লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ
এ বছরের ১৭ই জানুয়ারি সাভার থেকে পুলিশ রিপন নামক এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে যিনি ছিলেন একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির লাইন চিফ এবং অভিযুক্ত ছিলেন একই গার্মেন্টসের একজন নারীকে গণধর্ষণের অভিযোগে। তার গলার সাথে একটি ছোট নোট পাওয়া যায় যেখানে লেখা ছিল,“সেই ধর্ষণের মূল হোতা আমিই”। নয় দিন পর ঝালকাঠিতে সজল নামক ধর্ষণের অভিযুক্ত আরেকজন ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় যার সাথে পাওয়া যায় আরেকটি নোট যেখানে লেখা,”আমার নাম সজল। আমিই সেই ধর্ষক। এটাই আমার শাস্তি।” একই জেলায় আরেকটি ঘটনায় পহেলা ফেব্রুয়ারি রাকিব নামক অনুরূপ অভিযুক্ত একজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় এবং এই লাশের সাথেও নোটে লেখা ছিল,”আমি পিরোজপুর ভান্ডারিয়ার…(অমুকের) ধর্ষক রাকিব। ধর্ষকের পরিণতি ইহাই। ধর্ষকেরা সাবধান— হারকিউলিস”। এ ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাধারন মানুষ এরূপ ভিজিল্যান্টি প্রদত্ত শাস্তিকে স্বাগত জানাচ্ছে যেহেতু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এখনও সাধারণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজার ও সাতক্ষীরায় ২ জন নিহত হয়। ২০১৪ সালেও উত্তরায় এক কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনায় দায়ী আসামি পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন এ ঘটনাগুলোর পেছনে পুলিশেরই হাত থাকতে পারে যেহেতু পূর্বে তাদের এরূপ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার এ সন্দেহ আরো বেশি জোরালো হয় যখন ২৮ই জানুয়ারি চট্টগ্রামে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে একজন ধর্ষকের নিহত হওয়ার খবর বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত হয়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এতো গভীর বিচার বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষা করেন না। একারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বহু মানুষের মন্তব্য থেকে দেখা যায় যে তারা এ সকল ধর্ষকের “উচিত শাস্তি” হয়েছে বলে মনে করেন। অন্য অনেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকাকে দোষের কিছু মনে করেন না।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমর্থকেরা এরূপ একটি প্রবণতার দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাগুলো ভাবেন না অথবা ভাবতে চান না। কেননা বিচার বহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধী ও তার অপরাধকে সনাক্ত করা এবং সেজন্য তার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া উচিত কি না তা বিবেচনা করা হচ্ছে না। এরূপ একটি ব্যবস্থায় অসংখ্য নিরীহ মানুষের শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এ বাস্তবতা থেকেই কিংবদন্তী ব্রিটিশ বিচারপতি উইলিয়াম ব্লাকস্টোন বলেছিলেন, “একজন নিরপরাধ মানুষের শাস্তি পাওয়ার চেয়ে ১০ জন অপরাধীর পালিয়ে যাওয়া ভালো।” একটি ন্যায্য বিচার অনুষ্ঠান ছাড়া আমরা কীভাবে বলতে পারি যে একজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত? মানবাধিকার ছাড়াও আরো বহু বিষয় এক্ষেত্রে বিবেচ্য। ভিজিল্যান্টিদের দ্বারা সংঘটিত এসব হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন হলেও অনুরূপ প্রকার হত্যাকাণ্ড অর্থাৎ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা সাধারণ মানুষের মাঝে বহু আগে থেকেই লক্ষ্য করা যায়।
এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল জনতা কর্তৃক গণপিটুনির ঘটনা গুলো। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে যার স্বীকার হয়েছে বহু নিরপরাধ মানুষ। কিন্তু ধর্ষণের অপরাধী বা অভিযুক্তের ক্ষেত্রে ভিজিল্যান্টিদের দ্বারা এসব হত্যাকাণ্ডকে মানুষ প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার অসারতার কারণে সমর্থন করে থাকে। গত চার বছরে দেশে ১৭,০০০ ধর্ষণের মামলা হয়েছে (ঢাকা ট্রিবিউন, ৩১শে জানুয়ারী, ২০১৮)। যখনি ধর্ষণের মত কোন অপরাধ সংঘটিত হয় তখনই বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করার দাবি জানান। সাধারণ মানুষের মাঝে এরূপ মানসিকতার আবির্ভাব মূলত দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর সন্দেহ ও অপরাধীদের আইনের ফাঁক-ফোঁকর ব্যবহার করে বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য মতে বিগত ৫ বছরে ধর্ষণের করা মামলার মাত্র ২% নিষ্পত্তি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ভিজিল্যান্টিদের দ্বারা সংঘটিত এসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোকে গৌরবান্বিত করা যায় না এবং তা করা উচিতও নয়। তবে যারা নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের পক্ষে কাজ করে যান তারা এসব মানুষের কাছে কোন নায়কের চেয়ে কম নন হোক তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ অথবা কোন ভিজিল্যান্টি।
অনেক ছোট বেলায় একটি হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম যেখানে খলনায়ক কে কিছুতেই সুবিধা করতে না পেরে এক জন সৎ পুলিশ অফিসার ওই খল নায়ককে পিটিয়ে আধমরা করা করে দিচ্ছে এবং দর্শক হাজার করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। আর বলছে এই ধরনের সৎ পুলিশ অফিসার থাকলে তা হলেই দেশটা সিধা হয়, ইত্যাদি। ওই সময় কম বয়েসে আমারও আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু সেই আনন্দ যে কত ভ্রান্ত এবং এটা যে কুশিক্ষা সেটা আজ বুঝতে পারি। আমাদের ছোটবেলা থেকেই এই রকম অনেক ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে বড় হই।
লেখক লিখেছেন ধর্ষণের মাত্র ২% সুবিচার হয় বাকিটা সুবিচার হয় না। সে প্রসঙ্গে বলতে হয় অনেক ভ্রান্ত ধর্ষণের অভিযোগ যেমন আসে তেমনি আজকাল নারী ও সমাজ সচেতনার জন্য ধর্ষণের অভিযোগ নিবন্ধিত হয়ও বেশি। কিন্তু মুশকিল হল কত শতাংশ সমাজ সচেতনার জন্য বেড়েছে আর কতটাই বা মিথ্যা অভিযোগ তার সঠিক তথ্য নেই। প্রসঙ্গত একটি নাটকে একটি সংলাপে ছিল যেখানে নায়িকা নায়ককে (মজা করে) বলছে, “তোমাকে নারী নির্যাতনের কেসে পুলিশে দেব।” অর্থাৎ নারীরাও জেনে গেছে এই একটি কেসে যে কোন পুরুষকে কাবু করা যায়।
নারী আন্দোলন একটি পবিত্র আন্দোলন। কিন্তু অযোগ্য ও কায়েমি স্বার্থের হাতে পড়ে অনেক সময়ই অনেক পবিত্র আন্দোলন বিপথে চালিত হয়। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন, পিছিয়ে পড়া জাতের আন্দোলন প্রভৃতি অযোগ্য হাতে পড়ে দুঃখ জনক ভাবে আজ অনেকটা দুর্বল হয়েছে।
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবনতার জন্য প্রধানত আমাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থাই দায়ি। মানুষের মনে আস্থা নেই বলেই সে নিজের হাতে বিচার করতে বসে যায়। তা ছাড়া আইন আদালত, সাথে খরচা , সব মিলিয়ে আইন এবং সুবিচার সবার জন্য নিশ্চিত করা যায় নি। ফলে এই প্রবনতা কমাবার কোন সহজ পথ নেই।
হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ বইটি হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ নারীবাদী বই, হুমায়ুন আজাদের বইটি পড়লে অনেকের মনে হবে যে হুমায়ুন আজাদ নারীদেরকে পুরুষদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বা নারীদেরকে পুরুষবিদ্বেষী বানিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; হুমায়ুন আজাদ আসলে এমনটা চাননি তিনি আসলে চেয়েছিলেন পুরুষতন্ত্রবাদের অবসান হোক, হ্যাঁ পুরুষতন্ত্রবাদ, পুরুষ নয়, হুমায়ুন আজাদের কবিতা বা উপন্যাসগুলো পড়লে বোঝা যায় উনি নারীদেরকে পুরুষদের থেকে আলাদা করতে চাইতেননা, নারী ও পুরুষের মেলবন্ধন এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্য তিনি চাইতেন।
বাংলাদেশের সমাজে পুরুষতন্ত্রবাদের কারণেই মেয়েরা আগে স্বাধীনভাবে বাইরে চলাফেরা করতে পারতোনা কিন্তু এখন তো মেয়েরা অনেকটাই স্বাধীনভাবে বাইরে ঘোরাফেরা করছে, কিন্তু তাদের এক বড় অংশই পুরুষবিদ্বেষী বা পুরুষদের সঙ্গে মিশতে চায়না তারা, এটার কারণটা আসলে কি? মেয়েরা কি পুরুষদের সঙ্গ চায়না নাকি তারা জোরপূর্বক যৌনকর্মে লিপ্ত হবে তাদের সঙ্গে এমনটা মনে করে, কোনটা? আমার তো মনে হয় কারণ হচ্ছে তারা পুরুষদের সঙ্গ চায়না কারণ আগেকার মতো আজকালও মেয়েদের পরিবার তাদেরকে পুরুষ বা ছেলেদের সঙ্গে মিশতে মানা করে, মেয়েদের কাছে আগে ধর্ষণ শব্দটা ট্যাবু ছিলো কিন্তু আজ আর এটি ট্যাবু নয়, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি এ ধরণের শব্দগুলো আজ নারীদের মুখে মুখে। মেয়েরা ফেসবুকে নিজেদেরকে আড়াল করে রাখে, কিন্তু ওরা যখন কোনো পুরুষকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় তখন কিন্তু পুরুষদের কাছ থেকে তারা পজিটিভ রেসপন্সই পায়। এটাকে এক ধরণের ‘সেক্সিজম’ বা ‘লিঙ্গ বৈষম্য’ বলতে পারি, নারীরা প্রেম করার ক্ষেত্রেও পুরুষদের চেয়ে বেশি সুবিধা পায় তাদের থেকে এগিয়ে থাকে সবসময়, চাইলেই তারা প্রেমসঙ্গী পেয়ে যায়, অপরদিকে পুরুষ বা ছেলেরা না পেয়ে ভোগে দুশ্চিন্তায়। সম্প্রতি ঢা.বি.তে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা বঞ্চিত বা প্রেমিকা পায়নি এমন অনেক ছেলে মিলে আন্দোলন করলো, তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো বিষণ্ণতার ছাপ, হতাশার ছাপ।
লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান চাই, চাই নারীপুরুষের মেলবন্ধন, নারীদেরকে পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে আসতেই হবে, পুরুষদের মন-মানসিকতা ধনাত্মক করার জন্য নারীদের তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা অবশ্যই জরুরী। হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ বইটিও পুরুষেরাই বেশি পড়েছেন, বইটির নারী পাঠকের সংখ্যা খুব কম, কিংবা নারীরা পড়লেও ভালো করে পড়েননি, গুডরিডসে বইটির রিভিউয়ার অধিকাংশই পুরুষ অথচ বইটি নারীদের জন্য লেখা।
হায়রে সেক্সিজম, বাংলাদেশের সমাজে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মেয়েরা সেটাকে এক ধরণের হয়রানি বলে চালিয়ে দেয়, আর একটা মেয়ে আগে থেকে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বললে ছেলেরা সাধারণত ভালোভাবেই কথা বলে, আমি নিজে এবং আমার কয়েকজন বন্ধু এই ধরণের ঘটনার প্রমাণ। ধর্ষণ যে পুরুষ করেনা তাকে গণপিটুনি দেয়া আমাদের দেশের সমাজের মানুষের একটা বদঅভ্যাস হয়ে গেছে, যে মেয়েটা নালিশ করে তার সত্যমিথ্যার যাচাই না করে সবাই চড়াও হয় ঐ ছেলেটার উপরে যে ছেলেটার বিরুদ্ধে মেয়েটা নালিশ করেছে। যখন নারীরা পুরুষদের সঙ্গে বেয়াদোবি করে ওটার কোনো বিচার হয়না, অনেক মেয়ে ছেলেদেরকে থাপ্পড় মারে, তার বাবা বা অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয় দ্বারা ছেলেটাকে মার খাওয়ায়, এভাবে একটা ছেলের মন-মানসিকতা নষ্ট করা হয়, ছেলেরা ভোগে বিষণ্ণতায়, হতাশায়। এইসব সেক্সিজম বা লিঙ্গ বৈষম্য এর বিরুদ্ধে সচেতন পুরুষেরা (এবং উদারপন্থী নারীরাও) আওয়াজ গড়ে তুলুন, মানবিক হন, সত্যিকারের ধর্ষককে সাজা দিন। নারীরা পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান, পুরুষেরাও মানুষ, নারীবাদের নামে পুরুষবিদ্বেষী হবেননা।