন্ধটি এগিয়ে চলো ওয়েবপোর্টালে নভেম্বর ২৬, ২০১৭ – তে প্রথম প্রকাশিত হয়। (লিংক)
### প্রবন্ধটি ২০১৮ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন Arnika. (লিংক)
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পারস্পরিক বোঝাপড়া অটুট ছিল। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকার পরও যাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিতৃতুল্য সম্মান করতেন। মওলানা ভাসানীও বঙ্গবন্ধুকে সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। ১৯৫৭ সালে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলেও সত্তরের নির্বাচন বর্জন ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু পর্যন্ত ইতিহাস বিশ্নেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ১১ মার্চ টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি বাঙালির নেতা। নেতার নির্দেশ পালন করুন।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মওলানা ভাসানী গুরুর মতো পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মসিউর রহমান ১৫ আগস্ট, ২০১৫ দৈনিক কালের কণ্ঠে লিখেছেন, মওলানা ভাসানীর অনুরোধ কখনও উপেক্ষা করা হতো না। একবার বঙ্গবন্ধুকে তিনি চিঠি লিখলেন, তাঁর ওষুধের দরকার। থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানালে তাঁরা ওষুধটি পাঠান। মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে সেই ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয়।
১৯৭৪ সালের ১৪ এপ্রিল ভাসানী পল্টনে এক মহাসমাবেশের ডাক দেন। পরে একটি মিছিল নিয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ঘেরাওয়ের জন্য বঙ্গভবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। খবর শুনে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান রাস্তায় চলে আসেন। মিছিল কাছে আসতেই বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। এ দৃশ্য দেখে হাজার হাজার মিছিলকারী জনতা হতভম্ব। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘হুজুর’ ও কয়েকজন নেতাকে সম্মান দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। হুজুরকে ধরে ধরে নিলেন। ভেতরে বসিয়ে মিষ্টিমুখ করালেন। সার্বিক পরিস্থিতি হুজুরের সামনে তুলে ধরলেন। হুজুর কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলেন।
মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা নিয়ে ইতিহাসে এমন বহু ঘটনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মওলানা পুত্রসম স্নেহ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেক সেক্রেটারি এসেছে, কিন্তু মুজিবরের মতো যোগ্য সেক্রেটারি অন্য কাউকে পাইনি।’ উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মওলানাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায়ই কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই শুধু গাড়ির ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। সে খবর তৎকালীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই জানতেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তখন মওলানা ভাসানী খুবই কেঁদেছেন। তিনি ওইদিন বারবার বলেছেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল!’ তিনি এত দুঃখ পেয়েছিলেন যে, ওইদিন কোনোকিছুই খাননি; কারও সঙ্গে সাক্ষাৎও করেননি।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো অবনতি ঘটেনি। মওলানা ভাসানী-বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে চমৎকার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। ‘ভাসানীকে যেমন জেনেছি’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন (পৃ. ৭৮) :”গভর্নরদের নাম ঘোষণার তিন-চার দিন আগে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গণভবনে গেছি। দেখি বঙ্গবন্ধু বের হচ্ছেন। দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো কাজ আছে নাকি?’ বললাম, ‘না, এমনিই আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।’ বঙ্গবন্ধু আর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী একটা টয়োটা গাড়িতে উঠলেন। সাধারণত বাড়িতে ফেরার সময় তিনি মার্সিডিসে ফেরেন এবং একা। আমি ভাবলাম, বঙ্গবন্ধুর পিছু পিছু তাঁর বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বাসায় ফিরব। ওমা! গণভবনের গেট ছেড়ে গাড়ি ডানে না গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিল। আমরাও পিছু নিলাম। ভাবলাম, অন্য কোথাও যাবেন। ফার্মগেট থেকে শহরের দিকে না গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিলো। আমরাও পিছু নিলাম। ভাবলাম, অন্য কোথাও যাবেন। ফার্মগেট থেকে শহরের দিকে না গিয়ে গাড়ি ঘুরল টাঙ্গাইলের দিকে। অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে আমরা যখন চৌরাস্তা পর্যন্ত এলাম, তখনও বুঝতে পারিনি- যাচ্ছেন কোথায়। চৌরাস্তায় এসে পরে বুঝলাম, টাঙ্গাইল যাচ্ছেন। সত্যিই তাই। উনি সন্তোষ গেলেন। বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু ও মনসুর ভাই হুজুরের ঘরে গেলেন। আমি প্রায় তিনশ’ গজ পেছনে রাস্তা থেকে দূরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খুব সম্ভবত তাদের মিনিট চল্লিশেক আলাপ হলো। আবার ছুটলেন ঢাকার দিকে।”
স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ায় তৎপর মওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জন করায় ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে জিতে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত সময়ে শেখ মুজিবের প্রতি মওলানা ভাসানীর ‘সমর্থন’ দেওয়ার এই কৌশলকে ‘রীতিমতো মাস্টার স্ট্রোক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরও একবার স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মওলানা ভাসানী।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার শোকের মাস আগস্ট এলেই দেশে কিছু চাটুকার মুজিব-বন্দনার আড়ালে ইতিহাস বিকৃতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যা আজকের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে। এসব চাটুকার কিছুটা ঘুরিয়ে হলেও সুকৌশলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মওলানা ভাসানীকে জড়িত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। তারা কখনও কখনও বলে থাকে, মওলানা ভাসানী নাকি খন্দকার মোশতাকের সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানাননি। অথচ সত্য হলো, খন্দকার মোশতাকের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে দূত পাঠানো হয়েছিল তার সরকারকে সমর্থন করে একটি স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু মওলানা তার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ মওলানাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মওলানা সবার চালাকি বুঝতে পারতেন।
মনে রাখতে হবে, মওলানা ভাসানী কোনো সাধারণ নেতা ছিলেন না। প্রায় ৮০ বছরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি নিজের দেশ ও জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই-সংগ্রাম করেছেন আপসহীন ভূমিকায় থেকে। বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কোনো না কোনোভাবে মওলানা ভাসানীর কাছে ঋণী। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে সংঘাত ও অনৈক্যের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়াও ছিল মওলানা ভাসানীর প্রধান অবদান। তিনি
ছিলেন মুজিবনগর সরকার গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশ্নে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর অবস্থানকে যারা বিতর্কিত করতে চায় বা করছে, তারা মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। তারা মওলানা ভাসানীর অনুসারী ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও চেতনার পক্ষের শক্তিকে বিভক্ত রেখে নিজেদের ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। মনে রাখতে হবে, ভাসানী-মুজিবের সম্পর্ক প্রসঙ্গে যাদের সামান্যও ধারণা রয়েছে, তাঁরা নিশ্চয় একবাক্যে স্বীকার করবেন, ‘পুত্রের মতো’ প্রিয় শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবাসতেন মওলানা ভাসানী।
প্রসঙ্গক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সংলাপের কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। সেদিন আমি মওলানা ভাসানী সম্পর্কে কিছু কথা বললে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উত্তরে বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী মহান নেতা। তিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধার। তাঁর অমর্যাদা করা কারও উচিত হবে না। ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর মওলানা ভাসানীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মধ্যে ছিল ‘প্রগাঢ় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’। এই বিষয়টি বরাবরই তিনি উল্লেখ করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যটুকু থেকে নামধারী ইতিহাসবিদদের শিক্ষা নেওয়া এবং এর মর্মকথা অনুধাবন করা উচিত। ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, মজলুম জননেতা প্রদর্শিত পথ ভুলে গেলে কিংবা সেই পথ থেকে বিচ্যুত হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
“স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর রাজনীতির ধারা ছিল চীনের আদেশ পালন করা- এই কাজ করতে যেয়ে ভাসানী বঙ্গবন্ধু, তাঁর সরকারের ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করতে চেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির বিরোধিতা করেছেন, ভারত বিরোধিতা করেছেন, হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়েছেন, পাকিস্তানের সাথে উষ্ণ যোগাযোগ রেখেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছেন, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে চীনের ভূমিকা ও ভাসানীর দায় তাই এক সূঁতোয় গাঁথা। ”
ভাসানী অবশ্যই চীনপন্থী ও বংগবন্ধু বিরোধী ছিলেন। কিন্তু কিছু পেপার ক্লিপিং এ পুরো লেখায় এরকম একপেশে সরলীকরণ, নাবালক ফতোয়ায় বিস্মিত হয়েছি।
লক্ষ্যনীয়, পুরো লেখায় কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন, অসংখ্য কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, এমন কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাধ্যমত সহায়তা — ভাসানীর সারাজীবনের আত্মত্যাগ উপেক্ষা করা হয়েছে।
সে সময় সরকার ব্যবস্থার ভেতরের অস্থিরতা, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, অপরাপর চীনপন্থী বাম দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা, একদলীয় বাকশালি, শাসন, রক্ষীবাহিনীর অপারেশন — ইত্যাদি বাস্তবতাও এই লেখায় নাই, যা হয়তো বাস্তবে ক্যু – পাল্টা ক্যুকে অনিবার্য করে তোলে। মাসকারেনহাস “আ লিগেসি অব ব্লাড” বইয়ে বিষয়টি আরও বিশদে বলেছেন।
এছাড়া ১৯৭১ পাকিস্তানকে সক্রিয়ভাবে সবচেয়ে বেশি সহায়তাকারী আমেরিকা, তথা সিয়াইএ বংগবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যে মূখ্য ভূমিকা রাখেনি, সে সন্দেহ নিছক অমূলক নয়। বংগবন্ধুর খুনি চক্রও পরে আমেরিকা ও ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছিল, তা-ও লক্ষ্যনীয়।
যাই হোক। এককথায় এটি একটি “যতো দোষ নন্দ ঘোষ” টাইপ অতি দুর্বল রচনা মনে হয়েছে। আপাতত এইটুকু।
পুনশ্চঃ ভাসানী সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে দু-চার কথা–
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীই প্রথম ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দেন। পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সেই প্রথম রাজনৈতিক ভাষা পেয়েছিল, শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এক দশকের লড়াইয়ে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে শেষ পদাঘাত ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অবিসংবাদিত নেতা তিনিই। পূর্ব বাংলায় সর্বদলীয় ভাষাসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসাবে ভাষা আন্দোলনেরও অন্যতম নেতৃত্ব ছিলেন তিনি।
মওলানা ভাসানীই পূর্ব বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে কৃষক-মজুরদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে দেশব্যাপী তৃণমূলে রাজনৈতিক সচেতনতার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। যেমনটা তিনি করেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বরাজ আন্দোলনে, আসামে জমিদার ও সুদখোর মহাজনবিরোধী কৃষক-মজুরদের ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। মওলানা ভাসানীই প্রথম মানুষের আত্মমর্যাদা ও নাগরিকত্বের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসে আজকের এনআরসি’র পূর্বসূরি আসামের কুখ্যাত লাইন প্রথা ও বাঙালি খেদাও বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশব্যাপী জনমত গঠনে ব্যাপক তৎপরতা চালান তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যার শুরুর দিকেই তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলতে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যেতে বাধ্য হন।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে সংবিধান প্রণয়নে নতুন জনপ্রতিনিধিত্বের দাবি তোলেন মওলানা ভাসানী। রাজনৈতিক জুলুম-নিপীড়ন ও লুটপাটের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন তিনি। দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার অনুমান করে দুর্ভিক্ষের প্রতিরোধ ও জনগণের জীবন বাঁচাতে আন্দোলনও গড়ে তোলেন তিনিই।
জীবনের শেষ সময়েও মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষ ও নদী বাঁচাতে ফারাক্কা লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। নদীতে বাঁধ দেয়ার নীতির বিরুদ্ধে রাজনীতিকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অবস্থান নেন। তিনিই দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “পিন্ডির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব করতে নয়।”
যতই দিন যাচ্ছে মওলানা ভাসানী সার্বভৌমত্ব ও মানুষের মুক্তির রাজনীতির দিশা নিয়ে ততই আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
সংযুক্তঃ “ভাসানী-বংগবন্ধু সম্পর্ক ও সংহতি” একটি তথ্য নির্ভর গুরুতর রচনা পাওয়া যাবে এইখানে ক্লিক করলেই।