লিখেছেন: নাম পুরুষ

আমি ভীতু মানুষ, কারণে অকারণে ভীত হই, খুব বেশি ভীত হই। সময়ে অসময়ে বুকে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে থু দেই,সুরা তর্জমা করি। রাস্তায় চলতে চলতে বেড়াল কেটে গেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করে পরে রওনা হই, নিজস্ব যানবাহনে থাকলে তা থামিয়ে দাঁড়াই এমনকি পাব্লিক পরিবহনে থাকলে রাস্তায় নেমে পরি, এতটাই ভীত আতঙ্কগ্রস্থ মানুষ আমি । বরং আমাকে যখন আপনি অভিজিৎ রায়ের দর্শন নিয়ে কিছু বলতে বলবেন কিংবা লিখতে বলবেন তখন মনে মনে একটা আতঙ্কিতভাব আপনার মাঝেও যে বিরাজ করবে এতে সন্দেহের কিছু নেই।

তবে আমি অভিজিৎ রায়-কে খুব মন দিয়ে পড়েছি, ফেসবুক জনপ্রিয় হবার আগে ব্লগস্ফিয়ারটাই ছিল আমার কাছে অনেকটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো, ওইখানে ভাব বিনিময় হতো, ক্ষেত্রবিশেষে মন বিনিময় হতো আর অনেকের সাথেই পরিচয় হওয়া যেতো; যাদের সাথে দেশ, বিদেশ, বিজ্ঞান, সামাজিক আচার, রাজনীতি সম্পর্কে মুক্ত আলোচনা করা যেতো। আমার মতো হালকা বোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে সেটা অনেকটা টক-শোতে অংশগ্রহন করার মতই ছিল। ব্লগস্ফিয়ারেই আমি অভিজিৎ’দা কে পড়েছি, তাঁর দর্শন সম্পর্কে জেনেছি। যদিও তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল না কিন্তু তাঁর সাথে পরিচিত হবার একটা অব্যক্ত বাসনা আমার মনে ছিল মারাত্মকভাবে, উনি চলে গেছেন পৃথিবীর উপারে তবুও আমার সেই আগ্রহ-তে ভাটা পড়েনি ?

সালটা বিশেষ মনে নেই তবে সম্ভবত সেনা সমর্থিত সরককারের আমলে অভিজিৎ’দা জাহানারা ইমাম পুরষ্কার পান। সে সময়েই অভিজিৎ দা সম্পর্কে জানার আগ্রহ হয় । সচলায়তনে “ অসম্ভবের বিজ্ঞান (প্রথম পর্ব)” দিয়ে আমার শুরু হয় অভিজিৎ পঠন। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও বিজ্ঞানের বই পড়তে আমার অসম্ভব বিরক্তি অনুভব করতাম কিন্তু “অসম্ভবের বিজ্ঞান (প্রথম পর্ব)” পড়ে বেশ অনেকগুলা বই পড়ার প্রবনতা আমাকে পেয়ে বসলো, এমনকি জুলভার্ণে-র বই পড়তেও বাধ্য করেছিল। এইটা একটা সিরিজ লেখা ছিল অনেকগুলো বিষয় যেমন টাইম ট্রাভেল, ইনভিজিবিলিটি, টেলিপোর্টেশন, রবোট, স্টারশিপ, স্টার ওয়ারস, প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে অভিজিত’দার আলোচনা তন্ময় হয়ে পড়েছি। ভাবতাম কি আশ্চর্য লেখার হাত উনার বিজ্ঞানের, কত জটিল বিষয়গুলি তিনি কত সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন আমাদের মত হালকা মানসিক গড়নের মানুষ-কে জানানোর জ্ঞাতার্থে। অসম্ভবের বিজ্ঞানে তিনি জীবন ও বিশ্বাসের অদৃশ্য ভেলকিবাজির তত্ত্বে জোর প্রশ্ন এঁকে দিয়েছিলেন তার স্বভাবজাত সরলরৈখিক লেখনীতে। সেই সময়টা অভিজিৎ রায় কে শুধু পড়তাম না বলে গিলতাম বলা ভালো। এরকম একবার হুমায়ুন আজাদের লেখা পড়তে গিয়ে হয়েছিল। তাঁর ব্লগে আমার কমেন্ট করতে ইচ্ছে হত কিন্তু কমেন্ট করার মত বোধশক্তি তখন আমার ছিল না, বোধ করি এখনোও নেই। এভাবে পড়তে পড়তে তাঁর লেখা ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’, মানুষ কি সত্যই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হয়ে পৃথিবীতে জন্মায়?, মানব প্রকৃতির জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা -১ (বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান), বিশ্বাসের ভাইরাস (মুম্বাইয়ের সন্ত্রাস) ,অসম্ভবের বিজ্ঞান (৪র্থ পর্ব), লাইসেঙ্কোইজম’ পড়া হয়ে গেল। আগেই বলেছি আমি সমাজসিদ্ধ একজন ভীতু মানুষ। তাঁর লেখাগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা আসলে কারো সাথে করা হত না। তবে মাঝে মাঝে অফিস থেকে প্রিন্ট করে কিছু বন্ধু বান্ধব-কে পড়তে দিয়েছি। একটা জিনিস খেয়াল করেছি উনার লেখা পড়ে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাই অন্তত কয়েকদিন কি রকম যেন মোহের মধ্যে দিনাতিপাত করত।

আমি অভিজিৎ রায়ের দর্শন ধারন করতে হয়ত পারি না কিন্তু আমি জানি কুসংস্কার কিংবা অলীক অবাস্তব কোন কিছুর উপর আস্থা টিকে থাকে শুধুমাত্র মানুষের বিশ্বাসের কারণে। কেননা, যুক্তি দিয়ে বিচার করলে কিংবা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, এসবের আসলে কোনো ভিত্তি নেই। মানুষ তার অমঙ্গলের ভয়ে ভীত হয়ে বিভিন্ন হাস্যকর বিষয়কেও বিশ্বাস করে মেনে চলে। তাদের অন্ধ বিশ্বাসই কুসংস্কারসহ দুরাচারী সৃষ্টিকর্তাকে অন্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় এবং বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ সেগুলোকে প্রচলিত রাখে। বিশ্বাসী মানুষের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাস এত দৃঢ় হয় যে তারা উদ্ভট বিশ্বাসগুলোকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করে। কোনো রকম চিন্তা বা বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে বিচার করা ছাড়াই তারা এক অলীক অন্ধকারের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে। আর তাই আমার মত অনেকেই মঙ্গল কিংবা শনিবার অমঙ্গল ও অশুভ কিছু ঘটার আশংকায় অনেক প্রয়োজন থাকলেও কোথাও যাত্রা করে না। বিড়াল কিংবা এক শালিক দেখলে যাত্রা অশুভ ভেবে যাত্রাবিরতি দেয়। কোনো কথা বলার সময় টিকটিকি যদি টিক টিক করে শব্দ করে তাহলে সেই শব্দকে ঐ কথার সত্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। জোড়া শালিক দেখলে ভাগ্য সু-প্রসন্ন হবে বলে বিশ্বাস করে। এর সবই হলো অন্ধবিশ্বাসের অশ্বডিম্ব। এগুলো আমি অভিজিৎ রায়কে পড়তে গিয়ে জেনেছি কিন্তু ধারন করিনি। বিশেষ করে শুন্য থেকে মহাবিশ্ব পড়তে গিয়ে আমি নিজের মাঝে আরেকটি চোখের সন্ধান আমি পেয়েছি। যে চোখে সৃষ্টিকে দেখা যায়।

বিজ্ঞানমনষ্কতার বাইরে গিয়েও অভিজিৎ দা লিখেছেন “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটি পড়ার আগে ভেবেছিলাম প্রায় সব বইয়ের মত অহেতুক রবীন্দ্র বন্দনা হবে কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখেছি ওকাম্পো-র চোখেই বরং তিনি রবি ঠাকুরে-কে দেখেছেন । এখানে অভিজিত’দার একটা অনুভব প্রখর সাহিত্য দর্শনের খোঁজ পাওয়া যায়। অভিজিৎ দা’র সব লেখা পড়া হয়নি এখনো, পড়ার অভ্যেসটা লোপ পেয়েছে অনেক আগেই। তবুও সময় পেলে মুক্তমনায় ঢুকে এক দুই লাইন হলেও মাঝে মাঝে পড়ে নেই। ভবিষ্যতে হয়ত এভাবেই বাকী লেখাগুলো পড়া হয়ে যাবে।

আমি ভাবতাম ভবিষ্যতে বুদ হয়ে থাকার একজন সমসাময়িক লেখক আমরা হয়ত পেলাম কিন্তু দাদা বেশী লিখে যেতে পারেননি, অজ্ঞ চাপাতির আঘাতে যে মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন হলো জড় সেই চাপাতি যদি জানতো কোথায় আগাত করেছে সেও হয়ত লজ্জা পেত। সে লজ্জা মানুষ নামধারী আমরা কি পাই?

আমি শিক্ষক মানুষ, আগেও বলেছি এই অবনত সিস্টেমের একজন জড় ক্লীব মস্তিষ্কজাত মানুষ। অভিজিৎ রায়-কে ধারন করা আমার পক্ষে হয়ত সম্ভব নয়। তারপরেও আমি চেষ্টা করি অভিজিৎ রায়-কে ছড়িয়ে দিতে অন্তত আমার কজন অনুসন্ধিৎসু ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে। আমি তাদের অভিজিৎ রায়কে পড়ার পরামর্শ দেই। যেন এই প্রজন্ম না হোক ভবিতব্য প্রজন্ম অন্তত প্রশ্নের নীড়ে যেন আশ্রয়নের ঠিকানা খুঁজে পায়।

অভিজিৎ দা’কে নিয়ে আমার একটা কথাই আমি সবজায়গায় বলি, “ এই অভাগা জাতি জানলো না কি হারালো। কোনদিন জানতে পারবে কি না তাও জানি না।নির্বোধদের শহরে একজন অভিজিৎ রায়কে কত সহজেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি “

শুভ জন্মদিন দাদা।