লিখছেন: আরজ আলী (জুনিয়ার)
গর্ব করে বলা হয়- বাঙালি ‘ধর্মান্ধ’ নয়; ‘ধর্মভীরু।’ বহুল ব্যবহৃত শব্দ দুটির অর্থ জানতে অনলাইন ডিকশনারী খুঁজে ধর্মভীরুর সুনির্দিষ্ট অর্থ পেলাম না। যা পেলাম তাহলো- “ধর্মভীরুতা, ধর্মের ভয় এবং ধর্ম নষ্টের ভয়।” তবে ধর্মান্ধের স্পষ্ট অর্থ হলো- “নিজ ধর্মে অন্ধবিশ্বাসী কিন্তু পরধর্মবিদ্বেষী।”
প্রশ্ন হলো- যারা ধর্মের ভয়ে ভীতু বা ধর্ম নষ্ট হওয়ার ভয়ে সদা শঙ্কিত, তারা কীভাবে ও কোনো ‘ধর্মভীরু’ বলে গর্ববোধ করে? যাকে ভয় পাই, তাকে নিয়ে গর্বের কী থাকতে পারে বোধগম্য নয়। যা সত্য, সুন্দর, মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান, যা নিত্য পালনীয় ও অতিপ্রয়োজনীয়, যা না থাকলে হয়তো কথিত ঈশ্বর(গণ) মানুষই সৃষ্টি করতো না… তা নিয়ে ভয় কিংবা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কেনো? আবার যদি বলা হয়- ‘ধর্মভীরু’ তারা, যারা ধর্মের ভয়ে নিয়মিত ধর্মকর্ম করে। তাহলেও প্রশ্ন- ভয় থেকে যা পালন করা হয়, তা কীভাবে সত্য-সুন্দর, মহৎ… হতে পারে? যদি ধরেও নেই ‘ধর্মভীরু’ ভালো অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ এর মানে- ধর্মপ্রিয় কিংবা ধার্মিক। তাহলে মানুষ কী সত্যিই ‘ধর্মভীরু’ নাকি ধর্মের চোখরাঙ্গানির (কবরের ও নরকের মহাতাঙ্কজনক অত্যাচার) ভয়ে ভীত বলেই ধর্ম পালনে বাধ্য? যেমন, দেশের কিছু আইন আছে যা আমি নিজেও পালন করতে চাই না কিন্তু দাম্ভিক শাসকদের হয়রানির ভয়ে পালন করতে বাধ্য হই। হয়রানির ভয়ে আইন পালন করা আর শ্রদ্ধায় পালন করা কী এক জিনিস? ধর্মভীরুতাও কী সেরকমই নয়? অর্থাৎ ভয়ে মানছি, শ্রদ্ধায় নয়! অতএব, ধর্মভীরুতা গর্বের নয় বরং হীনতার।
অন্যদিকে ‘ধর্মান্ধ’র শর্ত দুটি- যিনি নিজ ধর্মে ‘অন্ধবিশ্বাসী’ বা যুক্তিহীনভাবে বিশ্বাসী এবং একই সাথে ‘পরধর্মবিদ্বেষী’ অর্থাৎ অন্য ধর্মের কুৎসা রটানাকারী অথবা ঘৃণাকারী। প্রশ্ন হলো, কতো পার্সেন্ট ধার্মিক নিজ ধর্মে (প্রকাশ্যে না হলেও)- ‘অন্ধবিশ্বাসী’ এবং ‘পরধর্মবিদ্বেষী’ নয়? উল্লেখ্য, এখানে ধার্মিক বলছি, মানুষ নয়। কারণ আমার স্বল্প জ্ঞানে- মানুষে ও ধার্মিকে পার্থক্য রয়েছে। সমষ্টিগতভাবে মানুষের যে মৌলিক ধর্ম বা স্বভাবধর্ম, তাই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তা নয়। স্বভাবধর্ম পালনে কাউকে আইন বা নিয়ম বেঁধে দেয়া হয় না; ভয় দেয়া, লোভ দেখানো কিংবা হুমকি দেয়াও হয়; প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পালনে দেয়া হয়! ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে মানুষের স্বভাবধর্ম সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এজন্যই যখন ধার্মিকরা পরস্পর ধর্মরক্ষার অজুহাত তুলে, কথিত ধর্মের কারণে, ধর্মের জন্যে, ধর্ম দ্বারা, দিয়ে, কর্তৃক… খুনাখুনি করে মরে, তখন যতোটা কষ্ট পাই, অযথা নিরীহ মানুষ (হতে পারে ধার্মিক কিন্তু বিশেষ করে নারী-শিশু, যারা ধর্মদাঙ্গায় যুক্ত নয়) হত্যায় তারচেয়ে হাজারগুণ বেশি কষ্ট পাই।
যাহোক, অতি সাধারণ জ্ঞানে বুঝি- ধর্মে ‘অন্ধবিশ্বাসী’ আর ‘সাধারণ বিশ্বাসীর’ মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ বিশ্বাসীরাও অন্ধবিশ্বাসীদের মতোই যুক্তিহীন এবং অন্ধভাবেই ধর্মবিশ্বাস করে। কারণ যখন কেউ তার ধর্ম ছাড়া অন্য সব ধর্ম মিথ্যা, বানোয়াট, ভুল… এসবে বিশ্বাস করে তখন তাকে ‘অন্ধবিশ্বাসী’ বলাটাই তো যুক্তিযুক্ত। আর এরকম বিশ্বাস কমবেশি সকল ধার্মিকের মনেই বদ্ধমূল। অতএব বলতেই পারি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সকল ধার্মিকই ‘অন্ধবিশ্বাসী’। হয়তো বিশ্বাসের সাথে গোড়ামির মিশ্রণটা কারো কারো ক্ষেত্রে কমবেশি হয়। এর কারণ ধর্মের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নির্দ্বিধায়, নিঃশর্তে, বিনা প্রশ্নে এর সবটুকুই বিশ্বাস করতে হবে এবং একে রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের ন্যায় মহৎ কাজ আর নেই। কমবেশি এসব বিশ্বাস না করলে, তিনি ধার্মিক হওয়ার যোগ্যই নয়। ধার্মিকরা এটাও বিশ্বাস করে, তাদের ধর্মের বহু শত্রু আছে, ভিন্নমতালম্বী, ভিন্ন ধর্মালম্বীরা তাদের ধর্মের প্রধান শত্রু। তারা ধর্ম নষ্ট করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে, তাই নিজেদেরকেও ওঁৎ পেতে থাকাতে হবে (যা ধর্মে উল্লেখ আছে এবং ধর্মপ্রচারকরা গোপনে বা প্রকাশ্যে সবসময়ই তা শোনাতে থাকে)। এমন বিশ্বাস কী অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে পড়ে না? বোধকরি, তফাৎ একটাই ধর্মান্ধরা এর চর্চা করে, দাঙ্গার জন্য অস্ত্রসহ প্রস্তুত থাকে আর সাধারণ ধার্মিকরা তা করে না (তবে অন্তরে রাখে)। ফলে ধর্মান্ধরা যখন সাধারণদের অতিমাত্রায় উত্তেজিত করতে সমর্থ হয়, তখন তারাও ঝাপিয়ে পড়তেও দ্বিধা করে না।
মূলত মানুষের যে স্বাভাবিক গুণাবলী (স্বভাবধর্ম) রয়েছে, সে কারণেই সাধারণ বিশ্বাসীরা প্রতিবেশী ভিন্নধর্মীদের সাথে খারাপ আচরণ করে না। অন্যদের ধর্মের প্রথাগুলো মানা দূরে থাক প্রশংসা করা নিষেধ সত্ত্বেও মানবিকতার খাতিরে গোজামিল দিয়ে চলা আর কী! কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, ধর্মের উপর কোনোরকম সামান্য আঘাত হলে একবিন্দুও ছাড় না দেওয়ার শিক্ষা/বিশ্বাস প্রত্যেকের অন্তরেই রয়েছে। ধর্মরক্ষার প্রশ্নে সাধারণরাও যে অন্ধবিশ্বাসীদের ন্যায় উচ্ছৃংখল হয় না, লুটপাটে, ধর্ষণ, হত্যায় লিপ্ত হয় না… তা মোটেও সত্য নয় (রামু-উখিয়াসহ পৃথিবীতে এর বহু উদাহরণ আছে, যেখানে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে প্রায় সকল ধার্মিকই জড়িত থাকে)। এছাড়া সাধারণদের বেশিরভাগই ধর্মদাঙ্গা/যুদ্ধে অংশ না নিলেও মানিসকভাবে সমর্থন দেয়, কেউ কেউ চুপ থেকে কিংবা তা-না-না-না… করে চলে (অন্যতম প্রমাণ, রোহিঙ্গা নির্যাতনে মায়ানমারের সুচিসহ সাধারণদের বক্তব্য ও নিরবতা)। অর্থাৎ এসব অন্যায়ে তারা জোরালো কোনো প্রতিবাদ করে না (লালনের ভাষায়, সবই দেখি তা-না-না-না…)। গ্রামাঞ্চলে এর বহু প্রমাণ রয়েছে (যদিও সব বিষয়েরই ব্যতিক্রম কিছু থাকেই)। তবে পার্থক্য হলো, যাদেরকে ধর্মান্ধ বলা ও ভাবা হয়, তারা প্রকাশ্যে ধর্মরক্ষার জন্য হুমকি ছাড়ে, কার্যক্ষেত্রে সরাসরি উপসি’ত থাকে, গর্বের সাথে এবং বুক ফুলিয়ে নিজ ধর্মের সবকিছুই পালনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় বলে জানাতে থাকে, অন্যরা নিরবে শোনে ও মনে মনে পুলকিত হয়, স্বসি-বোধ করে যে, তাদের ধর্মের কোনো হানি ঘটবে না, নিরাপদেই থাকবে, ভবিষ্যতে আরো পোক্ত হবে, কারণ তাদের ধর্মবীরের অভাব নেই ইত্যাদি।
এবার দেখি ধর্মান্ধর দ্বিতীয় শর্ত- ‘পরধর্মবিদ্বেষ’ কী? এদেরকে কে বা কারা সৃষ্টি করছে? এ শর্তটি প্রায় শতভাগ ধর্মের সাথেই ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। একটি নতুন ধর্ম যখন কোনো ধর্মসৃষ্টিকারী তথা কথিত ধর্মাবতার সৃষ্টি করে, সেই মুহূর্তেই এর মধ্যে ঢুকে যায় অন্য সব ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ! কারণ যখন ঘোষণা করা হয়, আমার ধর্ম, আমার ঈশ্বর, আমার বিশ্বাসই সর্বশ্রেষ্ঠ, মহান, সর্বশক্তিময়… আর সব ফালতু/বাতিল ইত্যাদি, তখন কী তা বিদ্বেষের মধ্যে পড়ে না? সামান্য একটু চিন্তা করলেই দেখা যায়, প্রায় সব ধর্মসৃষ্টিকারীই পূর্বে অন্য কোনো ধর্মের অন্ধ অনুসারী ছিলো। যাদের জন্ম হয়েছে ত্যাগ করে আসা কথিত ঈশ্বর কর্তৃক এবং ওই ধর্মের পিতা-মাতার ঔরস্যে (ডিম্ব ও বীর্য থেকে)। যিনি কিনা নিজের মাতৃধর্মের ভালো-মন্দ, ভুল-ত্রুটি, দুর্বলতাসহ সবকিছুই জানেন (কারণ সাবালক না হওয়া পর্যন্ত নিজেও তার কথিত বিকৃত, ঘৃণিত, ভুলে ভরা, ওই মিথ্যা ঈশ্বর এবং ধর্মকেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন)। পরবর্তীতে নিজেকে কথিত ঈশ্বরের প্রায় সমান মর্যদায় অধিষ্ঠিত করতে ও ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে, সর্বপ্রথম মাতৃধর্মের বিরোধিতা দিয়েই নতুন ধর্ম সৃষ্টির কাজটি শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য প্রায় সব ধর্মের যাবতীয় দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে নিজের অনুসারী বাড়ান। অর্থাৎ মাতৃধর্মসহ সর্ব ধর্মবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড দিয়েই তার নতুন ধর্ম সৃষ্টির কাজ আরম্ভ করেন। এভাবেই তার সম্মোহন শক্তির গুণে অনুসারী যতো বৃদ্ধি পেয়েছে, ধর্মবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড ও নিয়মগুলো আরো কঠোর করেছে। ফলে প্রায় সব অনুসারীর মনেই তাদের ছেড়ে আসা ধর্মসহ অন্যান্য সব ধর্মের প্রতিই কমবেশি ঘৃণা, শত্রুতা তথা বিদ্বেষী মনোভাব জন্মেছে, যা প্রায় সকল ধার্মিককেই আজীবন বহন করতে হচ্ছে (প্রকাশ্যে না হলেও অন্তরে)।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সম্ভবত যা এখন ধার্মিকদের জেনিটিক্যাল হয়ে গেছে। তাছাড়া, কথিত প্রায় প্রতিটি ধর্মাবতার কিংবা অনুসারীরা মাতৃধর্মের প্রতি যেমন ঘৃণা-বিদ্বেষের কথা বলেছে, তেমনি তাদের সাথে যুদ্ধ-দাঙ্গায় লিপ্ত হয়েছে, তাদের ধর্মালয়, দেবতা, ধর্মপুস্তক ইত্যাদি ধ্বংস করেছে, তাদের ঈশ্বরকে গালাগালি দিয়েছে… যা ধর্মের ইতিহাসেই পরিষ্কার (বর্তমানেও চলমান)। অতএব, ঘৃণা-বিদ্বেষের মাধ্যমেই যা জন্ম নেয়, তার মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ থাকবে না, তো কী থাকবে?
যদিও প্রকাশ্যে সাধারণ ধার্মিকরা ধর্মান্ধদের পছন্দ করে বলেই বলছেন কিন্তু কোনো কোনো সময়ে তাদের মাথায় তুলে নেয়। যেমন, ধর্মদাঙ্গার সময় ধর্মান্ধদেরকেই মহাবীর বলে মান্য করে ও তাদের তথাকথিত বীরত্বের গল্প করতে গর্বিতবোধ করে (ইতিহাসে এমন বহু যুদ্ধ-দাঙ্গা রয়েছে যা নিয়ে সব ধার্মিকই গর্বিত)। বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে, কথিত ধর্মানুভূতিতে কথিত আঘাতের অজুহাতে ধর্মান্ধরা যখন তান্ডব সৃষ্টি করে, তখন সাধারণ ধার্মিকরাও নিরবে সমর্থন দেয়। সময় ও সুযোগ পেলে নিজেরাও অংশ নেয় (প্রমাণ রামু-উখিয়া-সাইথিয়া…)।
তাই বলছি, ‘ধর্মান্ধ’ নই আমরা ‘ধর্মভীরু’ বলায় কোনো গর্ব নেই। কারণ এ শব্দ দুটোতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ এর কোনোটা হওয়াই গর্বের ও সুখের নয় বরং সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধি।
Leave A Comment